- 11 September, 2021
- 0 Comment(s)
- 656 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
উপরন্তু, শরীরী ভালোবাসা যেখানে বিবাহের আগে থেকেই বর্তমান অথবা বিবাহের শুরু থেকেই জেগে ওঠে, সেখানেও বহু বছর ধরে এই শরীরী ভালোবাসার টিকে থাকা বেশ বিরল। নিশ্চয়ই, শরীরী ভালোবাসার ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা জরুরি। কারণ প্রেমমুগ্ধ প্রেমিক-প্রেমিকার আকাঙ্ক্ষা তাঁদের স্বতন্ত্রতাকে আবৃত করে রাখে। তাঁরা চান না এই আকাঙ্ক্ষা কোনো বাইরের অভিজ্ঞতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ুক। একে-অপরের কাছে তাঁরা অপরিবর্তনীয় থাকতে চান। কিন্তু এই বিশ্বস্ততা যে-পরিমাণ স্বতঃস্ফূর্ত, সেই পরিমাণেই সেই বিশ্বস্ততার অর্থ নির্ভর করে। আর স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কামোত্তেজনার জাদু খুব দ্রুত বিলীন হয়ে যায়। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, এই কামোত্তেজনার জাদু প্রতিটি প্রেমিককে তাৎক্ষণিকভাবে এবং তাদের শরীরী উপস্থিতিতে এমন একটি সত্তা দান করে যার অস্তিত্ব উৎকর্ষের অভিমুখে অনির্দিষ্ট সীমাতিক্রমী : আর এই সত্তার ওপর অধিকার নিঃসন্দেহে অসম্ভব। তবে বিশেষাধিকারযুক্ত এবং মর্মস্পর্শী উপায়ে অন্ততপক্ষে এই অস্তিত্বে পৌঁছোনো সম্ভব। কিন্তু দু-জন ব্যক্তি যখন নিজেদের মধ্যকার শত্রুতা, বিতৃষ্ণা এবং উদাসীনতার জন্য একে-অপরের কাছে আর পৌঁছোতে চান না, তাঁদের মধ্যে ইরোটিক আকর্ষণ তখন অদৃশ্য হয়ে যায়। আর এই ইরোটিক আকর্ষণের প্রায় নিশ্চিত মৃত্যু হয় সম্মান এবং বন্ধুত্বে। কারণ দুজন মানুষ যখন এক হয়ে পৃথিবীব্যাপী এবং তাঁদের সাধারণ কর্মোদ্যমে উৎকর্ষ-অতিক্রমী পথে চলেন, তখন তাঁদের আর শারীরিক মিলনের প্রয়োজন হয় না। এমনকি, এই শারীরিক মিলন তার নিজস্ব তাৎপর্যও হারিয়ে ফেলে। এই শারীরিক মিলনকে তাঁরা ঘৃণা করেন তখন। এই প্রসঙ্গে মঁতেইন-এর ব্যবহার করা ‘অজাচার’ শব্দটি অমোঘ। ইরোটিজম হল অন্য হওয়ার দিকে এক ধরনের চলন আর এটাই তার অপরিহার্য চরিত্র। কিন্তু দম্পতিদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী একে-অপরের জন্য একই হয়ে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে আর কোনো বিনিময় সম্ভব নয়। সম্ভব নয় কোনো দান বা বিজয়। তাঁরা যদি একে-অপরকে ভালোওবেসে চলেন, তাহলেও তা প্রায়শই বিব্রতকর হয়ে পড়ে। তাঁরা অনুভব করেন যে, যৌনক্রিয়া আর নিজেদের মধ্যবর্তী কোনো অভিজ্ঞতা নয় যেখানে প্রত্যেকে নিজেকে ছাপিয়ে যায়। এটি বরং এক ধরনের যৌথ হস্তমৈথুন। স্বামী-স্ত্রী একে-অপরকে তাঁদের প্রয়োজন বা সন্তুষ্টির তৃপ্তি মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র হিসাবে বিবেচনা করেন। আর এই সত্যই বৈবাহিক ভদ্রতা দ্বারা গোপন করে রাখা হয়। কিন্তু এই ভদ্রতা যখন লোপ পায়, তখনই প্রকৃত সত্য বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়ে। উদাহরণ হিসাবে ডাক্তার লাগাশ-এর বিবৃত পর্যবেক্ষণের উল্লেখ করা যেতে পারে যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘ঈর্ষার প্রকৃতি এবং রূপ’ শীর্ষক রচনায়। সেখানে দেখা যায়, স্ত্রী তাঁর একান্ত আনন্দের উৎস হিসাবে যে-পুরুষ সদস্যকে বিবেচনা করেন, আলমারিতে সংরক্ষিত টিনজাত সামগ্রীর মতো তিনি সেই পুরুষ সদস্যকে কৃপণভাবে রক্ষাও করেন। পুরুষটি যদি তাঁর প্রতিবেশী মহিলাকে কিছুটা পরিমাণেও দেন, তাহলে স্ত্রীর জন্য আর কিছুই থাকবে না। ফলত স্ত্রী সন্দেহজনকভাবে পুরুষ সদস্যের প্যান্ট পরীক্ষা করে দেখেন কোনো মূল্যবান বীর্য নষ্ট হয়েছে কি না। ‘বিবাহের ইতিহাস’ রচনায় জুয়াঁন্দো নির্দেশ করেছেন যে, “বৈধ স্ত্রীর দ্বারা এই প্রত্যেকদিনের নজরদারি, যিনি প্রত্যেকদিন আপনার শার্ট এবং আপনার ঘুম পরীক্ষা করে আবিষ্কার করবেন অপমানের চিহ্ন”। স্বামী অবশ্য স্ত্রীর মতামত না নিয়েই স্ত্রীর ওপর দিয়ে নিজের তৃপ্তি পূরণ করে নেন।
প্রয়োজনের এই পাশবিক তৃপ্তি মানুষের যৌনতা তৃপ্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়। এ কারণেই প্রায়শই অনৈতিকতা ও অধর্মের একটা রেশ থেকে যায় আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে বৈধ আলিঙ্গনে। মাঝেমধ্যেই দেখা যায় মহিলারা কামুক কল্পনার সাহায্য নেন। স্টেকেল ২৫ বছর বয়সি একজন মহিলার কথা উদ্ধৃত করেছেন যিনি : “তাঁর স্বামীর সঙ্গে মিলনমুহূর্তে মৃদু অর্গাজম অনুভব করেন এই কল্পনা করে যে, অন্য একজন শক্তিশালী এবং বেশি বয়স্ক পুরুষ জোর করে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় যাতে তিনি আত্মরক্ষা করতে না পারেন”। তিনি কল্পনা করেন যে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে, মারধর করা হয়েছে। আর এই কাজ যিনি করেছেন তিনি তাঁর স্বামী নন, বরং অন্য একজন। স্বামীও একই স্বপ্ন লালন করেন। স্ত্রীর শরীরে তিনি দেখেন কোনো একটি মিউজিক হলে দেখা এক নৃত্যশিল্পীর উরু, দেওয়ালে আটকানো ছবির মহিলার স্তন যেই ছবি তিনি উপভোগ করেছেন। একটি স্মৃতি, একটি ছবি। অথবা অন্যথায় তিনি কল্পনা করেন তাঁর স্ত্রীকে অন্য কেউ কামনা করেছে, তাঁর স্ত্রীকে অধিকার করে নেওয়া হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে—যা হল অন্য একটি পন্থা যার দ্বারা তাঁর স্ত্রীর হারিয়ে যাওয়া পরিবর্তনকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্টেকেল জানিয়েছেন : “বিবাহ এক উদ্ভট ও বিপরীতমুখী স্থানান্তর সৃষ্টি করে, তৈরি করে চৌখস অভিনেতাদের। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অভিনয় করা এই কমেডি নাটক ভয় দেখায় প্রকাশিত চেহারা এবং প্রকৃত চেহারার মধ্যবর্তী সীমা ধ্বংস করে দেওয়ার। পরিশেষে, প্রকৃত অনৈতিক কাজগুলি প্রকাশিত হয়ে পড়ে। স্বামী হয়ে ওঠেন ঈক্ষণকামী। তিনি তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন, অথবা স্ত্রীর জাদু পুনরায় উপলব্ধি করবার জন্য জেনে নেন যে স্ত্রী অন্য প্রেমিকের শয্যাসঙ্গী। অথবা স্বামী ধর্ষকামীর মতো চেষ্টা করেন স্ত্রীকে এমনভাবে উসকে দিতে যাতে স্ত্রী তাঁর প্রেমিককে প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর বিবেক এবং স্বাধীনতা জাগ্রত হয় এবং স্ত্রী যেন স্বামীর অধিকারে থাকা প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারেন। বিপরীতভাবে, মর্ষকামী আচরণ সেই সব নারীদের মধ্যে তৈরি হয় যাঁরা ছেলেদের মধ্যে প্রভুর ভাব জাগিয়ে তুলতে চান। পুরুষের মধ্যে তাঁরা সন্ধান করেন একজন অত্যাচারীকে, যদিও সেই পুরুষ অত্যাচারী নন। একজন মহিলাকে আমি জানি যিনি কনভেন্টশিক্ষিত এবং খুব ধার্মিক, দিনের বেলা যিনি কর্তৃত্ববাদী এবং আধিপত্যবাদী, অথচ রাতের বেলা প্রবল আবেগে স্বামীর কাছে প্রার্থনা করেন যাতে স্বামী তাঁকে চাবুক দিয়ে পেটান। ভীত হলেও স্বামী অবশ্য এই কাজে সম্মত হন। বিবাহের মধ্যে অনৈতিকতা নিজেই একটি সংগঠিত এবং শীতল দিক গ্রহণ করে। এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যা অনৈতিকতাকে করে তোলে সম্ভাব্য পছন্দগুলির মধ্যে সবচেয়ে দুঃখজনক।
সত্য হল, শারীরিক প্রেমকে একটি চরমতম সমাপ্তি বা একটি নিছক মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। কোনো অস্তিত্বকে ন্যায্যতা দিতে পারে না শারীরিক প্রেম। আবার বাইরের কোনো সমর্থনও শারীরিক প্রেম গ্রহণ করতে পারে না। এর অর্থ হল : শারীরিক প্রেম মানুষের গোটা জীবন জুড়ে অবশ্যই একটি ধারাবাহিক এবং স্বশাসিত ভূমিকা পালন করে যাবে। অর্থাৎ সর্বাগ্রে শারীরিক প্রেমকে অবশ্যই স্বাধীন বা মুক্ত হতে হবে।
(ক্রমশ, আগামী পর্ব —চতুর্দশ)
লেখক: অধ্যাপক ও সমাজকর্মী
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment