বিভাজন ও আমরা

  • 29 May, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 413 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
 আমাদের মনের ভিতরকার আগে থাকতে ধরে রাখা ধারণাগুলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেবল আড়ালে গিয়ে পড়েছে, অথবা সামান্য ধুলোতে মলিন হয়ে রয়েছে – কেবল এইটুকুই। সময় এলে পরে বিদ্বেষ অথবা ‘প্রেজুডিস’ প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা কেউই বোধহয় কারোর সাপেক্ষে পিছিয়ে থাকব না। ভিতরে ভিতরে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের ধর্ম, আমাদের লিঙ্গপরিচয় অথবা আমাদের গাত্রবর্ণ নিয়ে ‘প্রি-কনসিভড নোশন’এর এক দুর্দান্ত পৃথিবীতে আত্মগোপন করে থাকতেই অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।

আমরা বিভাজিত। যতই মুখে আমরা ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’এর বাণী আওড়াই না কেন, ভিতরে ভিতরে আমরা বিভাজিত। সেই বিভাজনের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা গভীর। গত আট বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন আমাদের মধ্যকার সেই বিভাজনকে কেবল সামনে এনেছে মাত্র। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বা সেই বিভাজনকে আরও প্রকট, আরও প্রভাবশালী করে তুলেছে। কিন্তু বিভাজন আমাদের অন্তরে ছিলই। বীজ ভিন্ন বৃক্ষের জন্ম হয় না। সেই বীজটুকুকে উৎপাটন করাটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আজ পুরনো কিছু ইতিহাসকে ফিরে দেখতে চাইব। মেলাতে চাইব প্রাসঙ্গিক বর্তমানকে। উপলব্ধি করতে চাইব কতখানি প্রয়োজন আমাদের এই আন্দোলন, আর কতখানিই বা এই সমাজের গভীরে প্রোথিত নারীর অবদমনের ইতিহাস। ঠিক কতখানিই বা নীচতলা থেকে আমাদের এই আন্দোলনকে শুরু করা উচিত।

 

সম্প্রতি ইতিহাসের এক অদ্ভুৎ পরিহাসের কারণে, দুইটি বিশেষ ঘটনার এক আশ্চর্য সমাপতন ঘটে গিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে, এই মাত্র গত সপ্তাহেই যেদিন স্কুলচত্বরে উন্মত্ত এক বন্দুকবাজের হামলার কারণে শিশু ও শিক্ষকহত্যার চরমতম দুঃখের ঘটনাটি ঘটে, দুর্ভাগ্যবশত সেই একই দিনে ছিল ব্ল্যাক_লাইভস_ম্যাটার আন্দোলনের অন্যতম সূত্রধর হয়ে ওঠা, শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে প্রাণ হারানো জর্জ ফ্লয়েডের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ভূতপূর্ব মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই দুটি ঘটনারই পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন, যার মূল বক্তব্য ছিল “টেক্সাসের ঘটনার কারণে প্রাণ হারানো প্রত্যেক শিশু ওই সেই দুইজন শিক্ষকের পরলোকগত আত্মার প্রতি আমাদের যেমনটা শ্রদ্ধা জানানো উচিত, ঠিক তেমনি ভাবেই আমাদের মনে রাখা উচিত পরলোকগত জর্জ ফ্লয়েডকে – দুইবছর আগে আজকের দিনেই যাঁর মৃত্যু হয়।” এই বিবৃতি প্রকাশের পরেপরেই সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সমালোচনার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে, এবং টেক্সাসের মর্মন্তুদ ঘটনার সময় তার দিকেই যে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও সহানুভূতির পরিমাণ বেশি থাকবে, এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওবামার বক্তব্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে এখনও মার্কিনি জনমানসে সাদাকালো বিদ্বেষের যে ভয়াবহ চেহারা সামাজিক মাধ্যমের একেকটি মন্তব্যে প্রত্যক্ষ করতে হলো, নির্দ্বিধায় বলতে পারি – বর্তমান ভারতবর্ষের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষের চেয়ে তাকে সামান্যতর কোনও অংশেও লঘু বলে মনে হলো না। হিন্দুতে-মুসলমানেতে, অথবা সাদাতে-কালোতে আমাদের যে সহস্রাব্দের অন্ধকার তার প্রভাব এখনও যে বিশেষ ভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়নি, সেই ধারণাই বোধ করি ভিতরে গিয়ে বদ্ধমূল হলো কোথাও। আমাদের মনের ভিতরকার আগে থাকতে ধরে রাখা ধারণাগুলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেবল আড়ালে গিয়ে পড়েছে, অথবা সামান্য ধুলোতে মলিন হয়ে রয়েছে – কেবল এইটুকুই। সময় এলে পরে বিদ্বেষ অথবা ‘প্রেজুডিস’ প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা কেউই বোধহয় কারোর সাপেক্ষে পিছিয়ে থাকব না। ভিতরে ভিতরে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের ধর্ম, আমাদের লিঙ্গপরিচয় অথবা আমাদের গাত্রবর্ণ নিয়ে ‘প্রি-কনসিভড নোশন’এর এক দুর্দান্ত পৃথিবীতে আত্মগোপন করে থাকতেই অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।

 

যে ইতিহাসের কথা বলতে চেয়েছিলাম। ১৯৯১ সালে সেদেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ বিচারপতি থারগুড মার্শালের স্বেচ্ছাবসরের পরবর্তীতে তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ (অথবা বুশ সিনিয়র)’এর তরফে জনৈক ক্ল্যারেন্স থমাসকে সেই পদের জন্য মনোনীত করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মনোনয়নের ক্ষেত্রে, সেদেশের সেনেটের বিশেষ বিচারবিভাগীয় কমিটিতে নির্বাচিত সদস্যদের প্রত্যেকের ভোটাভুটির ভিত্তিতে সাধারণ ভাবে রাষ্ট্রপতি-কর্তৃক মনোনীত সেই বিচারপতির মনোনয়নকে মান্যতা দেওয়া হয়ে থাকে। যদি কোনও কারণে বিচারবিভাগীয় কমিটিতে রাষ্ট্রপতির মনোনীত ব্যক্তি আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হন, সেই অবস্থায় তাঁর মনোনয়নের বিষয়টিকে পূর্ণাঙ্গ সেনেটের সম্মুখে বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। সেনেটকে মার্কিন সংসদের উচ্চতর কক্ষ বা আমাদের রাজ্যসভার অনুরূপ বলে ভেবে নেওয়া যেতে পারে। ক্ল্যারেন্স থমাসের মনোনয়নের কথা প্রকাশ্যে আসার পরেপরেই একটি অরাজনৈতিক অধিকার-সংগঠনের পক্ষ থেকে সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির সচিবকে জানানো হয় ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কমিটির ইইওসি বা ইক্যুয়াল এমপ্লয়মেন্ট অপরচুনিটি কমিশনে অধিকর্তা হিসেবে কাজ করার সময়ে বিচারপতি থমাস তাঁর একাধিক অধস্তন কর্মচারীর বিরুদ্ধে যৌন-ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যবহার করেছেন, যা কিনা কর্মক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থার সমতুল। এই প্রসঙ্গে আক্রান্তদের মধ্যে একজনের পরিচয় হিসেবে, ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনিতা হিলের নাম কেনেডির সচিবকে ব্যক্তিগত স্তরে জানানো হয়। সচিব এই প্রসঙ্গটি সেনেটের বিশেষ বিচারবিভাগীয় কমিটির প্রধানকে জানান এবং এফবিআই তদন্তের ব্যবস্থা করেন। এফবিআই এবং কেনেডির সচিবালয়ের তরফেই প্রথম অনিতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও যতটা সম্ভব সামাজিক সুরক্ষা, এবং তৎসহ অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক আক্রমণ বা মিডিয়ার কাছ থেকে তাঁর পরিচয় আড়ালে থাকবে, এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়েই অধ্যাপক হিল কেনেডির সচিবালয় ও তার পরবর্তীতে এফবিআইয়ের কাছে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। কিন্তু বিচারবিভাগীয় কমিটির সদস্যেরা তখনও অবধি ক্ল্যারেন্সের মনোনয়নের বিষয়টিতেই অনড় ছিলেন। প্রসঙ্গত বলে রাখার, ক্ল্যারেন্স এবং অনিতা, দুইজনেই ছিলেন জন্ম ও বর্ণ সূত্রে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রো-আমেরিকান গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। কোনওভাবে এফবিআইয়ের কাছে দেওয়া অনিতার বক্তব্য তখন সেনেট কমিটির ভিতর থেকেই মার্কিন সংবাদমাধ্যমের কাছে ফাঁস হয়ে যায় এবং দেশব্যাপী এক আলোড়নের সূত্রপাত ঘটে। শেষমেশ বিশেষ বিচারবিভাগীয় কমিটির তরফে একটি প্রকাশ্য শুনানির ব্যবস্থা করা হয় এবং থমাসের মনোনয়নের বিষয়টিকে পূর্ণাঙ্গ সেনেটের কাছে বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর পরেপরেই পুরুষতন্ত্রের দাঁত-নখ ও অন্যান্য অস্ত্রেরা একে একে বেরিয়ে আসতে শুরু করে।

 

বিস্তারিত বিবরণে যেতে চাইব না। শুধু এটুকু বলব, সামান্য অক্ষরকর্মী হিসেবে যেটুকু বুঝেছি (নারী আন্দোলনের কর্মীরা এই বিষয়ে আরও ভালো বলতে পারবেন) – যৌন-হেনস্থার শিকার হওয়া একজন নারীকে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের সম্মুখে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে গেলে যে ঠিক কতখানি হেনস্থা, অপমান, ও অবমাননার সম্মুখীন হতে হয় – তা কেবল সেই আক্রান্তই জানেন। পদে পদে হেনস্থা, অপমান ও তির্যক দৃষ্টির সম্মুখে দাঁড়িয়ে, তির্যক মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হতে – সেই আক্রান্তকে যে অবর্ণনীয় নরকের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তা আমরা সোফাতে বা ড্রয়িংরুমের কফি-কাউচেতে বসে নেটফ্লিক্স উপভোগ করতে করতে, এতটুকুও উপলব্ধি করতে পারি না। ১৯৯১ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রথম বিশ্বের একটি প্রথম সারির দেশেও – সুপ্রিম কোর্টে মনোনীত হতে চলা একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক হেনস্থার অভিযোগ আনেন, প্রকাশ্য শুনানিতে সেই অধ্যাপককে তাঁর বয়স্ক মা-বাবার সামনেই বারংবার সেই হেনস্থার বিবরণ শোনাতে বাধ্য করা হয়। একেকজন সেনেটর বিভিন্ন মনোবিদ ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ক পপুলার সায়ান্সের বই থেকে একেকটি করে উদ্ধৃতিকে তুলে এনে তাঁদের সুললিত বাগ্মীতায় অনিতার মানসিক ভারসাম্যহীনতার কথা সেনেট ভবনের প্রাসাদোপম অলিন্দগুলি থেকে সংবাদমাধ্যমে প্রচার করতে সহায়তা করেন। বিচারবিভাগীয় কমিটির প্রধান, রাজনৈতিক ভাবে রাষ্ট্রপতি বুশের বিপক্ষ হওয়া সত্ত্বেও কার্যকরী কোনও ভূমিকা নিতে অস্বীকার করেন। ব্যর্থ হন, এমনটা বলতে চাইব না – কারণ দীর্ঘমেয়াদে তাঁরও কেরিয়রের তখন অনেকটাই বাকি পড়েছিল। অনিতা হিল পলিগ্রাফ টেস্টে উত্তীর্ণ হন, তাঁর বক্তব্যের সত্যতা এই টেস্টের মাধ্যমে যাচাই করা হয়। বিচারপতি থমাস এই টেস্টে বসতে অস্বীকার করেন। এই প্রসঙ্গ টেনে রাষ্ট্রপতি বুশকে প্রশ্ন করা হলে পরে তিনি হালকা চালে প্রসঙ্গটিকে এড়িয়ে যান। অনিতার সাক্ষী হিসেবে আরও চারজন মহিলা সেনেট কমিটির সামনে নিজেদের বক্তব্য রাখতে এগিয়ে আসেন। শেষ একজন সাক্ষীকে, যার সাক্ষ্যদান অনেকে মনে করেন থমাসের পক্ষে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারত, শেষ মুহূর্তে কমিটির সদস্যদের চাপে তাঁকে সাক্ষ্যদান থেকে বিরত রাখা হয়। অনিতা সামনে আসতে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের মুখোশধারী নপুংসকেরা তাঁকে নিরাপত্তার মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে সামনে নিয়ে আসে এবং শেষমেশ তাঁকে প্রকাশ্য ব্যঙ্গের গিলোটিনে পর্যুদস্ত করে। বিচারপতি থমাস তাঁর নাটকীয় বক্তব্যে এই ঘটনাকে কালোদের বিরুদ্ধে সাদাদের চক্রান্ত হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। জাতিগত বিদ্বেষের বিষয়টিকে টেনে নিয়ে আসার কারণে, যৌন-হেনস্থার বিষয়টি আরোই আড়ালে চলে যায়। প্রবল রাজনৈতিক ও সামাজিক হেনস্থার চাপে অনিতা শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই সময়ের লড়াই থেকে সরে আসেন। ৫২-৪৮ ভোটে মার্কিন সেনেট বিচারপতি থমাসকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে মনোনীত করে। মার্কিন ইতিহাসে এমন সংকীর্ণ ব্যবধানে সুপ্রিম কোর্টে নির্বাচিত হওয়ার কোনও ইতিহাস আজ অবধি নেই।

 

যদিও অনিতার লড়াই একেবারে বৃথা যায়নি। অনিতার আন্দোলনের কারণে ১৯৯২ সালে বিপুল সংখ্যক মহিলা প্রার্থী মার্কিন কংগ্রেস বা সেদেশের সংসদের নিম্নকক্ষে নির্বাচিত হন। মার্কিন ইতিহাসে কোনও একটি নির্বাচনে এত সংখ্যক মহিলা প্রার্থীর জয়লাভের ঘটনা তার আগে কখনও ঘটেনি। অনিতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি বুশ কর্মক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থা নিবারণের প্রশ্নে একটি নতুন আইন পাশ করেন। যার ফলে কর্মক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থার বিষয়টিতে অভিযোগ জানানোর যে পদ্ধতি, তারও অনেকাংশে সরলীকরণ ঘটে। এমনকি ইক্যুয়াল এমপ্লয়মেন্ট অপরচুনিটি কমিশনেও মেয়েদের তরফে কর্মক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থার বিষয়ে জমা পড়া অভিযোগের সংখ্যা রাতারাতি প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে দাঁড়ায়। কিছুটা হলেও আলোয় এসে পড়ে সমাজের নীচতলাকার অন্ধকার।

 

অনেক বছর পর, ২০১৯এর এপ্রিল মাসে সেনেটের বিচারবিভাগীয় কমিটির সেই প্রধান, অনিতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি অনিতার কাছে ক্ষমা চাইবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। অনিতা এই প্রসঙ্গে আবারও তাঁর তিক্ত অনুভূতির কথাই সংবাদমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে জানান। কারণ ততদিনে বিচারবিভাগীয় কমিটির সেই প্রধান প্রশাসনিক সিঁড়িতে আরও অনেক, অনেকটাই উঁচুতে উঠে গিয়েছেন। বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র পরিচালক, রাষ্ট্রপতি জোসেফ আর বাইডেন – যাঁর অঙ্গুলিহেলনেই পৃথিবী নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। কেরিয়রের সংকটপূর্ণ একেকটা সময়ে যাঁরা সুকৌশলে নিজেদের সামগ্রিক পুরুষতন্ত্রের গড়টিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে ভিতরে ভিতরে সাহায্য করেন, কে না বলতে পারে – ভবিষ্যতে কোন পথেই বা তার পুরষ্কার আসে।

 

যদিও রাষ্ট্রপতি বাইডেনকে একক ভাবে এই বিষয়ে কাঠগড়াতে দাঁড় করাতে চাইব না। যেমনটা অনিতাও বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি পদে ট্রাম্পের বিপরীতে বাইডেনই তাঁর পছন্দের প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প অথবা বাইডেন, দুইজনেরই বিরুদ্ধে যৌন-হেনস্থার যে অভিযোগ, তার প্রত্যেকটিরই নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করি। ডেমোক্র্যাটদের মনে রাখা উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে দক্ষিণী কৃষ্ণাঙ্গদেরকে কেবলই তাঁদের (ডেমোক্র্যাটদের) ভোটের প্রয়োজনে এক নিশ্চিত ভোটব্যাঙ্ক বলে ভাবতে থাকলে, দীর্ঘমেয়াদে তা কেবল অসন্তোষই বাড়াবে। বাড়াবে বৈষম্য। আর আপামর মার্কিনি ভোটার-জনসংখ্যারও মনে রাখা উচিত, স্রেফ পুরুষ হওয়ার কারণে উগ্রবাদী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে, হিলারি ক্লিন্টনের বিপরীতে জিতিয়ে আনার বিষয়টিও তাঁদের তরফে এক ঐতিহাসিক ভুল বলেই মানবতার ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা রাষ্ট্রপতি হিসেবে বুশ, ক্লিন্টন, ট্রাম্প অথবা ওবামার যুদ্ধ-বিষয়ক একেকটি নীতির ক্ষেত্রে যেমনটা সামঞ্জস্যের কথা বলব, তেমনটাই বলব মন্দের ভালো নীতিকেও যদি বা বিশ্বাস করতে হয় – তাহলেও সেই ‘অসামান্য দেশ আমেরিকা’র সমাজ-অভ্যন্তরেও অনেক অনেক অতলস্পর্শী গিরিখাত রয়ে গিয়েছে। সার্বিক নাগরিক আন্দোলন ভিন্ন যাদেরকে অতিক্রম করা অসম্ভব। এখনও আমাদের তরফে আরও অনেক অনিতা হিল অথবা সমতুল চরিত্রদেরকে সকলের সামনে নিয়ে আসা বাকি রয়ে গিয়েছে।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment