- 20 February, 2024
- 0 Comment(s)
- 855 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মাথাচাড়া দিয়েছিল ভাষার প্রশ্ন। পাকিস্তানের নাগরিকদের মাতৃভাষা পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচি, পুষতু, বাংলা। উর্দু কোন অঞ্চলের মাতৃভাষা ছিল না। কিন্তু যে সম্পদশালী-শিক্ষিত নেতা, মুসলমান জমিদার ও উচ্চপদস্থ চাকুরিজীবীরা প্রশাসনিক কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, তাঁদের ভাষা ছিল উর্দু। এই উর্দুভাষী শাসকদের ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানে বাংলাভাষী ছিলেন ছাপান্ন শতাংশ। ছাপান্ন শতাংশ বাঙালি দাবি করেছিলেন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করতে হবে। সেই দাবি শাসকদল মানেননি। পঠন-পাঠন উর্দুতেই হবে। তবে বাঙালি চাইলে আরবি হরফে বাংলা পড়তে পারে। শাসকদলের দখলদারি, আধিপত্যের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সচেতন হন। মুসলমান পাঞ্জাবি শাসকের পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে ব্যহত করতে সেখানকার বাঙালি রুখে ওঠেন। জাতিগত স্বাতন্ত্র্য চেতনা থেকে গড়ে ওঠে বাংলাভাষা রক্ষার আন্দোলন। বাঙালির মনন-চিন্তনের প্রকাশ, জীবিকার দাবি সব কেড়ে নেওয়ার অভিসন্ধি ছিল বাংলাভাষা লুপ্ত করার চেষ্টার মধ্যে।
সেদিনের পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসক ছাপান্ন শতাংশ বাঙালিসহ অন্য মাতৃভাষী নাগরিকদের উপর উর্দু চাপাতে চেয়েছিল—এক রাষ্ট্র, এক ভাষা, এক ধর্ম, এই দখলদারি তৈরির উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ চালু রাখতে গেলে বাঙালির সংস্কৃতি নষ্ট করা আগে দরকার। ইসলামি বোধ জাগিয়ে তুলে বাঙালিদের আনুগত্য আদায় করার জন্য প্রথমেই ভাষার উপর আঘাত হানে অবাঙালি মুসলমান শাসক। পূর্ব পাকিস্তানের উর্বর জমি থেকে যে ফসল উঠত তা বেশিরভাগ ভোগ করত পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিমরা। ব্যবসা, চাকরিতে বাঙালিদের সুযোগ কম। আবার বাঙালিদের ফলানো ফসলের আয়েও শাসকশ্রেণির হস্তক্ষেপ। চারদিক থেকে বাঙালি-পীড়ন ভয়াবহ আকার নিয়েছিল।
মাতৃভাষা লোপ করে উর্দু চাপালে, উর্দু ভাষার মানুষ অনেকটা বেশি সুবিধাজনক অবস্থা পাবে। লুপ্ত ভাষাভাষীর মানুষের কাছে চাপানো বা অন্যদের ভাষা শিখে শিক্ষা ও কর্মজগতে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে ওঠে। প্রতিযোগিতার জগতে যাতে শাসকশ্রেণির লোক এগিয়ে যেতে পারে সেদিকে তাকিয়ে অনেক দেশের শাসকদলই তাদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়। তবে পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন বাঙালি টের পেয়েছিলেন শাসকের গোপন ষড়যন্ত্র। তাছাড়া ধর্মের সঙ্গে ভাষা সংযুক্ত নয়। হিন্দুর ভাষা, মুসলমানের ভাষা, খ্রিস্টানের ভাষা বলে কিছু হয় না। তাই উর্দু মুসলিমদের ভাষা এই তত্ত্বকে তাঁরা খারিজ করে দেন। আহমদ শরীফ লেখেন, ‘আরবি ফারসি উর্দু ভাষা মুসলমানের ভাষা নয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই ইব্রীয়দের হিব্রুর ও আরবির হিন্দি-বাংলার মতোই অভিন্ন উৎস ও ভিত্তি। আরবি ভাষা প্যাগান, কাফের, ইহুদি, খ্রিস্টান নির্বিশেষের মাতৃভাষা ছিল ও আছে, ফারসিও তাই। ভারতে উর্দুও তাই। এ জন্যেই ইসলাম-পূর্বকালেও আমিনা, খাদিজা, মুহম্মদ, আবু তালেব, আব্দুল্লাহ, আবদুল মুত্তালেব প্রভৃতি নাম চালু ছিল, দেখতে পাই। ফারসি নামগুলোও অমুসলিম-মুসলিম নির্বিশেষের মধ্যে চালু রয়েছে।’ (ভাষা সংস্কার ও বাঙালি চেতনার বিকৃতি) ভাষার উপর আক্রমণ শাসকশ্রেণির অন্যতম এক কৌশল। ভাষাকে ধর্মের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে অজ্ঞ, অনক্ষর, নিম্নবিত্ত ও নিম্নবর্গের মানুষদের উশকানি দেওয়া ধর্ম-রাজনীতির অঙ্গ। চাকরি দখল, বাজার দখলের হাতিয়ার। ভাষা-ধর্মের আফিম পুরে বশ করার চেষ্টা। এক ধর্ম, এক ভাষা, এক রাষ্ট্র এই শ্লোগান ভিত্তিহীন। তাই জাগ্রত মানুষই পারেন শাসকের অপ-আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ের পতাকা ওড়াতে। পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি তারই উজ্জ্বল নিদর্শন।
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১
ছবি : সংগৃহীত
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment