কমলার কথা

  • 27 October, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 536 view(s)
  • লিখেছেন : প্রতিভা সরকার
‌বড় চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন মেয়েদের জন্য সর্বক্ষণ কাজ করবেন বলে। তার জন্য বা ব্যক্তিগত জীবনে নেমে আসা অনর্থের জন্য আফশোস করতে কেউ শোনেনি। আমৃত্যু সেই কাজ সমান যোশে করে গেছেন। ৫০ বছরের দীর্ঘ যাত্রায়  একাধিক নারী সংগঠন তৈরি করে শহরে গ্রামে সর্বত্র মেয়েদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার স্বপক্ষে কথা বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে অনবরত ঘটে যাওয়া হিংসার প্রতিবাদ করেছেন কমলা ভাসিন।

এক বাবা একদিন তার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করছে, তোকে পড়িয়ে আমার লাভ কী! পড়াশোনা করাবার জন্য আমার ছেলেরা আছে না! খামোখা তোকে পড়াতে যাব কেন রে? 
মেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, শোন বাবা—

 ‘‌‘‌মেয়ে আমি, তাই পড়া পড়ব
স্বপ্নের সুতোটাকে আকাশেই ছাড়ব।
আলো চাই, চাই যতো জ্ঞান
লড়াইতে জিতবার ধ্যান 
মেয়ে আমি, তাই পড়া পড়ব
অজানাকে জানবই জানব।

বোবা কান্নাকে ভাষা দিতে 
ঠিক আর মিথ্যাকে চিনে নিতে
চোখ-বাঁধা কানুনকে বদলাতে 
পড়া ছাড়া কী বলো উপায়! 
মুখ বুজে মার খাওয়া নয়। 
মেয়ে আমি তাই পড়া পড়ব
বিশ্বাস নিজে নিজে গড়ব। 

আওয়াজ বুলন্দ হোক, গাই আরো গান
শতকের ধুলো ঝেড়ে জেগে ওঠা প্রাণ,
পৃথিবীতে নিজেদের খুঁজে পাব স্থান।
মেয়ে আমি, তাই পড়া পড়ব
লড়াইটা শেষ তক লড়ব।’‌’‌ *

দিল্লিতে এক সভায় কমলা ভাসিন তাঁর এই কবিতার হিন্দি ভার্সনটি খুব আনন্দের সঙ্গে আবৃত্তি করছিলেন। তাইই করতেন তিনি। নিজের লেখা কবিতাটি তাঁর খুব প্রিয় ছিলো। 

সেদিনও মুখের হাসি, চোখের ঝকঝকে ভাব অক্ষুণ্ণ ছিল। কে বলবে শরীরের গভীরতম কোষে ছড়িয়ে গেছে মারণ রোগের বীজ! শ্রোতারা সমে এসেই হাত তালি দিচ্ছিলেন, সমস্বরে সাধুবাদ জানাচ্ছিলেন। ভাসিন সেই মূহুর্তগুলো থামছিলেন, যেন স্নাত হচ্ছিলেন ভালো লাগায়। তারপর আবার মেয়েদের পড়াশুনো করবার একশ কারণে চলে যাচ্ছিলেন হাসিমুখে। 

এমনই ছিলেন তিনি। বড় চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন মেয়েদের জন্য সর্বক্ষণ কাজ করবেন বলে। তার জন্য বা ব্যক্তিগত জীবনে নেমে আসা অনর্থের জন্য আফশোস করতে কেউ শোনেনি। আমৃত্যু সেই কাজ সমান যোশে করে গেছেন। তাঁর হাসিখুশি স্বভাব, তাঁর কবিতা, নির্দিষ্ট ভাষা ও অনুভূতির সীমানা পেরনো গানের কথা ও সুর, তাঁর রচিত শ্লোগান, নারীবাদের গভীর তাত্ত্বিক আলোচনায় সহজ সরল ভাষা ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির প্রাচুর্য, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মেয়েদের উন্নতির জন্য একদম মাঠে নেমে, সংগঠন গড়ে তুমুল কাজ, এইসবই তাকে শুধু কঠিন নীরস থিয়োরিস্ট করে রাখেনি, করে তুলেছে নারী আন্দোলনের চালিকা শক্তি, যাঁকে অবলীলায় শহর ও গ্রামের নিপীড়িত মেয়েরা নিজের লোক বলে ভেবেছে। 

কবিতা দিয়ে কমলার কথা শুরু করবার একটি কারণ আছে। কবিতা তার কাছে ছিলো অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। লিঙ্গসাম্য সম্বন্ধে সচেতনতা তৈরি এবং পিতৃতন্ত্র ও হিংসার বিরুদ্ধে প্রচারের হাতিয়ার। তাঁর গান, শ্লোগান, বক্তৃতা, বই সবই ছিলো এক একটি প্রহরণ। ৫০ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় যখনই তিনি একাধিক নারী সংগঠন তৈরি করে শহরে গ্রামে সর্বত্র মেয়েদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার স্বপক্ষে কথা বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে অনবরত ঘটে যাওয়া হিংসার প্রতিবাদ করেছেন, তখনই এই অস্ত্রগুলো খুব ফলপ্রসূ ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে কমলার হাতে। 

তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততার একটি সরল উদাহরণ দিচ্ছি, যা আমাদের অনেকেরই অজানা। ‘‌আজাদি’‌ শ্লোগান যা JNU, কানহাইয়া কুমার হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা উপমহাদেশে, তা আসলে কমলা ভাসিন সৃষ্টি করেছিলেন আর এক লড়াকু মহিলা, পাকিস্তানের নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী নিগাত সৈয়দ খানের সহায়তায়। 

নিগাত খানের কথায় মনে পড়ল নারীমৈত্রীর কাজে আন্তর্জাতিক সীমান্ত কখনও কমলার কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ১৯৯৮ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদী নেটওয়ার্ক ‘‌সঙ্গত’‌ গোটা উপমহাদেশে লিঙ্গসাম্যের দাবি তোলে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মেয়েরা হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেন। বৃহত্তর মুক্তির স্বার্থে তারা সেদিন স্ব স্ব রাষ্ট্রের যুদ্ধবাদী ও ঘৃণার রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন। সত্তর আশির দশকে বাংলাদেশি এবং পাকিস্থানি নারীদের এক ছাতার তলায় আনা খুবই কঠিন কাজ ছিল। কমলা এবং অন্যান্য নারী নেত্রীদের ঐকান্তিক চেষ্টায় বাংলাদেশি মেয়েদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচারকে ধিক্কার জানিয়ে পাকিস্তান থেকে একশোর বেশি স্বাক্ষর সম্বলিত দুঃখ প্রকাশের চিঠি (letter of apology) বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। একই ভাবে ভারতীয় ও পাকিস্তানি মেয়েদের মধ্যেকার রাষ্ট্রীয় শত্রুতা পেরনোর কাজ সফল হয়েছিল কমলা ভাসিন ও নিগাত খানের যৌথ এবং ঐকান্তিক চেষ্টায়।

নিজের বিশ্বাসের যাথার্থ্য দেখাতে গিয়ে কখনও লক্ষ্মী মেয়ের ছদ্ম আবরণে মুখ ঢাকেননি কমলা। চাঁছাছোলা ভাষায় ধরিয়ে দিয়েছেন অন্যায়ের স্বরূপ। সত্যমেব জয়তে নামের টিভি সিরিয়ালটি যারা দেখেছেন তারা ভুলবেন না কমলা ভাসিনের সেই তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, ‘‌আমি ধর্ষিত হলে লোকে বলবে, আমি নাকি আমার সম্মান খোয়ালাম। আমার প্রশ্ন, আমার সম্মান কী করে খোয়া গেল? আমার সম্মান তো আমার যোনিতে ছিল না কখনও। আমি বরং উল্টো প্রশ্ন করব, ভাই, তোমার সম্প্রদায়ের সম্মান তুমি কী করতে আমার যোনিতে রেখেছিলে, যে এখন সম্মান গেল গেল রব তুলেছ!’‌ সম্মানের প্রশ্ন তুলে নিপীড়িতা ও তার পরিবারকে একঘরে করে দেবার পিতৃতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র তাঁর কাছে খুব পরিষ্কার ছিল। 

নারীবাদী এক্টিভিস্ট হবেন জীবনের শুরুতে কমলাই কি জানতেন? জার্মানিতে অর্থনীতি নিয়ে পড়তে যান, সমাজ কী ভাবে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলাফলে প্রভাবিত হয়, এই ছিল তার আগ্রহের জায়গা। ফিরে এসে রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রামে সমীক্ষার কাজ শুরু করেন, রুখাশুখা গ্রামগুলোতে কুয়ো তৈরি করতে সাহায্য করতেন, সেখানেই প্রথম হাতেকলমে পরিচয় মেয়েদের বিরুদ্ধে অহরহ ঘটে যাওয়া অপরাধ আর অন্যায়ের সঙ্গে। 

তারপর এল ১৯৮০ সালের সেই সন্ধিক্ষণ, যখন মথুরা রেপ কেসে সুপ্রিম কোর্ট ধর্ষণে অভিযুক্ত দুই পুলিশ অফিসারকে বেকসুর খালাস দিল, কারণ মথুরা নাকি চেঁচামেচি করেনি আর তার শরীরে কোনো ক্ষত নেই। অর্থাৎ মথুরা কোনো প্রতিরোধই গড়ে তোলেনি। অতএব তার অসম্মতিতে তার ওপর চড়াও হওয়া, তাকে ধর্ষণ করা আইনসম্মত কাজ! 

হাজার হাজার মহিলা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন সেদিন, এক অর্থে ভারতে নারীমুক্তি আন্দোলনের শুরুর লগ্ন সেটি, কমলাও ঝাঁপিয়ে পড়েন, প্রতিবাদ, ধর্ণা, মিছিল, পথ-নাটক সবেতেই তাঁর সপ্রাণ উপস্থিতি। এমনই জোরদার ছিল সেই আন্দোলন যে ১৯৮৩ সালে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন পাল্টাতে বাধ্য হয় সরকার। 

সেই শুরু। একের পর এক আছড়ে পড়তে লাগল ঘটনার ঢেউ, আর কমলা আরও জড়িয়ে যেতে লাগলেন এক্টিভিস্টের জীবনে। ১৯৮৪-‌তে দিল্লি দাঙ্গায় শিখ নিধন, ১৯৮৬-‌তে শাহ বানো মামলা, ১৯৯২-‌তে ভানোয়ারি দেবী গ্যাং রেপ কেস, যা থেকে উদ্ভব কাজের জায়গায় মেয়েদের লাঞ্চনার প্রতিকারে বিশাখা গাইডলাইনের, এই সব কিছুর প্রতিবাদে মুখর হয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত নারী সংগঠন জাগরী। 

এনআরসি আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন কমলা ভাসিন, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমাজের প্রান্তিক মেয়েদের যন্ত্রণা আরও বৃদ্ধি করবে এই দানবীয় আইন। শাহিন বাগে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী কমলার শেষ ইচ্ছে ছিল বিলকিস দাদীকে নিয়ে শিশুদের জন্য একটি বই লেখার, তাঁর সঙ্গে ভবিষ্যত প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। শিশুরা তাঁর মনে খুব বড় জায়গা জুড়ে ছিল, কারণ তাদের অসহায়তা তিনি বুঝেছিলেন নিজের শৈশবের অভিজ্ঞতা দিয়ে। সে অত্যাচারের কথা খোলাখুলি আলোচনাও করেছেন। 

নারীবাদীদের নাম শুনলে যারা জ্বলে ওঠে এবং শব্দটাকে চোখা গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের জেনে রাখা ভাল, কমলা নারীমুক্তির লড়াইতে পুরুষদের একেবারেই ব্রাত্য মনে করতেন না। তিনি পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে নারীবাদের লড়াইকে দুই আদর্শের সংঘাত হিসেবেই দেখতেন। একটিতে পুরুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে অসীম ক্ষমতা, শেখানো হয়েছে নারী কেবল তার সেবাদাসী, আর একটিতে এই সমস্ত সামাজিক শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসবার, মানুষ বলে স্বীকৃতি পাবার অদম্য ইচ্ছে। দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু প্রথম দলে অনেক মানুষ এমন থাকেন, যারা দ্বিতীয় দলের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন। 

মনে পড়ে যাচ্ছে কমলার সৃষ্ট আর একটি চমৎকার পোস্টারের কথা, যাতে লেখা ছিলো, Men of quality always believe in equality. পুরুষ তারাই যারা অন্যকে সাম্যের সুযোগ দিতে দুবার ভাবেন না। 

২০২১-‌এর সেপ্টেম্বর মাসে কর্কট রোগের সঙ্গে যখন কমলা ভাসিনের মরণপণ লড়াই চলছে, তখনও আইসিইউ থেকে সব ওয়েবিনার, মিটিং-‌এ সোৎসাহে অংশ নিয়েছেন তিনি। অনেক কাজের ইচ্ছে মাথায় নিয়েই তাঁকে ঘুমিয়ে পড়তে হল, এটা এই উপমহাদেশের নারীমুক্তি আন্দোলনের দুর্ভাগ্য। 

আমাদের মধ্যে কমলা ভাসিন তো আর রাশি রাশি জন্মান না।


 *কবিতার অনুবাদ লেখকের নিজস্ব

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment