- 22 May, 2022
- 0 Comment(s)
- 370 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
পিয়েরে-নাতাসা মিথের সবচেয়ে আমূল নিন্দা করা হয়েছে লিও-সোফি দম্পতি দ্বারা। স্বামীর প্রতি বিকর্ষণ ছিল সোফির। স্বামীকে তাঁর ‘ক্লান্তিকর’ বলে মনে হত। আশেপাশের সমস্ত কৃষাণীর সঙ্গে স্ত্রীকে তিনি ঠকান। সোফি ছিলেন ঈর্ষান্বিত, বিরক্ত। একাধিকবার গর্ভবতী হওয়ার তিনি অস্থির এবং হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সন্তানেরা না-পেরেছে তাঁর হৃদয়ের শূন্যতা পূরণ করতে, না-পেরেছে প্রতিদিনের শূন্যতা ভরাতে। ঘর ছিল তাঁর কাছে ঊষর মরুভূমি। স্বামীর কাছে তা ছিল নরক। ব্যাপারটি শেষ হয় এই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত বৃদ্ধ মহিলার অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে জঙ্গলের আর্দ্র রাতে শুতে যাওয়া এবং এই তাড়া-খাওয়া বৃদ্ধ লোকটির শেষ পর্যন্ত আজীবনের ‘মিলন’-কে অস্বীকার করে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।
এটা ঠিকই যে, টলস্টয়ের ক্ষেত্রটি অবশ্যই ব্যতিক্রমী। এমন অনেক দম্পতি আছেন যাঁরা ‘ভালোভাবে চলেন’, অর্থাৎ যেখানে স্বামী-স্ত্রী একটি সমঝোতায় পৌঁছোন। খুব বেশি একে-অপরের পেছনে তাঁরা লাগেন না, একে-অপরকে খুব বেশি মিথ্যে বলেন না। কিন্তু একটি অভিশাপ থেকে তাঁরা খুব কমই রেহাই পান : সেটা একঘেয়েমি। স্বামী তাঁর স্ত্রীকে নিজের প্রতিধ্বনি বানাতে যতই সফল হোন না কেন, অথবা প্রত্যেকেই তাঁর নিজের মহাবিশ্বের আড়ালে যতই লুকিয়ে থাকুন না কেন, কিছু মাস বা কয়েক বছর পর তাঁদের একে-অপরের সঙ্গে কথা বলার মতো কিছুই থাকবে না। দম্পতিরা হলেন এমন একটি সম্প্রদায় যার সদস্যরা তাঁদের একাকিত্ব থেকে মুক্ত না-হয়েই নিজেদের স্বায়ত্তশাসন হারিয়ে ফেলেন। একে-অপরের সঙ্গে একটি গতিশীল এবং জীবন্ত সম্পর্ক বজায় রাখার পরিবর্তে তাঁরা একে-অপরের সঙ্গে পরিবর্তনহীনভাবে আত্তীকৃত হয়ে যান। এই কারণেই আধ্যাত্মিক ক্ষেত্র বা স্তরে তাঁরা একে-অপরকে কিছুই দিতে পারেন না, নিজেদের মধ্যে কিছুই বিনিময় করতে পারেন না। ডরোথি পার্কার তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘Too Bad’-এ অনেক দাম্পত্য জীবনের দুঃখের কাহিনিকে তুলে ধরেছেন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরেছেন মঁসিয়ে ওয়েলটন :
স্বামীর কলিং বেল বাজানোর আওয়াজ শুনে দরজা খুললেন শ্রীমতী ওয়েলটন।
--বলো ! স্ত্রী প্রফুল্লতার সঙ্গে বললেন।
একে-অপরের দিকে তাঁরা প্রাণবন্তভাবে হাসলেন।
--হ্যালো ! স্বামী বললেন। তুমি কি বাড়িতেই ছিলে?
আলতো করে একে-অপরকে তাঁরা চুম্বন করলেন। মৃদু আগ্রহের সঙ্গে শ্রীমতী ওয়েলটন লক্ষ করলেন স্বামী তাঁর কোট ঝোলালেন, টুপি ঝোলালেন, পকেট থেকে খবরের কাগজগুলি বের করে স্ত্রীকে একটা ধরতে দিলেন।
--খবরের কাগজগুলি তুমি এনেছ! একটা কাগজ নিয়ে শ্রীমতী ওয়েলটন বললেন।
--না হলে সারা দিন ধরে তুমি কী করবে? মঁসিয়ে ওয়েলটন জিজ্ঞাসা করলেন।
শ্রীমতী ওয়েলটন এই প্রশ্নেরই অপেক্ষা করছিলেন। স্বামীর ফিরে আসার আগে পর্যন্ত তিনি কল্পনা করছিলেন কীভাবে তিনি স্বামীকে গোটা দিনের সমস্ত ছোটোখাটো ঘটনার কথা বর্ণনা করবেন ... কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেগুলি একটি দীর্ঘ নীরস কাহিনি।
--সামান্য একটু প্রফুল্ল হাসি হেসে শ্রীমতী ওয়েলটন বললেন, উহ্ ! কিছুই না! আজ দুপুরটা তোমার ভালো কাটলো?
--আসলে ... মঁসিয়ে ওয়েলটন বলতে শুরু করলেন ... কিন্তু কথা বলতে শুরু করার আগেই তাঁর আগ্রহ মিলিয়ে গেল ... উপরন্তু স্ত্রী তখন কুশনের পশমের ঝালর থেকে একটা সুতো ছিঁড়তে ব্যস্ত ছিলেন।
--ওহ্ ! বেশ ভালোই – মঁসিয়ে ওয়েলটন বললেন।
...শ্রীমতী ওয়েলটন ভালোই জানতেন অন্য লোকেদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় ... আর্নেস্টও অন্যদের সঙ্গে বেশ আলাপচারী ছিলেন ... শ্রীমতী ওয়েলটন মনে করার চেষ্টা করছিলেন বিয়ের আগে বাগ্দান পর্ব চলাকালীন তাঁরা কী কী বিষয়ে কথা বলতেন। বড়ো বড়ো ব্যাপারে কথা বলার মতো তাঁদের কিছুই ছিল না। কিন্তু এই নিয়ে শ্রীমতী ওয়েলটন কখনোই চিন্তিত ছিলেন না ... তখন ছিল অজস্র চুম্বন আর মন ভরে রাখার মতো উপাদান। কিন্তু সাত বছর পর চুম্বন আর বাকি জিনিসের ওপর নির্ভর করে আপনি সন্ধ্যা কাটাতে পারবেন না।
কেউ ভাবতেই পারেন যে, সাত বছরে আপনি এই ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আপনি বুঝতে পেরেছেন যে ব্যাপারটা এরকমই হয়, ফলত আপনি এটাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু না। শেষ পর্যন্ত এটা আপনার স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলে। এটি সেরকম কোনো আরামদায়ক, বন্ধুত্বপূর্ণ নীরবতা নয় যা কখনো-কখনো মানুষের মধ্যে ঘটে। এটি আপনাকে এমন ধারণা দেয় যে, কিছু একটা করার আছেই আর আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করছেন না। আপনার তখন অনুভূতি হবে একজন অতিথিসেবিকার অনুভূতির মতো যাঁর সন্ধ্যাবেলার পার্টি ভালো যাচ্ছে না ... আর্নেস্ট কষ্টকরভাবে বই পড়ে যাচ্ছিলেন এবং খবরের কাগজ পড়ার মাঝপথেই তিনি হাই তুলতে শুরু করেন। শ্রীমতী ওয়েলটনের ভেতরে কিছু একটা হচ্ছিল যখন মঁসিয়ে ওয়েলটন এটা করছিলেন। শ্রীমতী ওয়েলটন ফিসফিস করে বলেন যে, তাঁকে অবশ্যই দেলিয়ার সঙ্গে কথা বলতে হবে। বলেই তিনি দৌড়ে চলে গেলেন রান্নাঘরে। অনেকক্ষণ তিনি সেখানে থাকলেন। বয়ামগুলির দিকে দীর্ঘসময় অব্যবস্থিতচিত্তে তাকিয়ে থাকলেন। পরীক্ষা করলেন লন্ড্রির জামাকাপড়ের তালিকা। যখন শ্রীমতী ওয়েলটন ফিরে এলেন, তখন মঁসিয়ে ওয়েলটন হয়তো রাতে ঘুমোনোর আগে স্নান করতে যাবেন।
এক বছরে ওঁদের তিনশো সন্ধ্যা এভাবেই কেটে গেল। সাত গুণ তিনশত হল দু-হাজারের বেশি।
কখনো-কখনো দাবি করা হয় যে, এই নীরবতা যে-কোনো শব্দের চেয়েও গভীর ঘনিষ্ঠতার লক্ষণ। এটা ঠিকই, এমনটাও কেউ অস্বীকার করার স্বপ্ন দেখেন না যে, দাম্পত্য জীবন অন্তরঙ্গতা তৈরি করে। পারিবারিক সমস্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রেই এটা সত্যি, এমনকি যে-সম্পর্কগুলির মধ্যে লুকিয়ে থাকে ঘৃণা, হিংসা, বিরক্তি সেখানেও। এই ঘনিষ্ঠতা এবং সত্যিকারের মানবিক ভ্রাতৃত্বের মধ্যে পার্থক্যকে দৃঢ়ভাবে চিহ্নিত করেছেন জুয়ানদো, যখন তিনি লিখেছেন :
এলিস আমার স্ত্রী। নিঃসন্দেহে, আমার বন্ধুদের মধ্যে, আমার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বা আমার নিজের লোকেদের মধ্যে কেউই তাঁর চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ নয় আমার। তবে তিনি তাঁর নিজের জায়গা আমার যত ঘনিষ্ঠবৃত্তেই তৈরি করুন না কেন এবং সেটি আমি আমার সবচেয়ে ব্যক্তিগত মহাবিশ্বে তাঁর জন্য যতই তৈরি করি না কেন, যতই তিনি আমার দেহ এবং আত্মার অবিচ্ছেদ্য তন্তুর মধ্যে প্রোথিত থাকুক না কেন, (এবং সেখানেই রয়েছে আমাদের অবিচ্ছিন্ন মিলনের পুরো রহস্য এবং পুরো নাটক), এইমাত্র যে-অচেনা ব্যক্তিটি বুলভার্ডে পেরিয়ে যাচ্ছেন এবং যাকে আমি আমার জানলা থেকে সামান্য দেখতে পাচ্ছি, তিনি আর যেই হোন না কেন, মানবিক দিক থেকে তিনি আমার কাছে আমার স্ত্রীর চেয়ে কম অচেনা।
অন্যত্র তিনি বলেছেন :
আমরা বুঝতে পারি যে আমরা একটি বিষের শিকার। কিন্তু এটিতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। নিজেদেরকে ছেড়ে না-দিয়ে কীভাবে এখন এটাকে পরিত্যাগ করবো?
এবং আরও :
আমি যখন তাঁর কথা ভাবি, তখন আমি অনুভব করি যে, সহানুভূতি, যৌনক্ষুধা চরিতার্থ করণ, প্রবল আবেগ, বন্ধুত্ব বা ভালোবাসার সঙ্গে দাম্পত্য প্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই। এই দাম্পত্য প্রেম নিজেই নিজের কাছে পর্যাপ্ত। এইসকল ভিন্ন অনুভূতির একপ্রকার বা অন্যপ্রকারে দাম্পত্য প্রেমকে সংকুচিত করা যায় না। একত্রিত হওয়া দম্পতির ওপরেই নির্ভর করে এই দাম্পত্য প্রেমের নিজস্ব প্রকৃতি, বিশেষ সৌরভ ও অনন্য শৈলী।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment