- 30 December, 2021
- 0 Comment(s)
- 602 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
এখানেও আবার আমরা বুঝতে পারি যে, ছোট্ট মেয়েটি আবেগের সঙ্গে তার বড়োদের অনুকরণ করতে পছন্দ করে : চক এবং ঘাস দিয়ে মূর্তি তৈরি করে। সত্যিকারের উনুন যখন পায়, তখন সে আরও খুশি হয়। অথবা, যখন তার মা তাকে রান্নাঘরে আসার অনুমতি দেয়, তার হাতের তালু দিয়ে পেস্ট্রি বের করতে দেয় বা গরম জ্বলন্ত ক্যারামেল কাটতে দেয়--তখন সে আরও খুশি হয়। তবে, এটা বাড়ির কাজের মতো : একই কাজের পুনরাবৃত্তি শীঘ্রই এই আনন্দগুলিকে একঘেয়ে করে দেয়। ভারতীয়দের জন্য, যারা মূলত পাতলা গোল-রুটি থেকে তাদের পুষ্টি পায়, সেখানে মহিলারা তাদের অর্ধেক দিন কাটায় আটা মেখে লেচি করা, রান্না করা, পুনরায় গরম করা, আবার একইরকম লেচি করে। প্রত্যকে ছাদের নীচে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একই ধরনের কাজ। উনুনের জাদু-বিষয়ে তারা খুব কমই সংবেদনশীল। প্রত্যেক দিনের বাজারকে গুপ্তধনের সন্ধানে রূপান্তর করা সম্ভব নয়, অথবা সম্ভব নয় একটি চকচকে জলের কল নিয়ে আনন্দ করা। মহিলা এবং পুরুষ লেখকরা এই বিজয়গুলিকে গীতাত্মকভাবে উচ্চারণ করতে পারেন, কারণ তাঁরা খুব বিরলক্ষেত্রেই ঘরের কাজ করে থাকেন অথবা কখনোই করেন না। একই কাজ প্রত্যেক দিন করতে করতে তা একঘেয়ে এবং যান্ত্রিক হয়ে ওঠে। অপেক্ষার গুরুভারে হয়ে ওঠে ভারাক্রান্ত : জল ফোটার জন্য অপেক্ষা করা, রোস্ট রান্না যাতে যথাযথ হয় তার জন্য অপেক্ষা করা, জামাকাপড় শোকানোর জন্য অপেক্ষা করা। এমনকি অন্যান্য কাজগুলি যদি সুসংগঠিতও হয়, তবুও রয়ে যায় নিষ্ক্রিয়তা এবং শূন্যতার দীর্ঘ মুহূর্ত। বেশিরভাগ সময়েই সেই কাজগুলি একঘেয়েমির মধ্যেই সম্পন্ন হয়। বর্তমান এবং আগামীকালের জীবনের মধ্যে সেই কাজগুলি কেবল একটি অপরিহার্য মধ্যস্থতাকারী। যে ব্যক্তি এগুলি সম্পাদন করে সে যদি নিজেই একজন উৎপাদক বা স্রষ্টা হয়, তবে সেই কাজগুলি জৈব ক্রিয়ার মতো স্বাভাবিকভাবেই তার অস্তিত্বের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। এই কারণেই পুরুষদের দ্বারা সঞ্চালিত হলে দৈনন্দিন কাজগুলি কম বিরক্তিকর বলে মনে হয়। পুরুষের কাছে এই কাজগুলি শুধুমাত্র একটি নেতিবাচক এবং আকষ্মিক মুহূর্ত উপস্থাপিত করা যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পুরুষেরা তাড়াহুড়ো করে। কিন্তু যে বিষয়টি অনেক স্ত্রী-দাসীকে অতৃপ্ত করে তোলে তা হল শ্রমের বিভাজন যা তাকে সম্পূর্ণরূপে সাধারণ এবং অপ্রয়োজনীয় করে দেয়। জীবনযাপনের জন্য বাড়ি এবং খাবার উপযোগী। যদিও নারীকে তা কোনো মূল্য প্রদান করে না।গৃহকর্মীর তাৎক্ষণিক লক্ষ্যগুলি কেবলমাত্র পথ, প্রকৃত গন্তব্য নয়।
এটা বোধগম্য যে, নিজের কাজের মধ্যে প্রাণ সঞ্চারিত করার জন্য নারী সেই কাজের মধ্যে নিজস্বতা যুক্ত করতে চায় এবং চেষ্টা করে প্রাপ্ত ফলের ওপর পরম মূল্য সংযুক্ত করার। নারীর স্বতন্ত্র আচার-অনুষ্ঠান আছে, কুসংস্কার আছে। টেবিল সাজানোর নিজস্ব ধরন আছে। নিজস্ব ধরন আছে বসার ঘর গোছানোর। কোনো কিছু মেরামত করা বা একটি পদ রান্না করারও নিজস্ব পদ্ধতি আছে। সে নিজেকে বোঝায় যে, তার মতো এত ভালো রোস্ট অথবা পালিশ আর কেউ করতে পারবে না। যদি তার স্বামী বা মেয়ে তাকে সাহায্য করতে চায় বা তাকে ছাড়া কাজটি করে নেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সে সূঁচ বা ঝাড়ু ধরে। “তুমি জানো না কীভাবে বোতাম সেলাই করতে হয়” ডরোথি পার্কার কারুণ্য-উদ্রেককারী বিদ্রুপের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন একজন যুবতী মহিলার আতঙ্ক যে তার বাড়ি গোছানোর জন্য চিরকুট আনার ব্যাপারে সহমত, কিন্তু জানে না কেমন করে সেই চিরকুটপেতে হবে :
মিসেস আর্নেস্ট ওয়েলডন সুসজ্জিত লিভিং-রুমের চারপাশে হেঁটেচলে বেড়াতেন, কিছু মেয়েলি ছোঁয়া দিতেন সেই ঘরে। নারী-স্পর্শ দিয়ে সজ্জিত করার ব্যাপারে তিনি বিশেষ দক্ষ ছিলেন না। তবে, এই ধারণাটি তাঁর কাছে ছিল চমৎকার এবং চিত্তাকর্ষক। বিয়ের আগে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি তাঁর নতুন বাসস্থানের মধ্যে মৃদুভাবে চলাফেরা করছেন, কুশলতার সঙ্গে এখানে একটা গোলাপ ফুল সরাচ্ছেন, ওখানে একটি ফুল সোজা করে রাখছেন। আর এইভাবে তিনি বাড়িকে রূপান্তরিত করছেন ঘরে। এমনকি এখনও, বিয়ের সাত বছর পরে, তিনি পছন্দ করেন নিজেকে সেই চারুকর্ম সম্পাদনকারী হিসাবে দেখতে। রোজ রাত্রে গোলাপ-ছায়াযুক্ত প্রদীপ জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি আন্তরিকভাবে যদিও এই কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন, তবুও তিনি সর্বদা কিছুটা বিভ্রান্ত ছিলেন কীভাবে একজন সেই ছোট্ট অলৌকিক কাজগুলি সম্পাদন করে চলেন যা ঘরের মধ্যে পৃথিবীর যাবতীয় বদল ঘটিয়ে দেয় ... মেয়েলি-স্পর্শে ঘরের পরিবর্তন ঘটানো স্ত্রীদের কাজ আর মিসেস ওয়েলডন সেরকম মহিলা নন যিনি নিজের যাবতীয় দায়িত্ব এড়িয়ে যাবেন। প্রায় করুণ অনিশ্চয়তার আবহাওয়ার মধ্যে তিনি চিমনির দিকে হাতড়ে বেড়ান, একটি ছোট্ট জাপানি ফুলদানি তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ফুলদানি হাতে নিয়ে হতাশভাবে ঘরের চারপাশ খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন ... তারপর পিছিয়ে গিয়ে নিজের উদ্ভাবনগুলি জরিপ করেন। এটা বিস্ময়কর যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনগুলি ঘরের মধ্যে কতটা বদল এনে দিয়েছে।
মৌলিকত্ব বা স্বতন্ত্র নিখুঁততার জন্য এই অনুসন্ধানে মহিলারা অনেক সময় এবং শ্রম নষ্ট করে। এটিই তাদের কাজকে “বিরতি বা সীমাবদ্ধতা ছাড়াই একটি সূক্ষ্ম এবং বিশৃঙ্খল কাজ”-এর চরিত্র প্রদান করে যেমনটা নির্দেশ করেছেন শারদন। পরিবারের প্রতি যত্ন বলতে আসলে যা বোঝায় তার ভার-পরিমাপকে এটি কঠিন করে তোলে। একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুসারে (১৯৪৭ সালে সি. হেবার্টের স্বাক্ষরে ‘কোমবা’ সংবাদপত্র দ্বারা প্রকাশিত) বিবাহিত মহিলারা গৃহস্থালির কাজে (পরিষ্কার করা, খাবার ইত্যাদি) প্রতিটি কর্মদিবসে প্রায় তিন ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় ব্যয় করে। আর বিশ্রামের দিনে ব্যয় করেন আট ঘণ্টা। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে তিরিশ ঘণ্টা যা একজন মহিলা শ্রমিক বা মহিলা কর্মীর সাপ্তাহিক কাজের চারভাগের তিন ভাগ। এর সঙ্গে কোনো চাকরি যোগ হলে কাজের সময় বিশাল হয়ে যায়। বিবাহিত নারীর অন্য কিছু করার না থাকলে এই হিসাবটা কম হয় (বিশেষত মহিলা শ্রমিক এবং কর্মচারীরা যাতায়াতে সময় নষ্ট করে এখানে যার কোনো সমতুলতা নেই)। সন্তানের যত্ন নেওয়া, যদি অনেক সন্তান থাকে, তাহলে তা বিবাহিত মহিলাদের ক্লান্তিকে যথেষ্ট পরিমাণে আরও ভারি করে তোলে। একটি দরিদ্র পরিবারের মা তার ব্যস্ত দিনগুলির মধ্যে প্রত্যেক দিনে তার শক্তি নিঃশেষিত করে ফেলে। বিপরীতে বুর্জোয়া নারীরা, যাদের পরিচারিকা বা সাহায্য করার লোক আছে, তারা প্রায় কর্মহীন দিন কাটায়। আর এই অবসরের মুক্তিপণ হল একঘেয়েমি। কারণ তারা একঘেয়েমি থেকে ক্লান্ত। যারা নিজেদের কাজকে জটিল এবং বহু গুণে বাড়িয়ে তোলে, তারা প্রশিক্ষিত কাজের চেয়েও বেশি নিষ্পেষিত হয়। নার্ভাস ব্রেকডাউনের মধ্য দিয়ে যাওয়া একজন মেয়ে বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, যখন তাঁর শরীর ভালো ছিল, কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই তিনি বাড়ির খেয়াল রাখতেন। অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং কাজের জন্য তাঁর হাতে তখন সময় থাকতো। যখন নিউরোস্থেনিয়া তাঁকে বাধা দেয় অন্য কাজে আত্মনিয়োগ করতে, তখন তিনি বাড়ির কাজে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে গ্রস্ত হতে অনুমতি দেন। বাড়ির কাজে দিনের সমস্ত সময় দিলেও সেই কাজ তিনি শেষ করতে পারতেন না।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment