- 12 July, 2021
- 0 Comment(s)
- 750 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
২০ ফেব্রুয়ারী, ১৮৮৮ – জনৈকা ইংরেজ ভদ্রমহিলা তাঁর এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখছেন, “আমাকে মিসেস গাঙ্গুলীর সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানাতে পারো কি ? যতদূর শুনেছি যে তিনি ইতিমধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম মহিলা প্র্যাকটিসিং ফিজিশিয়ান হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছেন, এবং আগামী বছর মার্চ মাসে তিনি শল্যচিকিৎসার অন্তিম পরীক্ষাতেও অংশ নিতে চলেছেন। তিনি অন্ততপক্ষে একটি বা দুটি সন্তানেরও জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু যতদূর জেনেছি, সেই সময়ও মাত্র ১৩ দিনের বিরতির পরই তিনি ফের চিকিৎসক হিসেবে তাঁর কাজে যোগদান করেছিলেন। ... আমি এই প্রসঙ্গে লেডি ডাফরিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি, কলকাতার কোনও একটি হাসপাতালের ফিমেল ওয়ার্ডে যদি মিসেস গাঙ্গুলীকে চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ করা যায় ...” জনৈকা এই ইংরেজ ভদ্রমহিলার নাম, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল; আর পত্রে উল্লিখিত মিসেস গাঙ্গুলীর সম্পূর্ণ পরিচয় কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, সেই কথাকেও নিশ্চয়ই আর এখানে আলাদা করে বলে দিতে হবে না। সেই কাদম্বিনী গাঙ্গুলী - সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে ধরলে, যিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, প্রথম স্বীকৃত মহিলা প্র্যাকটিসিং ফিজিশিয়ান। যদিও, সমকালীন সময়ে এই প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি নাম উঠে আসে। যেমন কিনা, আনন্দীবাই গোপালরাও যোশী, এ্যানি জগন্নাথন অথবা রূপাবাই ফারদুনজী – এঁদের সম্পর্কেও আলোচনা আসবে বৈকি, কিন্তু বিধির লিখনে এই সকল মানুষের মধ্যেও কাদম্বিনী একার কৃতিত্বে স্বতন্ত্র হয়ে রয়েছেন।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, জন্ম ১৮ই জুলাই, ১৮৬১ – সেই বছর, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও জন্মের বছর। কাদম্বিনী জন্মেছিলেন বিহারের ভাগলপুরে, বিশিষ্ট এক ব্রাহ্ম পরিবারে। তাঁর পিতা ব্রজকিশোর বসু ছিলেন একজন সমাজসংস্কারক, এবং স্থানীয় স্কুলের প্রধানশিক্ষক। ১৮৬৩ সালে তিনি এবং অভয়চরণ মল্লিক ভাগলপুর মহিলা সমিতি’র প্রতিষ্ঠা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এই সমিতিই সারা দেশের মধ্যে প্রথম স্বীকৃত মহিলা সমিতি বলে পরিচিত। কাদম্বিনীর বিয়ে হয় তাঁর চেয়ে সতেরো বছরের বড় দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সঙ্গে। কিন্তু, আলোকপ্রাপ্ত এবং শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে, প্রথমে পিতা ব্রজকিশোর এবং পরবর্তীতে স্বামী দ্বারকানাথ দুজনেই কাদম্বিনীর শিক্ষা এবং গুণগত সমৃদ্ধির বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন।
বিহারে জন্মগ্রহণ করলেও, বসু পরিবারের আদিভিটে ছিল বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। ঢাকা শহরের ব্রাহ্ম ইডেন ফিমেল স্কুল থেকে কাদম্বিনী প্রথম জীবনে পড়াশোনা শুরু করেন। পরে তিনি কলকাতার বালিগঞ্জে হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সালটা ১৮৭৬, দু’বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়, তৎকালীন বেথুন স্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এই বেথুন স্কুলেই কাদম্বিনীর সঙ্গে দ্বারকানাথের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এবং দেরাদুন-প্রবাসী এক বাঙালি পরিবারের কন্যা চন্দ্রমুখী বসু, দুজনে বেথুন স্কুল থেকে কলেজে ভর্তির জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ. এ. ক্লাসের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসেন। দ্বারকানাথের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই দুই মহিলা প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে সক্ষম হন, কারণ তার আগে অবধি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা তার অধীনস্থ কোনও কলেজে মেয়েদের ভর্তির কোনও ব্যবস্থা ছিল না। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৮০ সালে বেথুন কলেজ থেকে এই দুই মহীয়সী এফ. এ. পরীক্ষায় পাশ করেন। এই সময় কাদম্বিনী কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে চাইলে তিনি জানতে পারেন যে মেয়েদের জন্য সেই কলেজের দরজা তখনও অবধি খোলেনি। যদিও এর আগে ১৮৭৫ সাল থেকেই মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে মহিলা ছাত্র ভর্তির প্রক্রিয়াটি চালু হয়েছিল। বিফলমনোরথ হয়ে কাদম্বিনী এবং চন্দ্রমুখী আবার বেথুন কলেজেই ভর্তি হন এবং সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম দুই মহিলা হিসেবে ১৮৮২ সালে তাঁরা স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। চন্দ্রমুখী বসু পরবর্তীতে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে সেই বেথুন কলেজ থেকেই প্রথম এবং বেশ কিছু সময় অবধি একমাত্র ছাত্রী হিসেবে এম. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে এই চন্দ্রমুখী বসু বেথুন কলেজের অধ্যক্ষা নিযুক্ত হলে পরে, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে তিনি প্রথম মহিলা হিসেবে কোনও স্নাতক স্তরের কলেজে অধ্যক্ষের পদে বসেন।
১৮৮৩তে কাদম্বিনীর সঙ্গে দ্বারকানাথের বিবাহ হয়। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মহিলা হিসেবে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হন। ব্রিটিশ সরকার সেই সময়ে তাঁর জন্য ২০টাকা মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করে। যদিও, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কাদম্বিনীর এই উত্থান সহজ হয়নি। মেডিকেল কলেজের এক অধ্যাপক কাদম্বিনীর এই বিপ্লবের বিরুদ্ধে এতটাই খড়্গহস্ত ছিলেন যে, তিনি তাঁর একটি পেপারের পরীক্ষায় কাদম্বিনীকে ফেল করিয়ে দেন। এই কারণে ১৮৮৮ সালে কাদম্বিনী এম. বি. ডিগ্রির শংসাপত্র না পেলেও, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে প্রথম মহিলা হিসেবে তিনি এল. এম. এস. অথবা ডাক্তারি চিকিৎসার সরকারি ছাড়পত্র লাভ করেন। এছাড়াও, মেডিকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ অধ্যাপক জে. এম. কোটস কাদম্বিনীকে জি. বি. এম. সি. ডিপ্লোমাতে ভূষিত করেন। একই বছরে কাদম্বিনী লেডি ডাফরিনের হাসপাতালে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে চিকিৎসক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এই সূচনাপর্বটিও তাঁর জন্য একেবারেই সুখকর হয়নি। লেডি ডাফরিন হাসপাতালে তখন কাদম্বিনী মহিলা তো বটেই, তার উপরে আবার তিনি আদ্যন্ত ভারতীয় – কাজেই হাসপাতালের অন্যান্য বিলিতি মহিলা ডাক্তারেরা এম. বি. ডিগ্রি না থাকার কারণ দেখিয়ে কাদম্বিনীর প্রতি চরম বিদ্বেষমূলক আচরণ করতে শুরু করেন। আমাদের বীর বঙ্গপুঙ্গবেরাও এই সময়ে কাদম্বিনীর পাশে দাঁড়াননি। উলটে ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায় তাঁর চরিত্র নিয়ে নির্লজ্জ আক্রমণ করা হয়। এমনকি ঘুরিয়ে তাঁকে ‘পতিতা’ বলেও দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী ‘বঙ্গবাসী’র সম্পাদকের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হন, এবং মামলায় জিতে সম্পাদকের ছয়মাস জেল এবং ১০০টাকা জরিমানা নিশ্চিত করেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলতে ইচ্ছে করে যে, “কে বলে বাঙালি ‘মায়ের জাত’কে সম্মান করতে জানে না ?” এমন ‘সম্মান’ যেন কখনও, কোনও সমাজে, কাউকে অর্জন করতে না হয়।
সমস্ত বাধাবিপত্তি কুসংস্কারকে তুচ্ছ করে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে কাদম্বিনী উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত রওয়ানা হন। ২৩ মার্চ, ১৮৯৩ – কাদম্বিনী লন্ডনে এসে পৌঁছন। একে একে তিনি এল. আর. সি. পি. (এডিনবার্গ), এল. আর. সি. এস. (গ্লাসগো), এবং জি. এফ. পি. এস. (ডাবলিন) এই তিনটি ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৮৯৫ সালে তিনি নেপালে যান এবং সেখানকার রাজা দেব শমশের জং বাহাদুর রানা’র মায়ের চিকিৎসাভার গ্রহণ করেন।
ইতিপূর্বে আমরা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল অথবা ক্যাথারিন ইভান্সের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখেছি, বাঙালী কাদম্বিনীও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কেবল নিজের জ্ঞানবৃদ্ধি বা নিজের জীবনে উন্নতিই নয়, সমাজের সার্বিক পরিবর্তনের প্রয়োজনে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। ১৮৮৫তে যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয় সেই সময়ে কোনও মহিলাকে কংগ্রেসের সদস্যপদ দেওয়া হত না। ১৮৮৯ সালে প্রথম বারের জন্য আরও চারজন মহিলার সঙ্গে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন এবং কংগ্রেসের ইতিহাসে প্রথম মহিলা হিসেবে পরের বছর, ১৮৯০ সালের কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি ভাষণ দেন। বঙ্গভঙ্গের পরবর্তীতে ১৯০৬ সালে তিনি কলকাতায় একটি মহিলা সমাবেশের আয়োজন করেন। ১৯০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোহনদাস গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সমর্থনে তিনি একটি আমাদের শহরে একটি সহমর্মী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে এই আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহে সচেষ্ট হন। ১৯১৪ সালে ভারতবর্ষে ফিরে এসে কলকাতা সফরকালে, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সম্মানার্থে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ যে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেছিল, কাদম্বিনী গাঙ্গুলী তাতে সভাপতিত্ব করেন। স্বামী দ্বারকানাথের সঙ্গে তিনি আসামের চা-শ্রমিকদের দুর্দশার বিষয়টিকেও জনসমক্ষে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা চালান। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে সরকারি কমিশনের সদস্য হিসেবে তিনি কবি কামিনী রায়ের সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যার কোলিয়ারি অঞ্চলে সেখানকার মহিলা শ্রমিকদের দুর্দশার চিত্রগুলিকে লিপিবদ্ধ করেন।
তাঁর জীবনে বিশ্রাম ছিল না। উচ্চ রক্তচাপের অসুখে ভুগলেও তাঁর দৈনন্দিন কাজে-কর্মে সেই অসুখকে তিনি কোনোদিন বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেননি। ৩ অক্টোবর, ১৯২৩ – সেই বছরের দেবীপক্ষ শুরুর একসপ্তাহ আগে হাসপাতালে শক্ত একটি অপারেশন সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কাদম্বিনী অসুস্থ বোধ করেন। সেই দিন রাতেই তিনি প্রয়াত হন। বাষট্টি বছরের এক উত্তাল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। উত্তালই বলব কারণ, ১৮৬১ থেকে ১৯২৩ – এই সময়ে দাঁড়িয়ে যা কিছু কাদম্বিনী অর্জন করেছিলেন, যা কিছু অবদান তিনি রেখেছিলেন – এতগুলো দশক পেরিয়ে আজও, সেই সমস্ত কিছুকে গল্পের মতোই মনে হয়। তিনি কেবল, আরও অজস্র মানুষের মতো আরও একটিবার প্রমাণ করেছিলেন – “পারে! মেয়েরা সব পারে! মানুষ সব পারে!” সেদিনের সেই বাঙলিনীর প্রতিভার দাপটে, আজও আমরা তাই উচ্ছ্বসিত হই কেবল।
সুত্রঃ
[১] মালবিকা কার্লেকর, ‘এ্যানাটমি অব এ চেঞ্জঃ আর্লি উইমেন ডক্টরস’, ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার কোয়ার্টার্লি, খন্ড ৩৯, ২০১২
[২] বি. কে. সেন, ‘কাদম্বিনী গাঙ্গুলী – এ্যান ইলাস্ট্রিয়াস লেডি’, সায়ান্স এ্যান্ড কালচার – ইন্ডিয়ান সায়ান্স নিউজ অর্গানাইজেশন, সেপ্টেম্বর, ২০১৪
[৩] রোশনি চক্রবর্তী, ‘কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, ইন্ডিয়াজ ফার্স্ট ফিমেল ডক্টর হু মেড ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজ স্টার্ট এ্যাডমিটিং উইমেন’, ইন্ডিয়া টুডে, জুলাই, ২০১৯
[৪] ‘এ লেডি ডক্টর ইন অর্থোডক্স নেপাল’, ইংলিশম্যান’স ওভারল্যান্ড মেল, ২৭ নভেম্বর, ১৮৯৫
[৫] ডেভিড কফ, ‘দ্য ব্রাক্ষ্ম সমাজ এ্যান্ড দ্য শেপিং অব মডার্ন ইন্ডিয়ান মাইন্ডস’, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৯
ছবি : কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। সংগৃহীত
লেখক : প্রযুক্তিবিদ্যার গবেষক, প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment