- 15 November, 2022
- 0 Comment(s)
- 1442 view(s)
- লিখেছেন : মীরা কাজী
কালো রঙের পোশাক বরাবর অপছন্দ মোহনার। তার এই অপছন্দটি বাড়ির সবাই জানে। তাই ঈদে বা অন্য কোনো সময় তার জন্য পোশাক কিনতে গিয়ে কালো রংটি বাদ দেয় তারা। মোহনার বিয়েতে উপহার কেনার সময় নিকট আত্মীয়রাও মোহনার পছন্দটিকে গুরুত্ব দিল। তদের দেওয়া শাড়ি-সালোয়ারগুলোয় কালো রংয়ের ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না। এমনিতেই বিয়েতে কালো রংটিকে সযত্নে বাদ দেওয়া হয়ে থাকে। মোহনার বেলায় একটু যেন বেশি সতর্ক হল সবাই। যা খুঁতখুঁতে মেয়ে! কালো ফুটকি থাকলেও হয়তো ছুঁয়ে দেখবে না!
মোহনার পছন্দ অপছন্দ নিয়ে সবাই যখন এত ভাবছে, তখন তার গায়ে হলুদের দিনে “লগন”এর সুটকেশে কালো রংয়ের একটি পোশাক দেখে সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল। বোরখা! বোরখা দেখে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। অনেকেই পরে। কিন্ত মোহনা যে পরিবেশে বড় হয়েছে, সেখানে বোরখা পরা তো দূরের কথা, সেটা কেমন করে পরতে হয় সেই ধারণাটুকুও তার নেই। বোরখা নিয়ে সকলে যখন গুনগুন করছে, তখন মোহনার মা লায়লা এসে ব্যাপারটা সামাল দিলেন, “বোরখা দিয়েছে বলেই কি মোহনাকে ওটা পরে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে? অনেকেই বিয়ের বাক্সে দেয়। ও সব ছেড়ে, বাকি কাপড়চোপোড়গুলো দেখো তো কেমন দিয়েছে?” বাকি কাপড়চোপোড়গুলো যথেষ্ঠ দামী, প্রসাধন সামগ্রীও সব নামিদামী কোম্পানীর। নজর আছে বলতে হবে মোহনার শ্বশুরবাড়ির লোকের? সবাইকে এক বাক্যে স্বীকার করতেই হল।
বিয়ের রাতে বর দেখে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ, “একেবারে যেন রাজপুত্র! তার উপর আবার কলেজে পড়ায়! তিন জামাইয়ের মধ্যে ছোটই সরেস!” সবার কথা কানে যাচ্ছে মোহনার। তার মনেও রঙিন প্রজাপতিদের ওড়াওড়ি। বোনপো, বোনঝিরা তাকে এমন ভাবে ঘিরে আছে, রেহানের সঙ্গে মুঠো ফোনে কথা বলার অবকাশও পাচ্ছে না সে।
রেহানও তো ফোন করতে পারে? এর মধ্যে রেহান ও মোহনার দু বার দেখা হয়েছে। অন্য দুই দুলাভাই রেহানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, স্বলাজ মোহনা বলেছে, “আপনাদের মত খোলা মনের মোটেই নয়! কেমন যেন মুরুব্বী মুরুব্বী হাব ভাব!”
“সবার মন তো অত সস্তা নয় ভাই! যে প্রথম দর্শনেই হাট করে খুলে দেবে? সবুর কর, ধীরে ধীরে খুলবে।” রেবার বর শফিক ও রুবিনার বর ইরফান মজা করে বলেছে। বাড়ির লোকেরা কেমন হবে কে জানে? মোহনার এই প্রশ্নের উত্তরে রেবা ও রুবিনা বোনকে দু দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, “রেহান আছে না? কোন অসুবিধা হলে ও ঠিক সামলে দেবে। এখন থেকে অত ভাবিস নাতো?”
বরযাত্রীরা সবাই এসে পড়েছে। খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজোব চলছে। রেহানের এক ফুফু এসেছেন, তিনি একাই সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছেন। কখনও বলেন পাখাগুলো ভালো ঘুরছে না। কখনও বলেন খাবার ঠান্ডা। কনে সাজানোর সময়েও তিনি এসে নানা ফিরিস্তি জুড়লেন। খোঁপাটা ঠিক হচ্ছে না। শাড়ির আঁচলটা এভাবে থাকবে। বিউটি পার্লার থেকে আসা মেয়ে দুটি বিরক্ত হয়ে শেষে ভিতর দরজা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল। যথা নিয়মে বিয়ে হয়ে গেল। তিনি বৌকে আশীর্বাদ করে নাকছাবি পরাতে এলেন। কিন্তু মোহনার নাক বেঁধানো নেই। তিনি বুঝি আঁটঘাঁট বেঁধেই নেমেছেন। নাক বিঁধতে পারদর্শিনী এমন একজন মহিলা তাদের সঙ্গেই আছে। সে এগিয়ে এল সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু মোহনা বেঁকে বসল, সে নাক বেঁধাবে না। বরের ফুফু রেগে গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। এ নিয়ে অনেক বাকবিতন্ডা হল, মেয়ের শিক্ষা-সহবত নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হল বরপক্ষের কারো কারো মনে। বিভ্রান্ত মোহনা মাকে চুপি চুপি বলল, “মা! এরা যেন কেমন? কই, আপাদের বিয়েতে তো এমনটা হয়নি? ওখানে গিয়ে আবার যদি--!”
মোহনার মা লায়লা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, “ভাবিস না! উনি পুরোনো আমলের মানুষ! রেহান আছে না? দেখবি কোনো অসুবিধা হবে না?”
এবার বিদায়ের পালা। সবার মন খারাপ। মোহনাও কান্নাকাটি করছে। হঠাৎ মহিলাদের মধ্যে থেকে একজন রেবাকে ডেকে কিছু একটা বলতেই সে চিন্তিত হয়ে তার মায়ের কাছে ছুটে গেল। মোহনার আব্বাও এলেন। তাদের নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা হল। বরপক্ষের কিছুজনও এসে পড়ল। কিছু সময় ধরে কথা কাটাকাটি চলল উভয় পক্ষের মধ্যে। মোহনা এসবের কিছুই জানল না। আপনজনেদের ছেড়ে যাবার বেদনায় তার মন ভারাক্রান্ত। হঠাৎ দুটি মেয়ে এসে তার বেনারসি সজ্জিত চেহারার উপরে একটি কালো রংয়ের বোরখা চাপিয়ে দিল।
“কি, এটা? এটা আমি পরব না!” ছিটকে সরে গেল মোহনা।
“কিন্তু পরতে যে হবেই তোমাকে! “না হলে যে আবার উনি রাগ করবেন!” বলে এমন ভাবে হাসতে লাগল দুজনে, যেন খুব মজা পেয়েছে।
উনিটা যে কে, সেটা বুঝতে বাকি রইল না মোহনার। এসে থেকেই যা কাণ্ড করছেন? মেয়ে দুটি মোহনাকে এক রকম জোর করে বোরখাটি পরাতে শুরু করল। প্রতিবাদের ভাষাও বুঝি হারিয়ে ফেলেছে মোহনা। মাকে দেখতে পেয়ে তার মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গেলে, তার মা সবার কান বাঁচিয়ে বলল, “একবার পরলে কি আর হবে?”
মোহনা কান্না জড়ানো গলায় বলল, “যদি আবার পরতে বলে?” নিজের কান্না গিলে ফেলে, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, “বলবে না, রেহান আছে না?” কাঠ পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থেকে মেয়ে দুটিকে সহ্য করল মোহনা।
গাড়ীতে মোহনার পাশে রেহান। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায়নি ইকোনমিক্স এম এ-এর প্রথম বর্ষের ছাত্রী মোহনা। রেহান ইরফান ভাইয়ের বন্ধু রাশেদের ছোটভাই। সেই সুত্রে ইরফান রেহানকে চেনে। রাশেদ মোহনাদের বাড়ি অনেক বার এসেছে। সেই বিয়ের প্রস্তাবটি রাখে ইরফানের কাছে। প্রস্তাবটি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় মোহনার আব্বার কাছে। ছেলেটির কেরিয়ার ভাল। কিছুটা হলেও পরিচিত। আজকাল অনেক মেয়েই তো বিয়ের পরে পড়াশোনা করছে। মোহনার আপত্তি খড়কুটোর মত ভেসে যায়। তার পড়াশোনা এখনও শেষ হয়নি। গান শেখাও অর্দ্ধসমাপ্ত। পড়াশোনা শেষ করে বৃহত্তর জগতে নিজস্ব পরিচিতি অর্জন করতে চায় সে। নতুন পরিবারে তার স্বপ্ন পূরণ হবে তো? এই সব ভাবনা থেকে রেহাই পেতে “রেহান আছে না?” বারবার শোনা এই বাক্যটিকে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে থাকে মোহনা। এরই মাঝে রেহান কয়েক বার জিজ্ঞেস করেছে মোহনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা।
রেহানকে একটু একটু ভাল লাগতে শুরু করেছে তার। একটা ধাবায় গাড়ি থামানো হলে, সবাই হুড়মুড় করে নেমে পড়ে। মোহনাকেও ডাকে রেহান। মোহনা নামার উদ্যোগ করতেই, “আহ!” বিরক্ত রেহান, বোরখার যে অংশটি এতক্ষণ মোহনা মাথার ওপর তুলে রেখেছিল সেটিকে টেনে নামিয়ে দেয়। দম বন্ধ হয়ে আসে মোহনার। রেহান কি শুধু তার চেহারাটির ওপর কালো পর্দা টেনে দিল? নাকি তার সাথে সাথে মোহনার আজন্ম লালিত যাবতীয় স্বপ্নের, স্বাধীনতার, আলোকিত জগতের সাথে তার সম্পর্কের যবনিকাপাত ঘটে গেল? রেহানের মুখ নিঃসৃত “আহ!” শব্দটি এবং তার পরবর্তী কাজটি মোহনার মধ্যে তীব্র আভিঘাত সৃষ্টি করে। তার উপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় আবদার, যা বিগত কয়েকদিন ধরে সহ্য করার চেষ্টা করছিল মোহনা, মুহূর্ত্তের মধ্যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে সে। ক্ষিপ্র হাতে কালো বোরখাটি থেকে নিজেকে মুক্ত করে সেটিকে ছুঁড়ে ফেলে, একটা চেয়ার দখল করে বসে পড়ে মোহনা। এখন এক কাপ কড়া চা তার চাই।
ছবি : নেট থেকে সংগৃহীত
লেখক : গল্পকার
পুন:প্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ৩০ মে, ২০২০
0 Comments
Post Comment