- 16 September, 2021
- 0 Comment(s)
- 515 view(s)
- লিখেছেন : ময়ূরীকা মুখোপাধ্যায়
সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, হিন্দুকুশের কোল ঘেঁষা ‘কাবুলিওয়ালা’র দেশে কুয়াশার বদলে হঠাৎই চারিদিক ঘোলাটে হয়ে গেল বারুদের গন্ধে। বন্দুকের নল বেয়ে নেমে এল অন্ধকার। সে অন্ধকার অক্ষাংশ - দ্রাঘিমাংশ মানে না, মানে না বয়স-কালের ভেদাভেদ। সে অন্ধকার শুধু বশ্যতা স্বীকার করতে জানে, নীচু হয়ে জবাবদিহি করতে জানে ট্রিগারের কাছে। আমাদের যাদের রাতের বেলা গোলা-বারুদের বদলে এ. সি’র ফ্যান মোডের শুষ্কতার শব্দ শোনার অভ্যেস, তারা যেমন জানি না সেই অন্ধকারের স্বরূপ - ঠিক তেমন ভাবেই হয়তো বা অনুভবও করতে পারি না, সেই অন্ধকার খুঁড়ে আলো খোঁজার সংগ্রাম। আমরা খালি বিস্মিত হই, অনুপ্রাণিত হই সেই সব ঘটনার থেকে - যারা স্বমহিমায় ইতিহাস হয়ে উঠেছে। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে সেই বন্দুকের নলের সামনে, ট্রিগারের সেই অদ্ভুৎ বিজ্ঞানের সামনে।
হেরাৎ। আফগানিস্তানের পশ্চিম প্রান্তে, হরি নদীর উপত্যকা সংলগ্ন, দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ও ইসলামিক সংস্কৃতির পীঠস্থান। আর সেখান থেকেই শুরু একটা রূপকথার লড়াই। যে লড়াইয়ের নাম নাদিয়া নাদিম। যে নাদিয়া নাদিমকে সারা বিশ্ব চেনে তাঁর পায়ের জাদুতে। তবুও, সেই জাদুবাক্সের ভিতরকার অন্ধকারটা সম্পর্কে হয়তো অনেকেই অবগত নন। যে অন্ধকারের অতল গভীরতা তিলে তিলে তৈরি করেছে তাঁকে। রূপদান করেছে সর্বকালের সেরা একটি সৃষ্টির। একটি সুস্থ স্বাভাবিক শৈশব পেতে পেতেও পাওয়া হয়নি নাদিমের। ২০০০ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের সময়, বারো না পেরোনো একটি মেয়ে দেখল, তাঁর বাবাকে ক্ষমতালোভী কিছু উগ্রপন্থীদের হাতে নৃশংস ভাবে খুন হতে। যিনি পেশায় ছিলেন আফগানিস্তান আর্মির জেনারেল। একদিকে স্বজন হারানোর যন্ত্রণা, অন্য দিকে স্বৈরাচারী আতঙ্ক। নাদিম এবং তার পরিবার বাধ্য হল নিজেদের দেশ ছাড়তে। গন্তব্য লন্ডনের উদ্দেশ্যে থাকলেও, প্রায় পঞ্চাশ ঘন্টা দীর্ঘ যাত্রার পর ভাগ্যের ফেরেই হোক বা ভবিতব্যের জোর, তারা অবশেষে পৌঁছল ডেনমার্কের একটি ছোট্ট গ্রামে। নতুন আশ্রয় হল শরণার্থী শিবির। নতুন পরিচয় হল শরণার্থী। নিজেদের মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও, নাদিয়া নাদিমের বাকী জীবনটুকুর শাখা-প্রশাখার বিস্তার শুরু এখান থেকেই। জীবনে সেই প্রথমবার সে দেখল, শরণার্থী শিবিরের ঠিক পাশের সুবিশাল প্রান্তরে একটি মেয়েকে ফুটবল পায়ে। স্বপ্নের উড়ানদের আকাশ পেতে খুব বেশি দেরি হল না।
কিন্তু যেখানে আকাশ থাকে, যেখানে উড়ান থাকে, সেখানে থাকে পড়ে যাওয়ার ভয়ও। সমান্তরাল ভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে থাকে সংঘর্ষ। নাদিমের ক্ষেত্রে সে লড়াইয়ের পরিধি ছিল অনেক বেশি। নিজের অস্তিত্ব খোঁজার পাশাপাশি আর্থিক কিংবা সামাজিক সংঘর্ষের কাঁটাতারও পেরোতে হয়েছে তাকে। ভাঙা স্কুটারে, অন্ন সংস্থানের জন্য খবরের কাগজ বিক্রি করতে হয়েছে। তবু স্বপ্ন দেখা থামেনি। অদম্য জেদ, অসীম ইচ্ছেশক্তি, এবং স্বপ্নকে তাড়া করার অপরিসীম সাহস, নাদিয়া নাদিমকে এনে দাঁড় করালো সেই রূপকথার সামনে। সালটা ২০০১, আলবার্গের বি-ফিফটি টু ক্লাবের মাধ্যমে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ ঘটল সেই রূপকথার। আফগানিস্তানের গোলা-বারুদের ভয়াবহতা থেকে ডেনমার্কের স্টেডিয়ামের উত্তেজনা ... এই সুদীর্ঘ পথ, তিলে তিলে তাঁকে অনন্যা থেকে অসামান্যা করে গড়ে তুলেছে প্রতিনিয়ত।
তারপরে আর খুব বেশি ফিরে তাকাতে হয়নি নাদিমকে। এরপর একে একে স্কাই ব্লু এফ. সি, পোর্টল্যান্ড থ্রোনস্, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, পারি-স্যাঁ-জার্ম্যাঁ এবং বর্তমানে রেসিং রুইস ভিল্লি।
নাদিম যে ক্লাবেই গেছেন সমৃদ্ধ করেছেন। সমৃদ্ধ করেছেন ফুটবলকে। সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর দেশও। যে দেশ তাঁকে আগলে রেখেছে, পালন করেছে, সম্মান করেছে তাঁর সঞ্চিত সাহসের, পরখ করতে পেরেছে তাঁর প্রতিভার। আর সেই কারণেই হয়তো, ‘শরণার্থী’ নাদিমকে দেশের জাতীয় দলে খেলানোর জন্য ড্যানিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন দাঁতে দাঁত চেপে আইনি লড়াই লড়ে গেছে ফিফার সঙ্গে। যার ফল স্বরূপ পঁচাশিরও বেশি ম্যাচের অভিজ্ঞতা আজ নাদিয়া নাদিমের ঝুলিতে। শুধুমাত্র ক্লাবের হয়েই গড়ে ফেলেছেন দুশোটিরও বেশি গোলের রেকর্ড!
নাদিয়া নাদিম, সবুজ ঘাসে ঘেরা, ফ্লাড লাইটের ঝলকানিতে চমকিত রূপকথার রাজ্যের একজন অনন্য রাজকন্যা। নাম, যশ, খ্যাতি, স্বীকৃতি খুব সহজাত ভাবে, প্রাকৃতিক নিয়মে এসেছে তাঁর কাছে। তাও মাটির কাছাকাছি কখনো থাকতে ভোলেননি নাদিয়া। শরণার্থী শিবিরের পাশের সেই মাঠ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ছেঁড়া বল জমা দিয়ে নতুন বল ছোঁয়ার যে উচ্ছ্বাস তাঁর ছিল, সেই একই উচ্ছ্বাস, একই উদ্দীপনা পরবর্তীকালে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর প্রত্যেকটা শটের ভিতরে।
ফুটবল এবং নাদিয়া নাদিম। এই শব্দবন্ধনীর মধ্যে 'প্যাশন' শব্দটাও কখনও কখনও যেন ছোটো হয়ে যায়, আর সেখানে জায়গা করে নেয় শুধুই বিস্ময়, আর ভালোলাগা। তবে শুধুই ফুটবল জগতের ঘেরাটোপ দিয়ে নাদিমকে আটকে রাখলে, সেটা অনেকটাই ভুল হবে।
সেদিনের সেই গভীর রাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসা ভয়ার্ত, ক্ষুধার্ত নাদিম আর তাঁর পরিবারকে ডেনমার্কের এক পুলিশ অফিসার নিজের আশ্রয়ে নিয়ে গিয়ে, সামান্য খাবার এবং জল দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এ ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে খুবই স্বাভাবিক হলেও এগারো বছরের নাদিয়াকে ড্যানিশ পুলিশ অফিসারের এই ছোট্ট একটি ব্যবহার সাংঘাতিক ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেই থেকেই তিনি চেয়েছিলেন নিজের কাজের মাধ্যমে সমাজে কিছু প্রভাব ফেলতে। নাদিম চেয়েছিলেন ডাক্তার হতে। সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর জনৈক ব্যক্তি নাদিমকে ডাক্তার অথবা ফুটবল যেকোনো একটাকে গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন। কিন্তু নাদিমদের জীবনে যে অপশনের কোনো জায়গা থাকে না। ফলস্বরূপ ফুটবলার নাদিয়া নাদিমের ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ডাক্তার নাদিয়া নাদিমের। ফুটবল চর্চার পাশাপাশি নাদিম আজ আরহুস ইউনিভার্সিটির একজন ডাক্তারীর ছা্ত্রী। স্বপ্ন ছোঁয়াকে নাদিম আসলে অভ্যেস বানিয়ে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এতকিছুর পরেও নাদিয়া নাদিমের আরেকটি বিশেষত্ব হল, তিনি মাতৃভাষা ছাড়াও পৃথিবীর আরো নয়টি ভাষায় সাবলীল! বিস্ময় ?
সফল ফুটবলার, ভবিষ্যৎ ডাক্তার, দায়িত্ববান সন্তান, কৃতী ছাত্রী - সর্বোপরি নাদিয়া নাদিম আদতে সাহস ও আত্মবিশ্বাসের আরেক নাম। চোখে চোখ রেখে লড়াই করার নাম ...
নাদিয়া নাদিম সেই সরলতার নাম, একটি সততার নাম - যার জেরেই এতগুলো বছর পরেও শৈশবের ফেলে আসা দেশ, ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি সুন্দর পরিবারের স্বপ্ন, নাদিমকে আজও ভাবিয়ে তোলে। অবসরে তাড়া করে বেড়ায়। যে ভাবনারা ঠাঁই পায় তাঁর চোখের মণিতে, হৃদয়ের মণিকোঠায়।
নাদিয়া নাদিম এক প্রতিবাদের নাম
নাদিয়া নাদিম এক সহানুভূতির নাম
নাদিয়া নাদিম এক ইচ্ছেশক্তির নাম। যে ইচ্ছেশক্তিকে ভর করে কাঁটাতারের ক্ষতকে নিয়েও উঠে দাঁড়ানো যায়, করে দেখানো যায় অনেক কিছুই। পরিশেষে নাদিয়া নাদিম এক অনুপ্রেরণার নাম ...
নাদিয়া নাদিমেরা ভালো থাকুক
আর ভালো থাকুক ফুটবল
ভালো থাকুক সেই সমস্ত ছাই চাপা আগুন
আর এই পৃথিবীর মহাযজ্ঞে আহুতি দিক নিষ্ঠা, পরিশ্রম, অধ্যবসায়
দাউ দাউ করে প্রাণ পাক ইচ্ছেরা, স্বপ্নেরা
বারুদ নয় – বরং সাফল্যের ধোঁয়াতেই আজ সবদিক ভরে উঠুক ... জন্ম হোক কোটি কোটি নাদিয়া নাদিমের।
লেখক: কবি ও শর্ট ফিল্ম নির্মাতা
ছবি: সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment