- 19 May, 2023
- 0 Comment(s)
- 2612 view(s)
- লিখেছেন : শাম্মা বিশ্বাস
‘তোমরা যদি হিজাব
পরো
লাগবে অনেক ভালো
সবাই তোমায় বলবে দারুণ
হও যদি তাও কালো।..’
কিছুদিন আগে হিজাব বা বোরকা নিয়ে পড়তে গিয়ে গুগল সার্চ করছিলাম, তখনই এই কবিতাটি চোখে পড়ে। কবিতার লেখক হয়ত সেরকম বিখ্যাত নন। তবে তাঁর মানসিকতা দেখে প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। কালো মানেই খারাপ, আর সেই কালো রঙকে ঢাকতে নাকি বোরকা পরতে হবে। তাহলে সবাই দারুণ বলে বাহবা দেবে। পিতৃতান্ত্রিক ভাবনা কী অবলীলায় আজও কবিতার ছন্দে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে। মুসলিম সমাজের কিছু মানুষ, ছোট থেকেই একটা মেয়ের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় পুরুষের কুদৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করতে বোরকা পরা জরুরি, তাতে তার সম্ভ্রম বজায় থাকবে। মেয়েদের আপাদমস্তক পোশাকে ঢেকে রেখে সম্ভ্রম বা নিরাপত্তা তৈরি করার অর্থটা কী দাঁড়াতে পারে? পুরুষরা খুব খারাপ, লোলুপ দৃষ্টি, ক্ষতিকারক। তাহলে যারা ক্ষতিকারক, বিঘ্ন ঘটাতে পারে, নিরাময় তো তাদের দরকার। পুরুষের কুদৃষ্টির ভোগান্তি মেয়েদের নিতে হবে কেন? আর ছেলেদের নজর থেকে মেয়েদের আড়াল করে রাখতে হবে, এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই রয়েছে ছেলেদের প্রতি অবিশ্বাস ও অসম্মান করার প্রবণতা। বোরকা পরলেই নিরাপত্তার বলয় তৈরি হয় না। দুষ্কৃতীর হামলা বোরকা পরিহিতকেও রেহায় দেয় না। অবশ্য যাঁরা এই পোশাক সংস্কৃতির চর্চা করেন, তাঁদের ধারণা হচ্ছে এতে মেয়েদের শালীনতা, ইজ্জত বজায় থাকবে। রোকেয়া অবরোধবাসিনী-র তের সংখ্যক লেখাতে দেখিয়েছেন একটি ন’বছরের মেয়ে চোখঢাকা বোরকা পরে আয়ার সঙ্গে স্কুলে যাতায়াতের পথে কখনও বিড়ালের গায়ে পড়ছে, কখনও হোঁচট খাচ্ছে, কখনও চায়ের পাত্রবাহী লোকের গায়ে ধাক্কা খেয়ে চা ফেলে দিচ্ছে। মেয়েটির চলাফেরায় বোরকাজনিত দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রোকেয়া লিখলেন, ‘দেখুন দেখি, হীরার বয়স ৯ বৎসর- ‘এতটুকু বালিকাকে ‘অন্ধ বোরকা’ পরিয়া পথ চলিতে হইবে! ইহা না করিলে অবরোধের সম্মান রক্ষা হয় না!’
গ্রীষ্মের দম বন্ধ করা গরমেও তোমার শালীনতা বজায় রাখার জন্য তোমাকে বোরকা পরতে হবে। বর্ষায় জবজবে ভিজে গেলেও তুমি বোরকা খুলতে পারবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, মেয়েদের শরীরকে আড়াল করার প্রবণতার মধ্যেই কি লুকিয়ে নেই কুৎসিত ঈঙ্গিত?
এই বোরকার মধ্যে একটা মেয়ে শুধু নিজের শরীর ঢেকে রাখে তা নয়, শরীরের সাথে সাথে কিছু ইচ্ছে, ভাললাগাও গুমরে মরে। হয়ত একটি মেয়ের বন্ধুদের দেখে খুব শখ হল সেও নাচ করবে। মঞ্চ মাতিয়ে নাচবে, মাঠ দাপিয়ে খেলার প্রতিযোগিতা করবে। সেই সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে ছোটার গতি কি এই পোশাক দিতে পারবে? চর্চা অনুযায়ী জীবন তৈরি হয়। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করেছে এই পোশাক বিধি। উদ্দেশ্য মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করা। এ প্রসঙ্গেও আমরা আশ্রয় নেব রোকেয়ার কাছে। ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এ ভগিনী সারার সঙ্গে সুলতানা নারীস্থানে গিয়ে দেখলেন সেখানে কোন মেয়ে বোরকা পরে না। প্রকাশ্য রাস্তায় বোরকাহীন মেয়েদের চলাফেরা দেখে বিস্মিত সুলতানা। নারীস্থানের মেয়েরাই দেশ চালানোর সব দায়িত্ব নিয়েছে। ‘পর্দানশীন স্ত্রীলোক’ সুলতানাকে সারা বলেছে, ‘...দোষ কার, বন্দী হয় কে! কিন্তু বলি, আপনারা ওসব নিগড় পরেন কেন?...কেবল শারীরিক বল বেশী বলিয়াই কেহ প্রভুত্ব করিবে, ইহা আমরা স্বীকার করি না। সিংহ কি বলে বিক্রমে মানবাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নহে? তাই বলিয়া কি কেশরী মানবজাতির উপর প্রভুত্ব করিবে? আপনাদের কর্ত্তব্যের ত্রুটি হইয়াছে, সন্দেহ নাই। আপনারা সমাজের উপর কর্ত্তৃত্ব ছাড়িয়া একাধারে নিজের প্রতি অত্যাচার এবং স্বদেশের অনিষ্ট দুই-ই করিয়াছেন। আপনাদের কল্যাণে সমাজ আরও উন্নত হইত—আপনাদের সাহায্য অভাবে সমাজ অর্দ্ধেক শক্তি হারাইয়া দুর্ব্বল ও অবনত হইয়া পড়িয়াছে।’
মেয়েরা কী চায় তার স্বাধীনতা তাদের দেওয়া হয় না। ছোট থেকেই তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় পিতৃতন্ত্রশাসিত সমাজের ইচ্ছে। বোরকাও তার বাইরে নয়। ছোট থেকে বা একটা বয়সের পর অনেক পরিবারে বোরকা বাধ্যতামূলক। যেসব মেয়েরা পছন্দ না হলেও পরে, তাদের কখনও কখনও দেখেছি অভিভাবক ও পাড়ার চৌহদ্দি পেরিয়েই বোরকা ব্যাগে ভরে নিচ্ছে। ফলে কোনটা পরবে আর কোনটা পরবে না, সেটা মেয়েরা নিজেরাই ঠিক করুক। আর সেই সঙ্গে ভাবতে শিখুক মেয়েদের শরীর আপাদমস্তক ঢেকে দিয়ে আগলে রাখার পিতৃতান্ত্রিক ভাবনা সত্যিই কি সম্মানজনক?
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ৭ অক্টোবর ২০২০
লেখক : বাচিকশিল্পী
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment