নেটদুনিয়ার থোড়-বড়ি-খাড়া

  • 11 June, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 329 view(s)
  • লিখেছেন : অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
কোভিডের সময় থেকেই সম্ভবত এই ভিডিওকারীদের আবির্ভাব। কোভিডের আগে এইসব ভিডিও খুব বেশি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মহামারির কারণে বহু মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছে, ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, যেসব মেয়েরা এতদিন শুধুমাত্র গৃহশ্রম দান করত, ঘরের বাইরে বেরিয়ে এতদিন কোনো জীবিকা গ্রহণ করেনি, তারা আজ ঘরে থেকেই রোজগারের উপায় করে নিয়েছে, সংসারের হাল ধরতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

ফেসবুকের নিউজফিড ঘাঁটতে ঘাঁটতে না চাইলেও চলে আসে এই ধরনের রিল বা অল্প সময়ের ভিডিও। একটি মেয়ে, যে প্রোফাইলে নিজের নাম রেখেছে ‘গ্রামের মেয়ে’, হাতকাটা নাইটি পরে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে যৌনইঙ্গিতবাহী নানান রসিকতায় ভরপুর ভিডিও করে। কথাবার্তা শুনে বোঝা যায় খুব বেশি লেখাপড়া শেখেনি। একদিন শুনলাম, নানা রকম মুখভঙ্গী করে বলছে, ‘তোমাদের খুশি করার জন্য আমার বুক-পেট দেখালাম তাও তোমরা ‘লাইক’ দিচ্ছ না। আমার চ্যানেলে ‘সাবস্ক্রাইব’ করছ না !’ ঘরদোর আসবাবপত্রের অভাব-অনটনের স্পষ্ট লক্ষণ। আরেকটি রিলে দেখলাম, একজন মধ্যবয়সী মহিলা, নাম লেডি সোনু, মাটিতে বসে হাঁটুর ওপর নাইটি তুলে বসে ভাত খাচ্ছে আর বলছে, ‘আহা! কী ভালো রান্না করেছি! কী ভালো খাচ্ছি। বারবার পায়ের অবস্থান পরিবর্তন করছে। পাশে একজন পুরুষও বসে খাচ্ছে। কথোপকথন শুনে বোঝা যাচ্ছে পুরুষটি মহিলার স্বামী। মাঝে মাঝে মহিলা এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে তার দিকে। আরেক মহিলা, যিনি নিজের নাম রেখেছেন ‘মিষ্টি বউদি’, বাড়ির কলতলায় নাইটি পরে বসে স্নান করছে এবং দর্শকদের তার সঙ্গে স্নান করতে আহ্বান জানাচ্ছে। আরেকটি ভিডিও দেখে চক্ষু চড়কগাছ। একটি সাদামাটা মেয়ে নাইটি পরে বক্ষ সম্পূর্ণ উন্মোচিত করে শিশুকে দুগ্ধপান করাচ্ছে। চোখ মুখে ক্লান্তির ছাপ। এই মেয়েদের প্রত্যেকের মাথা ভর্তি সিন্দুর, হাতে শাখা পলা। অর্থাৎ তাদের বিবাহিত মর্যাদার সমস্ত লক্ষণ তারা বয়ে নিয়ে বেড়ায়। অনেক সময় তাদের নাবালিকা কন্যারাও ভিডিওতে সামিল হয়, মায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নানান রঙ্গ-রসিকতা করে। কোনও কোনও ভিডিওতে স্বামী-স্ত্রীকে একসঙ্গে পাই। তারা তাদের অন্তঙ্গতার কিছু মুহুর্ত ভিডিও করে মেলে ধরে সকলের সামনে, নিজেদের মধ্যে রঙ্গ-রসিকতা, মান-অভিমান, খুনসুটি করে।।

 

ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম ও ফেসবুকে এই মহিলাদের ক্রমবর্ধমান দাপট। না চাইলেও চলে আসে তাদের ভিডিও।  নেটনাগরিকদের হাজার হাজার ‘লাইক’ পেয়েও তাদের মন ভরে না। আরো ‘লাইক’ দিতে দর্শকদের অনুনয় বিনয় করে, অভিমানে ঠোঁট উল্টোয়। এদের কমেন্ট বক্সে উপচে পড়া মন্তব্য। মন্তব্যকারীদের মধ্যে মহিলারাও থাকে। মহিলারা তীব্র ভাষায় এদের আক্রমণ করে। এদের ‘নোংরামি’র বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে। রোজগারের এই পন্থাকে নিন্দা করে, স্বামীর রোজগার, পরিবারের শিক্ষা-দীক্ষার মান নিয়ে কথা তোলে। পুরুষদের একটি ছোট অংশ মহিলাদের মতো একটা উচ্চতর নৈতিক অবস্থান নিলেও তাদের বেশির ভাগ নানান অশ্লীল মন্তব্যে ভরিয়ে দেয় কমেন্ট বক্স। বোঝাই যায়, তারা এই ভিডিওগুলো তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। আবার এইসব মহিলাদের ‘রোস্ট’ করে কেউ কেউ ভিডিও বানায়। সেইসব ভিডিওর দর্শকও অনেক। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মেয়েরাও যে এই বিষয়ে পিছিয়ে নেই তার প্রমাণ মেলে। এরা ভিডিওর মাধ্যমে বিয়ের পাত্র খোঁজে, রাতের সঙ্গী খোঁজে।  

 

এইসব ভিডিও থেকে আয় হয়। নির্দিষ্ট সংখ্যার লাইক বা ফলোয়ার/সাবস্ক্রাইবার পেলে অর্থ সমাগম হতে থাকে। তারকাদের রিলের থেকে এদের দর্শক বা লাইকের সংখ্যা কিছু কম নয়। বলাই বাহুল্য অন্তর্জাল-নির্ভর সামাজিক মাধ্যম বহু মহিলার রোজগারের উপায় হয়ে উঠেছে। রোজকার ঘরকন্নার থোড় বড়ি খাড়া বা নিজেদের যৌনতাকে পুঁজি করে তারা রোজগার করতে চাইছে। একটি মেয়ে সেদিন ঘরের কোণে একটা চালের বস্তা দেখিয়ে বলল, ‘তোমরা জিজ্ঞেস করো, কেন আমি ভিডিও করি? এই দেখো এই চালের বস্তাটা কিনেছি ভিডিওর টাকায় । আগে বরের টাকায় ছোট বস্তা আসত। এখন আমি রোজাগার করতে শুরু করায় বড় বস্তা কিনতে পারছি।’

 

কোভিডের সময় থেকেই সম্ভবত এই ভিডিওকারীদের আবির্ভাব। কোভিডের আগে এইসব ভিডিও খুব বেশি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মহামারির কারণে বহু মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছে, ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, যেসব মেয়েরা এতদিন শুধুমাত্র গৃহশ্রম দান করত, ঘরের বাইরে বেরিয়ে এতদিন কোনো জীবিকা গ্রহণ করেনি, তারা আজ ঘরে থেকেই রোজগারের উপায় করে নিয়েছে, সংসারের হাল ধরতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এবং গালমন্দের পাশাপাশি কিছুটা স্বীকৃতিও হয়তো মিলেছে। একজন মেয়ে জানালো তাকে আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশী- মহলে বিস্তর নিন্দার মুখোমুখি হতে হয় ঠিকই কিন্তু তাদের সঙ্গে সেলফি তুলতে চায় রাস্তায় বেরোলে এমন লোকও কম নয়। এদের ঘরদোর অতি সাধারণ অগোছালো কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। দামী পোষাক, মেকআপ কোনটাই নেই। সস্তার হাতকাটা নাইটি, ঠোঁটে একটু লিপস্টিক আর সিঁদুর থাকলেই বৌদিদের বাজিমাত!

আবার নির্ভেজাল ঘরকন্নার কথা নিয়ে কেউ কেউ ভিডিও করেন। হরেক রকম রান্না শেখান, সুস্থ থাকার নানা টোটকা বাতলান, ঘরকন্নার নানান টিপস। কেউ আবার রোজকার ঘরের কাজের ধারাবিবরণী দেয়। আজ কি রাঁধলাম, কি খেলাম, বিছানায় কোন চাদর পাতলাম, বাচ্চাকে স্কুলে কি টিফিন দিলাম -- এই প্রতিদিনকার ঘরকন্নার কথা। আবার কেউ অসুস্থ। কর্কট বা অন্য কোনও মারণ রোগে আক্রান্ত। তার স্ত্রী বা স্বামী রোজ ভিডিও করে রোজকার খবর দিচ্ছে, ডাক্তার কি বলল, টেস্ট রিপোর্টে কি বলছে, রান্না করে কি খাওয়ানো হল, ইত্যাদি।  সহানুভূতির ঢেউ উঠছে। তবে এদের সংখ্যা কম। নাইটি পরা রঙ্গবতী বৌদিদেরই সোশ্যাল মিডিয়ায় দাপট বেশি। তাদের ভিডিয়োর প্রতি হাজারে হাজারে বর্ষিত হয় ভাললাগার আবেগচিহ্নটি, কাতারে কাতারে অনুগামীদের ভিড় তাদের চ্যানেল বা মুখপুস্তিকার পৃষ্ঠায়। এই সব ভিডিয়োকে ঘিরে যৌনসুড়সুড়িলোভী পুরুষদের উন্মাদনা তুঙ্গে।

 

সোশ্যাল মিডিয়া সাধারণ মেয়েদের জীবনে এইভাবে এক অভূতপূর্ব এক বিপ্লব এনেছে। ঘর ও বাহির একাকার করে দিয়েছে। রোজগার করতে হলে আর বিশেষ কোন শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ দরকার নেই। রোজকার রাঁধা-বাড়া-খাওয়া এবং যৌনতাকে পুঁজি করে ঘরে থেকেই উপার্জনের রাস্তা খুঁজে পেয়েছে বহু মেয়ে। এমনিতেই কোভিডের সময় থেকেই ঘর-বাহির একাকার হয়ে গেছে। স্কুল কলেজ পড়ুয়া ও তাদের শিক্ষকেরা আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গেলেও বহু বেসরকারী সংস্থা কর্মীদের ঘরে বসে কাজ করাটাই পছন্দ করে। এখন work from home ই দস্তুর। আর্থিক দিক থেকে এটাই লাভজনক। আর যেসব মেয়েরা এতদিন কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে ছিল তাদের কাছে এখন ঘর ও হাতের মোবাইলটি হয়ে উঠেছে জীবিকা উপার্জনের সহজ একটি রাস্তা। বিবাহিত নারীর স্বামীর প্রতি অখন্ড যৌন আনুগত্যের আদর্শ হয়তো লঙ্ঘন করে এই মেয়েরা । নারীর শরীর যে একমাত্র তার স্বামীর ভোগের বস্তু এই ধারণাকে তোয়াক্কা না করেই এই মেয়েরা গার্হস্থ্যজীবনে প্রোথিত হয়েও এইসব যৌনগন্ধী ভিডিও বানানোর নেশায় মেতে ওঠে। স্বামীর সায় বা সহায়তা কখনো থাকে আবার কখনো থাকে না। এদের রোজগার হয়তো পরিবারের জন্য, সন্তানদের জন্য, বেকার স্বামীর রোজগারের খামতি পূরণ করার জন্য, অথবা নিজেদের সখ-সাধ মেটানোর জন্য। সমাজের এক অংশের মেয়েদের এই প্রবণতা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের আরো গভীর অনুসন্ধান জরুরি।              

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment