- 24 December, 2020
- 1 Comment(s)
- 800 view(s)
- লিখেছেন : সারদা ঘোষ
সবাই তাঁকে এক নামেই চেনেন--উত্তরাদি। আদতে তিনি আমার শিক্ষিকা। তাই তাঁর সামনে বা সচেতনভাবে তাঁকে কখনোই নাম ধরে ডাকিনি। তাঁর জন্য একটি সম্বোধনই যথার্থ মনে হত—‘দিদি’। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বেথুন কলেজে ইতিহাসের স্নাতক স্তরে যখন ভর্তি হলাম, তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। প্রথমে আরও অনেক ছাত্রীর ভিড়ে তাঁকে দেখতাম দূর থেকে। তারপর ক্রমশ পঠনপাঠন, জিজ্ঞাসা আর উত্তরের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে তাঁর সঙ্গে নৈকট্য বাড়তে থাকে। দিদি বলতেন ছাত্রী হিসাবে আমার জানার আগ্রহ, মনোযোগিতা তাঁকে আমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। আমি বলি তাঁর বিশ্লেষণী ব্যাখ্যা, উচ্চতর যুক্তি, ব্যাখ্যা দিয়ে ইতিহাসকে দেখার শিক্ষাই আমাকে তাঁর প্রতি অনুরক্ত করে তুলেছিল। সংখ্যাগত বিচারে তিন বছরের স্নাতক স্তরে তাঁর কাছে আমি পড়েছি, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে শিখেছি সারা জীবন ধরে, সেই ২৯ নভেম্বরের আগের দিন পর্যন্তও। কখনও বন্ধুর মতো, কখনও মায়ের মতো, কখনও সহকর্মীর মতো দিদি আমাকে জীবনের পাঠ দিয়ে গেছেন প্রতিনিয়ত। তাঁর দেওয়া সেই অফুরন্ত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার, জীবনের উপলব্ধি, মূল্যবোধে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে আমার ব্যক্তিজীবন, আমার কর্মজীবন। সেই শিক্ষার ভাণ্ডার এতটাই প্রাচুর্যময় যে, একা তাঁকে অনুভব বা উপভোগ করা যায় না। মন চায় সেই সমৃদ্ধির ভাগ অন্যদেরও দিই। বিশেষত আজ যখন আমি নিজেই একজন শিক্ষিকা হিসাবে ছাত্রছাত্রীদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমি আমার সেই প্রাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ফসল এখনও আমার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভাগ করে নিই, ভবিষ্যতেও তা করবো। স্মরণে, মননে দিদি চিরকাল থেকে যাবেন আমার সঙ্গে। আমার মতো অসংখ্য আগত, অনাগত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে।
দিদির লেখা বলতে গেলে সামান্য কয়েক পাতায় তা কুলিয়ে ওঠার কথা নয়। কারণ তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্রী-শিক্ষিকার গণ্ডি অতিক্রম করে বহু বছর আগেই এক আন্তরিক, গভীর মেলবন্ধনের মধ্যে বাঁধা পড়েছিল। শেখা ও শেখানোর পরিসর পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও বৃহত্তর জীবনদর্শনেও প্রসারিত হয়েছিল, এবং সেই শিক্ষার গুণে সমৃদ্ধতর হয়েছে আমার চলার পথ। দিদি হয়ে উঠেছেন আমার জীবনের পথপ্রদর্শক। বেথুনে পড়াকালীন মুগ্ধ হয়ে আমরা দেখতাম তাঁর ব্যক্তিত্বের ঋজুতা, ভাবনার ঋজুতা, বক্তব্যের ঋজুতা। পরবর্তীকালে জেনেছি এই দৃঢ় অথচ মমতাপূর্ণ জীবনচর্চার মূলে আছে তাঁর জীবনদর্শন। যার পাঠ তিনি নানাভাবে, নানা সময়ে আমাকে দিয়েছেন। খুব সরল কিছু ভাবনা, কিছু গভীরতর ব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ যা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলে একজন আদর্শবাদী অথচ সফল শিক্ষক হয়ে ওঠা যায়, আবার এক আত্মবিশ্বাসী মানুষও হতে পারা যায়। আমার কাছে দিদি তাই আদ্যন্ত এক আদর্শ শিক্ষক, যাঁর শেখানোর বিষয় ও ব্যাপ্তি কখনও নিঃশেষ হয়ে যাবে না। এক জাগতিক জীবন পার করে থেকে যায় তা প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে, অগণিত ছাত্রসমাজের মধ্যে।
শিক্ষকের শিক্ষার মধ্যে মমত্ব মেশানো থাকলে তা শিক্ষার্থীর কাছে আরও মহার্ঘ্য, আরও উপাদেয় হয়ে ওঠে। উত্তরাদির শিক্ষায় আমি এবং আমার মতো বহু ছাত্রছাত্রী খুঁজে পেয়েছিলাম সেই আকর্ষণের বিষয়। শিক্ষার্থীর কাছে তাঁর কাম্য ছিল কেবলমাত্র তাদের নিষ্ঠা ও জানার আগ্রহ। এটুকু সম্বল করে কেউ তাঁর দিকে এক পা এগোলে তিনি সাদর আগ্রহে এগিয়ে আসতেন যেন দশ পা, উজাড় করে দিতেন তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার যাবতীয় ভাণ্ডার। ছাত্র-শিক্ষকের এই দেওয়া-নেওয়ার মাঝে কোনো প্রতিষ্ঠান, কোনো প্রথাগত স্বীকৃতি কখনও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। শুধু ভালো ছাত্র হয়ে ওঠার পাঠই নয়, তিনি শিখিয়েছিলেন ভালো শিক্ষক ও মানুষ হয়ে ওঠার পদ্ধতিও। এই কর্মময়, সুবৃহৎ অভিজ্ঞতানির্ভর জীবনে এক দীর্ঘ সময়ের সাক্ষী হয়ে থাকতে পেরে আমি চিরকাল নিজেকে ধন্য মনে করেছি, আজও করি এবং ভবিষ্যতেও করব।
দিদি চলে যাবার পর তাঁর সম্পর্কে কথা বা স্মৃতিচারণার জন্য অনেক অনুরোধ এসেছে। প্রতিবারই ভেবেছি আমার কাছে তাঁর সম্পর্কে বলার মতো বহু বিষয় আছে। কিন্তু যখনই বলতে গেছি, মনে হয়েছে সেই বিশাল স্মৃতির সরণি বেয়ে যেতে গেলে আমি হয়তো পথই হারিয়ে ফেলবো। সব ক্ষেত্রেই তাই আমার বক্তব্য আমার একান্ত, ব্যক্তিগত অনুভূতির মধ্যে সীমায়িত থেকে গেছে। অন্য অনেকের মতো গুছিয়ে অতীত অভিজ্ঞতা আমি তুলে ধরতে পারিনি। আজ এখন দিদিকে নিয়ে লিখতে বসেও আমার সেই একই অনুভূতি হচ্ছে। স্মৃতির ভাণ্ডার এতই ভরপুর যে কোথা থেকে শুরু করে কোথায় শেষ হবে, আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। সেই সব কিছুই আমার স্মরণ, মননের একান্ত নিজস্ব সম্পদ হয়েই হয়তো থেকে যাবে চিরদিন। আর দিদি আমার কাছে থেকে যাবেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা হয়েই। তাঁর কাছে শুনেছি, তিনি বলতেন মানুষের জীবন একটা বইয়ে ভরা লাইব্রেরির মতো। আজ বারেবারে তাঁর সেই কথাটাই আমার মনে হচ্ছে। সত্যিই তো, তিনি তো আমাদের কাছে সেই বই-ঠাসা লাইব্রেরির মতোই। যেখানে থরে থরে সাজানো আছে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর অনুপ্রেরণার হাজারো রসদ। তাক থেকে বই নামিয়ে পড়লে সেই স্থান সাময়িকভাবে ফাঁকা হয়ে যায় বটে, কিন্তু পাঠকের অন্তর-মন তো পূর্ণ হয়ে ওঠে। হাজারো মানুষ বহু কাল ধরে আনাগোনা করে সেই লাইব্রেরিতে নিজেদের ব্যক্তিমননকে সমৃদ্ধ করতে। লাইব্রেরির বহু বিচিত্র বই তাদের সেই চাহিদা পূরণ তো করেই আবার নিজেকে সুসজ্জিত ও সুরক্ষিত করে রাখে আগামী দিনের জন্য, আগামী প্রজন্মের জন্যও। তার দেওয়ার ভাণ্ডার কখনও ফুরায় না, তার প্রয়োজনও কখনও শেষ হয়ে যায় না। উত্তরাদি তাঁর সমস্ত জাগতিক জীবনে এই চরম সত্যটাকেই বারেবারে প্রমাণ করে গেছেন। তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতির অভাব তাই চিরকাল কষ্ট দিয়ে যাবে, শূন্যতায় ঘিরে রাখবে। কিন্তু স্মরণে, মননে, জীবনে চলার পথে তিনি জীবিত থাকবেন সবসময়। তাঁর এক সাধারণ ছাত্রী থেকে তাঁর অপার স্নেহ ও সাহচর্যের সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছি আমি। আমার কাছে তাঁর নির্যাস চিরকাল সুগন্ধি ফুলের সুবাস বহন করে এনেছে এবং আগামী দিনেও আনবে। শোকের প্রাথমিক রেশ কাটিয়ে ওঠার পর সেই অনুভূতি যেন এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে, তিনি আছেন আমারই মধ্যে, আমারই পাশে, আমারই সঙ্গে। তাঁকে আমি হারাইনি, হয়তো আমরা কেউই হারাইনি। তাঁর থেকে যা পেয়েছি, তাকে সুরক্ষিত রেখেও তার সেই সুবাস বৃহত্তর ছাত্রসমাজ আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমি তাই আমার ক্ষুদ্র সামর্থ দিয়েও পরিপূরণ করার সংকল্প নিয়েছি। তিনি আমায় যা দিয়েছেন, তার প্রতিদান তাঁকে আমি হয়তো কিছুই দিতে পারিনি। কিন্তু তাঁকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তাঁর এই কন্যাসমা ছাত্রী স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি আমার জীবনের বাকি সমস্ত বিষয়ের মতো এই উদ্যোগেও তিনিই হবেন আমার সর্বপ্রধান ও সবথেকে আগ্রহী পৃষ্ঠপোষক ও অনুপ্রেরণাদাত্রী।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
1 Comments
Unpassy
08 October, 2022
what is the generic name for lasix I m not as worn out after my workouts and I m seeing better results in the gym
Post Comment