- 29 March, 2023
- 0 Comment(s)
- 482 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
অক্টোবর, ২০২০। হাথরাসের ঘটনার পর লেখা নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘কাঁদো প্রিয় দেশ’, অন্নদাশঙ্কর রায়ের অন্য এক নিবন্ধের শিরোনাম থেকে ধার করে নিয়ে। মার্চ ২০২৩এ দাঁড়িয়ে সেই মামলার প্রাথমিক রায় ঘোষণার পর, প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিখতে চলা এই নিবন্ধের কিইবা শিরোনাম দেওয়া উচিত জানি না। আপাতত কোনও কিছুই মাথায় আসছে না। কোনও এক ইংরেজি পোর্টালে এই বিষয়ক নিবন্ধের যে শিরোনাম লিখেছে, বঙ্গানুবাদ করলে তা দাঁড়ায়, “আক্রান্ত না অভিযুক্ত, কারই বা বিচার হলো, পরিষ্কার নয়!” হয়তো বা এইটিই সবচেয়ে জুৎসই শিরোনাম হতে পারত। বিশেষত ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে ধর্ষণের মতো একটি অপরাধের ক্ষেত্রে আক্রান্ত নারীদের যে কি অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, আমরা তা খবরের কাগজে, টিভিতে, অথবা নাটক-সিনেমাতে প্রত্যক্ষ করে থাকি। তাতে সবটা বোঝা যায় না। পুরুষ হয়ে তো আমরা কখনই নারীর সঠিক যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করতে পারি না। এছাড়াও আমরা উচ্চকোটির সমাজবৃত্তে বসে থাকা মার্ক্স-লেনিন-রবীন্দ্রনাথ আওড়ানো মানুষ। সমাজ অথবা সামাজিক পরিস্থিতির বিচারে এমন একেকজন নারীকে যে কি ভয়ানক অবস্থারই বা সম্মুখীন হতে হয়, আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আমরা যদি সমাজের কথাও বা ছেড়েই দিই, আদালতের এই রায়টিকে অল্পবিস্তরে উলটিয়ে দেখলে পরেই যে চরম সত্য আমাদের কাছে প্রতিভাত হবে, তাই আমাদের আতঙ্ক জাগানোর পক্ষে অনেক। এমন নির্জলা সত্যকে আমরা না পারি অস্বীকার করতে, না পারি নির্মূল করতে। সভ্যতা, শোভনতা, অথবা নারী-নিরাপত্তার অঙ্গীকার, এসবই কেবল চাকরির পরীক্ষা অথবা ইন্টারভিউ প্যানেলগুলিতে নিজের ছদ্ম-শিরদাঁড়াকে জাহির করবার প্রয়োজনে। বাস্তবতার মাটিতে এমন শব্দ অথবা শব্দবন্ধগুলির অস্তিত্ব থাকে না।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এফআইআর দায়ের হবার পর, মেয়েটির মৃত্যু অবধি, আটদিন অপেক্ষা করা হয়েছিল আদৌ ধর্ষণ হয়েছে কি না সেই বিষয়ক শারীরিক পরীক্ষার জন্য। এর কারণে যথাবিহিত ভাবেই ধর্ষণের ডাক্তারি প্রমাণ মেলেনি। ভরসা বলতে ছিল কেবল আক্রান্ত মেয়েটির মৃত্যুকালীন জবানবন্দি, ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে যার গুরুত্ব অসীম। মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে মেয়েটি ধর্ষণ হয়েছে এবং গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি জানায়। আদালত তার পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, “যদি ধর্ষণের মতো ঘটনা আদৌ ঘটে থাকত, তাহলে সেই ঘটনা মেয়েটি নিশ্চিত করেই আগে সাংবাদিকদের জানাতো।” এই বিষয়ে আলোকপাত করতে গেলে বলি, রক্তাক্ত, নগ্ন অবস্থায়, তখনও অবধি জীবিত মেয়েটিকে যখন প্রথম উদ্ধার করে নিকটবর্তী চাঁদপা পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়, স্থানীয় এক সাংবাদিক সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ঘটনার একটি ভিডিও করেন এবং মেয়েটির মাকে যখন সেই ভিডিওতে কি ঘটেছে বলে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়, ভদ্রমহিলা “কিছু হয়নি” বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। পরে “মারপিট হয়েছে” এমন একটি প্রতিক্রিয়া জানান। এরপর (দীর্ঘক্ষণ কড়া রোদের তাপে চাঁদপা পুলিশ ফাঁড়িতে একটি পাথরের চাঁইয়ের উপর শুইয়ে রাখার পর) মেয়েটিকে যখন তাঁর পরিজনেরা হাথরাস জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসেন, সেই সময় আরেক স্থানীয় সাংবাদিক সেখানে হাজির ছিলেন। তিনিও বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ নেন, সেখানেও “মারপিট”এর ঘটনা ঘটেছে এমনটাই অভিযোগ শোনা যায়। ধর্ষণ বা গণধর্ষণের কোনও বয়ান তখনও অবধি শোনা যায়নি – এই দুই সাংবাদিকের ভিডিও ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই আক্রান্ত মেয়েটির মৃত্যুকালীন জবানবন্দিকে মান্যতা দিতে আদালত অস্বীকার করে। এই ঘটনাগুলি ঘটেছিল ১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে। ১৯শে সেপ্টেম্বর শারীরিক অবস্থার ক্রমাগত অবনতি হতে থাকলে প্রথমবারের জন্য আক্রান্ত মেয়েটি শ্লীলতাহানি (দেহাতি হিন্দিতে সে বলেছিল ‘ছেড়খানি’) ও ধর্ষণ (‘জবরদস্তি’) করা হয়েছে বলে অভিযোগ জানায়। ২২শে সেপ্টেম্বর সে মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে আবারও ধর্ষণ ও গণধর্ষণের কথা বলে, এবং অভিযুক্তদের নামও স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয়। এর আগে মূলত অভিযুক্ত সন্দীপ শিশোদিয়ার নামই ‘পারিবারিক বিবাদ’এর সূত্রে উঠে এসেছিল। মৃত্যুকালীন দুইটি বক্তব্যে আক্রান্ত মেয়েটি সন্দীপ, রামু, লবকুশ ও রবি, মোট এই চারজন অভিযুক্তেরই নাম বিবৃত করে। এই জবানবন্দির সময় চাঁদপা থানার মহিলা কনস্টেবল সরলা দেবী ও কোহল তহশিলের নায়েব তহশিলদার মণীশ কুমার সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সরলা দেবী জানান, এই জবানবন্দির পর তিনি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেন – কেন সে এর আগে চাঁদপা থানায় প্রথম নিয়ে আসার সময় ধর্ষণের কথা উল্লেখ করেনি। মেয়েটি জবাবে জানায় সেই সময় সম্পূর্ণ ঘটনাকে বর্ণনা করার মতো তার সম্যক জ্ঞান বা বোধশক্তি ছিল না। মনে রাখতে হবে সারারাত পৈশাচিক অত্যাচারের পর, আহত, রক্তাক্ত অবস্থায় কিভাবে তাকে রোদের মধ্যে, পাথরের উপর চাঁদপা থানার প্রাঙ্গণে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। সেই অবস্থায় জ্ঞান থাকলেও, দলিত মেয়ে হিসেবে সমাজের উচ্চবর্ণের পুরুষদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ সরাসরি নিয়ে আসা, যা আনলে পরে কি না কেবল যে সমাজে ধোপা-নাপিতই বন্ধ হয়ে যাবে তাই নয়, মেয়েটির নিজের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণরূপেই অন্ধকারে ঢেকে আসবে। এই সবকিছুকে উপলব্ধি করতে করতে, যন্ত্রণায়, লজ্জায় বিঁধতে বিঁধতে কোন মেয়ের পক্ষেই বা প্রথম প্রশ্নোত্তরেই সমস্ত ঘটনাকে কাঠগড়ার সাক্ষীর মতো বিবৃত করা সম্ভব? জানা থাকলে কেউ জানিয়ে দিতে পারেন। এমন প্রবল ও নিষ্পেষক শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আক্রান্তকে যেতে হয় বলেই, মৃত্যুকালীন জবানবন্দির উপর এতখানি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কারণ তখন আক্রান্ত মোটের উপরে বুঝতে পেরে গিয়েছে আর সে ফিরছে না কোনও ভাবেই। এই কথাগুলি আশা করব আমার লিখতে যতখানি কষ্ট হচ্ছে, ঠিক ততখানি – ততখানিই অস্বস্তি ভাব যেন আপনাদের মধ্যেও জেগে উঠতে পারে। আমরা এই পিশাচদের দেশেই বসবাস করে থাকি। আমাদের দেশপ্রেম এই দেশমাতৃকার উদ্দেশ্যেই এখন। অন্য সাক্ষী মণীশ কুমার, মেয়েটি যে তাকে ধর্ষণের কথা তার মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছে, এই তথ্যটুকুকে স্বীকৃতি দিতেই অস্বীকার করে।
আদালত তার রায়ে জানায়, যেহেতু ১৯শে সেপ্টেম্বরের জবানবন্দিতে সন্দীপ ছাড়া আর কারও নামের উল্লেখ নেই, সে কারণে ২২শে সেপ্টেম্বরের অন্তিম জবানবন্দিতে আরও তিনজনের নাম জুড়ে যাওয়ার পিছনে দূরভিসন্ধি থাকার অবকাশ রয়েছে। আক্রান্তকে এই নামগুলি শিখিয়ে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। এমনকি ততদিনে গোটা ঘটনাটি রাজনৈতিক মাত্রা পেয়ে যাওয়ায়, নেতানেত্রীদের যাতায়াত ও তাঁদের তরফে মেয়েটির পরিবারকে দেওয়া পরামর্শ মেয়েটির জবানবন্দিকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। তদন্তকারী সংস্থার তরফে জমা দেওয়া চার্জশিটে এও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল যে, সন্দীপ আক্রান্ত মেয়েটির প্রতি ‘আগ্রহী’ হয়ে ওঠে। মেয়েটি সন্দীপকে গুরুত্ব না দেওয়া ‘বিরক্তি’ থেকেই সন্দীপ মেয়েটির প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এমন সহজ সরল ভাবেই ধর্ষণের মতো একটি ঘটনা সম্পর্কে লিখে দেওয়া যায়, বিস্মিত হতেও বোধকরি বা অস্বস্তি বোধ হয় তখন। তদন্তকারী সংস্থার তরফে জমা দেওয়া মেডিকেল রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, “ধর্ষণ অথবা যৌন হেনস্থার মতো ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু সঠিক সময়ে ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়ায় সেই বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না।” আদালত তার ১৬৭ পৃষ্ঠার রায়ে জানিয়েছে, যেহেতু বিষয়টি রাজনৈতিক মাত্রা পেয়ে যায়, সেই ক্ষেত্রে আক্রান্ত মেয়েটিকে ‘শিখিয়ে-পড়িয়ে’ দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। শেষ অবধি তিন অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করে, সন্দীপ শিশোদিয়াকেও ধর্ষণের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে, আদালত অনিচ্ছাকৃত খুনের অপরাধে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শোনায়।
এরই মাঝে আর কেউ প্রশ্ন করে না, কেনই বা তাহলে তড়িঘড়ি সরকারি তরফে ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করা হয়েছিল? কেনই বা রাতের অন্ধকারে ১৪৪ ধারা জারি করে আক্রান্ত মেয়েটির দেহ গ্রামে নিয়ে আসা হয়েছিল?
আর কেনই বা, শেষমেশ কেরোসিন তেল ঢেলে রাতের অন্ধকারে খোলা ক্ষেতের উপরে মেয়েটির ‘শেষকৃত্য সম্পন্ন’ করা হয়েছিল? এখনও যে কান পাতলে শুনতে পাই, সাংবাদিক তনুশ্রী পাণ্ডের সেই কন্ঠস্বর, “অন্ধেরে মে ও কেয়া জ্বল রহা হ্যায়?” পুড়ছিল তখন গোটা একটা দেশ। একটা দেশের সমস্ত মানবতাটুকুই তখন, জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল কেবল!
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment