- 30 January, 2022
- 0 Comment(s)
- 412 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
[১৮]
আমি খুন হচ্ছি, চৈতি : সুমন
দরজা ঠেলে জয়নালের গা ধাক্কা মেরে হুট করে ঢুকে পড়েছে এক মেয়েমানুষ। চারাগাছের মতো নড়ে উঠেছে জয়নাল। একটা বিদুৎ প্রবাহ যেন ধাক্কা খেয়ে ঢেউ খেলে গেছে দেহে।
চৈতি! লাফিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সুমন।
সুমনের এ হেন পরিবর্তন দেখে বিস্মিত জয়নাল। এখনি যে মানুষ তিনমাথা হয়ে কোড়চা মুরগির মতো ঝিমুচ্ছিল, সে মানুষ এখন কত ফুরফুরে, টগবগে! আনন্দের চোটে শেষে মেয়ে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে কি না কে জানে! মেয়েমানুষটার ভাবসাব দেখো—যেন প্রস্তুত হয়েই এসেছে। দ্রুত সরে পড়াই মঙ্গল।
সরে পড়লেও অন্যদিনের মতো কোথাও গিয়ে সমপদের কারও সাথে আড্ডায় বসল না জয়নাল। আশেপাশেই থাকল। শালার স্যার, জাতে পাগল হলেও তালে ঠিক! যাবো নাকি একবার নাস্তার ছুঁতো নিয়ে? স্যার, ম্যাডামের জন্য একটা কিছু—চা বিস্কিট ইত্যাদি। বন্ধ ঘরে কী কী দৃশ্যপট হতে পারে, মেয়েমানুষটার নগ্ন ছবি কল্পনা করে, খিক্ খিক্ করে হেসে ওঠে। দুই হাঁটু চিপে নিজেরটাকে পোষ মানায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কান খাড়া করে। চেয়ারম্যান স্যার ওর সামনে দিয়ে গেল। ওকে জিজ্ঞেস করে, সুমন কী করছে?
একজন কে এসেছেন, তার সাথে কথা বলছেন স্যার?
জয়নাল ভয় পেয়েছিল, যদি চেয়ারম্যান স্যার দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ত? স্যারের কপাল ভালো, বেঁচে গেলেন আজ।
চৈতি মনে মনে আজ খুব ক্রেজি। সুমনকে এক পলক দেখার লোভ এমন করে ভেতরে হইচই জুড়ে দিল যে, আসতে বাধ্য হল। সুমনদা, কী ভাবছেন এত? আপনাকে এত ম্লান দেখাচ্ছে কেন?
চমকে তাকাল সুমন।
ঠোঁট কামড়ে কম্পমান চোখে সুমনকে পঁই পঁই করে দেখে নিচ্ছে চৈতি। এই দেখার লোভেই এসেছে। কী অমৃত তার মধ্যে! কী যাদু নিয়ে জন্ম তার! চির কাঙালিনীর মতো ছুটে আসতে হল চৈতিকে। হায় রে চৈতি! নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করে, আমি কি খুব দেউলিয়া হয়ে পড়ছি! এই মানুষটার সঙ্গ না পেলে আমি আর বাঁচব না। আমার সবল সমৃদ্ধ একজন স্বামী আছে, সোনার পুতুলের মতো একটা ছেলে আছে, ঘর আছে, সুখ আছে, তারপরেও কোন সুখের লোভে পা দিলাম! শেষে ফাঁদে পড়া ঘুঘুর মতো প্রাণ যাবে না তো!
বড় বড় শ্বাস ফেলছে সুমন। ঘোলাটে নেশাভরা ভয়ার্ত চোখ। হাত কাঁপছে বেদম। বেসামাল চৈতি নিজেকে সামাল দিয়ে ব্যালেন্স ফিরিয়ে এনে বলে, সুমনদা। এ কয়দিন ধরে অনেক ভেবে অনেক ভেঙেচুরে তবেই এলাম এখানে। আপনার কাছে।
জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় সুমন।
চৈতির ঘোলাটে চোখে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা জমা হয়ে বৃষ্টির ফোঁটার মতো বড় হয়ে উঠছে। ভেতর থেকে হাঁপর টেনে বাতাস বের করে বলে, মন্ত্র পড়ে সাত পাক দিয়ে যাকে ঠাঁই দিলাম জীবনে, সে আমার জীবনের পরম আত্মীয়। এ কথা আমি অস্বীকার করতে পারব না। সে-ই আমার স্বর্গ, সে-ই আমার নরক। তারপরেও সেদিনের সন্ধ্যার কথা মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারিনি!
সুমনের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। কি বলে পাগলি!
লম্বা করে শ্বাস ফেলে চৈতি। হ্যাঁ সুমনদা, হেঁয়ালি নয়, সত্যিই বলছি। আমার বুকে আপনার নখের দাগ জমির নকশার মতো দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিল সেদিন সন্ধ্যায়। এ কয়দিন নিজের সাথে ভয়ানক সংঘর্ষ করে অনেক কেঁদে কেটে তবে এই সত্যগুলো জানাব বলে ঠিক করে এসেছি। হয়ত বেহায়া ভাবতে পারেন। দ্বি-চারিণী ভাবতেও পারেন। সেটা আপনার ব্যাপার। এক নিমেষেই গুছানো কথাগুলো বলতে পারায় চৈতির মধ্যে যেন আনন্দের হিল্লোল বয়ে চলছে।
সুমন হঠাৎ বলে ওঠে, আমি খুন হচ্ছি।
চৈতি হেসে দিল। খুন আপনি হবেন কেন, খুন তো হয়েছি আমি। নইলে এভাবে পতঙ্গের মতো কেউ ছুটে আসে নিজেকে সমর্পণের জন্য!
সুমন এবার মুখে গাম্ভীর্য টেনে বলে, না, সত্যিই আমি খুন হচ্ছি।
আমাকে ভড়কে দিতে চান, তাই তো? চৈতির ঠোঁটে এখনো হাসি।
আই এম সিরিয়াস। আই উইল ডেফিনেটলি বি কিলড্।
ফাজলামি ছাড়েন তো। আমি সেই কুষ্টিয়া থেকে এসেছি, কত কিছু ভেবে এসেছি, আর আপনি ভাবছেন, আমি আপনাকে খুন করতে এসেছি! আমার আবেগ, আমার ভালোবাসার মূল্য আপনি কোনদিনই দেবেন না, বুঝেছি। অভিমানে চৈতির গাল ফুলেছে। কাঁদো কাঁদো মুখ ভার করে নিশ্চুপ বসে আছে।
তুমি ভুল বুঝছো চৈতি। আমি কিন্তু নির্মম সত্য একটি কথাই বলছি। তুমি বিশ্বাস করতে চাইছো না। সুমনের কণ্ঠস্বর ভারি ভারি লাগছে। চোখে বিষাদের কালো মেঘ খেলা করে যাচ্ছে। চৈতির ভেতরে খটকা লাগে। জেদি মানুষ, ব্যক্তিত্ববান পুরুষ, হেঁয়ালি করার স্বভাব তেমন নেই, সোজাসাপ্টা কথা বলে, পারলে ‘হ্যাঁ’ না পারলে সরাসরি ‘না’ বলে, মাঝামাঝি থাকে না, সেই মানুষটি খুনের মতো ভয়ঙ্কর বিষয় নিয়ে হেঁয়ালি করার কথা নয়। তাও বারবার রিপিট করছে। আস্তে করে চেয়ার থেকে উঠে আসে চৈতি।
জানালা দিয়ে দ্রুত আত্মাহুতি দিতে যাওয়া সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে আছে সুমন। সামান্য ফাঁক হয়ে থাকা দরজা সেঁটে দিল চৈতি। জানালার পর্দাগুলো টানাই আছে, তারপরেও আর একবার দেখে নিল ফাঁক-ফোকর আছে কি না। অতঃপর ধীরে ধীরে সুমনের দিকে এগিয়ে গেল। কাঁধে হাত রাখল পরম মমতায়। চৈতির হাত বেয়াড়া ও অবাধ্য হয়ে ওঠে। সুমনের মাথার উপরে উঠে যায়, চুলের বিনুনি কাটে, ধীরে ধীরে দুটি হাতই বুকের দিকে নেমে আসে। এক সময় পিঠ-বুক বরাবর দুই হাতে জাপ্টে ধরে। সেদিনের সন্ধ্যার ঘুমন্ত নেশা জেগে উঠেছে চৈতির শরীরে। রক্তে। অস্ফুষ্ট স্বর চৈতির। আমি আপনাকে খুন করতে এসেছি, অ্যাঁ! আপনিই আমাকে খুন করেছেন! আমার স্বামীসুখ, আমার সংসারসুখ সব আপনি খুন করেছেন। পৃথিবীতে একদিনের জন্যও আমি সুখি হলাম না।
আবেগ অনুভূতিহীন জড়বস্তুর মতো সুমন নির্বিকার। চৈতি একাই জাগে। একাই শরীরের তাপ-উত্তাপ ছড়িয়ে যায়।
চরম শান্ত নির্বিকার সুমন হঠাৎ চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে। চরম উত্তেজনায় গলার রগগুলো ফুলে উঠেছে। চালু রেলইঞ্জিনের মতো কাঁপছে। এবার রাজনৈতিক বক্তার মতো হাত-পা নাড়িয়ে তিক্ত কর্কশ গলায় অশ্রাব্য কদর্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে দিল। খানকি মাগি! নিমকহারাম মাতারি! তোকেই আমি খুন করব। এনিহাও। হ্যাঁ, আমি, আমার এই হাতে গলা টিপে ধরে ইঁদুরের মতো পিষে মারব। না হয় তোর বুক বরাবর পাঁচটা গুলি চালিয়ে দেব। আমার বাচ্চাটা পেট থেকে আউট করে দেখ্ এবার। তুই কী পারিস, আর আমি কী করতে পারি দেখবি এবার। দেখবি, খেলারামের খেল্ কারে কয়।
হঠাৎ ঝড় থেমে গেল। শান্ত নিরীহ সুমন চেয়ারে বসে আছে প্রশান্তির চোখ বুঁজে।
হিরন্মময় নির্জনতা নেমে আসে।
চৈতি রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে। উন্মাদের মতো চিৎকার করে কাকে গালাগালি করল! কে কাকে খুন করবে? গোলমাল বেঁধে গেল ওর নিজের মধ্যে। ওর চোখকেই এখন বিশ্বাস করানো কঠিন। কিছুক্ষণ আগে এ মানুষটি কী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল, আর এখন কী নিবিড় শান্ত! ক্রমেই একটা রহস্যের জালে আটকে পড়ছে চৈতি। সুমনকে ঘিরে চেনা-অচেনার দ্বন্দ্ব, ভয় ও প্রশ্নে ঘুরপাক খায় মনে।
লম্বা শ্বাস ফেলে নিচু শান্ত কণ্ঠে বলে সুমন, অবশ্য এতদিনে ও-ই আমাকে নিকাশ করে ফেলে কি না।
এবার সিরিয়াস চৈতি। কি বলছেন? আমি তো উত্তর-দক্ষিণ কিছুই বুঝছি না। কে খুন করবে? এবং কেন খুন করবে? আপনার মতো মানুষকে কেউ খুন করে? ছাত্রজীবনে চৌধুরী স্যারের আড্ডায় বিপ্লবী বক্তৃতা দিতেন, কিন্তু সে অন্যকথা। স্রেফ কয়েকজনের পাগলামি ছিল। শুনেছি, ক্যাম্পাসের দলবাজি পদবাজি এসবে আপনি নেই। একা নিঃসঙ্গ চলেন নিজের মতো। কে করবে আপনাকে খুন?
নখ খুঁটতে খুঁটতেই নিস্তেজ কণ্ঠে জবাব দেয় সুমন, রিমা।
রিমা আপু! অ্যা! রিমা আপু!! বিস্ময়ের উত্তেজনায় বসা থেকে উঠে দাঁড়াল চৈতি। অবিশ্বাস্য! আমি বিশ্বাস করি না।
তুমি কেন, কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু এটাই নিষ্ঠুর রিয়ালিটি। রিমা আমাকে খুন করার ছক আঁটছে। অয়ন সাথে আছে। মিলেমিশে ষড়যন্ত্র করছে। ওরা দুজন ইয়ে করে কিনা।
কিন্তু কেন? অয়ন ভাই আপনার প্রিয় বন্ধু। ওরা আপনাকে খুন করার ছক আঁটছে! ষড়যন্ত্র করছে! এসব কী বলছেন? ‘ইয়ে’ করে মানেটা কী? স্বপ্নে সাপে তাড়া খাওয়া মানুষের মতন চৈতির চেহারা ভয়ার্ত হয়ে ওঠে। সমাজ-ধর্মকে তোয়াক্কা না করে, জীবনের সব সুখের প্রতাশ্যাকে গলা টেপে হত্যা করে একটা মহৎ আদর্শের শক্তিতে যে বন্ধন গড়লেন, সে বন্ধনের পরিণাম এত ভয়ানক হবে! কোন নারী কি তা পারে? কোন বন্ধু তা পারে? রিমা আপু এ কাজ করবে!
ষাঁড়ের মতো ভয়ানক লাল চোখে চৈতির দিকে তাকায় সুমন।
চৈতির ভেতরে ভয় বরফ হয়ে ওঠে। চৈতি কী বলবে, কী করবে বুদ্ধিতে কুল পাচ্ছে না। জীবিত এক মানুষ নিজেই বলছে সে খুন হবে! সেটা আবার নিজের স্ত্রী-বন্ধুর হাতে, এ কি বিশ্বাস করা যায়? এত নির্লিপ্তভাবে কেউ কখন কাউকে নিজের আসন্ন মৃত্যুর সংবাদ দিতে পারে নাকি?
অবিশ্বাস-বিশ্বাসের দ্বন্দ্বে চৈতির মাথার ভেতরে বিপরীত চিন্তার কুরুক্ষেত্র চলছে। সুমনের একটি কথা মুহূর্তেই চৈতিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অন্য দিগন্তে। অচেনা আনন্দের প্রসাদের ঢেউ খেলে গেল চৈতির দেহের গোপন জায়গাতে। সর্বাঙ্গে মাতম উঠেছে! দুই মাস সুমন বুভুক্ষু! শরীর ছুঁতেই ভয়ে কুঁকড়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে রিমা। পাথরের মতো শক্ত হয়ে বিশ্রীভাবে গুটিয়ে থাকে নিজের মধ্যে। রিমার নিষ্প্রাণ পাথর শরীরে কোন তাগিদ টের পায় না সুমন। হুঁ করে মৃদু হাসে চৈতি। কার জন্য এত মায়া! নিজেও তো অভুক্ত টানা তিন বছর। ক্ষুধায় ক্ষুধায় দেহে এখন মঙ্গা চলছে। গলা খেঁকিয়ে বলে, ওসব নেগেটিভ চিন্তা ঝেড়ে ফেলুন সুমনদা। সব ঠিক হয়ে যাবে।
তুমি রিমাকে কতটুকু চেনো? খুব ডেনজারাস মেয়ে। এছাড়া ও নিজেই বলেছে।
কী বলেছে? আপনাকে খুন করবে?
বালকের মতো নিরীহ মুখ থেকে হুঁ শব্দটি বের হয়।
সত্যি কি খুন করবে আপনাকে?
হ্যাঁ।
নিজের স্বামীকে হত্যা করে কী লাভ হবে রিমা আপুর?
সোজা হিসাব। বাচ্চাকে মুসলমান বলে চালিয়ে দিতে সহজ হবে।
তা তো আপনি জীবিত থাকলেও অসুবিধা নেই।
পাগল! তা কী করে সম্ভব?
আপনাকে খুন করলেও তো জানবে।
কোথাও ঘাপটি মেরে থাকবে। না হয় বিদেশ চলে যাবে। ও বলেছে।
[চলবে...]
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ)
0 Comments
Post Comment