লকডাউনের বাস্তব কিছু ছবি

  • 16 May, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 815 view(s)
  • লিখেছেন : বিনীতা দেব
করোনায় মৃতের সংখ্যার হিসেবে গরমিল করতে যেন প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই। নিজের দেশের মানুষকে ঠকানোর কি হাস্যকর প্রচেষ্টা।

আমাদের জীবনে এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনে এমন ঘটনা প্রথম—বিশ্বব্যাপী অতিমারী আর মানবজাতির বেঁচে থাকার তাগিদে দুনিয়া জুড়ে লকডাউন। কেমন যেন স্বপ্নের ঘোরে পেরিয়ে চলেছি রূপকথার রাক্ষসপুরীর চৌহদ্দি, বন-জঙ্গল কালো নদী আর রাক্ষস উঠে আসা সাগর। নীলকমল আর লালকমল যেন ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে আর তরোয়ালের কোপে কেটে ফেলছে রাক্ষসদের মাথা। কিন্তু হায়! সেই রাক্ষসগুলোর বিন্দু বিন্দু রক্ত থেকে আবার গজিয়ে উঠছে সহস্র রাক্ষস। 

ঠিক দুঃস্বপ্নের মতোই গজিয়ে উঠেছে করোনা ভাইরাস। যার বিজ্ঞানসম্মত নাম নভেল করোনা ভাইরাস ওরফে কোভিড-১৯। 

সারা বিশ্ব জুড়ে দোষারোপ করছে চীনকে। সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করছে আমেরিকা। চীন যেন ‘‌রাক্ষস’‌ নির্মাণ করে ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা দুনিয়ায়। আর সে জন্যই নাকি চীন নিজের দেশে রোগ নিয়ন্ত্রণ করেছে জাদুর ক্ষিপ্রতায়। যদিও পুরোপুরি মুক্ত বলা যায় না। এখনও সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

আমেরিকার অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতিদিন বেড়েই চলেছে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। অবস্থার সামাল দিতে ‘‌বন্ধু’‌কে ধমক দিয়ে ভারত থেকে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে গেলেন ট্রাম্প। আর আমার দেশ ভারতেও সংক্রমণ রোধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিজ্ঞানসম্মত সাবধানতা অবলম্বনে প্রচুর ফঁাক থেকে যাচ্ছে।

ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের সরকার জনগণের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে ভীষণ ভালোবাসে। করোনা সংক্রমণে সেটা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠছে। ভারতে   প্রতিদিন কতজন আক্রান্ত হচ্ছে, কতজন সেরে উঠছে আর কতজনের মৃত্যু হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া সেই সংখ্যাতে যথেষ্ট গরমিল রয়েছে মনে করছেন সচেতন মানুষজন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্যেও বিতর্ক কম হচ্ছে না। সেই সঙ্গে কোমর্বিডিটির তত্ত্ব নিয়ে সন্দেহ, বির্তকও তুঙ্গে। সর্বোপরি মৃতের সংখ্যার হিসেবে গরমিল করতে যেন প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে দুই সরকারই। নিজের দেশের মানুষকে ঠকানোর কি হাস্যকর প্রচেষ্টা। বাংলাদেশ, পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও এই রকমই অভিযোগ সে দেশের নাগরিকদের।

খবরের শিরোনামে এখন পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার গল্প। এই সংখ্যাটা ঠিক কত?‌ প্রায় চার কোটি। কায়িক শ্রমজীবীদের নিজেদের গ্রাম, চেনা পরিবেশ পরিজন ছেড়ে রুটিরুজির জোগাড়ে এই বিশাল ভারতের কত দূরেই না যেতে হয়।

পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া লকডাউন হওয়ায় ভারতে এই পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজ, বাসস্থান হারিয়ে আকাশের নীচে দাঁড়িয়েছেন। তঁারা এখন পায়ে পায়ে শতশত মাইল পেরিয়ে নিজের গ্রামে, নিজের ঘরের দিকে। বহু রাজনৈতিক চাপানউতোর, টালবাহানার পর কিছু শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন এখন চলছে। নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ অসুস্থ মিলে শতশত কিলোমিটার ঠেঙিয়ে পথে পড়ে মরতে হবে না। কীটনাশকে স্নান করতে হবে না আর‌‌‌!‌ বড্ড দয়ালু সরকার আমাদের। কিন্তু তাতে চেপে কতজন বাড়ি ফেরার সুযোগ পাবেন যথেষ্ট সন্দেহ আছে। চিত্র সাংবাদিকদের ক্যামেরায় এখনও যে ছবি ধরা পড়ছে, তা ভয়ঙ্কর। ট্রেড ইউনিয়নগুলি কোথায় গেল?‌

ভাল কথা। সরকার নজর দিচ্ছে রেশনে খাদ্যসামগ্রীর যোগানে যেন কোনো গাফিলতি না হয়। কিন্তু এখানেও সন্দেহ। রেশনের চাল গম ভোজ্য তেল প্রকৃত দরিদ্র নাগরিক ঠিক বরাদ্ধ পাচ্ছে তো! অভিযোগ, এই লকডাউনে বিপিএল কার্ড হোল্ডারদের পাশাপাশি নিম্নবিত্ত জনগণ খাদ্যসামগ্রী পাচ্ছে অতি অল্প মাত্রায়, কারণ রেশন দোকানের তথাকথিত ডিলারগণ জনগণের প্রাপ্য রেশনে থাবা বসাচ্ছে। আর বিনামূল্যে রেশন ঘরে তুলছে দুষ্কৃতিরা। আর শহরের পাড়ায় পাড়ায় গ্রাম থেকে এসে নানা বয়সের মেয়েরা বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করছে কিছু খাবার পাওয়ার জন্য। কোথায় নজরদারি?‌ আমাদের সরকার বড্ড দয়ালু।

ডাক্তার নার্স সহ যত স্বাস্থ্যকর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত বিনা ছুটিতে রোগীর সেবা করে চলেছেন। নিজেরা রোগাক্রান্ত হচ্ছেন, মারাও গেছেন কযেকজন। তঁাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর নিশ্চয় কিছু উপায় ছিলো। যেমন প্রতি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সরকারি তরফে সব স্বাস্থ্যকর্মীকে সাম্মানিক অর্থ প্রদান, দুস্থ রোগীদের জন্য পথ্য প্রদান ইত্যাদি। তেমন কিছু সদর্থক কাজের বদলে কোটি কোটি টাকার জ্বালানি পুড়িয়ে, সামরিক বিমান উড়িয়ে, শতকোটি টাকার পুষ্পবৃষ্টি করে যে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন হলো তাতে তো ‘‌সাত মণ তেল পুড়িয়ে রাধার নাচ’‌ই হলো। সত্যিই আমাদের সরকার বড্ড দয়ালু।

সারা দুনিয়া সমেত ভারতের অর্থনীতিও ধ্বসে পড়েছে ভীতিপ্রদভাবে। নোবেলজয়ী দুই অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এবং অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় গরীবদের জন্য আ্যকাউন্ট খুলে সরকারকে টাকা দিতে বলেছেন। কিন্তু সে কাজ কতটা বাস্তবায়িত করার আগ্রহ দেখাবে সরকার সন্দেহ আছে। তবে দেশের অর্থনীতির উন্নতি ঘটানোর জন্য আবগারী বিভাগ মদের দোকান খোলার অনুমতি দিয়ে দিলো। আর মদের দোকানে দোকানে এমনই ভিড় শুরু হলো যে, করোনাকে আটকায় কার সাধ্যি।

এখন শুধু দিবাস্বপ্ন দেখছি যে, রূপকথার রাজপুত্তুররা রাক্ষস মারবে আর আমরা বেঁচেবর্তে থাকবো। ‘‌জয় হোক মানুষের, ঐ নব জাতকের’‌।

প্রতীকী ছবি‌
লেখক সমাজকর্মী

0 Comments

Post Comment