- 17 August, 2025
- 0 Comment(s)
- 124 view(s)
- লিখেছেন : মীরা কাজী
“ মঞ্জরী”
সে সময় ওপেন ইউনিভার্সিটির অফিসে ঢুকলেই দেখতাম, মঞ্জরী দাসগুপ্ত নিবিষ্ট মনে কাজ করে চলেছেন। তার চেয়ারের ঠিক পিছনের দেওয়ালে একটা ক্রাচ ঠেসানো। যারা কোনও কাজে প্রথমবার অফিসে আসত তারা মঞ্জরীকে বাদ দিয়ে অন্য কারও সাথে সেটাকে মেলানোর চেষ্টা করত। পায়ের পাতা পর্যন্ত লুটিয়ে শাড়ি পরা, চল্লিশ ছুঁই ছুঁই সুন্দরী তরুণীটির সাথে ক্রাচের সম্পর্ক তারা ভাবতে পারত না। আমিও যেমন পারিনি প্রথম দিকে। আমাকে শনি-রবিবার দু-একটা ক্লাস নিতে হত, শেষ হলেই চলে আসতাম। অফিসে বসে আড্ডা দেবার সময় হত না। তাই অফিসের করনিক মঞ্জরী সেনগুপ্তর সাথে আমার আলাপটা চোখাচোখি হলে হাসি বিনিময়ের বেশি আর এগোয়নি।
এক শনিবারের বিকেলে আমি আমার নির্দিষ্ট ক্লাস শেষ করে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসছি, গেটের মুখে মঞ্জরী সেনগুপ্তর সাথে দেখা। ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে আসছেন। আমার বাড়ি কলেজের কাছেই, আমি বরাবর হেঁটেই যাতায়াত করি। আজ আকাশে মেঘ দেখে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন রিক্সাওয়ালাকে ডেকে নিয়েছি।
“ কোনদিকে যাবেন?” মঞ্জরীদেবীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম।
“আনন্দ ভবনের দিকে”। হাঁটা থামিয়ে তিনি উত্তর দিলেন।
“আমিও তো ওই দিকেই যাব। উঠে আসুন”।
“অসুবিধে হবেনা। আমার কাছে ছাতা আছে।“
“আসুন তো! বৃষ্টি নামল বলে”।
“না,মানে!” মঞ্জরীদেবী এড়িয়ে যেতে চাইলেন।
“মানে- টানে পরে ভাববেন। এখন তাড়াতাড়ি করুন, নয়তো রিক্সাতে বসেও ভিজতে হবে”। আমি এক রকম তাড়াই দিলাম।
এবার একটু ইতস্তত করে এগিয়ে এলেন মঞ্জরীদেবী। রিক্সায় ওঠার সময় বেশ কসরত করতে হল তাকে। রিক্সাওয়ালার সাহায্য নিয়ে কোনও রকমে রিক্সার সিটে উঠে বসলেন। বুঝতে পারলাম কেন তিনি রিক্সায় উঠতে চাইছিলেন না।
বাড়ি পৌঁছানোর আগেই তেড়ে ফুঁড়ে বৃষ্টি এসে গেল। সঙ্গে মেঘের কড়কানি। রিক্সাওয়ালা আর এগোতে রাজি হল না। অগত্যা মঞ্জরীদেবীকেও নামতে হল আমার সাথে। নামাটাও সহজে হল না। ফের রিক্সাওয়ালার সাহায্যে শরীরটাকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে বহু কষ্টে সেটাকে সম্ভব করতে হল। তার সুন্দর মুখখানায় অক্ষমতার কালিমা লেপ্টে গেছে। আমিও অপ্রস্তুত। সাহায্য করতে চেয়ে ভদ্রমহিলাকে কি কষ্ট দিয়ে ফেললাম!
“বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন তো? চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম। মিইয়ে যাওয়া মঞ্জরীদেবীকে একটু হাল্কা করতে চাইলাম।
“বাড়িতে চিন্তা করবার মত কেউ নেই। আমি একাই থাকি”। শুকনো গলায় বললেন মঞ্জরীদেবী।
মঞ্জরীদেবী কি আমার কথায় কষ্ট পেলেন? কি যে হচ্ছে! আমি মনে মনে নিজেকে দোষ না দিয়ে পারলাম না।
“আমিও বহুকাল ওই আপনারই মত একা ছিলাম। ইদানীং শুভলক্ষীর কারণে দোকা হয়েছি”। অকারণে হেসে বললাম।
“ওই, যে মেয়েটি চা দিয়ে গেল?”
“হ্যাঁ, আমার বোন”।
“বোন না ছাই! উড়ে এসে দিদির ঘাড়ে জুড়ে বসেছি।” শুভলক্ষী জবাব দিল।
“বাজে কথা ছেড়ে এই দিদির জন্য কিছু খাবারে ব্যবস্থা কর দেখি।” শুভলক্ষীকে ধমক দিয়ে বললাম। মুখচোরা শুভলক্ষীটা আজকাল বড় বক বক করে।
“না না, ও সবের দরকার নেই। বৃষ্টি একটু ধরলেই আমি চলে যাব। রিক্সাটা নিশ্চয় এখনও আছে”?
“রাতটা এখানেই থেকে যান। বৃষ্টি এখনই থামবে বলে মনে হচ্ছে না। শুভলক্ষীকে বলি খিচুড়ি বসিয়ে দিক। কাল একেবারে অফিস করে ফিরবেন”।
খোঁজ নিয়ে দেখ গেল, রিক্সাটাও চলে গেছে। এই দুর্যোগে দ্বিতীয় রিক্সা পাওয়ার আশা নেই। আকাশের অবস্থাও ক্রমশ খারাপের দিকে। ক্রাচ নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটা বেশ ঝক্কি। সব দিক বিবেচনা করে মঞ্জরীদেবী না না করেও শেষমেশ আমার প্রস্তাবে রাজি হলেন।
“আমার হাতের খিচুড়ি একবার খেলে ভুলতে পারবে না দিদিমনি। ফ্রিজে ইলিশ মাছও আছে। জমে যাবে।”
“তাহলে না খেয়ে আর যাই কী করে?” মৃদু হেসে মঞ্জরীদেবী বললেন।
মঞ্জরীদেবীকে হাসতে দেখে আমার মনের ভার লাগব হল। আমি তার দিকে তাকিয়ে একমুখ হেসে বললাম”, আপনাকে খিচুড়ি না খাইয়ে ছাড়বে ভেবেছন? সাথে ওর বকবকানি ফ্রী !”
এরপর থেকে মঞ্জরীদেবীর সাথে আমার নৈকট্য তৈরি হয়ে গেল। ওই সূত্র ধ’রে আমার বাকি ভাই-বোনেদের সাথেও ধীরে ধীরে করনিক পরিচয়ের বাইরে তিনি অন্যভাবে পরিচিত হলেন। মঞ্জরীদেবীর একলা সংসারে তারা সদলবলে হানা দিতে লাগল। কলেজ আসা-যাওয়ার পথে আমার বাড়িতে মঞ্জরীদেবী মাঝে-মধ্যে আসেন। শুভলক্ষীর হাতে চা-জলখাবার খেতে খেতে টুক-টাক গল্প করেন। আমরা ততদিনে আপনি থেকে তুমি হয়ে গেছি।
সুন্দরী বললে কিছু কম বলা হবে, দুধে আলতা রঙ, একঢাল কালো চুলের দীর্ঘাঙ্গী, তরুণী মঞ্জরীকে অপরূপা বলাটাই যুক্তিযুক্ত। সৃষ্টিকর্তা যার শরীরটাকে এত মনোযোগ দিয়ে গড়েছেন, তার ললাট লিখনের বেলায় বেশ অমনোযোগী। তাই বুঝি অত রূপ নিয়ে জ্বলে পুড়ে শেষ হতে হল তাকে।
শহরের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর ঘরে, বলতে গেলে সোনার চামচ মুখে দিয়ে মঞ্জরীর জন্ম। পর পর দুই ছেলের পর এক মেয়ে। ছোট থেকেই সবার আদরের। পড়াশোনায় তেমন চৌকশ নয়, তাই যেমন তেমন করে গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট করার পরেই তার বিয়ে দেওয়া হল। ছেলে সরকারি ব্যাঙ্কে ভালো পোস্টে চাকরি করে। দেখতেও সুপুরুষ। সব দিক দিয়েই মঞ্জরীর উপযুক্ত। কিন্তু ওই যে, আগেই বলেছি, বিধাতা ওর ললাট লিখনে মোটেই মনোযোগ দেননি।
বিয়ের পর হিমাচল প্রদেশে হনিমুন করতে গিয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় মঞ্জরীর স্বামী প্রসুন মারা যায়। মঞ্জরী বেঁচে ফিরে আসে, তবে না ফিরলেই বোধ হয় ভালো ছিল। তার একটা পায়ের হাঁটু থেকে নীচের দিকটা কেটে বাদ দিতে হয়।
বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসে মঞ্জরী। তার আদর-যত্নের কোনও ত্রুটি হয়না, তবে মনের আঘাতের তো কোনও মলম নেই। সপ্রতিভ মঞ্জরী সবার থেকে মুখ লুকিয়ে বেড়ায়, যেন সব দোষ তারই। স্বভাবিক ভাবেই মঞ্জরীর আবার বিয়ে দেবার কথা ওঠে। টাকা দিলে যেখানে বাঘের দুধ মেলে, সেখানে কোটিপতির খোঁড়া মেয়ের পাত্র মিলবে না! একটু খোঁজ করতেই পাত্র মিলেও যায়। নোটের বান্ডিলে মঞ্জরীর পায়ের খুঁত ঢাকা পড়ে। তবে সেটা যে সাময়িক, সেটা বুঝতে দেরি হয় না।
বছর না ঘুরতেই মঞ্জরীর পায়ের খুঁত নিয়ে স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ী তাকে খোঁটা দিতে শুরু করে। বাবার কাছ থেকে টাকা আনার জন্য চাপ দেয়। মঞ্জরী প্রথম প্রথম মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছিল, শেষে না পেরে একদিন মায়ের কাছে ভেঙ্গে পড়ে। তার বাবা মেয়ের সুখ-শান্তির কথা ভেবে জামাইয়ের আবদার মত টাকা পাঠিয়ে দেন। সেই শুরু।
এরপর থেকে কিছুদিন পর পর মঞ্জরীর বর তিমির টাকার জন্য চাপ দেয়। মঞ্জরী সহ্য করতে না পেরে বাবাকে বলে। মঞ্জরীর বাবা মেয়ের মুখ চেয়ে জামাইয়ের আবদার মেনে নেন। কিছুদিন থেকে তার নিজের ব্যবসা মন্দা চলছে, তার উপর এত মানসিক চাপ, মঞ্জরীর বাবা একদিন হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি হন আর ফিরে আসেন না।
কয়েক মাস চুপচাপ থাকার পর তিমির ফের টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। পুরোনো বাইক পালটে নতুন বাইক কিনবে, সেই জন্য তার পাঁচ লক্ষ টাকা লাগবে।
মঞ্জরী বলে “যখন বাবা ছিল তখন যা বলেছ বাবার কাছ থেকে এনে দিয়েছি। এখন বাবা নেই, ব্যবসা দাদাদের হাতে। দাদাদের আমি টাকার কথা বলতে পারব না। তাছাড়া দাদারা দেবেই বা কেন? এমনিতেই ব্যবসা আগের মত ভালো চলছেনা।”
তিমির সে কথা শুনে যাচ্ছেতাই গালাগাল দিতে শুরু করে, “তোমার দাদারা জানে না, তার বোন খোঁড়া। আমি একা তার খেসারত দেব আর তারা দিব্যি বাপের টাকায় ফুর্তি করবে? বাবার সম্পত্তিতে তোমার অংশ আছে। সোজা পথে রাজি নাহলে আমি তোমাকে নিয়ে কোর্টে যাব।”
“আমি মরে গেলেও দাদাদের অমন কথা বলতে পারব না। আমার দুর্ভাগ্যের জন্য বাবা অসময়ে চলে গেছে। একথা শুনলে মাও বাঁচবে না। দাদারা যে কত কষ্ট পাবে তুমি বুঝতে পারছ না।”
“মা-দাদার কষ্টটাই তোমার কাছে বড় হলো? আর আমার কষ্টটা বুঝি কিছু নয়?”
“তা কেন? তুমি যা রোজকার কর তাতে আমদের তো বেশ চলে যাচ্ছে। অযথা অন্যের টাকায় লোভ করে নিজেও কষ্ট পাচ্ছ আমাকেও কষ্ট দিচ্ছ।”
মঞ্জরীর কথা শুনে তিমির চিড়বিড়িয়ে উঠে তার গালে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলে, “কী বললি। আমি পরের টাকায় লোভ করি? বেশ করি। খোঁড়া বোনকে সংসার করাতে গেলে গচ্চা দিতে হবে, এটা তোর দাদাদের ভালো করে বুঝিয়ে দিগে যা। টাকা আমার চাই।”
তিমির চলে গেলে মঞ্জরীর শাশুড়ি বলে, “মুখে মুখে তর্ক না করে যা বলল মেনে নিলেই তো পারতে।”
“ওতো অনেয্য কিছু বলেনি। তুমি দাদাদের হাত তোলা হয়ে থাকবেই বা কেন? নিজের ভাগ তুমি বুঝে নাও।” তিমিরের বাবার গলাতেও একই সুর।
ওদের কথার উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করে না মঞ্জরী।
বহুবার এখান থেকে চলে যেতে চেয়েছে মঞ্জরী। কিন্তু কোথায় যাবে ভেবে উঠতে পারে না। মৃত্যুকে সে খুব কাছ থেকে দেখেছে, তাই আত্মহত্যার কথা ভাবতে ভয় করে। দাদারা তাকে ফেলতে পারবে না, কিন্তু বৌদিদের কথা ভাবলে ভরসা পায় না। কিছুদিন আগে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে বাপের বাড়িতে তার আগের জায়গাটা যে হারিয়ে গেছে বুঝতে অসুবিধে হয়না মঞ্জরীর।
মাস খানেক আগের কথা, মায়ের শরীর খারাপ শুনে তাকে দেখতে গিয়েছিল মঞ্জরী। তিমিরের দুর্ব্যহার নিয়ে কিছু কথা মাকে বলতে তার মা বলেছিলেন, “তোকে আর ওখানে যেতে হবেনা। আমাদের কাছেই থাক। তোর দাদারা আসুক আমি তাদের বলছি!”
“একটা লোকের নামে অকারণ দোষ দিচ্ছ কেন? তিমির তো কাল এসে অন্য কথা বলে গেল।” মঞ্জরীর বড় বৌদি কখন এসে দাঁড়িয়েছিল মা-মেয়ে কেউ খেয়াল করেনি।
“ও কাল এখানে এসেছিল? কই আমাকে কিছু বলেনি তো।” মঞ্জরী বিস্মিত। এতদূর গেছে তিমির!
“আমি কি তবে মিথ্যা বলছি? বিশ্বাস না হয় মাকেই জিজ্ঞেস কর।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়েছিল মঞ্জরী।
“তিমির কাল বিকালের দিকে এখানে এসেছিল তো। তোকে বলেনি বুঝি? ও আর শোধরাবে না।”
“কী বলেছে সে?”
“আমার কাছে বসল কখন? বৌমাদের সাথেই গল্প করছিল।”
“কি বলেছে তিমির?” বড় বৌদির চোখে চোখ রেখেছিল মঞ্জরী।
“কী আর বলবে? খামোকা বউ-এর নিন্দে করতে কেউ কি চায়? একথায় সেকথায় বেরিয়ে পড়ল, তুমি নাকি নিজের সম্পত্তি বুঝে নিতে চাইছ। নিজে বলতে পারছ না, তাই তিমিরকে চাপ দিচ্ছ বলবার জন্য”।
“এই সমস্ত বলেছে? ছিঃ।”
“তোমার বলা কথাটা আমাদের কাছে বলেছে বলে মানুষটা ‘ছিঃ’ হয়ে গেল? আর তুমি বলে টলে সাধু থেকে গেলে? বাহ!”
“এ কথাও তো বলল, ভালোয় ভালোয় তোমার দাদারা ভাগ না দিলে তুমি কোর্টে যাবার কথা ভাবছ।” ছোট বৌদিও বড় জায়ের ঢেলে দেওয়া বিষের সাথে আরও কিছুটা বিষ যোগ করেছিল।
“তোমাদের কী মনে হয়, আমি একথা বলতে পারি?”
“তিমির যে ভাবে বলল, তাতে বিশ্বাস না করিই বা কী করে?” দুই বৌদি একই সাথে বলে উঠল।
“বাবা বেঁচে থাকতে তুমি বাবার কাছ থেকে প্রচুর টাকা হাত করেছ। তিমির না বললে কোনও দিনও কী জানতে পারতাম? সে বেচারা পই পই করে তোমাকে বারণ করেছে, বাবার কাছে টাকা চাইতে। তখন তুমি বলেছ, বাবার ব্যবসায় তোমার অংশ আছে। ওই টাকা দিয়ে তুমি নিজের শখ-সাধ মিটিয়েছ, গয়না বানিয়েছ। বাবা বেঁচে থাকতেই তলে তলে সব ফাঁক করে দিয়েছ। বাবার কাছে তার মেয়েই সব ছিল। মেয়ে-মেয়ে করে বাবা ব্যবসাটা পর্যন্ত লাটে তুলে দিয়ে চলে গেলেন। ছেলেদের কথা একটুও ভাবলেন না।”
“বড় বৌমা, ছোট বৌমা তোমরা থামো।”
এত বড় মিথ্যে শুনেও সেদিন কান্না আসেনি মঞ্জরীর। ওই নীচ, কুচক্রী লোকটার সাথে আর একটা দিনও কাটাবে কী করে, সেই ভাবনার সাথে আগের দুর্ঘটনায় কেন সে মরে যায়নি, এই আফশোস দুইয়ে মিলে তার কণ্ঠ রোধ করেছিল। নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে সেখান থেকে উঠে চলে এসেছিল মঞ্জরী। মায়ের হাজার ডাকাডাকিতেও ফিরে তাকায়নি।
তারপর আর ও বাড়িতে যায়নি সে। মা বেশ ক’বার ফোন করে ডেকেছে। এটা সেটা বলে সে এড়িয়ে গেছে। তিমির তার গায়ে হাত তুলতে মঞ্জরী স্থির করে, এখান থেকে চলে যাবে। তিমিরের মুখটা মনে পড়ে যেতেই সে আর কিছু ভাবতে পারে না, বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়ে। কিছুদূর গিয়ে অচেনা একটা জায়গায় নেমে এলোমেলো ঘুরতে থাকে। একজন মহিলা তাকে দেখে জিজ্ঞেস করে,” কাউকে খুঁজছ?”
“আমি একটা কাজ খুঁজছি।”
“কী রকম কাজ?”
“যে কোনও কাজ, সেলাই এর কাজ জানি। ছোট বাচ্ছাদের পড়াতে পারব। রান্নার কাজ পেলেও করব।”
“তোমার একটা পা নেই দেখছি। কী করে এমন হল?”
“গাড়ি দুর্ঘটনায়। ওতে অসুবিধে হবে না। আপনার কাছে কোনও কাজের সন্ধান আছে?”
“আমার স্বামীর টেলারিং এর ব্যবসা। সেখানে অনেক মেয়ে কাজ করে, তাকে বলে দেখতে পারি।”
“খুব ভালো হয়। মাইনে পত্তর যা হয় দেবেন। শুধু থাকা খাওয়ার একটা ব্যবস্থা হলেই হবে।” অকুল সমুদ্রে খড়-কুটোর মত অচেনা মহিলাটিকে আঁকড়ে ধরে মঞ্জরী।
মহিলাটি তাকে নিজের সাথে যেতে বলে। রেল লাইনের ধারে পড়ে থাকা ফাঁকা জায়গায় গজিয়ে ওঠা সার বন্দী কিছু টালি, টিনের ঘর। গায়ে গায়ে লাগানো ঘরগুলোর থেকে খানিকটা তফাতে একটা টিনের ঘরে মঞ্জরীকে এনে তোলে। চারধারে কচুরি পানায় ভরা জলাজমি, ঝোপ-ঝাড় আর রাশিকৃত আবর্জনা। সেখান থেকে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অর্ধ-উলঙ্গ কিছু ছেলে-মেয়ে সেই আবর্জনার মধ্যে বসে সেগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। দেখে মঞ্জরীর মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে, গা গুলিয়ে ওঠে। এমন জায়গা সে ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখেছে। এখানে এসে তাকে দাঁড়াতে হবে এটা তার কল্পনারও অতীত।
“আমার স্বামী এলে কথাবার্তা হবে। তুমি এখানে থাক, আমি একটু ঘুরে আসি।” মহিলাটি ঘরের মধ্যে তাকে বসতে বলে বেরিয়ে যায়।
ঘরের ভিতরটা তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার। ছোট্ট একটা জানালা, সেটা বন্ধ। প্রায়ন্ধকার ঘরটায় একটা হলুদ বাল্ব জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে মহিলাটি। একটা সস্তা কাঠের চৌকি আর একটা প্লাস্টিকের চেয়ার ছাড়া সেখানে আর কোনও আসবাব নেই। চৌকিটা খালি। ঘরটায় মানুষ বসবাসের কোনও চিহ্ন খুঁজে পেলনা মঞ্জরী। মহিলাটি কি তাহলে অন্য জায়গায় থাকে? যাক গে, মঞ্জরীর কাজ পাওয়া নিয়ে কথা। কাজটা পেয়ে গেলে সে ভদ্র-সভ্য জায়গা খুঁজে নেবে থাকার জন্য।
মঞ্জরী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। শরীর ভেঙ্গে আসছে। চৌকিটার উপর শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের ভাগ্যের কথা ভাবতে থাকে সে। দু- একদিনের মধ্যেই জানাজানি হয়ে যাবে। দাদারা তাকে নিশ্চয় খুঁজবে। বৌদিরা যাই বলুক। সে তো তাদের বোন। আর তিমির! সে নিজের গরজেই তাকে খুঁজবে। মঞ্জরী তার কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত অবসন্ন মঞ্জরী একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। সময়ের হিসেবে মনে হল, বিকেল হয়ে গেছে। কিন্তু সেই মহিলাটি তো এখনও ফিরলনা! ময়লা ঘাঁটা ছেলেমেয়েগুলোর গলার আওয়াজও কানে আসছে না। কিছু পাখির ও ঝিঁঝিঁর একটানা ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। দরজা খুলে বাইরে বেরোতে গিয়ে চমকে ওঠে মঞ্জরী। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ। ঘরে ঢুকে দরজাটা ঠেসিয়ে দিয়েছিল সে। নড়বড়ে দরজাটা তাহলে কী কোনোভাবে বন্ধ হয়ে গেছে! প্রথমে মৃদু মৃদু পরে জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে মঞ্জরী - “কেউ কি আছেন? দরজাটা খুলে দিন প্লিজ।”
বেশ কিছুক্ষণ ধাক্কা-ধাক্কির পর দরজার ওপার থেকে একটা হেঁড়ে গলায় জবাব আসে, “ চুপচাপ থাকো। চেঁচামেচি করলে বিপদ বাড়বে।”
“দরজাটা খুলে দিন।”
“সময় হলেই খুলে দোবো”।
“আপনারা আমকে আটকে রেখেছেন কেন?”
“তোমার কাজ চাই বলেছিলে না?”
“হ্যাঁ, একজন মহিলা বলেছিল, সেলাইয়ের কাজ আছে তাই এসেছিলাম।”
“কাজ পাবে,তবে ক’দিন পরে। কিন্তু কোনও আওয়াজ নয়।”
“আমার কাজের দরকার নেই, আমাকে যেতে দিন।” অনুনয় করে মঞ্জরী।
“চু-উ-প! আর একটা কথা বললে শেষ করে দোবো।” ধমকে ওঠে হেঁড়ে গলার লোকটা।
একটা অজানা আতঙ্কে বুকের ভিতরটা গুড় গুড় করে ওঠে মঞ্জরীর। “হে ঈশ্বর, এ কোন জায়গায় এনে ফেললে তুমি আমায়! আর কত দুর্ভোগ আমার জন্য বরাদ্দ করে রেখেছ?” ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে সে।
বিনিদ্র রাত কেটে স্বাভাবিক নিয়মেই সকাল হয়। একটু বেলায় দরজা একটু ফাঁক করে দুটো রুটি একটু তরকারি আর এক বোতল জল বাইরে থেকে কেউ একজন দিয়ে যায়। তাকে কিছু বলতে গেলে সে ঠোঁটে আঙ্গুল চাপা দিয়ে চুপ করে থাকতে বলে।
এভাবে কেটে যাচ্ছে। দিনে দুবার দরজা খুলে কেউ একজন খাবার দিয়ে যায়। প্রতি দিন আলাদা আলাদা লোক। মহিলাটি একদিনও আসে না। ঘরের লাগোয়া একটা ঘুপচিমত বাথরুম আছে, সেটাতে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হয়। প্রথম দিন থেকে বড় বালতির এক বালতি জল রাখা আছে। সেটাকেই মেপে মেপে খরচ করতে হচ্ছে। ওটুকু শেষ হলে কী হবে জানি না। ছোট্ট ঘুলঘুলির মত জানালাটা বাইরে থেকে বন্ধ করা। ভিতর থেকে কোনওভাবেই সেটা খোলা সম্ভব নয়। একদিন জানালায় ধাক্কা দিতে গিয়ে ধমক খেয়েছে মঞ্জরী। তার মানে, কেউ একজন সব সময় এখানে তাকে পাহারা দেয়।
কী করবে ভেবে পায়না মঞ্জরী। মোবাইলও নেই। বিয়ের পর নিজের সুবিধে-অসুবিধে মাকে ফোনে জানাত বলে, তিমির সেটা আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলেছিল। আর কেনা হয়নি। মাকে বললে ফের কিনে দিত। কিন্তু কী লাভ! দেখতে পেলে তিমির আবার ভেঙ্গে দেবে। তাই আর মাকে বলেনি।
একটা মোবাইল থাকলে এই বিপদে কাজে আসত। হঠাৎ মঞ্জরীর মনে পড়ে যায় - তার হাতব্যাগে কাগজ পেন আছে। সে দ্রুত হাতে কাগজটাকে বের করে সেটাকে কয়েকটা টুকরো করে নিয়ে সেগুলোর প্রত্যেকটাতে লেখে- “আমি ভদ্র পরিবারের মেয়ে। আমাকে এরা এখানে আটকে রেখেছে। এদের উদ্দেশ্য ভালো নয়। দয়া করে কেউ আমাকে উদ্ধার করুন।” এবার টুকরো কাগজ গুলোকে ছোট ছোট করে ভাঁজ করে, একটাকে রেখে বাকি গুলো ব্যাগে রেখে দেয়। হাতের কাগজটাকে বিড়ির আকারে সরু করে পাকিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে কোনওরকমে গলিয়ে নীচে ফেলে দেয়।
প্রথম দিনে মঞ্জরী দেখেছিল জানালার পিছনে পাহাড় প্রমাণ আবর্জনা। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সেখান থেকে বাচ্ছা ছেলে-মেয়েদের গলার আওয়াজ শোনা যায়। আবর্জনা কুড়োতে এসে যদি কেউ এই কাগজটা দেখে, তাকে উদ্ধার করে। একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা তার মনের মাঝে ঝিলিক দিয়ে সাথে সাথেই মিলিয়ে যায়। যাদের গলা পাওয়া যায়, তারা নেহাত ছেলে মানুষ। কাগজ দেখলেও লেখা কি পড়তে পারবে? তারা কি স্কুলে যায়?
দিন দিন করে অপেক্ষার পাঁচ-পাঁচটা দিন কেটে যায়। ছ’টা টুকরোর মধ্যে আর একটা আছে। ঠাকুর দেবতার নাম করে শেষ ভরসাটিকে জানালার ফাঁক গলিয়ে ফেলে দিয়ে অদৃশ্য দেবতার কাছে জোড়হস্ত হয় মঞ্জরী, “হে ঈশ্বর, আমার সন্মান তুমি রক্ষা করো, নয়তো মৃত্যুর কোনও উপায় আমাকে বলে দাও।”
মঞ্জরী এবার থেকে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখে। খাবার দিতে এসে ডাকাডাকি করলে তবে খোলে। অনেকটা রাত। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মঞ্জরী। হঠাৎ দরজায় ধাক্কার শব্দে চমকে জেগে ওঠে সে। যাহ! তাহলে শেষ রক্ষা হলনা। এখন কী করবে সে? দরজা খুললে নিশ্চিত নরকবাস। না খুলুলেও রেহাই নেই। নড়বড়ে দরজাটা খানিক পরেই ভেঙ্গে যাবে।
“ভয় নেই দরজা খুলুন। আমরা থানা থেকে আসছি।”
নিশ্চয় অভিনয়! এসব বলে-টলে দরজা খুলিয়ে তারপর তাকে নরকের রাস্তায় নিয়ে যাবে। ভয়ে আতঙ্কে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মঞ্জরী। ক্রাচটা শক্ত করে ধরে। এটাই এখন তার একমাত্র অস্ত্র।
দজার বাইরে একজন নয় অনেকের গলা পাওয়া যাচ্ছে। অনান্য দিনের মত চুপি চুপি, হিস হিস করে নয়, বেশ জোরে জোরে কথা বলছে তারা। একটু যেন সাহস হয়। তাহলে কী---! যা হয় হোক, শিরদাঁড়া শক্ত করে দরজাটা খুলে দেয় মঞ্জরী।
“ভয় নেই, আমরা থানা থেকে আপনাকে উদ্ধার করতে এসেছি। বেরিয়ে আসুন। নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে যেন এক আকাশ আলোর ঝলকানি। মঞ্জরী দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে একজন উর্দিধারী পুলিশ অফিসার। সাথে কয়েকজন কনেস্টবল।
“আমাকে আপনারা বাঁচান।” হাতের ক্রাচটা ফেলে দিয়ে অফিসারটির পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মঞ্জরী।
“আর ভয়ের কিছু নেই। যারা আপনাকে এখানে আটকে রেখেছিল, সেই নারী পাচারকারী দুজনকেই এ্যারেস্ট করা হয়েছে। আপনি এখন মুক্ত।” তাকে অভয় দিয়ে পুলিশ অফিসারটি বলেন।
পুলিশের গাড়িতে যেতে যেতে মঞ্জরী জানতে পারে, একজন কাগজ কুড়ানী বাচ্চা মেয়ে মঞ্জরীর ফেলে দেওয়া চিরকুট গুলো দেখে কৌতূহলী হয়ে সেগুলো কুড়িয়ে নেয়। সে কিছুটা লেখা পড়া জানে। বাড়ি ফিরে মাকে দেখায়। তারপর মায়ের সাথে থানায় এসে সমস্ত জানালে পুলিশ স্টেপ নেয়।
সেদিন ঘরটার পিছনে জঞ্জালঘাঁটা ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখে ঘেন্নায় নাক সিঁটকিয়েছিল মঞ্জরী। তাদেরই একজন দেবদূতের মত এই নরক থেকে তাকে উদ্ধার করেছে। আজ সেই মেয়েটিকে কোলে তুলে আদর করতে ইচ্ছে করে মঞ্জরীর।
এরপর দাদার বয়সী ওই পুলিশ অফিসারটি তাকে অনেক ভাবে সাহায্য করেন। সে বাড়ি ফিরতে চায় না শুনে তাকে একটা থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কিছু ছাত্র-ছাত্রী জুটিয়ে দেন, যাতে সে ভদ্রভাবে বাঁচতে পারে। তাঁরই সুপারিশে ওপেন ইউনিভার্সিটির অফিসে এই ক্লার্কের চাকরি।
মঞ্জরী ঘর ছাড়ার পরে পরেই তার মা মারা যায়। দাদারা তার সাথে যোগাযোগ করেছিল, ফেরার কথাও বলেছিল। তবে নিজেদের বাড়িতে নয়, তিমিরেরে বাড়িতে। মঞ্জরী এককথায় তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। তিমির বার বার এসে বিরক্ত করত, হুমকিও দিত।
পুলিশ অফিসারটির পরামর্শে মঞ্জরী তিমিরের নামে বধু নির্যাতনের কেস করে। তারপর ডিভোর্সের কেস।
অনেকদিন পর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে মঞ্জরী। সকালের ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা চলে গেলে সন্ধ্যের দিকে আর একটা ব্যাচ আসে। মাঝখানে বারোটার পর দুজন মহিলা আসেন সেলাই শিখতে। এর মধ্যেই মঞ্জরী নিজের কাজ গুছিয়ে, রান্না খাওয়া সেরে নেয়। শনি-রবিবার কলেজের কাজ। এমন বাঁচার স্বাদ জীবনে এই প্রথম। অকুলে হারিয়ে যেতে যেতে কুল পাওয়া জীবনটাকে আবার ভালোবাসতে ইচ্ছা করে মঞ্জরীর।
এ সমস্ত আমার জানবার কথা নয়। মঞ্জরীই আমাকে বলেছিল। তবে একদিনে, একটানা,এমনভাবে নয়। নিজের জীবনের নিদারুণ অপমান, দুঃসহ যন্ত্রণার কথা কি পরিপাটি করে গুছিয়ে বলা যায়? কোনও মেঘ মেদুর সন্ধ্যেয়, মন কেমন করা বিকেলে, বিমনা মঞ্জরীর মুখ থেকে ঝরে পড়েছিল, কথার ফাঁকে ফাঁকে, টুকরো টুকরো ভাবে। যেভাবে মামড়ি সরে যাওয়া ক্ষতমুখ থেকে বিন্দু বিন্দু রক্ত, রক্তরস ঝরে পড়ে। এইসব যন্ত্রণাদীর্ণ কথা হয়তো কাউকে বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। হয়তো মনের মত শ্রোতা পায়নি।
(চলবে)
লেখক : কথাসাহিত্যিক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment