- 01 October, 2022
- 0 Comment(s)
- 346 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, জানালার বাইরে পঞ্চমীর অন্ধকার।
রাত পোহালেই দেবীর আবাহন শুরু। এই সময়টা ভালো লাগে। মানুষের উৎসব, শহরের উৎসবে শামিল হতে ভালো লাগে। ঘড়িতে অনেক রাত। লিখতে গিয়ে ক্লান্তি বোধ হচ্ছিল। তবুও শান্ত হয়ে বসতে পারিনি। শুয়ে পড়তে পারিনি। সিউ-পোর্টাল কেবল নারীত্বের পোর্টাল নয়। সেই পোর্টাল মেয়েদের কথা বলে। মানুষের কথা বলে। মানুষের প্রতিবাদের কথা বলে। ইন্টারনেটের পাতায় কেবলই দেখে চলেছি সেই প্রতিবাদের খবর। এক দেশ থেকে অন্য দেশের অভিমুখে। একের পর এক প্রতিবাদের খবর। ইরান থেকে আফগানিস্তান, ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার গ্রাম থেকে শহর, সীমান্ত থেকে সাগরের অভিমুখেও – মানুষের প্রতিবাদের খবর। মানুষ যেমনটা কাঁদছে, তেমনই মানুষ – মানুষের চেয়েও বড় হয়ে উঠে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এই সংগ্রামের ঐতিহ্যটুকুই ভরসা যুগিয়ে যায়।
গত ২৫শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানী মস্কোর বুকে, কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির মর্মর মূর্তির সামনে এক বাৎসরিক কবিতা উৎসবের মঞ্চে বক্তব্য রাখতে উঠে, প্রতিবাদী কবিতায় মুখর হয়ে উঠেছিলেন কবি ও সমাজকর্মী আর্তিওম কামারদিন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কবি নিকোলাই দাইনেকো, এগর শোতবা, বান্ধবী আনা পোপোভা প্রমুখ। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং তারই সঙ্গে বলপূর্বক রাশিয়াতে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষকে সন্ত্রস্ত করে তাদেরকে রুশ সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করানোর যে সরকারি সিদ্ধান্ত, তারই বিপক্ষে এই সব কবিরা বক্তব্য রেখেছিলেন। কবিতা পাঠে শামিল হয়েছিলেন। ৪৮ঘণ্টা না কাটতেই মস্কোর পুলিশ প্রথমে কামারদিন ও পরে বাকি সকলকেও গ্রেপ্তার করে। পুলিশি হেফাজতে কামারদিনের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালানো হয়। কোনও দিন, কোনও একজন কবিরও প্রতিবাদ আদতে এইভাবে কখনও, কোনও ভাবেই বন্ধ করা যায়নি। মানুষের যে সোচ্চার বক্তব্য, সেই চিন্তার উপরে সেন্সর বসানোটা সম্পূর্ণভাবেই নীতি-বহির্ভূত কাজ বলে মনে করি।
মস্কোতে প্রতিবাদ চলছে। ইরান জুড়ে চলছে বিক্ষোভ। রুশ মেয়েরা পথে নেমে এসে পুতিন-বিরোধী বিক্ষোভে শামিল হচ্ছেন। যুদ্ধ-বিরোধী মিছিলে অংশ নিচ্ছেন। ইরানের প্রতিটি প্রদেশে এখন উত্তাল বিক্ষোভের সময়। ইরানীয় মেয়েরা আধুনিক পোশাক পরে, ইউটিউব অথবা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলিতে ‘বেলা সিয়াও’য়ের বিখ্যাত যে গান, তারই ফারসি অনুবাদ আপলোড করে সারা পৃথিবীতে গানটিকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। বিক্ষোভ-প্রদর্শনীতে আজ ইরান এক নতুন মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা। এইসময়ই আলোচনায় এসে পড়ছে আরও একটি নাম। সেই নাম কাবুল, সেই নাম আফগানিস্তান।
ভাবতে অবাক লাগে, তালিবান শাসিত কাবুলেও আজ ইরানের প্রতি সহমর্মিতার বার্তা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানী কাবুলে ইরানীয় দূতাবাসের সামনে বেশ কিছু সংখ্যক আফগান মহিলা মুখে শ্লোগান ও হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ‘জান, জিন্দগি, আজাদি’র পাশাপাশি তালিবান শাসকদের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধেও শ্লোগান তোলেন বিক্ষোভকারীরা। তালিবান যোদ্ধারা লাঠি চালিয়ে, শূন্যে গুলি ছুঁড়ে বিক্ষোভকারীদের হঠিয়ে দেয়। হিজাব-নিকাব-অবরোধ, তালিবান-শাসিত আফগানিস্তানে মেয়েদের লড়াইটা আরও, আরও অনেক গভীরে। সেখানে আরও অনেকখানি অন্ধকার। তবুও মেয়েরা সেখানেও মুখ বুজে থাকেনি। ১৫ই আগস্ট ২০২১, তালিবানদের হাতে আফগানিস্তানের পতনের পর, আজ অবধি সেখানকার ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে মাত্র ২টিতে মেয়েদের হাইস্কুলে পড়তে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে। সেখানকার এক মহিলা সমাজকর্মী বলেছেন, আফগানিস্তানের মেয়েদের লড়াই, ইরানীয় মেয়েদের লড়াই থেকে অনেকটা পিছিয়ে। চরিত্রগত ভাবেও অনেকটা অন্যরকম।
তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, ইরানে যেমনটা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সরকার-বিরোধী বিক্ষোভে শামিল হচ্ছেন, মেয়েরা লড়াই করছেন তাদের পোশাক-স্বাধীনতার প্রয়োজনে – অথচ আজ কাবুল অথবা আফগানিস্তান, একেকটি জায়গাতে দাঁড়িয়ে মেয়েদের পোশাকবিধির বিরুদ্ধে যে লড়াই, এখনও সেই সবকিছুকেই সেখানে অনেক, অনেকখানি ভবিষ্যতের পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে। সেই সমাজকর্মীর বক্তব্য অনুসারে আফগান মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আফগান পুরুষেরাই। তালিবানকে যত না ভয় বা গুরুত্ব দেওয়া হয়, এই প্রসঙ্গে নিজের বাড়ি, নিজের সমাজ, অথবা নিজের পরিবারের অন্য যে কোনও পুরুষ কি বলবে, অথবা কিই বা বলতে পারে, এই চিন্তাতেই আফগান মেয়েদের দিন কাটে। পুরুষতন্ত্র সেখানে প্রকট ও প্রকাশিত। তালিবানদের আগেই আফগান মেয়েদের একটা বড় অংশকেই হার মেনে বসতে হয় নিজের পরিবারের কাছে। সেই সমাজকর্মীদের কথায়, মেয়েদের অধিকারের আন্দোলন – কেবলই তো মেয়েদের নয়, পুরুষেরও তাতে সমান ভাবে দায়িত্ব রয়েছে। নারীর এই একেকটি আন্দোলনকেও যদি শ্রদ্ধা করতে আমাদের কারও অসুবিধে হয়, সেক্ষেত্রে ভবিষ্যদবাণীও করে যেতে পারি, নারী আন্দোলনের পরিসরে যেদিন বেশ কিছু সংখ্যাতে নিয়মিত ভাবে পুরুষ সহযোদ্ধাদেরও আমরা দেখতে পাব, আমরা সেদিনই জানব, মেয়েদের আন্দোলন অবশেষে পূর্ণতা পেয়েছে। তালিবান-শাসিত আফগানিস্তানে এই মুহূর্তে যা অসম্ভব।
এতদসত্ত্বেও আফগানিস্তান ইরানের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে কালো পোশাক পরিহিত এক আফগান মহিলার ভিডিও। যেখানে তিনি কি না, হিজাব মাথায় রেখেও, স্থানীয় কোনও একটি গানের সঙ্গে নাচের একটি সুন্দর উপস্থাপনা সৃষ্টি করেছিলেন। নিজের বাড়ির ছাদে এই ভিডিওটিকে বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলিতে আলোচ্য মহিলা নির্বিচারে তা ভাগ করে নিতে থাকেন। এখনও অবধি তিনি তালিবান যোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েননি বলেই খবর। আফগানিস্তানের মাটিতেও চাকা গড়ানো শুরু হয়ে গেছে। গত একমাসের মধ্যে পাকটিয়া প্রদেশে মেয়েদের জন্য আবারও নতুন করে ৫টি বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল চালু করা হয়েছে। কান্দাহার প্রদেশে মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক স্তর অবধি শিক্ষার প্রয়োজনে স্কুল চালু করা হয়েছে। খুব শিগগিরিই কাবুলের উত্তরে পারওয়ান প্রদেশেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। তারই মধ্যে ফুলকি হয়ে জ্বলে উঠেছে ইরানের আন্দোলন।
‘জান, জিন্দগি’ – আফগানিস্তান। ইরানে যেমনটা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে, আফগানিস্তানে এখন সময় নীরব প্রস্তুতির। পুরুষ প্রতিভূদের চোখে আঙুল দিয়ে তাঁদের ঔদ্ধত্যকে পরিহার করা। আফগানিস্তান আমাদের কাছে বামিয়ান বুদ্ধের দেশ, তালিবানের নয়। তবুও কুর্নিশ জানাতে হয় সেখানকার মেয়েদেরও বাইরেকার-ভিতরকার এই ক্রমাগত লড়াইকে। ইরানের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, আজ কাবু্লেরও ইরানীয় দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ, মহিলাদের পথে নেমে আসা, এই সবকিছুই কোথাও গিয়ে যেন একটা আত্মবিশ্বাস জাগায়। মনে হয়ে যেন, আজ হোক অথবা কাল – মেয়েদের লড়াইকে স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া আর পৃথিবীরও কোনও উপায় থাকবে না। আফগানিস্তানে আবারও পাগমান পাহাড়ের মাথায় বরফ পড়বে।
ইরানে বসন্ত যখন এসেছে, আফগানিস্তানই বা কতদিন তাহলে পিছিয়ে থাকবে আর!
0 Comments
Post Comment