- 23 June, 2022
- 0 Comment(s)
- 438 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
অনৈতিকতার প্রতি নারী নিবেদিত, কারণ তাঁর কাছে নৈতিকতা হল একটি অমানবিক সত্তাকে মূর্ত করা : শক্তিশালী নারী, প্রশংসনীয় মা, সৎ নারী ইত্যাদি। চিন্তা করা, স্বপ্ন দেখা, ঘুমোনো, কোনো কিছুর ইচ্ছা করা বা কোনো নির্দেশ ছাড়া শ্বাস নেওয়া মাত্রই পুরুষালি আদর্শের সঙ্গে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। এই কারণেই অনেক মহিলা তাঁদের স্বামীদের অনুপস্থিতি ছাড়া নিজেদেরকে ‘নিজেদের প্রকৃত স্বভাব’-এ উপনীত হতে দেন না। বিপরীতে, স্ত্রী তাঁর স্বামীকে চেনেন না। স্ত্রী বিশ্বাস করেন স্বামীর প্রকৃত স্বরূপ তিনি জানেন যেহেতু তিনি তা প্রতিদিনের আকস্মিকতায় উপলব্ধি করেন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে একজন পুরুষ হলেন অন্য পুরুষের মাঝে এই পৃথিবীতে তিনি যা করেন সেটাই। উৎকর্ষের উদ্দেশে পুরুষের এই চলনকে বুঝতে অস্বীকার করা হল এটিকে ভুলভাবে উপস্থাপিত করা। এলিস বলেছেন, “একজন মহিলা বিয়ে করেন একজন কবিকে। স্ত্রী হওয়ার পর তিনি প্রথম যা লক্ষ করেন তা হল প্রস্রাবকরে জল ঢালতে ভুলে যান স্বামী[1]”।
[1]বইয়ের নাম : Chroniques maritales লেখকের নাম : Marcel Jouhandeau
[1]বইয়ের নাম : Chroniques maritales লেখকের নাম : Marcel Jouhandeau
স্বামী তবুও একজন কবি হিসাবেই থেকে যান এবং স্বামীর রচনায় অনাগ্রহী স্ত্রী একজন দূরবর্তী পাঠকের চেয়েও স্বামীকে কম চেনেন। প্রায়শই এই দোষ কিন্তু স্ত্রীর নয় যদি এই জটিলতা স্ত্রীর জন্য নিষিদ্ধ হয়। স্বামীর কাজকর্মের গতির সঙ্গে স্ত্রী তাল মেলাতে পারেন না। স্ত্রীর অভিজ্ঞতা নেই। স্বামীকে ‘অনুসরণ’ করার মতো প্রয়োজনীয় সংস্কৃতি তাঁর নেই। প্রতিদিনের একঘেয়ে পুনরাবৃত্তির চেয়ে স্বামীর কাছে ঢের বেশি প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলিতে স্বামীর সঙ্গে যোগ দিতে তিনি ব্যর্থ হন।কিছু বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ক্ষেত্রে স্ত্রী তাঁর স্বামীর সত্যিকারের সহচর হয়ে উঠতে সফল হতে পারেন। স্বামীর প্রকল্প নিয়ে স্ত্রী আলোচনা করেন, স্বামীকে পরামর্শ দেন, স্বামীর কাজে অংশগ্রহণ করেন। তবে এই কাজগুলোর মাধ্যমে স্ত্রী যদি বিশ্বাস করেন যে তিনি নিজের ব্যক্তিগত কাজ করছেন, তাহলে তিনি নিজেই নিজেকে ভোলাবেন। একমাত্র এটিই থেকে যায় সক্রিয় ও দায়িত্বশীল স্বাধীনতা হিসাবে। স্বামীকে স্ত্রী অবশ্যই ভালোবাসবেন স্বামী-সেবায় নিজের আনন্দ খুঁজে পাওয়ার জন্য। অন্যথায় নিজের প্রচেষ্টার ফলাফলে হতাশ হয়ে স্ত্রী কেবল বিরক্তিই বোধ করবেন। স্ত্রীর সঙ্গে একজন ক্রীতদাসের মতো আচরণ করতে করতে স্ত্রীকে বোঝানো যে তিনি সম্রাজ্ঞী--বালজাকের এই নির্দেশের প্রতি বিশ্বস্ত স্বামীরা আনন্দের সঙ্গে অতিরঞ্জিত করেন স্ত্রীর প্রভাবকে। যদিও ভেতরে ভেতরে স্বামীরা বেশ ভালোভাবেই জানেন যে তাঁরা মিথ্যে বলছেন। জর্জেতল্য ব্লঁ এই রহস্যময়তার দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলেন যখন তিনি মেটারলিঙ্কের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন বইয়ের ওপর তাঁদের দু-জনের নাম লিখতে, যে-বই তাঁরা একসঙ্গেই লিখেছিলেন বলে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। একজন পেশাদার অপেরা বা ধ্রুপদি সংগীতের গায়িকার লেখা ‘Souvenirs’ বইয়ের মুখবন্ধে গ্রাসে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যে-কোনো পুরুষই সেই মহিলাকে স্বাগত জানান যিনি তাঁর জীবনের একজন সহযোগী, একজন অনুপ্রেরণাদাত্রী। কিন্তু সংগত কারণেই নিজের কাজকে তিনি একমাত্র তাঁর নিজেরই বলে মনে করেন। যে-কোনো ক্রিয়াকলাপ, যে-কোনো কাজে যা মূল্য পায় তা হল পছন্দ ও সিদ্ধান্তের মুহূর্ত। স্ত্রী সাধারণত সেই কাঁচের বলের ভূমিকা পালন করেন, যে-কাঁচের বল ব্যবহার করে শলা-পরামর্শ করেন আলোকদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিরা : অন্য একজন ঠিক একইভাবে করবে। আর এর প্রমাণ হল--প্রায়শই পুরুষ একইরকম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অন্য এক মহিলাউপদেষ্টা, অন্য এক মহিলা সহযোগীকে স্বাগত জানান। সোফি টলস্টয় তাঁর স্বামীর পাণ্ডুলিপিগুলির অনুলিপি করেছিলেন, সেগুলিকে সাজিয়ে রেখেছিলেন : পরে স্বামী তাঁর এক কন্যাকে সেটির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সোফি তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর উদ্যোগও তাঁকে অপরিহার্য করে তোলেনি। শুধুমাত্র স্বাধীন কাজই নারীদের প্রকৃত স্ব-শাসনকে নিশ্চিত করতে পারে[2]।
বিভিন্ন ঘটনার ওপর নির্ভর করে দাম্পত্য জীবন ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেয়। কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক মহিলার কাছে প্রায় একইরকমভাবে দিন কেটে যায়। সকালে তাড়াহুড়ো করে স্বামী বেরিয়ে যান স্ত্রীকে ছেড়ে। আনন্দের সঙ্গেই স্ত্রী শুনতে পান স্বামীর পিছনে পুনরায় দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। কোনোরকম নির্দেশ ছাড়া স্বাধীনভাবে, অখণ্ডসার্বভৌম কর্তৃত্বে বাড়িতে নিজেকে খুঁজে পেতে স্ত্রী পছন্দ বোধ করেন। এরপর সময়মতো বাচ্চারা পালাক্রমে স্কুলে চলে যায়। সারাদিন বাড়িতে একা কাটান স্ত্রী। দোলনায় নড়াচড়া করা শিশু বা পার্কে খেলে-বেড়ানো সন্তান কিন্তু তাঁর সঙ্গী নয়। পোশাক পরার জন্য, বাড়ির কাজ করার জন্য তিনি কম-বেশি সময় ব্যয় করেন। যদি কোনো পরিচারিকা থাকেন, তাহলে তাঁকে তিনি নির্দেশ দেন। রান্নাঘরে গল্প করতে করতে ঘোরা-ফেরা করেন। না-হলে বাজারে গিয়ে একটু হেঁটে আসেন। প্রতিবেশী বা দোকানদারদের সঙ্গে জীবনযাপনের খরচ সম্পর্কে কয়েকটি শব্দ বিনিময় করেন। স্বামী এবং সন্তানেরা যদি খাবারের জন্য দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে আসেন, তাহলেও তাঁদের উপস্থিতি থেকে তিনি অনেকটা লাভবান হন না। খাবার তৈরি করা, পরিবেশন করা, পরিষ্কার করা ইত্যাদি নানা কাজ তাঁর প্রচুর পরিমাণে থাকে। অবশ্য বেশিরভাগ দিনই স্বামী-সন্তানেরা দুপুরে বাড়ি ফেরেন না। যেভাবেই হোক না কেন, তাঁর সামনে পড়ে থাকে প্রশস্ত ফাঁকা বিকেল। সবচেয়ে কমবয়সি সন্তানদের তিনি পার্কে নিয়ে যান, সন্তানদের ওপর নজর রাখতে রাখতে সেলাই করেন বা বুনে চলেন। অথবা জানলার কাছে বসে তিনি কোনো কিছু মেরামত করেন। তাঁর হাত কাজ করে চললেও তাঁর মন খালি। পুরোনো উদ্বেগের চর্বিতচর্বণ করেন, যে যে কাজ করতে হবে তার রূপরেখা তৈরি করেন, দিবাস্বপ্ন দেখেন, বিরক্ত হন। তাঁর কোনো কাজই শুদ্ধমাত্র সেই কাজের মধ্যেই সম্পূর্ণ নয়। তাঁর চিন্তাভাবনা স্বামী-অভিমুখী। তাঁর চিন্তাভাবনা সন্তান-অভিমুখী। কে এই জামাগুলি পরবে, যে-পদ তিনি রান্না করছেন সেটা কে খাবে। কেবল স্বামী-সন্তানদের জন্যই তিনি বাঁচেন। এরপরেও কি স্বামী-সন্তানেরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ? ধীর ধীরে তাঁর একঘেমেয়ি বদলে যায় অধৈর্যে। উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করতে শুরু করেন স্বামী-সন্তানদের ফিরে আসার জন্য। সন্তানেরা স্কুল থেকে ফিরে আসার পর তিনি তাঁদের চুমু খান, নানারকম প্রশ্ন করেন। কিন্তু সন্তানদের হোমওয়ার্ক আছে, তারা চায় নিজেদের মধ্যে আনন্দ করতে। তারা পালিয়ে যায়। সন্তানরা কিন্তু বিনোদন নয়। তারপর তারা খারাপ নাম্বার পায়, তারা স্কার্ফ হারিয়ে ফেলে। তারা গণ্ডগোল, বিশৃঙ্খলা করে। নিজেদের মধ্যে মারপিট করে। সবসময়ই তাদেরকে তাঁর কম-বেশি বকাবকি করতেই হয়। মাকে শান্তি বা আরাম দেওয়ার পরিবর্তে তাদের উপস্থিতি মাকে ক্লান্ত করে দেয়। ক্রমশ আরও তীব্রভাবে তিনি স্বামীর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করেন। স্বামী কী কাজ করছে? ইতিমধ্যেই ফিরে আসেননি কেন? স্বামী কাজ করেন, জগৎ দেখছেন, লোকজনের সঙ্গে গল্প করেন। স্ত্রীর কথা তিনি ভাবেন না। স্নায়ুচাপে পীড়িত হয়ে স্ত্রী রোমন্থন করতে শুরু করেন যে, নিজের যৌবনকে এই স্বামীর কাছে অর্পণ করে তিনি ভুল করেছেন। স্বামী তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ নন। বাড়ির পথে চলতে চলতে, যে-বাড়িতে তাঁর স্ত্রী বন্দি হয়ে রয়েছেন, স্বামী নিজেকে অস্পষ্টভাবে অপরাধী অনুভব করেন। বিয়ের পর প্রথম কয়েক দিন স্ত্রীর জন্য নিয়ে আনতেন ফুলের তোড়া, ছোটোখাটো উপহার। কিন্তু এই রীতি শীঘ্রই তার সমস্ত অর্থ হারিয়ে ফেলে। এখন স্বামী বাড়ি ফেরেন খালি হাতে। বাড়ি ফেরার পরবর্তী দিনানুদৈনিক অভ্যর্থনাকে ভয় পাওয়ার কারণে এখন তিনি ফেরার জন্য কম তাড়াহুড়ো করেন। বস্তুতপক্ষে, স্ত্রীও প্রায়শই প্রতিশোধ নেন তাঁর গোটা দিনের একঘেয়েমি ও অপেক্ষার ছবি তুলে ধরে। এইভাবে তিনি এমন একটি উপস্থিতির হতাশা থেকে নিজেকে রক্ষা করেন যা তাঁর অপেক্ষার প্রত্যাশা পূরণ করে না। এমনকি স্ত্রী যদি নিজের অভাব-অভিযোগ নিয়ে নীরবও থাকেন, স্বামী তা সত্ত্বেও তাঁর দিক থেকে হতাশ থাকনে। নিজের অফিসে তিনি আনন্দ পান না, তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। উদ্দীপনা এবং বিশ্রামের জন্য তাঁর একটি পরস্পরবিরোধী ইচ্ছা আছে। স্ত্রীর অতি-পরিচিত মুখ স্বামীকে তাঁর নিজের থেকে আলাদা করে না। স্বামী অনুভব করেন--স্ত্রী তাঁর নিজের উদ্বেগগুলি স্বামীর সঙ্গে ভাগ করে নেবেন, স্বামীর থেকে তিনি প্রত্যাশা করবেন বিনোদন এবং উদ্বেগমুক্তি। স্ত্রীর উপস্থিতি স্বামী পূর্ণ না-করে বরং ভারস্বরূপ চেপে বসে। প্রকৃত অর্থে মন হালকা করার কিছুই স্ত্রীর কাছ থেকে খুঁজে পান না স্বামী। সন্তানেরাও আর না-আনে বিনোদন, না শান্তি। দুপুরের খাবার আর সন্ধ্যা কেটে যায় একটি অস্পষ্ট খারাপ মেজাজে। পড়াশোনা, T.S.F. শোনা বা হালকা আড্ডা যাই করুক না কেন--অন্তরঙ্গতার আড়ালে প্রত্যেকেই একা থেকে যাবেন। যাই হোক, একটি উদ্বিগ্ন আশা নিয়ে স্ত্রী বিস্মিত হয়ে ভাবেন--অথবা মোটেও কম উদ্বেগের নয় এমন একটা আশঙ্কার বোধ--যদি আজ রাতে--শেষ পর্যন্ত! আবার! --কিছু একটা ঘটবেই। হতাশা, বিরক্তি বা স্বস্তি নিয়ে তিনি ঘুমাতে যান। আনন্দের সঙ্গে পরদিন সকালে শুনতে পারেন দড়াম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। সেই সব স্ত্রীর ভাগ্য অনেক বেশি কঠিন যাঁরা দরিদ্র এবং যাঁদের ওপর থাকে অতিরিক্ত কাজের বোঝা। ভাগ্যের এই ভার অনেকটা হালকা হয়ে যায় যখন বিবাহিত মহিলারা একইসঙ্গে অবসর এবং বিনোদন পান। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই যে-ধরনটি পাওয়া যায় সেটি হল : একঘেয়েমি, অপেক্ষা, হতাশা।
[1]বইয়ের নাম : Chroniques maritales লেখকের নাম : Marcel Jouhandeau
[2]কখনো-কখনো পুরুষ এবং মহিলার মধ্যে একটি সত্যিকারের সহযোগিতা দেখা যায়--সেখানে উভয়ই সমানভাবে স্বায়ত্তশাসিত। যেমন জোলিও-ক্যুরি দম্পতি। যদিও স্বামীর সমান যোগ্য স্ত্রী কিন্তু তাঁর স্ত্রীর ভূমিকা থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁদের সম্পর্ক আর দাম্পত্যের চলতি বিন্যাস অনুযায়ী নয়। এমনও অনেক স্ত্রী আছেন যাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত লক্ষ্য পূরণের জন্য স্বামীকে ব্যবহার করেন। বিবাহিত মহিলার অবস্থা থেকে তাঁরা রেহাই পান।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment