- 26 February, 2021
- 0 Comment(s)
- 1584 view(s)
- লিখেছেন : খাদিজা বানু
নদীয়া জেলার রেজিনা আর আসলামের স্বামী–স্ত্রীর সম্পর্ক যথেষ্টই ভাল। হঠাৎ রাত্রে একদিন কথা কাটাকাটি দুজনের মধ্যে। তারপর ঝগড়া ও চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়। আসলাম মদ খায় না। তবে বন্ধুদের চাপে দু–একবার খেয়ে ফেলেছে। সেদিনের ঝগড়া সেই কারণেই। মাধ্যমিক পাশ রেজিনা আসলামের মদ খাওয়া কিছুতেই মানতে পারে না। রেজিনা থামে না। রাগের পারদ আসলামের বেড়ে গেল। বে–সামাল অবস্থায় আসলাম বলে—‘তালাক তালাক তালাক’। বিশাল ঝড়ের পর পরিবারে হঠাৎ করে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। রেজিনা বাকরুদ্ধ। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হল গা–লাগা প্রতিবেশীদের আগমনে। ঝগড়ার সময় কেউ থামাতে না আসলেও ‘তালাক’ শব্দে ছুটে এসে কিছু মহিলা এই শব্দ বলার জন্য আসলামকে অনেক তিরস্কার করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরুষরা এসে নির্দেশ দিল আসলামের ঘরে রেজিনার আর থাকা চলে না। বাবার বাড়ি অনেক দূরে। রাত্রে পাঠানো যাবে না। রাত্রে প্রতিবেশীদের ঘরেই থাকতে হবে। বাক্হীন রেজিনাকে টেনে নিয়ে গেল প্রতিবেশীরা। ছোট সন্তানদের তখনও রাতের আহার সম্পূর্ণ হয়নি। পরের দিন থেকেই আসলাম চরম অনুতপ্ত। রেজিনাকে ফিরে পেতে চায়। রেজিনার বাবার বাড়িতে লোক পাঠানো হল, রেজিনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন মোড়লদের বিধান ‘তালাক’ শব্দে রেজিনা অপবিত্র হয়েছে। তাকে হালাল হতে হবে। অর্থাৎ তাকে পবিত্র হতে হবে। ফলে পবিত্র হতে হলে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিবাহ। স্বামী–স্ত্রীর সম্পর্ক। সে তালাক দিলে পুনরায় আসলামের সাথে নিকাহ্ এবং পূর্বের স্বামীকে ফিরে পাবে। রেজিনা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে না করেই সে আসলামের ঘর অর্থাৎ নিজের ঘর, স্বামী এবং সন্তানদের কাছে ফিরে যাবে। ধর্মান্ধ পিছিয়ে পড়া সমাজের মানুষ সেটি মেনে নিল না। সমাজের প্রবল চাপে জোর করে রেজিনার বিয়ে দেওয়া হয় অন্য পুরুষের সঙ্গে। নারীর এই চরম অবমাননা, ধর্ষণের দ্বারা পবিত্র হওয়া ধর্মীয় নিষ্ঠুর বিধানকে না মানতে পেরে যুদ্ধে হেরে রণক্লান্ত সৈনিক রেজিনা আত্মহত্যা করে নিজেকেই শেষ করে দেয়। এমন বর্বর ঘটনা তো কতই না ঘটে চলেছে। সংবাদ মাধ্যমকে এড়িয়ে নীরবে নিশ্চুপে। সেখানেও মৌলবাদীদের প্রবল চাপ নিজেদের ধর্মের ব্যাপার বাইরে যেন প্রকাশ না পায়। এইভাবেই তো ধর্মের নামে হিন্দু সমাজে জোর করে সতীদাহ প্রথা চলেছিল। নারীদের মতামতের কানাকড়ি সেদিন মূল্য দেওয়া হয়নি।
‘তালাক’, নিকাহ্ হালালা আজও চলছে। মুর্শিদাবাদের ইসলামপুরের দরিদ্র পিতৃ–মাতৃহারা মাজেদার স্বামী তালাক দেয় রান্না করতে দেরি হয়েছে বলে। ছ’মাসের সন্তান নিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি চেয়েচিন্তে আর কতদিন বাঁচা যায়? পাড়ার লোকেরা স্বামীকে পুনরায় গ্রহণ করতে রাজি করায়। তবে মোড়লদের নির্দেশ অন্য পুরুষের সাথে বিবাহ। বর পাওয়া গেল দূর সম্পর্কের এক জামাইবাবু। বিয়ে মানে সহবাস। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ধর্ষণ। সেই ধর্ষণের একরাশ লজ্জা নিয়ে সন্তান আর নিজের একটু আশ্রয় ও বাঁচার তাগিদে পুনরায় স্বামীর ঘরে ফিরতে পারল মাজেদা। নিষ্ঠুর পুরুষতন্ত্র নির্দোষ একজন ব্যক্তিকে এমন বীভৎস অত্যাচার চালিয়ে ধর্মের নামে মেয়েদের সীমাহীন অবমাননা করে ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে চলেছে আজও। দু বছর পর স্বামী আবার আর একটি মেয়েকে বিয়ে করে। দরিদ্র অশিক্ষিত মাজেদা নির্যাতনের দগদগে ঘা বয়ে বেড়াচ্ছে সর্বক্ষণ। আমাদের মিটিংগুলিতে নিকাহ্ হালালার শিকার মাজেদা মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে তার বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, আর কিছুই বলতে পারে না।
জঙ্গীপুরের এক সাহসিনী নারীকে স্বামী তালাক দেওয়ার পর গ্রামের মোড়লরা নিদান দেয় স্বামীর ঘরে থাকতে হলে নিকাহ্ হালালা করতেই হবে। সাহসিনী নারী কথাটি গোপন করেননি। জানিয়েছে অনেককে। সংবাদ মাধ্যমকেও। যে গ্রামে মোড়লদের নির্দেশে ১৭ টি মেয়ে নিকাহ্ হালালার শিকার হয়েছে, বাধ সাধল সাহসিনী নারী। মোড়লদের নির্দেশে স্বামীর ঘর ছেড়ে অন্যত্র ভাড়া বাড়িতে ছেলে মেয়েদের নিয়ে অনাহারে থেকেছে। অসুস্থ হয়েছে কিন্তু মাথা নত করেনি। নিকাহ্ হালালা ছাড়াই স্বামী সসম্মানে তাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়েছে এক বছর পর। কেননা এই সাহসিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিল বহু মানুষ। বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে জেতে মেয়েটি।
২০১৯–এর মে মাসে একই গ্রামে ৩৮ বছরের শেফালিকে স্বামী তালাক দেয়। স্ত্রী ও তিন সন্তানকে মেরে ঘর থেকে বের করে দেয় স্বামী। কেননা আর একটি বিয়ে করা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তাকে ঘরে ঢোকাতেই স্বামীটির এই মহাকর্ম। থানায় পুলিশের সাহায্য চাইলে তারা বলে, তালাক হওয়া মেয়েদের স্বামীর ঘরে ঢোকানোর নির্দেশ তাদের কাছে আসেনি। কেননা ওটা মুসলিম ধর্মের ব্যাপার। শেফালিকে সাহায্য করে সেই সাহসিনী নারী। গ্রামের মেয়েদের সংগঠিত করে বীরের মতো লড়ে স্বামীর বাড়িতে ঢুকিয়ে দিল শেফালি ও তার সন্তানদের। এখান থেকেই শিক্ষা নিতে হবে যে অন্ধের মতো মেনে নেওয়া নয়, চাই সংগঠিত প্রতিবাদ। বীরভূম জেলাতে এমন নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নারী।
“২০১১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর বরেলিতে এক মহিলাকে তাঁর স্বামী তালাক দেয়। মেয়েটির পরিবারের অনুরোধে তাঁর স্বামী তাঁকে ঘরে ফেরাতে রাজি হলেও শর্ত দেয় যে, মেয়েটিকে তাঁর শ্বশুরের সাথে নিকাহ্ হালালা করতে হবে। আদালতে মেয়েটির দিদি জানিয়েছিলেন—‘বোন হালালায় রাজি না হলে তাঁকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে জোর করে হালালা করানো হয় শ্বশুরের সাথে। এরপর টানা ১০ দিন তাঁকে ধর্ষণ করে ওই বৃদ্ধ। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ফের বোনকে ডিভোর্স দিয়ে স্বামী ও তাঁর পরিবার দেওরের সঙ্গে মেয়েটিকে জোর করে নিকাহ্ হালালা করতে বাধ্য করে।’ এরপরেই আদালতের দ্বারস্থ হয় মেয়েটির পরিবার। বরেলিতে মেয়েটির খোরপোষ মামলা চলাকালীন ঘটনাটি প্রকাশ্যে এসেছে। বিচারক মাননীয় অজয় সিং–এর এজলাসে দায়ের করা এফিডেফিট দাবি করা হয়েছে। সন্তান না হওয়ায় তাঁর উপর অত্যাচার করত স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন”। (৭, মে, ২০১৯, এই সময় পত্রিকা।)
“আশির দশকে বি বি চোপড়ার ছবি (সিনেমা) ‘নিকাহ্’–তে রাগের বশে স্ত্রী নিলুফারকে তিন তালাক দিয়েছিল ওয়াসিম। পরে ভুল বুঝতে পেরে ফিরিয়ে নিতে চাইলে একই বিধান ইমামদের। মুসলিম পার্সোনাল ল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে শুনানিতে তিন তালাক, বহুবিবাহ ও নিকাহ্ হালালা নিয়ে আলোচনা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান প্রাক্তন বিচারপতি ইন্তাজ আলি শাহের সাফ কথা—‘নিকাহ্ হালালার মতো ব্যবস্থা কোনো মতেই সমর্থনযোগ্য নয় আজকের সময়ে’। বিপক্ষ মত রয়েছে জোরালো ভাবেই। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য উজমা আলমের বক্তব্য—‘ ইসলাম কোনোভাবেই তালাককে উৎসাহিত করে না। তাই তালাকের অপব্যবহার রুখতেই নিকাহ্ হালালার মতো ব্যবস্থা রয়েছে শরিয়ত আইনে’। (৬ই মে, ২০১৭, এই সময়)।
উজমা আলমের মতো ধার্মিক মহিলা সত্যিই কি নারীদের অধিকার দিতে পারলেন? সারা দেশের খবরে তিনি কি প্রমাণ করতে পারবেন যে নিকাহ্ হালালার ব্যবস্থা থাকাতে তালাকের অপব্যবহার বন্ধ হয়েছে? সারা ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ নারী তালাক, বহুবিবাহ ও নিকাহ্ হালালার শিকার হচ্ছেন। সেইসব নির্যাতিত নারীদের জন্য ল বোর্ড ধর্মের স্বার্থেই কোনো দায়িত্ব নিয়েছে কি?
‘‘চার বছর আগে ফারজানাকে যখন তার স্বামী আব্দুল কাদির তিন তালাক দেন, তখন ফারজানা গর্ভবতী। চার বছর আব্দুল একবারও ফারজানার সাথে যোগাযোগ করেননি। ফোনে নিকাহ্ হালালা করে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব। না হলে বস্তায় পুরে নালার জলে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি। বুলন্দ শহরের সিকান্দরাবাদের বাসিন্দা ফারজানা সুপ্রিম কোর্টে নিকাহ্ হালালার বিরুদ্ধে সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মামলা দায়ের করেছেন”। (১লা আগস্ট, ২০১৮, আনন্দবাজার পত্রিকা।)
এখন দেখা যাক মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে কী আছে? Remarriage of divorced couple – (1) Where the husband has repudiated his wife by three pronouncements (8.311 (2) and see 311 (3)) if is not lawful for him to marray her again until she has married another man and the latter has divorced her or died after actual consummation of the marriage. (Mulla’s principle of Mahamedan law by M. Hidayatullah and Arashad Hidayatullah – page- 276).
মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে তালাক বললেই বিবাহ বিচ্ছেদকে গ্রাহ্য করা হচ্ছে। শরিয়তে একসঙ্গে তিন তালাক না দেওয়ার নির্দেশ আছে। তালাক সম্পর্কে কোরানে বর্ণিত—“সমুদয়, অনুমোদিত বস্তুর মধ্যে আল্লাহর কাছে ‘তালাক’ বিবাহ বিচ্ছেদ সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য।’’ হাদিসে আরও পাওয়া যায় (১) একসঙ্গে তিন তালাক বে আইনি (২) রাগের মাথায় তালাক গ্রহণযোগ্য নয়। (৩) উন্মাদ ও নিদ্রিত অবস্থায় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘোষণা অবৈধ। (৪) স্ত্রীকে অপবিত্র বলে তালাক বললে তালাক নয়। (৫) তালাকের সঙ্গে মহিলাদের ঋতুচক্র জড়িত।
বিভিন্ন ধর্মীয় আইন রচনা হয়েছিল হাজার বছর আগে সেই যুগের প্রয়োজনের ভিত্তিতে। আজ বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন নিয়মনীতির বিস্তর পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে ধর্মীয় আইন, নিয়ম, নীতিরও।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা অতীত যুগে ধর্মের নামে নির্যাতিত হয়েছে। বহু ধর্মের ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়। ব্যাবিলনে এইরকম ব্যবস্থা ছিল যে প্রত্যেক কুমারী মেয়েকে অন্তত একবার মিলিটাদেবীর মন্দিরে তীর্থযাত্রা করতে হতো। দেবীর সম্মানার্থে আগন্তক পুরুষের পছন্দ অনুযায়ী তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা বাধ্যতামূলক ছিল। ইজিপ্ট, সিরিয়া, সাইপ্রাস, গ্রীস, রোম এমনকি ইহুদিদের মধ্যেও ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে নারীর পতিতাবৃত্তির প্রচলন ছিল। মালবারে এমন প্রথা ছিল যে ব্যক্তি কনের কুমারীত্ব প্রথম নষ্ট করবে তাকে বর পুরস্কার দেবে। রাজাদের জন্য এ কাজ করার দায়িত্ব ছিল উচ্চস্তরের পুরোহিতদের। কুমারী মেয়েদের দ্বারা দেহ ব্যবসার প্রথাটিকে ধর্মীয় নিয়মের কর্তব্য বলে ধরা হত। গ্রীস দেশে দ্রব্য সামগ্রী দিয়ে নারী বিনিময় করা হত। নারীরা ছিল পুরুষের হাতের সম্পত্তি। পুরুষ তাঁকে ইচ্ছেমতো রাখতে পারত, ফেলে দিতে পারত।
এ দেশেও ধর্মের নামে চলত নারীদের উপর নির্যাতন। বৃদ্ধের সাথে শিশু কন্যার বিবাহ, কুলীন ব্রাহ্মণরা ৫০–৬০টি করে বিবাহ করত। ছিল বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ প্রথা। বালিকারা বিধবা হলে চলত সামাজিক–ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ও নির্যাতন। হিন্দু নারীদের সতীদাহ প্রথা এ দেশে ছিল। রামমোহনের মতো মহান মনীষীদের আন্দোলনের ফলে সতীদাহ রদ আইন চালু হয়। বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের ফলে বিধবা বিবাহ আইন চালু হয়। নারীর উপর নির্যাতনের অনেক অবসান হয়েছে বিশ্বজুড়ে রেনেসাঁসের পথ বেয়ে। এদেশে ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের সময়ে ও পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে শুরু হয় স্বাধীনতা আন্দোলন। এই আন্দোলন ও নবজাগরণের জোয়ারে সামন্ত চিন্তা ও সামন্ত প্রথার বিরুদ্ধে উন্নত ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ। সামন্ত আঞ্চলিক অর্থনীতি ভেঙে জন্ম নেয় পুঁজিবাদী জাতীয় বাজার, জাতীয়তাবাদী আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের। পরিবর্তন আসে শিল্প, সাহিত্য, মুল্যবোধ, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রেই। রেনেসাঁর ঊষালগ্নে এদেশে নারীদের মানুষের মর্যাদা দিতে এবং নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে সমাজ ও সংস্কারমূলক আন্দোলনের পথেই মনীষীরা সতীদাহ প্রথা ও বিধবা বিবাহ আইন চালু করতে পারলেন। সাম্য–মৈত্রী–স্বাধীনতার বাণী যখন দুনিয়ার বুকে ঝড় তুলেছে, ইতিহাসের ধারায় এ দেশেও নারীদের মুক্তি হল অনেকাংশেই। কিন্তু সামগ্রিক পরিবর্তনের পথে মুসলিম সংস্কার আন্দোলন এদেশে তেমন গড়ে উঠল না। কেননা স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে উঠল হিন্দু অধ্যাত্ববাদী দার্শনিক ভাবধারাকে ভিত্তি করে। তাই জাতি ধর্ম বর্ণ উপজাতীয়তা নির্বিশেষে এক জাতি হিসেবে সংস্কৃতিগত ভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠতে পারেনি। নবজাগরণের প্রভাব, উন্নত জ্ঞান–বিজ্ঞান, শিক্ষা— সর্বক্ষেত্রেই মুসলিম সমাজ পিছিয়ে পড়ল। এর ফলে মুসলিম সংস্কার আন্দোলনও তেমন করে গড়ে উঠতে পারল না। যার বিষময় প্রভাব মুসলিম নারীকে বইতে হচ্ছে আজও। ধর্মের নামে তালাক, বহুবিবাহ, নিকাহ্ হালালা ইত্যাদির মতো কু–প্রথার মধ্য দিয়ে।
আমাদের বিচার করা দরকার যে সারা বিশ্বজুড়েই আজ পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা। কিন্তু নিজ নিজ দেশে ধর্মীয় আইনের পরিবর্তন হয়েছে বিস্তর। মুসলিম ব্যক্তিগত আইন অর্থাৎ শরিয়তি আইন সেক্ষেত্রেও পরিবর্তন হয়েছে ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, আলবেনিয়া, রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে। বিশ্বের প্রায় ২২টি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের পরিবর্তন হয়েছে। মরোক্কো, তিউনেশিয়া, মালদ্বীপ, ইয়েমেন, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, মিশর, জর্ডন, আলজেরিয়া প্রভৃতি দেশে এইসব প্রথার পরিবর্তন হয়েছে। পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, বাংলাদেশে তাৎক্ষনিক তালাক নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
এ দেশে মৌলবাদীদের পক্ষ থেকে বার বার প্রশ্ন উঠছে ধর্মের বিধানকে একটি সরকার কীভাবে নিষিদ্ধ করতে পারে? কিন্তু আমাদের দেশে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামে যে শাস্তি অনুসরণ করার কথা বলা আছে তা কি পরিবর্তন হয়নি? চুরি করলে তো হাত পা কেটে নেওয়া হয় না। ফৌজদারি আইনে পুলিশ–প্রশাসনেরই সাহায্য নেওয়া হয়। ইসলামে সুদ নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও মুসলিমরা সুদ গ্রহণকে মেনে নিয়েছেন। চুক্তি, সাধারণ ও ফৌজদারি বিষয় সংক্রান্ত বহু ইসলামি আইনের পরিবর্তে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগ হয়েছে। শুধু নারীর অধিকারের প্রশ্নে স্বার্থান্বেষীরা, মৌলবাদীরা সোচ্চার হচ্ছেন ধর্মের উপর আঘাত বলে।
ইসলামে তো মদ নিষিদ্ধ। অথচ মদ খেয়ে মেয়েদের উপর নির্মম অত্যাচার এমনকি মদ্যপ অবস্থায় তালাক—মদের কারণে একের পর এক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। শরিয়ত রক্ষায় ল বোর্ড ও ধর্মীয় রক্ষকরা এক্ষেত্রে কী ভূুমিকামিকা পালন করছেন? পণ দেওয়া ও নেওয়া ইসলামে চলে না। অথচ মুসলিম কন্যার পিতা মাতারা পণ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। গরীব মুসলিম পরিবারগুলি দেউলিয়া হয়ে গেলেও মুসলিম ল বোর্ড ও মৌলবাদীরা এক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকেন কি ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করার জন্য?
এই মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করেই ভারত সরকার ৩০ শে জুলাই ২০১৯ তিন তালাক বিল পাশ করেছে। ফৌজদারি অপরাধের তকমা দেওয়া ছাড়া বিলে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কার্যকরী হতে দেখা গেল না। তালাক সংক্রান্ত অভিযোগ করলে অপরাধীর জেল হতে পারে। তারজন্য আমাদের দেশে গার্হস্থ্য আইন তো আছেই। তিন তালাকের সঙ্গে জড়িত করে দেওয়া হচ্ছে কেন? প্রশ্ন হল স্বামী জেলে গেলে স্ত্রী, সন্তানদের ভরণপোষণ, শিক্ষা, চিকিৎসার দায়ভার কে গ্রহণ করবে? মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে বহুবিবাহ স্বীকৃত। শাস্তি পাওয়ার পর স্বামী তালাক দেওয়া স্ত্রীকে গ্রহণ না করে আর একটি বিয়ে অনায়াসেই করতে পারে। কেননা ভারত সরকার সেটি নিষিদ্ধ করেনি। আজও ধর্মান্ধতা সমাজে বিদ্যমান ‘তালাক’ শব্দটি স্বীকৃত থেকে গেলে মুসলিম সমাজ তালাকপ্রাপ্ত নারীটি কি স্বামীর সঙ্গে থাকবে নিকাহ্ হালালা ছাড়া? এই তালাক বিলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নিকাহ্ হালালার সমস্যা ও তার সমাধান এখানে কোথায়? আইনে নারীও কি পুরুষের সমান অধিকার পেয়েছে?
শরিয়ত রক্ষায় ল বোর্ডের সদস্য উজমা আলম সহ অনেক সদস্যই নিকাহ্ হালালার পক্ষে জোরালো মত দিয়েছেন, তালাকপ্রাপ্ত নারীকে স্বামীর ঘরে ফিরতে হলে অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে মানে সহবাস। সে তালাক দিলে তবেই পূর্বের স্বামীর ঘরে স্থান। আজকের আধুনিক যুগে ধর্ষণের নির্দেশ দিয়ে হালালা করা অর্থাৎ পবিত্র করার রায় য াঁরা দেন তাঁরা কি সত্যিই ধার্মিক না মানুষ? মহান হজরত মহম্মদের নির্দেশ ছিল শরিয়তের দ্বারা কোনো সমাধান না হলে মনুষ্যত্বকে কাজে লাগাবে। মৌলবাদীরা বর্তমানে মনুষ্যত্বকে কাজে লাগাচ্ছেন কি? কিন্তু দেখা যাচ্ছে তিন তালাক বিলে তালাককে অনুমোদন, যার সঙ্গে যুক্ত নিকাহ্ হালালা তা বহাল তবিয়তেই রইল মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করে। এটা তো ধর্ষণের অনুমোদনেরই নামান্তর। এই বর্বর প্রথা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মনুষ্যত্বকেও কাজে লাগানো গেল না।
বিজেপি সরকার দাবি করছে মুসলিম নারীদের আত্মসম্মান, সামাজিক নিরাপত্তা, মর্যাদা দিতে সরকার তিন তালাক বন্ধ করেছে। বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ প্রচার করছেন এই বিলের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রামমোহন, বিদ্যাসাগরের পরই আর একজন সমাজ সংস্কারের মর্যাদায় ভূষিত হলেন। ইতিহাসের এমন বিকৃতি কি কোনো চেতনাসম্পন্ন মানুষ মানতে পারে? বাস্তবে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে অপব্যাখ্যা করে তিন তালাক বিলের দ্বারা পরোক্ষে তালাক প্রথাকে কার্যত রক্ষা করে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করেছে এই সরকার। এখানে রয়েছে প্রতারণা। তালাক বিলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নিকাহ্ হালালা, যা অমানবিক ও রুচিহীন। মেয়েদের আত্মমর্যাদার প্রতিবন্ধক এই আইন। এর পরিবর্তনের সময় এসেছে। নীতিহীন নিকাহ্ হালালা সহ বহুবিবাহ, তালাক ইত্যাদি প্রশ্নে নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব না নিয়ে এবং মুসলিম মেয়েদের আইনি সুরক্ষা না দিয়ে বিজেপি সরকার সমাজ সংস্কারের মর্যাদায় কখনও ভূষিত হওয়ার দাবি করতে পারে কি?
পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৪ মে, ২০২০
0 Comments
Post Comment