আন্তর্জাতিক নারীদিবস : কিছু ভাবনা

  • 17 March, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 289 view(s)
  • লিখেছেন : অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
নারীবাদ হল এমন এক তাত্ত্বিক অবস্থান যা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় যে জীবনের সব ক্ষেত্রে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে পিতৃতন্ত্র নামের এমন একটি শক্তিশালী সর্বত্রবিরাজমান ব্যবস্থা যা আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিতে চায় যে নারী পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট, পুরুষ নারীর প্রভু। পিতৃতন্ত্রের আধিপত্য কায়েমের পন্থা এবং কৌশল সম্বন্ধে সচেতনতা থেকে উদ্ভূত হয় এই ব্যবস্থাটাকে ধ্বংস করার তাগিদ, অসাম্যভিত্তিক এই সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তনের তাগিদ, নারী-পুরুষের সাম্যের জন্য লড়াই। ব্যক্তিপুরুষের বিরুদ্ধে নারীবাদ কথা বলে না।

অধ্যাপিকা আফরোজা খাতুন যখন নারীদিবস উপলক্ষে আমায় একটি লেখা দিতে বললেন তখন আমি ভাবতে শুরু করলাম, কী লিখি! কী লিখি! লেখার তো অনেক কিছু থাকে, বলার থাকে অনেক কথা, মাথায় অনেক ভাবনা ঘুরপাক খায় কিন্তু ব্যস্ততার মাঝে লিখতে বসলে সবসময় লেখা আসে না। আন্তর্জাতিক নারীদিবস উপলক্ষে কিছু বলার জন্য আমন্ত্রণ পাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয় এই সুবাদে। কথা বলা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গেও। এবার দুই-তিন জায়গায় বলার পর কতগুলো ভাবনা মাথায় এল। সেগুলোই ভাবলাম লিখে ফেলি।

প্রথমত, শিক্ষক–পড়ুয়া নির্বিশেষে একটা প্রবণতা লক্ষ করেছি। নিজেদের নারীবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে বেশির ভাগ দ্বিধান্বিত। সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে শত শত কর্মসূচী সত্ত্বেও নারীবাদের ধারণা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। জিজ্ঞেস করি, তোমরা কি নারী-পুরুষের সাম্য বিশ্বাস করো? উত্তর পাই, হ্যাঁ। এবার যদি প্রশ্ন করি, তুমি কি নারীবাদী? তাহলে দুইএকটি হাত আধখানা ওঠে। বেশির ভাগ ওঠে না। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। ‘হ্যাঁ, আমি নারীবাদী’ -- একথা বলতে অদ্ভূত এক দ্বিধা। আসলে নারীবাদ কী এবং কেন, এই বিষয়ে এখনও চরম বিভ্রান্তি। উলটোপালটা সব ধ্যানধারণা মাথায় গেঁথে থাকা। নারীবাদ মানে পুরুষ-বিদ্বেষ। নারীবাদ মানে জীবন থেকে প্রেম-বিবাহকে ছেঁটে ফেলা। নারীবাদ মানে পুরুষকে বাদ দিয়ে জীবনে চলা। নারীবাদ মানে তথাকথিত বেপরোয়া জীবনযাপন, ধুমপান, মদ্যপান, উগ্র পোষাক, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই কারণেই বহু বিদগ্ধ কৃতী নারীও সভয়ে বলে ওঠেন, আমি নারীবাদী নই। পুরুষকে বাদ দিয়ে কি জীবনে চলা যায়? নারী পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক। আবার কেউ কেউ বলেন, আমি নারীবাদী নই, আমি মানবতাবাদী, humanist।

আরেকটা প্রবণতা দেখি ইদানিং। আমায় বলা হয়, ‘ম্যাডাম, নারী শব্দটা ব্যবহার না করে জেন্ডার শবদটা ব্যবহার করছি বক্তৃতার শিরোনামে’। এই শব্দটা inclusive। এই শব্দটা ব্যবহৃত হলে কেউ বাদ পড়বে না। শুধু মেয়েদের কথা বললে পুরুষদের গোঁসা হয়। তাছাড়া নারী-পুরুষ এই দ্বিবিধ পরিচয়ের বাইরে যারা থাকেন অথবা থাকতে পছন্দ করেন তাদের আলোচনা থেকে বাদ দিলেও তারা দুঃখ পেতে পারে। জেন্ডার শব্দটা একটা ছাতার মতো। সবাই এঁটে যায় এর তলায়।

কতগুলো কথা স্পষ্ট বুঝে নেওয়া দরকার। নারীবাদ হল এমন এক তাত্ত্বিক অবস্থান যা প্রথমত আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় যে জীবনের সব ক্ষেত্রে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে পিতৃতন্ত্র নামের এমন একটি শক্তিশালী সর্বত্রবিরাজমান ব্যবস্থা যা নারীকে পুরুষের নীচে ঠেলে দেয়, যা আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিতে চায় যে নারী পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট, পুরুষ নারীর প্রভু। দ্বিতীয়ত, পিতৃতন্ত্রের অস্তিত্ব, তার আধিপত্য কায়েমের পন্থা এবং কৌশল সম্বন্ধে সচেতনতা থেকে উদ্ভূত হয় এই ব্যবস্থাটাকে ধ্বংস করার তাগিদ, অসাম্যভিত্তিক এই সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তনের তাগিদ, নারী-পুরুষের সাম্যের জন্য লড়াই। এটাই নারীবাদ, এবং যারা এই অসাম্যের বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়ে পরিবর্তনের তাড়নায় চালিত হয় তারাই নারীবাদী। তারা নারী হতে পারে, পুরুষ হতে পারে, ভিন্ন লিঙ্গ হতে পারে। ব্যক্তিপুরুষের বিরুদ্ধে নারীবাদ কথা বলে না। যে ব্যবস্থা ব্যক্তিপুরুষকে বেশি সুযোগ-সুবিধে দেয়, তার বিরুদ্ধে কথা বলে। নারীবাদীরা সবরকম বৈষম্যের বিরুদ্ধেই কথা বলে, বিভিন্ন রকমের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার ঘাতপ্রতিঘাতের বিষয়ে কথা বলে। নারীকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবী করে। তাই নারীবাদের সঙ্গে মানবতাবাদের কোনও দ্বন্দ্ব নেই। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় মেয়েদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে পুরুষ আপনা থেকেই আলোচনায় এসে পড়ে, কারণ পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় পুরুষ সুবিধেভোগী হলেও নারীত্বের, পৌরুষের যে ছাঁচ নির্মাণের প্রক্রিয়া নিরন্তর চলে, তার শিকার পুরুষও। আপাতদৃষ্টিতে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুরুষ সুবিধেজনক অবস্থায় থাকলেও পৌরুষের দাবী অনেক সময় তার ক্ষেত্রে চাপ হয়ে যায়, তার ব্যক্ত্বিত্বের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে ওঠে। আবার সে এই সুবিধেটা নাও চাইতে পারে। সুতরাং পুরুষকে বাদ দিয়ে আলোচনার কোন প্রশ্ন নেই। দ্বিতীয়ত, সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে পুরুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। কাধে কাঁধ মিলিয়ে করতে হবে লড়াই। তবে হ্যাঁ, শুধুমাত্র মেয়েদের নিয়েই এত কথা বলার থাকে যে হতে পারে যে পুরুষেরা সেভাবে আমার আলোচনায় এল না। আর শুধুমাত্র নারীকে নিয়ে আলোচনা করতে যদি কারুর অস্বস্তি হয় তাহলে দরকার কী সেই আলোচনার?

এবার আসি ভিন্ন লিঙ্গপরিচয়যুক্ত মানুষের কথায়। বিশেষত আমি transwoman দের কথা বলতে চাই। যারা শরীরের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পুরুষ অথচ নিজেদের নারী মনে করে তাদের transwoman হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একথা অনস্বীকার্য, এদের অস্তিত্ব বহু সমস্যায় আকীর্ণ। কিন্তু এদের সমস্যার ধরনগুলো সেইসব নারীদের থেকে অন্যরকম যাদের দেহমনের কোন বিরোধ নেই। এদের কোনও পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক থাকতে পারে অথবা নারীর সঙ্গে। তাদের প্রতি নারীবাদীরা সহানুভূতিশীল কিন্তু বিসমকামী সম্পর্কে থাকা cis নারীর পীড়ন-দমন শোষণের অভিজ্ঞতার সঙ্গে trans নারীর সমস্যাকে এক করে দেখা যাবে না। একটি বিশেষ আলোচনার পরিসরের মধ্যে নারীর, পুরুষের, এবং ভিন্ন লিঙ্গের সমস্ত সমস্যার বিশ্লেষণ ও সমাধানসূত্র খুঁজে বের করা সহজ নয়। সবার কথা একসঙ্গে বললে কারুর সঙ্গে সুবিচার করা যাবে না। আমি যেখানে বলতে চাই, স্পষ্ট করে দিই যে আমি আপাতত বিসমকামী সম্পর্কে থাকা cis নারীদের নিয়ে কথা বলতে চাইছি। তাদের সমস্যা নিয়ে আমি ভাবিত কারণ আমি নিজে তাদের একজন। বিশেষ করে আমায় যেটা ভাবায় সেটা হল নারী-পুরুষের প্রেম ও পারস্পরিক যৌন আকর্ষণের সঙ্গে শোষণ, দমন ও পীড়নের সহাবস্থান, ঘাত-প্রতিঘাত। এই বিষয়েই আমার গবেষণা। কোথাও বলতে গেলে এই বিষয়গুলোই আমার মাথায় ঘুরপাক খায়। আর মাথা থেকে মুখে চলে আসে কথা।

এক জীবনে সবার কথা বলা হয়ে উঠবে না। যেমন ইচ্ছে থাকলেও বলতে পারব না সেই সব মুসলিম মেয়েদের কথা যারা নাকটা পর্যন্ত ঢাকা দিয়ে আমাদের মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করতে আসে। তাদের মনের ভেতরে প্রবেশ করার আমার সাধ্য নেই। তাই আমার চেনাজানা পরিসরের মেয়েদের নিয়েই আমি কথা বলি। অন্য কেউ হয়তো তাদের কথা বলতে এগিয়ে আসবে ভরসা রাখি। 

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment