বিবাহিত নারী (সপ্তম পর্ব)

  • 03 April, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 604 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
যাই হোক, উনিশ শতক ধরে বুর্জোয়া ধারণাগুলি কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছিল। মধ্যবিত্ত বুর্জোয়ারা বিবাহ রক্ষা এবং বজায় রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। সেন্ট সাইমন, ফুরিয়ার, জর্জ স্যান্ড এবং বাকি সমস্ত রোমান্টিক ব্যক্তিত্ব বেশ হিংস্রভাবেই ভালোবাসার অধিকার দাবি করেছিলেন। এরপরেই ‘বিবাহিত প্রেম’ নামক সন্দিগ্ধ ধারণার জন্ম হয়, যা ছিল ঐতিহ্যগত বিবাহের সুবিধার অলৌকিক ফল।

প্রকৃতপক্ষে, স্বামী যদি মেয়েলি যৌনতা জাগ্রত করেন, তবে তিনি এটিকে সাধারণ রূপে জাগ্রত করেন, যেহেতু তিনি এককভাবে স্ত্রীর দ্বারা নির্বাচিত হননি। তিনি তাঁর স্ত্রীকে প্রস্তুত করছেন অন্যের বাহুতে আনন্দ খুঁজে নিতে। স্ত্রীকে অত্যন্ত বেশি পরিমাণে যত্ন করা নিয়ে মোঁতেইন আবার বলেছেন : “ টুপিতে পটি করে সেই টুপি আবার মাথায় দেওয়া”। যদিও দৃঢ় বিশ্বাসে তিনি স্বীকার করেছেন যে, পুরুষালি দূরদর্শিতা মহিলাদের প্রশংসাহীন অবস্থানে রেখে দিয়েছে।

মহিলারা যখন পৃথিবীতে প্রচলিত জীবনের নিয়মকে প্রত্যাখ্যান করেন তখন তাঁরা মোটেই ভুল করেন না, যেহেতু এই নিয়মগুলি পুরুষেরা তাঁদের ছাড়াই তৈরি করেছিলেন। তাঁদের আর আমাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই কলহ এবং বিবাদ চলছে। অনিচ্ছাকৃভাবে আমরা তাঁদের সঙ্গে নিম্নলিখিত আচরণগুলি করি : যখন আমরা জানতে পারলাম যে মহিলারা আমাদের চেয়ে প্রেমক্রীড়ায় বেশি সক্ষম, বেশি উৎসাহী আর এই ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কোনো তুলনাই চলে না ... তখন ... আমরা চেয়েছি মহিলারা সুস্থ, সবল, ভালো অবস্থায়, ভালোভাবে পুষ্ট এবং একইসঙ্গে সতী থাকুন : অর্থাৎ একইসঙ্গে গরম এবং ঠান্ডা। কারণ, আমাদের রীতিনীতি অনুসারে, বিবাহের কাজ হল কামাতুর দহন থেকে তাঁদের রক্ষা করে তাঁদের কিছুটা স্বস্তি-সতেজতা এনে দেওয়া।

প্রুধোঁ-র মধ্যে দ্বিধা কম ছিল। ‘ন্যায়বিচার’ অনুসারে বিবাহ থেকে তিনি ভালোবাসাকে সরিয়ে রেখেছিলেন।

প্রেমকে অবশ্যই ন্যায়বিচারে সমাহিত করা উচিত ... বাগদত্ত-বাগদত্তা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে-কোনো প্রণয়মূলক কথোপকথনই ঘরোয়া শ্রদ্ধার ধ্বংসসাধক। কাজের প্রতি ভালবাসা এবং সামাজিক কর্তব্যের অনুশীলন ... (একবার প্রেমের অফিস পরিপূর্ণ হয়ে যায়)। ... আমাদের অবশ্যই প্রেমকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিতে হবে রাখালের মতো যে-রাখাল দুধ জমাট বাধার পর চাপ বন্ধ করে দেয়...

যাই হোক, উনিশ শতক ধরে বুর্জোয়া ধারণাগুলি কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছিল। মধ্যবিত্ত বুর্জোয়ারা বিবাহ রক্ষা এবং বজায় রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। অন্যদিকে, প্রাতিস্বিকতার প্রগতি নারীদের দাবি-দাওয়াকে সহজে শ্বাসরোধ করার পথে বাধা তৈরি করেছিল। সেন্ট সাইমন, ফুরিয়ার, জর্জ স্যান্ড এবং বাকি সমস্ত রোমান্টিক ব্যক্তিত্ব বেশ হিংস্রভাবেই ভালোবাসার অধিকার দাবি করেছিলেন। এর ফলে সমস্যা হল বিবাহের মধ্যে ব্যক্তিগত অনুভূতিকে একীভূত করা, যা তখনও পর্যন্ত সহজেই শান্তিপূর্ণভাবে নির্বিঘ্নে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এরপরেই ‘বিবাহিত প্রেম’ নামক সন্দিগ্ধ ধারণার জন্ম হয়, যা ছিল ঐতিহ্যগত বিবাহের সুবিধার অলৌকিক ফল। এই সমস্ত অসংগতির মধ্য দিয়ে প্রতিভাত রক্ষণশীল বুর্জোয়ার ধারণাগুলিকে বালজাক প্রকাশ করেছেন। তিনি চিনতে পেরেছিলেন যে, নীতিগতভাবে বিবাহ এবং প্রেমের মধ্যে বিন্দুমাত্র কোনো একত্র-সম্বন্ধ নেই। তবে বিবাহ নামক শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিবাহ একটি সাধারণ বাজার যেখানে মহিলাদের পণ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয় এমন ধারণাকে আত্মীকরণ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তিনি তাই পৌঁছেছিলেন ‘বিবাহের দেহতত্ত্ব’-র উদ্বেগজনক অসংগতিতে। বালজাক লিখেছিলেন :

রাজনৈতিক, নাগরিক এবং নৈতিকভাবে বিবাহকে একটি আইন, একটি চুক্তি এবং একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে ... বিবাহ তাই অবশ্যই সাধারণ সম্মানের বিষয়। বৈবাহিক সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সমাজ তাই একমাত্র এই তিনটি বিষয়কেই বিবেচনা করতে পারে।

বেশিরভাগ পুরুষ বিবাহের মধ্য দিয়ে প্রজনন, সম্পত্তি এবং সন্তানকেই দেখে থাকেন। যদিও প্রজনন, সম্পত্তি বা সন্তান কোনো কিছুই সুখানুভব প্রদান করে না। বৃদ্ধি এবং বহুগুণিত হওয়া ভালোবাসা বোঝায় না। আইন, রাজা এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে পনেরো দিনের মধ্যে চোদ্দোবার বিয়ের জন্য দেখতে আসা কোনো মেয়েকে প্রেমের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা একেবারে অযৌক্তিক, যা পূর্বনির্ধারিত বা দৈবনির্দিষ্ট হওয়ার যোগ্য।

এটি হেগেলিয়ান তত্ত্বের মতোই স্পষ্ট। তবে, কোনো পরিবর্তন ছাড়াই বালজাক বলে চলেন :

প্রেম হল প্রয়োজন এবং অনুভূতির সামঞ্জস্য। স্বামী-স্ত্রীর আত্মার যথাযথ বোঝাপড়া থেকেই বৈবাহিক আনন্দ জাত হয়। এই মত অনুসরণ করে বলা চলে যে, একজন পুরুষকে সুখী হতে হলে তাঁকে অবশ্যই নির্দিষ্ট কিছু শ্রদ্ধেয় এবং সুমার্জিত নিয়ম মেনে চলতে হবে। সামাজিক নিয়মের সুবিধাগুলি উপভোগ করার পর, যে-নিয়ম ইচ্ছা বা প্রয়োজনকে পবিত্ররূপ দান করেছে, একজন পুরুষকে অবশ্যই প্রকৃতির গূঢ় আইনকে মান্য করতে হবে যা অনুভূতির জন্ম দেয়। ভালোবাসা পাওয়ার ওপর যদি তাঁর আনন্দানুভব নির্ভর করে থাকে, তাহলে তাঁকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসতে হবে : প্রকৃত গভীর আবেগকে কোনো কিছুই প্রতিরোধ করতে পারে না। তবে, প্রকৃত আবেগী হওয়া মানে সর্বদা আকাঙ্ক্ষা থাকা। আপনি কি সর্বদা আপনার স্ত্রীকে আকাঙ্ক্ষা করেন?

--হ্যাঁ।

বালজাক এরপর উন্মোচন করলেন বিবাহের বিজ্ঞানটি। তবে আমরা দ্রুত উপলব্ধি করতে পারি যে, স্বামীর জন্য বিবাহ বলতে বোঝায় ভালোবাসা পাওয়া নয়, প্রতারিত না-হওয়া। কোনোরকম ইতস্তত না করেই নারীর ওপর তিনি আরোপ করবেন নীতিহীন শাসনব্যবস্থা। সমস্তরকম সংস্কৃতি থেকে নারীকে বাদ দিয়ে স্বামীর সম্মানরক্ষার একমাত্র লক্ষ্যে তাঁকে বোকা বানিয়ে রাখবেন। এর পরেও কি একে প্রেম বলা চলে? কেউ যদি এই সব অস্পষ্ট এবং অসংলগ্ন ধারণা থেকে কোনো অর্থ খুঁজতে চান, তাহলে মনে হবে পুরুষের অধিকার আছে এমন এক নারীকে নির্বাচন করা যাঁর মাধ্যমে সাধারণভাবে পুরুষ তাঁর চাহিদা পূরণ করতে পারবেন। এই ‘সাধারণভাব’ আসলে তাঁর বিশ্বস্ততার নিশ্চয়তা। এরপর পুরুষের দায়িত্ব হল নির্দিষ্ট কিছু কৌশল প্রয়োগ করে স্ত্রীর ভালোবাসা জাগ্রত করা। কিন্তু কোনো পুরুষ যদি সম্পত্তি বা বংশধরের জন্য বিয়ে করে তাহলে কি সেই পুরুষটি যথার্থই প্রেমে পড়েছেন বলা যায়?

ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

0 Comments

Post Comment