সেইসব ফুলেদের দল : সাবিত্রীবাই ও তার সাথিদের জীবনের কিছু কথা

  • 03 January, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 707 view(s)
  • লিখেছেন : মলয় তেওয়ারী
১৮৩১ সালের ৩ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রে সাবিত্রীর জন্ম। সাবিত্রীকে জোতিরাওয়ের পাত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন জোতিবার পিসিমা সাগুনাবাই। ১৮৪৮ সালে মহারাষ্ট্রের ভিদেওয়াড়ায় তাঁদের প্রচেষ্টায় প্রথম মেয়েদের স্কুল হয়। সাবিত্রী এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। যে ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ্যবাদী বিধানে শুদ্র ও নারীর জ্ঞানার্জন নিষিদ্ধ ছিল, সেখানে শুদ্র নারী-পুরুষ দ্বারা শুদ্রাতিশুদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার স্কুল প্রতিষ্ঠা ছিল এক যুগান্তের সূচনা।

ক্রান্তিজ্যোতি

১৮৯০-এর ২৮ নভেম্বর সাবিত্রীবাই ফুলে তাঁর বিগত পঞ্চাশ বছরের বন্ধু ও সহকর্মী, স্বামী ও শিক্ষক মহাত্মা জোতিরাও ফুলের শেষযাত্রা ও শেষকৃত্যের লোকাচার নিজের হাতে সম্পন্ন করেন—নিজেই এগিয়ে এসে জলভরা ঘট হাতে শেষযাত্রায় সামনে থাকেন ও চিতায় আগুন দেওয়ার কাজ নিজ হাতেই করেন। ২০০৮ সালে ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন রিসার্চ অ্যাণ্ড ট্রেইনিং’ কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তকে এই ঘটনাকে “ভারতের বিগত হাজার বছরের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম কোনও নারীর হস্তে শেষকৃত্যের লোকাচার সম্পন্ন হল” বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী বিধানে শেষকৃত্যের অধিকার কেবলমাত্র পুরুষ উত্তরাধিকারীর ওপরই অর্পিত। সাবিত্রীবাই এই পিতৃতান্ত্রিক বিধান অমান্য করেছিলেন।

ন’বছর বয়সের বালিকা সাবিত্রীর বিয়ে হয়েছিল তের বছরের কিশোর জোতিরাওয়ের সাথে ১৮৪০-এ। এই দুই বালক বালিকা পরবর্তী পাঁচ দশকে হয়ে ওঠেন মারাঠি নবজাগরণের অগ্রদূত, প্রান্তিক অচ্ছুৎ নিপীড়িত জগতের অন্ধকারে উৎসারিত আলোকশিখা। জোতিরাওয়ের মৃত্যুর পর সাবিত্রীবাই ‘সত্যসোধক আন্দোলন’ এগিয়ে নিয়ে যান; ১৮৯৩-এ সাবিত্রীবাই ফুলের সভানেতৃত্বে সাসওয়াড়ে ‘সত্যসোধক সম্মেলন’ সংগঠিত হয়। সম্মেলনের সর্বোচ্চ পদে একজন মহিলার অধিষ্ঠানও ছিল এক বৈপ্লবিক ঘটনা।  ১৮৯৬’র প্রবল খড়া ও দুর্ভিক্ষের দিনগুলিতে সংগঠনের সকলকে নিয়ে উদয়াস্ত ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন সাবিত্রী। খড়ার দিনগুলি শেষ হতে না হতেই শুরু হয় মহামারি। পুণে ও তার আসপাশে প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছিল প্লেগে। সাবিত্রী তাঁদের ছেলে, আর্মি ডাক্তার যশবন্তকে চাকরি থেকে ডেকে পাঠালেন, গড়ে তুললেন শুশ্রূষাকেন্দ্র ও হাসপাতাল। নিজে নিলেন সর্বত্র ঘুরে ঘুরে আর্ত রোগিদের হাসপাতালে নিয়ে আসার কাজ। ছোঁয়াচে রোগের বিপদ উপেক্ষা করে মুমূর্ষু রোগিকে নিজ হাতে তুলে নিয়ে আসতেন চিকিৎসার জন্য। মুণ্ডোয়া গ্রামের উপকণ্ঠে মাহার সম্প্রদায়ের পাণ্ডুরাং বাবাজি গায়কোয়াড়ের শিশুসন্তানের প্লেগের খবর শুনে ছুটে গেলেন। মরণাপন্ন শিশুটিকে নিজের পিঠে বয়ে নিয়ে এলেন হাসপাতালে। এরপরই সংক্রমিত হন তিনি, এবং ১৮৯৭-এর ১০ মার্চ সন্ধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন নারীবাদী সমাজবিপ্লবী সাবিত্রীবাই ফুলে।

সাবিত্রী সাগুনা ফতিমা

১৮৩১ সালের ৩ জানুয়ারি সাতারা জেলার নইগাঁওয়ের এক মালি পরিবারে সাবিত্রীর জন্ম। জোতিরাওদের পূর্বপুরুষেরাও ফুলচাষী, একসময় সাতারা জেলা থেকে পুণা শহরে এসে ফুলমালার ব্যবসায় যুক্ত হয়ে পদবি নেয় ‘ফুলে’। সাবিত্রীকে জোতিরাওয়ের পাত্রি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন জোতিবার পিসিমা সাগুনাবাই, জোতির বাবা গোবিন্দরাওয়ের তুতো বোন। সাগুনা খিরসাগরের জন্ম সাতারা জেলায় নইগাঁওয়ের কাছে ঢাঙ্কাওয়াড়া গ্রামে। বাল্য বিধবা সাগুনা জীবিকার সন্ধানে পুণা শহরে এসে খ্রীষ্টান প্রচারক জন সাহেবের বাড়িতে গৃহকর্মে নিযুক্ত হন। সেখানে জন সাহেবের নিজের ছেলেমেয়েরা ছাড়াও আরও কয়েকজন অনাথ সন্তান আশ্রিত ছিল। সাগুনার কাজ এইসব ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করা। পরম স্নেহ ও আদরে সেই কাজ করতেন তিনি। দুর্বল ও পীড়িতের প্রতি অসীম অনুকম্পা ও সহমর্মিতায় অন্তর পূর্ণ ছিল তাঁর। আর ছিল শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ, বাচ্চাদের সাথে সাথে তিনিও শিখছিলেন নিজের মত করে। জোতিরাওয়ের যখন মাত্র এক বছর বয়স তখন তার মা চিম্নাবাইয়ের মৃত্যু হয়। জোতির বাবা গোবিন্দরাও ছোট্ট জোতিকে নিয়ে বিশেষ চিন্তিত ছিলেন, তিনি আর বিবাহ করেন নি। ছোট্ট জোতিকে তিনি রেখে এলেন বোন সাগুনার কাছে। জন সাহেবের বাড়িতে অন্যান্য অনাথ ছলেমেয়েদের সাথে তার আউ-মা সাগুনার কাছে বড় হতে থাকলেন জোতি। ছোট্ট জোতির ব্যতিক্রমী মেধা ও সংবেদনশীল মন নজরে আসে সাগুনার। জোতির শিশু মনকে তিনি আর্তের প্রতি সহমর্মিতা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসায় ভরে দেন। জোতিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন তাঁর— শুধু পরিবারের নয়, সমাজের মুখ উজ্জ্বল করবে জোতি। তিনি জোতিকে লেখাপড়া শিখতে ক্রমাগত অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। সাবিত্রী-জোতিরাওদের জন্মের এক দশক আগে ১৮১৮ সালে ভীমা কোরেগাঁওয়ের যুদ্ধে পেশোয়া শাসনের অবসান ঘটেছে, কিন্তু সমাজটা ব্রাহ্মণ্যবাদী অনাচারে শাসিত। অব্রাহ্মণ ‘নীচু জাত’-এর শিক্ষাদীক্ষা নিষিদ্ধ। গোবিন্দরাওয়ের আর্থিক স্বচ্ছলতা যতই থাক না কেন ছেলেকে লেখাপড়া শেখানোর ‘দুঃসাহস’ তার ছিল না। তিনি চান ছেলে ফুলচাষ ও ব্যবসার কাজ করবে। ব্যতিক্রম ঘটালেন সাগুনাবাই। অনেক জেদাজেদি করে তিনি তাঁর দাদাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন। জন সাহেবের সাহায্যে সাগুনাবাই জোতিকে মিশনারি স্কুলে ভর্তি করলেন। কিন্তু এক ব্রাহ্মণ কেরানি গোবিন্দরাওকে বোঝালেন যে শুদ্র হয়ে লেখাপড়া শিখলে ব্রাহ্মণের অভিশাপ লাগবে এবং তাছাড়া স্কুলে গেলে ব্যবসার কাজও তো শিখতে পারবে না জোতি। যুগযুগান্তরের সংস্কারে এই কুমন্ত্রণাই মনে ধরল গোবিন্দরাওয়ের, ছেলেকে স্কুল ছাড়িয়ে চাষের কাজে লাগিয়ে দিলেন। এই বিপর্যয়ে ধাক্কা খেলেন সাগুনাবাই, কিন্তু দমে যান নি। পুণা শহরের প্রভাবশালী পারসি পণ্ডিত গফফর বেগ ও এক ব্রিটিশ কর্মচারি লিজিট সাহেবকে গিয়ে ধরেন তিনি, এবং তাঁরা গোবিন্দরাওকে রাজি করান আবার ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে। স্কটিশ মিশন হাই স্কুলে ভর্তি হয় জোতিরাও। গোবিন্দরাও ছেলের বিবাহের উদ্যোগ নিলে সাগুনাবাই সাবিত্রীকে যোগ্য পাত্রী হিসেবে বেছে নেন। সাবিত্রীর বয়স তখন নয়-দশ, জোতিরাওয়ের বয়স তেরো-চৌদ্দ।

নইগাঁওয়ে মালি পরিবারের সাবিত্রীর তো স্কুলে ভর্তি হওয়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না, যদিও শৈশব থেকেই তার অনুসন্ধিৎসু চরিত্র সকলের নজরে পড়েছিল। বিবাহের পর পুণা এলেন। কিশোর জোতিরাও ততদিনে অনেক এগিয়ে গেছেন পড়াশোনায়। সাবিত্রী ও সাগুনা জোতিরাওয়ের কাছে লেখাপড়া শিখতে শুরু করলেন। পরবর্তীতে জোতিবার দুই বন্ধু, সখারাম যশবন্ত পরাঞ্জাপে ও কেশব শিবরাম ভাবালকর, বাড়িতে এসে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। কয়েকবছর পরম নিষ্ঠায় গৃহশিক্ষার পর সাবিত্রী ভর্তি হলেন মেসার্স মিচেলের নর্মাল স্কুলে। সাগুনাবাই শুরু করলেন ‘অচ্ছুৎ’ বসতি মাহারওয়াড়ার মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে, ১৮৪৬ সালে।  প্রকৃত প্রস্তাবে মহারাষ্ট্রের গণ শিক্ষা আন্দোলন সাগুনাবাইয়ের প্রত্যক্ষ কার্যকলাপের মধ্যে দিয়েই শুরু হয়েছিল। মাহারওয়াড়ার ‘অতিশুদ্র’-দের মাঝে সাগুনাবাইয়ের স্কুল ব্যাপক ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। অপপ্রচার শুরু হয় যে মাহারদের খ্রীষ্টান বানানোর উদ্দেশ্যেই সাগুনাবাই এসব করছেন। মাহার সম্প্রদায়ের মোড়লদের মগজধোলাই করে উচ্চবর্ণের লোকেরা। দুয়েক মাসের মধ্যেই জোর করে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুণার ব্রাহ্মণ্যবাদীদের এই কুটিল ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে প্রকাশ্যে এগিয়ে আসেন তরুণ জোতিরাও। ১৮৪৬-এর ২৫ ডিসেম্বর শহরের বুকে একটি বিশাল বিক্ষোভ সভা সংগঠিত করেন ১৯ বছর বয়সের এই তরুণ, যেখানে তিনি জ্বালাময়ি ভাষণে- সাধারণ মানুষকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখার ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচিত করেন। এই ছিল মহাত্মা জোতিরাওয়ের গণ আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ, ব্রাহ্মণ্যবাদী জোটের বিরুদ্ধে খোলা তরোয়াল হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া।

নর্মাল স্কুলে পড়াশোনার পর সাবিত্রী আহমেদনগরে মিস ফারারের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার ট্রেনিং নিতে যান এবং সাগুনা আউমার উদ্যোগে অনুপ্রাণিত সাবিত্রী ও জোতি মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর লক্ষ্যে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে নেমে পড়েন। ১৮৪৮ সালে ভিদেওয়াড়ায় এক সম্পন্ন উকিলের বাড়ির চত্ত্বরে তাঁদের প্রচেষ্টায় প্রথম স্কুলটি শুরু হল, মেয়েদের স্কুল। ১৮৪৮-এ প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলকেই কোনও ভারতীয়র দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম আধুনিক স্কুল হিসেবে গণ্য করা হয়। সাবিত্রী এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। যে ভারতবর্ষে হাজার বছর ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদী বিধানে শুদ্র ও নারীর জ্ঞানার্জন নিষিদ্ধ ছিল, সেখানে শুদ্র নারী-পুরুষ দ্বারা শুদ্রাতিশুদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার স্কুল প্রতিষ্ঠা ছিল এক যুগান্তের সূচনা, এক সুদূরপ্রসারী শ্রেণীসংগ্রামের নয়া ঘোষণা। ১৮৪৮ সাল সারা পৃথিবীর শোষিত নিপীড়িত জনতার মুক্তিসংগ্রামেই বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয় কারণ সেই বছরই কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’, যে ঘোষণার কেন্দ্রে থাকে দুনিয়ার সমস্ত শ্রমজীবি মানুষের ঐক্যবদ্ধ হয়ে শোষণের সব শেকল ছিঁড়ে ফেলার শ্লোগান।

সাগুনা-সাবিত্রী-জোতির কার্যকলাপে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজকর্তারা মরিয়া হয়ে উঠছিল। জোতির বাবা গোবিন্দরাওয়ের পক্ষে সমাজের চাপ নেওয়া আর সম্ভব হচ্ছিল না। পুত্র ও পুত্রবধুকে নির্দেশ দিলেন— হয় এসব বন্ধ করতে হবে, নয় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে। এই সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন পুণার সম্পন্ন প্রতিষ্ঠিত মুসলমান পরিবারের দুই ভাইবোন, ফুলেদের দুই বন্ধু, উসমান শেখ ও ফতিমা শেখ। সাবিত্রী ও জোতিবা গিয়ে উঠলেন তাঁদের বাড়িতে। পুণের মুসলমান সমাজের তৎকালীন পিতৃতান্ত্রিক লছমনরেখা অমান্য করে দাদা উসমান শেখের অনুপ্রেরণায় ফতিমা লেখাপড়া শিখেছেন, মেসার্স মিচেলের নর্মাল স্কুলে পড়েছেন, আহমেদাবাদে মিস ফারারের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার ট্রেনিং নিয়েছেন — সাবিত্রী ও ফতিমা হয়ে উঠলেন ‘কমরেডস ইন আর্মস’। উসমান শেখ উন্মুক্ত করে দিলেন বাড়ির সংগ্রহের সমস্ত বইপত্র। ভিদেওয়াড়ার প্রথম স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেছিল ফাণ্ডের অভাবে, ফতিমাদের বাড়িতেই শুরু হল স্কুল, নাম, ‘ইণ্ডিজেনাস লাইব্রেরি’। ১৮৫১ সালে ১৫০ জনের ওপর ছাত্রী নিয়ে তিনটি স্কুল চালাচ্ছেন তাঁরা। ১৮৫২’র ১৬ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হল ফুলে দম্পতিকে, সাবিত্রীকে দেওয়া হল সেরা শিক্ষকের সম্মান। ‘দ্যা পুণা অবজার্ভার’ পত্রিকায় ১৮৫২ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ি জোতিরাওয়ের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত পুণের স্কুলগুলিতে ‘ছাত্রী’-সংখ্যা সরকারি স্কুলগুলির ‘ছাত্র’-সংখ্যার দশগুণ বেশী।

দলিত পরিবারের এক বাল্য বিধবা সাগুনাবাই মারাঠি নবজাগরণের বিপুল কর্মকাণ্ডের সলতে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। সাগুনা বিশেষ গর্বিত ছিলেন জোতি-সাবিত্রীকে নিয়ে। প্রতিকুলতার মুখে দাঁড়িয়ে তাঁরা আলোচনা করতেন ‘স্ত্রী-শুদ্র-অতিশুদ্র’-দের ওপর দমন-পীড়নের ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে। খুঁজতেন সেই ষড়যন্ত্রের শেকলকে সমাজের গভীর থেকে ছিন্নভভিন্ন করে দিয়ে মুক্তিলাভের পথ।  জোতিবা কোনও নতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হলে সাগুনা সোৎসাহে তার সমর্থনে দাঁড়াতেন, প্রার্থনা করতেন। সব মানুষ তথা সমস্ত সৃস্টির একই স্রস্টা, একই ঈশ্বর—এই ছিল তাঁর ধর্মবিশ্বাস। ১৮৫৪ সালের ৬ জুলাই সাগুনা খিরসাগরের জীবনাবসান হয়। তাঁর মরমী মনের সৌন্দর্য ও সাম্যবাদ জোতিবা ও সাবিত্রীবাইয়ের সারাজীবনের কর্মকাণ্ডে আলোকবর্তিকার মত প্রোজ্জ্বল ছিল। সাবিত্রী তাঁর ‘বাওয়ান কষি সুবোধ রত্নাকর’ কাব্যগ্রন্থে তাঁদের প্রিয় আউমাকে “আমাদের শিক্ষাদেবী” বলে অভিহিত করে লিখছেন, “এমন পরিশ্রমী আমাদের আউ, এমন তাঁর ভালোবাসা ও করুনা, যে অতল সাগরকেও অগভীর মনে হয়, আকাশের উচ্চতাকেও খাটো মনে হয়”। জোতিবা তাঁর ‘নির্মিচক সোধ’ (স্রস্টার সন্ধান) গ্রন্থটি সাগুনাবাইকে উৎসর্গ করে লিখছেন, “সত্যের সাক্ষাৎ প্রতিমা, সাগুনাবাই, তুমি আমাকে মানবিক ও বিনয়ি হতে শিখিয়েছ। তুমিই আমাকে শিখিয়েছ অন্যের সন্তানকে ভালোবাসতে। গভীর উপলব্ধিতে এগুলো শিখেছি তোমার কাছে”।

১৮৫৫ সালে শ্রমিক ও কৃষকদের লেখাপড়ার জন্য নৈশ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ফুলেরা। মহারাষ্ট্রে সাবিত্রী-ফতিমাদের শিক্ষা আন্দোলনের এই সময়টাতে বাংলায় শুদ্রদের শিক্ষার অধিকার কেমন দশায় ছিল তা শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়। অত্যাচারি জমিদার ও নায়েবের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের আন্দোলন। ১৮৪৭ সালে তাঁর পুত্র শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের জন্ম হয়। শৈশব উত্তীর্ণ হওয়ার পর গুরুচাঁদকে তাঁর পিতা স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। উচ্চবর্ণের সমাজকর্তাদের পরিচালিত স্কুলে তাঁকে ভর্তি নেওয়া হয় নি। শেষ পর্যন্ত হরিচাঁদ তাঁর পুত্রকে ভর্তি করেন মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে চলা মক্তবে। এই স্কুল থেকেই আরবি ফারসি ভাষায় লাখাপড়া শেখেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। এই ঘটনা গুরুচাঁদকে বিশেষ প্রভাবিত করে। ১৮৮০ সালে শুদ্রদের জন্য প্রথম স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে শিক্ষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রয়োজনে ভিক্ষে করেও ছেলেমেয়েকে লাখাপড়া শেখাতে হবে—এই বার্তা ছড়িয়ে দেন তিনি এবং তা গ্রহণ করে আত্মসম্মানবোধে উঠে দাঁড়ায় নমশুদ্র সমাজ।

ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষোনা করায় শারিরীক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে ফুলেদের। জোতিবাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। এরকম একজন হামলাকারী, ঢণ্ডু নামদেব, পরবর্তীতে জোতিবার কাছেই শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং জোতিবার নির্দেশে কাশি গিয়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মগ্রন্থ পড়াশোনা করে ব্রাহ্মণ্যবাদের তীক্ষ্ণ সমালোচক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সাবিত্রীবাই ও ফতিমা শেখ যখন স্কুলে যেতেন তখন রাস্তায় তাদের দিকে টোনটিটকিরি সহ কাদানোংরা বা গোবর ছোড়া হত। সাবিত্রীরা এসব সহজেই উপেক্ষা করে যেতেন, কেবল ব্যাগে আরেক সেট কাপড় রাখতে হত। এক যুবক প্রায়শই সাবিত্রীকে উত্যক্ত করত, শেষে একদিন সরাসরি রাস্তা আটকে টোনটিটকিরি শুরু করে; সাবিত্রী যুবকটির গালে সপাটে থাপ্পড় মারায় সে এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল যে আর কোনও কথা না বলে সরে পড়ে এবং আর কখনও সাবিত্রীকে উত্ত্যক্ত করেনি।

ফতিমাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের সাথে সাথে নিজের মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকেও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তাতে মোটেই দমে যাননি তিনি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী জোগাড় করতেন, অসীম ধৈর্য নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পরিবারের মানুষদের বোঝাতেন মেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখানোর প্রয়োজনীয়তা। শিক্ষকতার একটা বড় অংশ দেখতেন ফতিমা। সাবিত্রী অত্যন্ত স্নেহভরে ফতিমার কথা বলতেন। ১৮৫৬’র অক্টোবরে সাবিত্রীবাই সাতারায় গ্রামের বাড়ি গিয়ে অসুস্থ হয়ে আটকে পড়েন এবং তখন জোতিবাকে লেখা চিঠিতে বলছেন, “আমি জানি আমার আনুপস্থিতিতে ফতিমার খুব আসুবিধা হবে, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে ও বুঝবে এবং কোনও অভিযোগ করবে না”। ফতিমার জীবন নিয়ে এখনও তেমন অনুসন্ধানমূলক কাজ হয় নি। কিন্তু, উনবিংশ শতকে মুসলমান সমাজ থেকে আসা প্রথম শিক্ষিকা হিসেবে ফতিমা শেখের নাম এখন গর্বের সাথে উল্লিখিত হয়। ২০১৪ সালে মহারাষ্ট্রের উর্দু টেক্সটবুকে তাঁর অতি সংক্ষিপ্ত জীবনী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নারীমুক্তি আন্দোলনের ময়দানে নিপীড়িতের ঐক্যের উজ্জ্বল প্রতীক সাগুনা সাবিত্রী ও ফতিমা।

মহিলা সেবা মণ্ডল

কেবল স্কুলের শিক্ষাদানের মধ্যেই সীমিত না থেকে ১৮৫২ সালে ‘মহিলা সেবা মণ্ডল’ গঠন করেন ফুলেরা। মেয়েদের মাথা উঁচু করে বাঁচার ক্ষেত্রে যত রকম বাধা বা বিধি সমাজে আছে তার তীব্র বিরোধিতা করা এই সংগঠনের মূল কাজ। ভারতে এটিই প্রথম নারীবাদী সংগঠন, সাবিত্রীবাই তার নেত্রী। ‘মহিলা সেবা মণ্ডল’ জাতবর্ণ নির্বিশেষে সব মেয়েদের সমস্যাকে নিয়েই কাজ শুরু করে। মেয়েদের অধিকার সচেতন করে তুলতে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে, বিধবা বিবাহের পক্ষে ও বিধবাদের দুর্দশার বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চলে। বিধবাবিবাহে উৎসাহ দিতে থাকেন। ভ্রুণহত্যার বিরুদ্ধে প্রচার চালান। অন্তঃসত্বা বিধবারা যাতে সমাজের চাপে আত্মহত্যা করতে বা ভ্রূণহত্যা করতে বাধ্য না হন তার জন্য ‘বাল হত্যা প্রতিবন্ধক গৃহ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সাবিত্রীর নিজের বাড়িটাও হয়ে ওঠে তথাকথিত ‘অবৈধ’ অনাথ সন্তান এবং সন্তানসম্ভবা বিধবাদের আশ্রয়। ১৮৬৮ সালের ২৯ আগষ্ট সাবিত্রী নইগাঁওয়ের বাড়িতে থাকাকালীন জোতিবাকে ‘সত্যের প্রতিমূর্তি মাই লর্ড’ বলে সম্বোধন করে স্যালুট জানিয়ে লেখা চিঠি থেকে অনেক কিছু বোঝা যায়। চিঠির বয়ান বাংলায় এরকম,

“তোমার চিঠি পেয়েছি। আমরা ভালো আছি। পরের মাসের পাঁচ তারিখে ফিরব, সে বিষয়ে চিন্তা করিও না। ইতিমধ্যে এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। গল্পটা এরকম। গণেশ নামের একটি ব্রাহ্মণ ছেলে গাঁয়ে পূজোয়াত্তি ও ভাগ্যগণনা করে বেড়ায়। ওটাই তার রুটিরুজি। গণেশ ও মাহার(অচ্ছুৎ) সম্প্রদায়ের এক কিশোরী, নাম শারজা, প্রেমে পড়েছে। ব্যাপারটা যখন জানাজানি হয় তখন মেয়েটি ছ’মাসের গর্ভবতী। ক্রুদ্ধ গ্রামবাসীরা তাদের গ্রামের মধ্যে প্যারেড করায়, মেরে ফেলার হুমকি দেয়।

আমি এই খুনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরে ছুটে যাই। প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলকে হত্যা করলে ব্রিটিশ আইন অনুযায়ি কী শাস্তি হতে পারে তা স্মরণ করিয়ে আমি তাদের বিরত করি। আমার কথা শোনার পর ওরা মন বদলায়।

সাড়ুভাউ ক্রুদ্ধ হয়ে বলে যে ব্রাহ্মণ ছেলেটি ও অচ্ছুৎ মেয়েটিকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। দুজন ভিক্টিমই তাতে রাজি। আমার হস্তক্ষেপে এই যুগল প্রাণে রক্ষা পেল। ওরা আমার পায়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করে। কোনভাবে সান্ত্বনা দিয়ে ওদের থামিয়েছি। এখন ওদের দুজনকে তোমার কাছে পাঠালাম। আর কী বা লেখার আছে?

তোমার সাবিত্রী”।

অনেক ব্রাহ্মণ বিধবা সাবিত্রীর আশ্রয়ে আসেন। এরকমই একজনের সন্তান যশবন্তকে অফিসিয়ালি দত্তক নেন ফুলে দম্পতি।

ফুলেদের বন্ধু এবং স্কুলের সহশিক্ষক মোরো ভিত্তো ওয়ালভেকারের সাথে প্রায়শই নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে চর্চা হত ফুলেদের। সাবিত্রীর পরামর্শে ওয়ালভেকার ‘গৃহিণী’ পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন যেখানে কেবলমাত্র নারীমুক্তির প্রশ্নেই লেখা ছাপা হবে। নারীশিক্ষা ও সমাজে নারীর সমানাধিকারের প্রশ্ন তুলে ধরে প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। সাবিত্রী অধীর আগ্রহে এই পত্রিকার অপেক্ষায় থাকতেন, নিজে সেখানে লিখতেন, কিন্তু ছদ্মনামে বা অন্য কারও নামে, নিজের নাম প্রকাশ করতে চাইতেন না সাবিত্রী। ছাত্রীদের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন, প্রায়শই তাদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক বইপত্র উপহার দিতেন। সমস্ত লাঞ্ছনা অপমান অত্যাচার সহ্য করেও ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রকে তিনি যেভাবে একের পর এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন তা মহারাষ্ট্রের সমাজকে আলোড়িত করে এবং লিঙ্গসাম্যের লড়াইকে অনুপ্রাণিত ক’রে একঝাঁক নেত্রীর জন্ম দেয় যাদের মধ্যে আছেন ডক্টর আনন্দিবাই জোশি, পণ্ডিতা রমাবাই, তারাবাই শিন্ডে, রমাবাই রাণাডে প্রমুখ।

সত্যসন্ধানী

১৮৭৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ফুলেরা স্থাপন করেন সত্যসোধক সমাজ। এই সংগঠনটি ভারতে তৃণমূল স্তরে প্রথম জাতব্যবস্থা-বিরোধী গণসংগঠন। সংগঠনের দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন সাবিত্রী। তাছাড়া সংগঠনের মহিলা ইউনিট চলত তাঁর নেতৃত্বে। সামজিক-ধার্মিক আলোড়ন তৈরী করে শুদ্র-অতিশুদ্র জনতাকে ব্রাহ্মণ্যবাদের শেকল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে আঘাত হানতে থাকে সত্যসোধকেরা। সত্যসোধক সমাজের আন্দোলনের একটি দিক ছিল সত্যসোধক বিবাহ। ব্রাহ্মণ পুরোহিত তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক লোকাচার এবং পণ দেওয়ানেওয়া বর্জন করে পাত্র-পাত্রীর পারস্পরিক সম্মতি ও মঙ্গলকামনা উচ্চারণের মাধ্যমে সম্পন্ন হত বিবাহ। ১৮৭৩-এর ২৫ ডিসেম্বর সত্যসোধকদের ব্যবস্থাপনায় এরকম প্রথম একটি বিবাহ অনুষ্ঠান নির্বিবাদে সম্পন্ন হয়ে যায়। মাসখানেক পর এরকম দ্বিতীয় বিবাহটির ক্ষেত্রে পুণার কট্টর ব্রাহ্মণেরা আগে থেকেই তৈরী ছিল। বিবাহ অনুষ্ঠানে সংগঠিত আক্রমণ ঘটার উপক্রম হয়, পাত্র ভয়ে পিছু হটতে শুরু করে। কিন্তু সাবিত্রীবাই তাঁর এক প্রভাবশালী উকিল বন্ধুর মাধ্যমে পুলিশ প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করেন। ব্রাহ্মণেরাই পিছু হটতে বাধ্য হয়, বিবাহ শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। তখনকার সময়ে পুণা শহরে এই বিবাহ ছিল পুরোহিততন্ত্রের ওপর প্রবল আঘাত। ব্রাহ্মণের পৌরহিত্য বর্জন করে আইনি সহায়তায় আধুনিক বিবাহের এটিই বোধ হয় প্রথম নিদর্শন। প্রায় একই সময়ে দেশের অপর প্রান্তে পূর্ব বাংলায় শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া ভাবান্দোলনেও ব্রাহ্মণ পুরোহিত তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী পূজো-আচ্চার রীতিনীতি বর্জনের আন্দোলন চলেছিল। পরবর্তীতে দক্ষিণ ভারতে পেরিয়ার রামাস্বামীর আন্দোলনেও একই ধরণের বিবাহ প্রথা চালু করা হয়।

সত্যসোধকদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের ঊর্ধতন পদে থাকা ব্রাহ্মণদের দ্বারা চাকুরিচ্যুত হয়েছেন। সত্যসোধক সমাজের সেক্রেটরিকে ভিনরাজ্যে বদলির শাস্তি দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী অহং চরিতার্থ করেছে ঊর্ধতন ব্রাহ্মণ অফিসাররা। কিন্তু আন্দোলন থামে নি। সাবিত্রী নিজের সন্তান যশবন্তের বিবাহও অসবর্ণ ও সত্যসোধক পথে দিয়েছিলেন। এবং শুধু তাই নয়, বিবাহের বেশ কিছুদিন আগেই হবু পুত্রবধু রাধাকে সাবিত্রীবাই বাড়িতে এনে রেখেছিলেন যাতে বিবাহের আগে তারা পরস্পরকে আরও ভালোভাবে জেনেবুঝে নিতে পারে।

১৮৭৬-এ মহারাষ্ট্রে মন্বন্তর দেখা দেয়। সত্যসোধকদের নিয়ে সাবিত্রীবাই ঝঁপিয়ে পড়েন ত্রাণকার্যে। দুর্ভিক্ষে অনাথ হওয়া শিশুদের জন্য ৫২টি বোর্ডিং স্কুল গড়ে তোলেন তাঁরা। ১৮৭৭ সালের এপ্রিল মাসে গ্রামে গ্রামে ত্রাণের কাজ পরিচালনা করবার সময় জোতিবাকে লেখা একটি চিঠিতে সাবিত্রী খুব সংক্ষেপে পরিস্থিতি তুলে ধরছেন,

“১৮৭৬ সাল চলে গেছে, কিন্তু মন্বন্তর এখনও যায় নি—বরং আরও ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে এখানে বিরাজ করছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। পশুপাখি মারা যাচ্ছে, মাটিতে পড়ে। খাবারের চরম সংকট। পশুদেরও খাদ্য নাই। সকলে গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। কেউ কেউ নিজের ছেলেমেয়েদের, কম বয়সি মেয়েদের পর্যন্ত, বিক্রি করে দিচ্ছে এবং গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে। নদী নালা পুকুর তালাও সব শুকিয়ে ঠাঠা করছে—এক ফোঁটা জল নেই পান করার। গাছগুলো শুকিয়ে মরে যাচ্ছে—একটাও পাতা নাই। জমি ফেটে চৌচির। সূর্যের প্রখর তাপে সব পুড়ে ছারখার। খাবার আর জলের জন্য হাহাকার করতে করতে মাটিতে আছড়ে পড়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। কেউ কেউ বিষাক্ত ফল খেয়ে ফেলছে এবং তৃষ্ণা মেটাতে নিজের প্রস্রাব পান করছে। খাবার ও পানীয় জল চেয়ে আর্তনাদ করতে করতে মারা যাচ্ছে মানুষ।”

এই চিঠিতে সাবিত্রী জানাচ্ছেন যে সত্যসোধক স্বেচ্ছাসেবিরা রিলিফ স্কোয়াড গঠন করেছে এবং মানুষকে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যোগান দেওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় কমিটি গঠন করেছে। দুর্ভিক্ষের মধ্যে সুদখোর মহাজনদের শোষনের দুরভিসন্ধি ও সত্যসোধকদের সাথে সংঘাতের একটি ঘটনারও উল্লেখ করছেন সাবিত্রী,

“ঋণদাতা মহাজনেরা নিস্করুণভাবে এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে। মন্বন্তরের কারণে খুব খারাপ সব ঘটনা ঘটছে। রায়ট ছড়িয়ে পড়ছে। কালেক্টর মহাশয় এই পরিস্থিতির কথা জানতে পারেন এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আসেন। তিনি শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার নিয়োগ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। পঞ্চাশ জন সত্যসোধককে আটক করা হয়। কালেক্টর আমাকে ডাকেন কথা বলার জন্য। আমি কালেক্টরকে প্রশ্ন করি কেন এইসব সৎ স্বেচ্ছাসেবিদের মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হল এবং কোনও কারন ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হল। কালেক্টর মহাশয় যথার্থই ভদ্র ও পক্ষপাতহীন। তিনি শ্বেতাঙ্গ সৈনিকদের প্রতি চিৎকার করে বললেন, “এই পাটিল কৃষকেরা কি ডাকাতি করেছে? ওদের ছেড়ে দাও”। সাধারণ মানুষের দুর্দশা দেখে কালেক্টর সাহেব প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তিনি তৎক্ষণাৎ চার গোরুগাড়ি ভর্তি খাবার(জোয়ার) আমাদের জন্য পাঠিয়ে দেন”।

চিঠির শেষে সাবিত্রী গরিব ও অভাবি মানুষের মুক্তির জন্য জোতিবার মহৎ জনহিতৈষি উদ্যোগের প্রশংসা করছেন, এই কাজে সাবিত্রী তাঁর নিজের দায়িত্বটুকু পালন করতে ইচ্ছুক বলে জানাচ্ছেন, জোতিবাকে সর্বদা সাহায্য করার অঙ্গীকার করছেন এবং এই মঙ্গলকার্যে আরও বহু মানুষ যে জোতিবার পাশে এসে দাঁড়াবে তা জানিয়ে আশ্বাস দিচ্ছেন।

ভারতের দুই প্রান্তের দুই ধর্মঘট

বিধবা বিবাহের পক্ষে প্রচার চালানোর সাথে সাথে আরও বড় আলোড়নের দিকে এগোন সাবিত্রীরা। ব্রাহ্মণ বিধবাদের মস্তক মুণ্ডনের বিরুদ্ধে প্রচার চালান হয়। ক্ষৌরকারদের মধ্যে প্রচার চালান হয় তারা যেন মুণ্ডনের কাজ করতে অস্বীকার করেন। অনেকেই সেই অঙ্গীকার করেন। পরবর্তিতে ফুলেদের বন্ধু ও কমরেড তথা শ্রমিক আন্দোলনের নেতা নারায়ণ মেঘাজি লোখান্ডে ক্ষৌরকারদের ধর্মঘট সংগঠিত করেন। প্রায় ৫০০ ক্ষৌরকার এই বিশেষ ধর্মঘটে সামিল হন। বিধবা মেয়েদের দুর্দশার বিরুদ্ধে পুরুষ ক্ষৌরকাররা আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেও ধর্মঘট করছেন—এমন ঘটনা আমাদের ইতিহাসে অভিনব।

১৮৬২ সালের মার্চ মাসে ‘আট ঘন্টা কর্মদিবস’ দাবিতে হাওড়া স্টেশনের ১২০০ রেলশ্রমিকের ধর্মঘট দেশের প্রথম সংগঠিত শ্রমিক ধর্মঘট হিসেবে গণ্য হয়। তারও অনেক আগে ১৮২৭ সালে কলকাতার পাল্কি বাহকেরা নতুন ট্রাফিক আইনের বিরুদ্ধে কয়েক মাস কাজ বন্ধ রেখে স্ট্রাইক করেছিল বলে জানা যায়। কিন্তু অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার ঊর্দ্ধে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রশ্নে সর্বপ্রথম সাড়া জাগানো ধর্মঘট সংগঠিত হয়েছিল ১৮৭২-৭৩ সালে বঙ্গ প্রদেশের পূর্ব অংশে। হিন্দু সমাজে ‘চণ্ডাল’ নামে ধিক্কৃত ছিল বাংলার এই অঞ্চলের শুদ্রাতিশুদ্ররা। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে নৌকার মাঝি, মুটে মজদুর, কুলি, ছুতোর, কুমোর, জেলে, ঘরামি ইত্যাদি সবরকম কাজের সাথে যুক্ত ‘চণ্ডাল’-দের প্রায় মনুষ্যেতর জীব হিসেবেই গণ্য করত বাবু বাঙ্গালিরা। জেলখানাগুলিতে তাদেরকেই বাধ্য করা হত বর্জ্য সাফাইয়ের কাজে। এই আবহে ১৮৭২ সালে ‘সামাজিক সম্মান’ ও ‘আইনের চোখে সমব্যবহার’ পাওয়ার দাবিতে তারা উচ্চবর্ণের লোকেদের বাড়িতে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল বা ‘বয়কট’ করেছিল (যদিও ‘বয়কট’ শব্দটি তখনও ইংরেজি ডিকশনারিতে উঠে আসেনি)। পূর্ব বঙ্গের বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর ও জশোর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল এই ‘চাঁড়াল বিদ্রোহ’। সাধারণ ধর্মঘট প্রায় ছয় মাস চলেছিল। এই ধর্মঘট ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যে জোরাল আঘাত হেনেছিল এবং সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ অহিংস পথে অসহযোগ আন্দোলনের এক মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। সামাজিক ন্যায় ও সমতার এই লড়াইয়ে পথপ্রদর্শক ও প্রণোদক হিসেবে রাই চাঁদ মণ্ডল, নীলমনি বিশ্বাস, শিবু ঢালি, রামচন্দ্র বাগশা, ভজন বালা, চরণ সপা ইত্যাদি নামগুলি পাওয়া যায়। দেশের পশ্চিম প্রান্তের মহারাষ্ট্রে নবজাগরণের সমসময়েই পূর্বপ্রান্তের বঙ্গ প্রদেশে চলছিল এই দলিত জাগরণ—হরিচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া ভাবান্দোলন ও পরবর্তীতে তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে চণ্ডালদের সাংস্কৃতিক জাগরণ—ইতিহাসে যা নমশুদ্র আন্দোলন নামে পরিচিত হয়। কলকাতা কেন্দ্রীক ‘বাংলার নবজাগরণ’ দলিত শ্রমজীবি মানুষের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বরাবর অবহেলা করেছে।

বিপ্লবী কবি সাবিত্রী

একদিকে প্রত্যক্ষ অ্যাক্টিভিজমের ময়দানে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া, অন্যদিকে বহু সংখ্যক আশ্রিত ছাত্রছাত্রীদের পালনপোষোন-শিক্ষার কাজ দেখভাল করা—এই দুইয়ের মাঝেও সাবিত্রীবাই লেখালেখি ও সংকলন-সম্পাদনার কাজ চালিয়ে গেছেন। বস্তুত সাবিত্রীবাইকে আধুনিক মারাঠি কবিতার জননী হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৮৫৪ সালে প্রকাশিত ‘কাব্য ফুলে’ সম্ভবত ব্রিটিশ ভারতে কোন ভারতীয়র লেখা প্রথম মুদ্রিত কাব্যগ্রন্থ। সাবিত্রীর লেখা দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বাওয়ান কষি সুবোধ রত্নাকর’ প্রকাশিত হয় ১৮৯১ সালে। এটি পদ্যছন্দে লেখা মহাত্মা জোতিরাওয়ের জীবনিগ্রন্থ। সাবিত্রী সচেতনভাবে মারাঠি লোকসাহিত্য ধারার ধরনে নিজের কবিতা রচনা করেছিলেন এবং কবিতাগুলি ছিল প্রচারধর্মী। কবিতাগুলির কিছু শিরোনাম এরকম— যাও, শিক্ষিত হও; শিক্ষিত ও সক্রিয় হতে উঠে দাঁড়াও; ইংরেজি শেখো; তো, মনু বলছেন…; শুদ্রদের দুর্দশা, ইত্যাদি। কবিতাগুলি সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের উন্মোচন ও দরিদ্র নিপীড়িত দলিত মানুষের প্রতি আহ্বান,

জাগো, ওঠো, এবং শিক্ষিত হও

নিজেকে মুক্ত কর—ঐতিহ্য-প্রথা গুঁড়িয়ে দাও!

আধুনিক শিক্ষা তথা ইংরেজি ভাষা শেখার গুরুত্ব ও ক্ষমতা তিনি প্রথম থেকেই অনুধাবন করেছিলেন। একাধিক কবিতাতে তিনি আহ্বান রেখেছেন—“ইংরেজি শেখো জাতের বিনাশ করতে”। জোতিরাওয়ের বিভিন্ন ভাষণ সম্পাদনা করে ১৮৫৬ সালে “জোতিবা ভাষণে” নামে প্রকাশ করেন সাবিত্রীবাই। পরবর্তীতে আরও তিনটি খণ্ড সম্পাদনা করেন। সাবিত্রীর কয়েকটি ভাষণ ও গানের সঙ্কলনও প্রকাশিত হয় যা তিনি নিজেই সম্পাদনা করেন।

ফুলেদের স্কুলগুলিতে শিক্ষাদানের পদ্ধতি ছিল স্বাধীন চিন্তা বিকাশের লক্ষ্যে চালিত। জীবিকা ও কর্মমুখী শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়। একবার এক অফিসার অতিথি হিসেবে এসে ছাত্রীদের কিছু প্রাইজ দিচ্ছিলেন, এক ছাত্রী স্বতস্ফুর্ত উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “স্যার আমাদের খেলনা বা টফি উপহার দেবেন না; আমাদের স্কুলে একটা লাইব্রেরি চাই আমরা”। ১৮৫৫ সালে, ১৪ বছর বয়সী ছাত্রী মুক্তা মাতাং একটি প্রবন্ধ লেখেন যা মারাঠি সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম মাইলস্টোন বলে বর্ণিত হয়েছে। ‘দ্যানোদয়া’ পত্রিকায় প্রকাশিত “মাং মাহারচ্য দুখবিষয়ী” শীর্ষক এই প্রবন্ধে মুক্তা লেখেন,

“যদি বেদ কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের হয় তাহলে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে কিতাবটি আমাদের নয়। আমাদের কোনও কিতাব নেই—আমাদের কোনও ধর্ম নেই। যদি বেদ কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদেরই হয় তাহলে আমরা তো বেদের বিধান মেনে চলতে মোটেই বাধ্য নই। যদি বেদের দিকে তাকালেও আমাদের মহা পাপ হয় (যেমন ব্রাহ্মণেরা দাবি করে থাকে) তাহলে বেদের নির্দেশ মেনে চলাও কি চরম বোকামি নয়?...

ওরা আমাদের, গরিব মাং ও মাহারদের, নিজস্ব জমি থেকে উচ্ছেদ করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের জমি দখল করে নিজেদের অট্টালিকাগুলি বানিয়েছে। এবং সেটাই সব নয়। ওরা মাং ও মাহারদের লাল সীসা মেশানো তেল খেতে বাধ্য করেছে আর আমাদের লোকেদের ওদের অট্টালিকার ভিতে জীবন্ত পুঁতে দিয়েছে। এভাবে আমাদের একের পর এক প্রজন্মকে ওরা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ব্রাহ্মণেরা আমাদের এতটাই নীচু বানিয়ে দিয়েছে যে তারা আমাদের গরু মহীষের থেকেও নীচু ভাবে। পেশোয়া বাজীরাওয়ের শাসনকালে ওরা কি আমাদের গর্দভের থেকেও নীচু হিসেবে গণ্য করত না? যদি তুমি একটি ল্যাংড়া গাধাকে মারো তাহলেও তার মালিক এসে তোমাকে ধরবে। কিন্তু মাং ও মাহারদের যে প্রতিদিনি রুটিন করে পেটানো হত তার প্রতিবাদ করার কেউ তো ছিল না। বাজীরাওয়ের রাজত্বে কোনও মাং বা মাহার যদি পাঠাশালার সামনে দিয়ে যেত তাহলেই তার মাথা কেটে নিয়ে ওরা মাটিতে ফেলে ‘ব্যাট বল’ খেলত, তরবারিকে ব্যাট আর কাটা মুণ্ডুকে বল করে। ওদের বাড়ির দরজার সামনে দিয়ে গেলেই যেখানে আমাদের শাস্তি পেতে হত সেখানে লেখাপড়া শেখা বা শিক্ষার স্বাধীনতা পাওয়ার প্রশ্ন কোথা থেকে আসে?”

‘দলিত’ শব্দটি প্রথম ফুলেরাই রাজনৈতিক অর্থে ব্যবহার করেন। দলিত বলতে তাঁরা স্ত্রী-শুদ্র-অতিশুদ্র এবং আদিবাসী ও মুসলমান—এক কথায় ভারতীয় সমাজের সমস্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে বুঝতেন এবং এই সমস্ত নিপীড়িত জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত ছিল তাঁদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কর্মকাণ্ড। সাবিত্রীবাই ফুলে উনবিংশ শতকের সেই ব্যতিক্রমী সমাজবিপ্লবী যিনি জাতবর্ণের প্রশ্নকে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর সাথে যুক্ত করে বুঝেছিলেন। বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর বুদ্ধ-কবীর-ফুলে ত্রয়ীকে তাঁর জীবনের শিক্ষক ও অনুপ্রেরণা বলে বারবার উল্লেখ করেছেন এবং জাতের বিনাশ ও নারীস্বাধীনতার প্রশ্নকে অবিচ্ছেদ্য বিষয় বলে তাঁর সমস্ত লেখাপত্রে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন।১০  বাস্তবেও ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে যে কোনও উত্থানেই নারীসমাজ উৎসাহভরে সামনের সারিতে থেকেছে এবং শ্রেণীসংগ্রামের দিগন্ত প্রসারিত করেছে। ভারতে বৈদিক-ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী প্রতিস্পর্ধী বৌদ্ধ ও ভক্তি আন্দোলনের ধারার সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার মন্ত্রের সাথে ফুলেরা যুক্ত করেছিলেন আধুনিক আইনী শাসনের ন্যায় বা জাস্টিসের ধারণা। আম্বেদকর তাকে আরও প্রসারিত করে সামাজিক ন্যায় ও অর্থনৈতিক ন্যায়ের পরস্পর অবিচ্ছেদ্যতার ভিত্তিতে দাঁড় করান এবং ভারতের সংবিধানে এই প্রতিস্পর্ধী ধারাকে যতদূর সম্ভব প্রতিষ্ঠিত করেন। এই ধারায় আধুনিক গণ আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথিকৃৎ সাবিত্রীবাই ফুলে। “আ ফরগটন লিবারেটর: দা লাইফ অ্যান্ড স্ট্রাগল অব সাবিত্রীবাই ফুলে” প্রবন্ধ সংকলনের সংকলক-সম্পাদক ব্রজ রঞ্জন মণির ভাষায়, “… “দার্শনিকেরা জগৎকে বহুভাবে বুঝেছে মাত্র; আসল প্রশ্নটা কিন্তু তাকে বদলানোর”—বিপ্লবী চিন্তক কার্ল মার্ক্সের এই আকুল আবেদনের এক চমৎকার আন্তরিক সাড়া যেন সাবিত্রীবাইয়ের জীবন ও সংগ্রাম। তিনি জগৎকে বহুভাবে নয় বরং এক সহজ সরল অর্থে বুঝেছিলেন—জগৎটাকে আরও মানবিক, আরও সর্বজনগ্রাহ্য, আরও সহমর্মী করে তোলার প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্যতা। এই সহজ বোধকে সম্যকরূপে সমগ্র জীবনে যাপন করেছেন বলেই তিনি এত গুরুত্বপূর্ণ”।

তথ্যসূত্রঃ

১. Prof. Hari Narake

https://ncert.nic.in/pdf/publication/otherpublications/Memorial-Lectures-Series/FINAL%20COVER%20OF%20SAVIRTIBAI%20PHULE.pdf

২. Divya Kandukuri

https://www.livemint.com/Leisure/DmR1fQSnVD62p4D3eyq9mO/The-life-and-times-of-Savitribai-Phule.html

৩. Ruchika Sharma

https://www.dailyo.in/arts/savitribai-phule-dalits-maharashtra-jyotiba-phule-education-feminist-untouchability/story/1/22815.html

৪. Neera Majumdar

https://theprint.in/report/amid-maharashtra-caste-violence-its-worth-remembering-savitribai-phule/26339/

৫. Govind Ganapat Kale

https://www.thenewsminute.com/article/snapshots-mahatma-jotirao-phule-s-life-through-eyes-his-close-aide-122339

৬. Anita Bharati

https://www.forwardpress.in/2014/01/savitribai-harbinger-of-social-revolution/

৭. Siddhant Mohan

https://sabrangindia.in/article/remembering-fatima-sheikh-first-muslim-teacher-who-laid-foundation-dalit-muslim-unity

৮. A Forgotten Liberator: The Life and Struggle of Savitribai Phule,

by Braj Ranjan Mani, Pamela Sardar

৯. Shekhar Bandyopadhyay

Caste, Protest and Identity in Colonial India: The NamaSudras of Bengal, 1872-1947.

১০. Against the Madness of Manu: B. R. Ambedkar’s writings on Brahminical Patriarchy, Selected and Introduced by Sharmila Rege.

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১১ জানুয়ারি ২০২২  

লেখক: সমাজকর্মী

সৌজন্য ইতিহাস আড্ডা

0 Comments

Post Comment