- 28 June, 2025
- 0 Comment(s)
- 33 view(s)
- লিখেছেন : মীরা কাজী
রোহিনী
রোহিনীর সাথে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল ‘ওপেন ইউনিভার্সিটি’তে পড়ানো শুরু করার কয়েকদিনের মাথায়, যেদিন আমি সবার নাম জিজ্ঞেস করে জানতে চেয়েছিলাম- কেন তারা এত দিন পরে ফের পড়াশোনার কথা ভেবেছে। চল্লিশোর্দ্ধ রোহিনী সেদিন বলেছিল, পড়াশোনার প্রতি ভালবাসা তাকে এখানে এনেছে। এর আগে একদিন ওকে কলেজের গাছতলায় সহপাঠীদের বুঝতে না পারা বিষয় বুঝিয়ে দিতে দেখেছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে ওদের প্রতি আমার মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। সবার মত রোহিনীও আমার কাছাকাছি এসেছে। রোহিনীকে যত দেখেছি বুঝেছি, শরীরের বয়সটা কিছু নয় মনের বয়সই একটা মানুষের আসল বয়স। রোহিনী ওর সহপাঠীদের থেকে অনেকটাই বড় কিন্তু সবার সাথে মেলামেশা বা সখ্যতার ক্ষেত্রে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। ‘রোহিনী্দি’ কে ছাড়া ওদের চলেনা। বলতে গেলে ওদের ব্যাচে রোহিনীই মধ্যমনি।
রোহিনী একদিন গল্পচ্ছলে তার জীবনের কিছু কথা সবাইকে শুনিয়েছিল।
“ পড়া শোনা করার খুব ইচ্ছা ছিল আমার। অন্যদের পড়াতে আমার খুব ভালো লাগত। নিজে যতটুকু শিখেছি, শিখছি সেটা অন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দেবার জন্য মনের ভিতর এক ধরনের আকুলতা কাজ করত, সেই ছোটোবেলা থেকে। পড়াশোনায় খুব একটা যে ভালো ছিলাম তা নয়, তবে যে বিষয়টা ভালো লাগত সেটা সম্পূর্ণ আয়ত্ব না করা পর্যন্ত মনে শান্তি পেতাম না। স্বপ্ন দেখতাম, বড় হয়ে স্কুলে পড়াব।
পড়াশোনার মাঝপথে, হঠাৎ করে আমার বিয়ের ঠিক হলো। আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা- এই কথাটা বাবাকে মুখ ফুটে বলার সাহস পাচ্ছি না। মনে মনে অনেক রিহার্সাল দিচ্ছি, কিন্তু সময়কালে মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। একদিন ভাবলাম, আজ বাবা যখন তার মাথার পাকা চুল তুলে দিতে ডাকবে তখন বলে ফেলব। পিছন দিক থেকে আমার মুখটা তো আর বাবা দেখতে পাবে না। যথা সময়ে বলেও ফেললাম, কিন্তু বাবা কিছু বলল না ভেবে অবাক হলাম। বলবে কী করে? আমার কথা কানে যাবার আগেই সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
অগত্যা বাবাকে বাদ দিয়ে মাকে গিয়ে বললাম , "মা, আমি এখন বিয়ে করবনা।”
“তাহলে কী করবে শুনি?”
“যেমন পড়াশোনা করছি তেমনই করব”।
“ওই তো রেজাল্ট! ওই নিয়ে পড়ে কী এমন হাতি-ঘোড়া হবে? যা করার বিয়ের পরে কোরো।“
“ তখন যদি ওরা পড়তে না দেয়?”
“ না দেয় না দেবে! সবাই যেমন সংসার করে তেমন করবে!”
“বিয়ে না করলে কী হয়? তুমি বাবাকে বল, না হয় আমিই বলব”।
“তোর পরেও আরো দুজন আছে সে কথাটা ভেবেছিস? তিনটে আইবুড়ো মেয়ে নিয়ে গলায় দড়ি দোবো না জলে ঝাঁপ দোব, সেটা আগে ঠিক কর, তারপরে যা করার করবি।মা আমার দিকে অগুন চোখে তাকিয়ে বলল”।
এরপর আর কিছু বলার সাহস হলো না আমার।
আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমার বর সুহাস বেশ ভালো মনের মানুষ। আসাম থেকে চা-পাতা এনে এখানে বিভিন্ন দোকানে সাপ্লাই করে। সেই সাথে নিজেদের কিছু চাষের জমি আছে, সেসব দেখাশোনা করে। শাশুড়ি নেই। শ্বশুর মশাই আর ক্লাস নাইনে পড়া একটি ননদ- মৃত্তিকা। খুব ছোটোবেলায় মৃত্তিকা তার মাকে হারিয়েছে। বাবা আর দাদা মিলে তাকে বড় করেছে। এ পর্যন্ত কোনও মহিলার সান্নিধ্য সে পায়নি। মন খুলে কথা বলবার মত এক জনকে পেয়ে সে খুব খুশি। শ্বশুর মশাইও আমাকে মেয়ের মত দেখেন। আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে, সেটা নিয়ে মনের মধ্যে একটা অতৃপ্তি সর্বক্ষণ আমাকে ছটফটিয়ে মারে, তবে এদের সবার ভালোবাসা সেই ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দেয়।
দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেছে। একদিন ভাবলাম, আমার মনের ইচ্ছেটা এদের বলে দেখলে কেমন হয়। একদিন সাহস করে সুহাসকে বলতে, সে বলল, “আমার কোনও আপত্তি নেই, বাবাকে একবার বল”।
আমার মনে খুশির বন্যা। আমি আবার পড়ব। মৃত্তিকার বইগুলো বুকে চেপে ধরে ঘ্রাণ নিলাম, "আহ!”
শ্বশুর মশাই খেতে বসেছেন আমি গিয়ে রোজকার মত কাছটিতে গিয়ে বসলাম। তারপর মনের ইচ্ছাটি বলে ফেললাম।
শুনে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন , “তোমার তো পড়াশোনা করারই বয়স। আমরা স্বার্থপরের মত সংসারে জুড়ে দিয়েছি। তুমি পড়তে চাইলে আমি বারণ করার কে? তবে একটা কথা, এই সংসারটিও তোমার, এর ভালো-মন্দটুকু তোমার নজর এড়িয়ে না যায় সেটা দেখো”।
এবার যেন কিছুটা ভয় এসে বুকের ভিতর বাসা বাঁধল। আমি দু-দিক সামাল দিতে পারব তো!
আমার ভর্তির সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সুহাসই সমস্ত করে দিয়েছে।
সেশন শুরু হলেই আমি কলেজে যাব। খুশির চোটে রাতে ঘুমোচ্ছি না। সুহাসও খুশি। কয়েক মাস বাদে তার হায়ার সেকন্ডারি পরীক্ষাটা হয়ে গেলে একসঙ্গে দুজনে কলেজ যাওয়া হবে, এটা ভেবে মৃত্তিকাও খুশি। কেবল শ্বশুর মাশাই একটু চুপচাপ। আমি দেখেও না দেখার ভান করে থাকছি, দেখতে গেলে আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে।
আমাদের বাড়িতে আমরা তিনজন ছাড়া আর একজন থাকে, সে হলো রতন। পাড়ার অনাথ ছেলেটি ছোটোবেলা থেকেই এ বাড়িতে বড় হয়েছে। বয়সে মৃত্তিকার চেয়ে কিছুটা বড়। সুহাসকে ব্যবসার কাজে সাহায্য করা ছাড়া মাঠের কাজ করে, বাড়ির সবার ফাই- ফরমাস খাটে।
একদিন সন্ধের সময় দেখি, রতন আর মৃত্তিকা কিছু একটা নিয়ে তর্ক করছে। রতন মৃত্তিকার একটা হাত ধরে রেখেছে, মৃত্তিকা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেও পারছে না। আমি কাছে যেতেই দুজনেই ছিটকে দুদিকে সরে গেল। মৃত্তিকা আর রতনকে অনেক সময় গল্প করতে দেখেছি। ওর বাবা-দাদা সেটা নিয়ে কিছু বলেনা। কিন্তু আজকের ব্যপারটা একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হলো। রতন চলে যেতে আমি মৃত্তিকাকে জিজ্ঞেস করলাম-
“ রতন কি বলছিল?”
“ কই! কিছু না তো?”
আমি আর কথা বাড়ালাম না।
আমি কলেজ যেতে শুরু করেছি। ফিরতে বেশির ভাগ দিন বিকেল হয়ে যায়। ততক্ষণে মৃত্তিকা স্কুল থেকে চলে আসে। কিন্তু ক’দিন থেকে দেখছি ও আমার থেকেও দেরিতে ফিরছে। জিজ্ঞেস করলে এটা-সেটা বলে এড়িয়ে যাচ্ছে। সুহাসকে কথাটা জানাতে গিয়েও জানালাম না। ভাবলাম, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। এ রকম তো হয়েই থাকে, দেখি না আর কটা দিন। তাছাড়া আমি এই সংসারে নতুন, সামান্য ব্যপারগুলো সুহাসের কানে তুললে মৃত্তিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে সুহাসের মনে সন্দেহ তৈরি হতে পারে।
একদিন কলেজ যাব বলে বেরিয়ে, বাস বন্ধ থাকার কারণে কলেজ যাওয়া হলনা। বাড়ি ফিরে দেখলাম শ্বশুর মশাই নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছেন। মৃত্তিকার ঘরের পাশ দিয়ে আমার ঘরে যেতে হয়। ওর ঘরের ভিতর কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে দরজা ঠেলতে গিয়ে দেখলাম, ঘর ভিতর থেকে বন্ধ। মৃত্তিকা কি তবে স্কুলে যায়নি? দরজায় টোকা দিতে বেশ কিছুক্ষণ পর মৃত্তিকা দরজা খুলল। দরজার সামনে আমাকে দেখে তার মুখ ফ্যকাশে।
“তুমি আজ স্কুলে যাওনি?”
“না, মানে শরীরটা ভালো লাগছিল না “।
“ কী হয়েছে?”
“তেমন কিছু না। মাথাটা একটু ধরেছে”।
“কিছু খেয়েছ?”
“খিদে নেই। পরে খেয়ে নেবো।“
“ আমি ততক্ষণে বুঝে গেছি ভিতরে কেউ আছে। বাইরে থেকে বিড়ির গন্ধ পাচ্ছি”।
“রতন কী করছে ভিতরে?’”
“র-ত-ন! কই! নেই তো!”
“আর কথা বাড়িও না। শিগগির ওকে বের হতে বল, নাহলে আমি বাবাকে ডাকব”।
আমার কথা শেষ হবার আগেই রতন খাটের তলা থেকে বেরিয়ে আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
মৃত্তিকা আমার কাছে ভেঙ্গে পড়ল। “প্লীজ বৌদি! বাবা-দাদাকে কিছু বোলো না।“
“রতন কোন সাহসে তোমার ঘরে ঢোকে?”
“কাস্তে না কী যেন একটা খুঁজতে ঢুকেছিল”।
“ দরজা বন্ধ করে?”
“দরজা তো খোলাই ছিল, তুমি যদি কিছু ভাব তাই তোমাকে দেখেই তো আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম”।
“ আজে বাজে কথা ছাড়। ওর সাথে তোমার কী সম্পর্ক?”
“কিছু না!”
“ কিছু না, তাহলে ওকে প্রশ্রয় দাও কেন? সেদিনেও দেখলাম তোমার হাত ধরে টানাটানি করছিল”।
“ ও আমাকে ভালোবাসে”। কিছু সময় পর মৃত্তিকা বলল।
“ভালোবাসে!”
“হ্যাঁ, আমকে না পেলে ও নাকি মরে যাবে”।
“মরলে মরবে, তাতে তোমার কী দায়?”
“একটা ছেলে মরে যাবে তাতে আমার দায় থাকবে না? তুমি হলে কী করতে?” একটু যেন উত্তেজিত হয়ে মৃত্তিকা বলল।
মৃত্তিকার কথা শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। সুহাসও বাড়িতে নেই, ব্যবসার কাজে আসাম গেছে। আগামীকাল ফেরার কথা। ফোনে তাকে সব জানাতে সে বলল, “বাবাকে এখনি জানাবার দরকার নেই, তবে মৃত্তিকাকে এখন চোখে চোখে রাখতে হবে”।
রাতে ঘুমোতে পারলাম না। এই সংসারে আসার পর প্রথমবার শাশুড়ির অভাব বোধ করলাম। এই ধাক্কায় আমার বয়স যেন রাতারাতি অনেকটাই বেড়ে গেল। পর দিন শরীর খারাপের অজুহাতে আমি কলেজ গেলাম না। দুপুরে শ্বশুর মশাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি রতনকে ডাকলাম।
“তুই মৃত্তিকার ঘরে ঢুকেছিলি কেন? জানিস বাবাকে বলে দিলে এর ফল কী হবে?”
“না বললেই তো হলো”।
“ মানে?”
“মানে আমরা দুজন দুজনাকে ভালোবাসি। একথা শুনলে জ্যাঠামশাই রেগে যাবে। তাই তাকে না জানানোই ভালো”।
“মোটেই না। মৃত্তিকা কোন দুঃখে তোর মত একজনকে ভালবাসতে যাবে?”
“ও তোমাকে তাই বলেছে বুঝি?”
“ হ্যাঁ !”
রতন কিছু না বলে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকল।
“এবার যা এখান থেকে। না ডাকলে আর এ বাড়ি আসার দরকার নেই”। আমি বেশ কড়া গলায় বললাম।
“ মৃত্তিকা যদি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একথা বলে তবেই আমি ওকে ছেড়ে, তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাব, নইলে যাব না”। রতন গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে থাকল।
“যাবি না?”
“ বললাম তো, না।“
রতনের ব্যবহারে আমি স্তম্ভিত। ভেবেছিলাম ধমকে কাজ হবে। কিন্তু দেখলাম তা হবার নয়। বাবা জেনে যাক এটা আমি চাইছি না। তবে এরপর রতনের আর এ বাড়িতে থাকা চলবেনা, ওকে তাড়াতে হবে। তারপর সুহাস এসে যা ভালো বোঝে করবে। আমি মৃত্তিকাকে ডেকে বললাম , “তুমি রতনকে ভালোবাস না, একথা ওকে নিজের মুখে বলে দাও”।
মৃত্তিকা কিছু না বলে মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
“কী হল! বল? আর ঝামেলা বাড়িওনা”।
“ বল! বৌদি যা বলতে বলছে বল!” বাবা চিৎকার করে উঠলেন। এর মধ্যে বাবা কখন চলে এসেছেন বুঝতে পারিনি। তিনিও কিছুদিন থেকে কিছু একটা আঁচ করেছিলেন।
“আমি তো-- ওকে কোনোদিন ভালোবাসিনি---- ওই আমাকে ----!“ বাবার ধমকে চমকে উঠে মৃত্তিকা কাঁদতে কাঁদতে কোনোমতে বলল।
বাবা রতনের গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন, “আর কিছু শুনতে চাস! এই মুহুর্তে আমার বাড়ি থেকে দূর হয়ে যা। আর কোনোদিন আমার মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখলে তোকে পুলিশে দেবো, মনে থাকে যেন”। বাবা এতটাই উত্তেজিত হয়ে গেছেন তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে বসিয়ে না দিলে হয়তো পড়েই যেতেন।
বাবার চেঁচামেচিতে পাড়ার দু-চার জন ততক্ষণে আমাদের বাড়িতে জড়ো হয়ে গেছে।
কেউ বলল, “ওকে ছাড়বেন না পুলিশে দিন। নাহলে আপনার মেয়ের জীবন অতিষ্ট করে তুলবে”। একজন এসে ওকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। মওকা বুঝে কানমলা, চড়-চাপড়,দু- চার ঘা লাঠির বাড়ি বসিয়ে দিল কেউ কেউ। রতন একটি কথাও বলল না, কোনো প্রতিবাদ করলনা। চুপচাপ সবটা সহ্য করে গেল।
সুহাস ততক্ষণে এসে পড়েছে। সে সবাইকে নিরস্ত করে ওকে ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করল। পাড়ার মানুষ পুলিশে দেবার কথা বললেও সুহাস সেটা করলনা।
কিছুক্ষণ অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে রতন ধীরে ধীরে আমাদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এতটা বাড়াবাড়ি হোক আমি সেটা চাইনি। চেয়েছিলাম মৃত্তিকার জীবন থেকে রতন দূরে সরে যাক। কিন্তু কিভাবে যে কী হয়ে গেল!
পরদিন সকালে এমন একটা দুঃসংবাদ পেলাম, যার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। রতন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সুইসাইড নোটে লিখে গেছে, তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
গতকাল রতনের সাথে কী হয়েছে সেটা গ্রামে কারো অজানা নেই। পুলিশ যথারীতি আমাদের বাড়িতে এসে একে একে আমাদের সবাইকে জেরা করল। আমরা আগেই ঠিক করেছিলাম, যা ঘটেছে সমস্তটা পরিষ্কার করে বলব, তাতে যা হয় হবে। মৃত্তিকাকেও সেই মত বোঝানো হয়েছিল ।
মৃত্তিকা যে রতনকে মিথ্যা বলেছিল, সেটা তার আচরণে এখন স্পষ্ট। রতনের মৃত্যুর খবর পেয়ে সে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। পুলিশের সামনে মৃত্তিকা কী বলবে, পুলিশ তার কী ব্যখ্যা করবে সে নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
কিন্তু শেষ-মেশ কিছু হলো না। গোটা গ্রাম আমাদের হয়ে সাক্ষ দিল। এমনকি রতনের কাকা- কাকিমাও আমাদের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলল না। পুলিশ রতনের ডেডবডি নিয়ে চলে গেল।
এরপর আমাদের বাড়িতে মৃত্তিকাকে নিয়ে নতুন ঝামেলা শুরু হলো। সে একা থাকতে ভয় পায়। ইস্কুল যেতে চায় না। নিজের ঘরে চুপ চাপ পড়ে থাকে।
এমত অবস্থায় আমার কলেজ যাওয়ার প্রশ্নই নেই। প্রথম সেমেস্টার পরীক্ষাটা দেওয়া হলো না।
কয়েক মাস লাগল মৃত্তিকার স্বাভাবিক হতে। সে আবার স্কুলে যাচ্ছে, টিউশন যাচ্ছে তবে আগেকার হাসি খুসি ভাবটা নেই।
আমি এবার কলেজ যাওয়া শুরু করব ভাবছি। সেকথা বাবাকে জানাতে বাবা বললেন, “যাবে, যাও। তবে সোমবারটা বাড়িতে থেকো”।
“কেন বাবা? বিশেষ কোনো কাজ আছে?”
“ হ্যাঁ, ওই দিন মৃত্তিকাকে দেখতে আসবে”।
“আপনি মৃত্তিকার বিয়ের কথা ভাবছেন? ও সবে টুয়েল্ভে উঠেছে!”
“ভাবতে হচ্ছে মা! এই ঘটনাটা না ঘটলে হয়তো এখন ভাবতাম না। তবে সমন্ধ এলেই বিয়েটা হবে তার কোনো ঠিক নেই। ভাংচি দেবার লোকের তো অভাব নেই”।
“আপনি অকারণ দুশ্চিন্তা করছেন। তেমন কিছুই হবেনা। আর কিছুদিন যেতে দিন সবাই ভুলে যাবে”।
“ভয় হয়, এই ঘটনার জের ওকে সারা জীবন বইতে হবেনা তো!” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাবা বললেন।
বিয়ের কথা শুনে মৃত্তিকা কান্নাকাটি জুড়ে দিল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার নিজের জীবনের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। ভাবলাম, কিছু একটা করতে হবে। সুহাসের কাছ থেকে ছেলের বাড়ির ঠিকানাটা যোগাড় করলাম। কিন্তু আমার প্ল্যানের কথা কিছু বললাম না। এবার নিজের পরিচয় দিয়ে ছেলের বাড়িতে চিঠি লিখে জানালাম , “মেয়েটি নাবালিকা, সে এখন বিয়ে করতে রাজি নয়। জোর করে ওর বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একজন নাবালিকাকে বিয়ে করার পরিণাম কী হয় সেটা নিশ্চয় আপনাদের বুঝিয়ে বলতে হবে না। এই চিঠির ব্যাপারটা গোপন রাখবেন। জানাজানি হলে আমি বিপদে পড়ে যাব”।
কয়েকদিন পর ছেলের বাড়ি থেকে ফোনে জানাল, বিশেষ কারণে তারা এখন মেয়ে দেখতে আসতে পারছে না। সময় সুযোগ মত তারা নিজেরাই যোগাযোগ করে নেবে।
শ্বশুর মশাই ভাবলেন নিশ্চয় কেউ ভাংচি দিয়েছে। মৃত্তিকা স্বস্তি পেল। ভিতরের ব্যাপারটা আমি ছাড়া কেউ জানল না।
সব কিছু ঠিক ঠাক চলছে। রতনের জায়গায় একজন বয়স্ক মানুষকে কাজে বহাল করা হয়েছে। আমি নতুন উদ্যমে বই-পত্র গোছগাছ করছি। কলেজে যে ক’জন বন্ধু হয়েছিল তাদের সাথে যোগাযোগ করে পড়াশোনার হাল হকিকত জেনে নিচ্ছি। আমাকে দেখে অলক্ষ্যে থেকে বুঝি একজন হাসলেন। তখন তো আর জানিনা, ক্ষণিকের এই রোদের আড়ালে কতখানি মেঘ ঘনিয়ে আছে। খেয়াল করলাম- শুকিয়ে আমলতা হয়ে যাওয়া মৃত্তিকার কিশোরী শরীরটা হঠাৎ করে জল পাওয়া গাছের মত চিকন হয়ে উঠছে। ভয়ে, উৎকন্ঠায় আমি দিশেহারা হয়ে উঠলাম। যদিও আমি তখনো মা হইনি, তবু মেয়ে তো? মৃত্তিকার শরীরের এই অভাবনীয় পরিবর্তন কিসের লক্ষণ বুঝে নিতে আমার অসুবিধে হলনা। তবুও ভাবলাম, আমার সন্দেহ ভুলও তো হত পারে। মৃত্তিকার সাথে কথা বলার পর,তার কান্না আর অসংলগ্ন কিছু কথায় আর কোনো সন্দেহ থাকলনা।
সুহাসকে বলতে সেও ভারি মুষড়ে পড়ল- বাবাকে কী বলবে? এমনিতেই তিনি আগের ব্যাপারটা এখনও সামলাতে পারেননি। যে যাই বলুক রতনের মৃত্যুর পিছনে মৃত্তিকারও যে দায় আছে সেটা এড়াবেন কী করে? মা মারা যাবার পর তিনি যাকে মায়ের যত্ন দিয়ে বড় করেছেন, সেই মেয়ের এত বড় কেলেঙ্কারীর কথা সহ্য করতে পারবেন! আত্মঘাতী হবেন না তো?
অনেক ভাবনা চিন্তার পর আমি আর সুহাস দুজনে মিলে ঠিক করলাম, আমরা মৃত্তিকাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব। ইতিমধ্যে আসামে একটা চা- কোম্পানীর সাথে সুহাসের কাজ করার কথাবার্তা চলছিল। সেটাকেই পাখির চোখ করে আসাম যাবার সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলল সুহাস। এছাড়া মৃত্তিকাকে, সেই সাথে বাবাকে বাঁচানোর আর কোনো রাস্তা নেই। চিন্তার বিষয়, বাবাকে কিছুদিন একা থাকতে হবে।
বাবাকে বলতে বাবা আপত্তি করলেন না। বরং যেন খুশিই হলেন।
গৌহাটিতে একটা দু কামরার ঘর ভাড়া করে আমরা থাকতে শুরু করলাম। সুহাস ব্যবসার কাজে বাইরে বাইরে ঘোরে। আমরা দুটিতে ঘর বন্দী। আশ-পাশটা একটু ঘুরে দেখব, মৃত্তিকার জন্য সেটাও হয় না। ভয়ে, লজ্জায় সে কুঁকড়ে থাকে। এর মধ্যে সুহাস কয়েকবার গ্রামে গেছে। সুহাসের মাধ্যমে বাবা জেনেছে, আমি মা হতে চলেছি। আমার বাবা-মাকে সে কথা জানানো হয়েছে। তারা আসামে আমাদের কাছে আসতে চাইলে এটা-সেটা বলে কোনোমতে তাদেরকে ঠেকিয়ে দিয়েছি।
যথা সময়ে মৃত্তিকা একটা ছেলের জন্ম দিল। মৃত্তিকাকে কিছুই করতে দিইনা। ছেলে আমার কাছেই থাকে।
“বৌদি আগের জন্মে তুমি আমার মা ছিলে”। একদিন ছলছলে চোখে মৃত্তিকা আমাকে বলল।
“ না, আগের জন্মেও আমি তোমার বৌদি ছিলাম”। মৃত্তিকাকে কাছে টেনে নিলাম।
মৃত্তিকার চোখে জলে আমি ভিজতে লাগলাম।
এরও কয়েকমাস মাস পর আসামের পাট চুকিয়ে আমরা গ্রামে ফিরে এলাম। আমি জন্ম না দিয়েও একটা ফুটফুটে ছেলের মা হলাম। আর মৃত্তিকা হল তার ‘পি মনি’ ।
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এর দু-বছর বছর পর আমার একটা ছেলে হয়।
বেশ কিছুদিন হল শ্বশুর মশাই মারা গেছেন। আমার দুই ছেলেই এখন কলেজে পড়ে। মৃত্তিকা স্বামী, দুই মেয়ে নিয়ে নিজের সংসারে ব্যস্ত গৃহিনী।
ভাবলাম, এবার মনের ইচ্ছাটি পূরণ করলে কেমন হয়! সুহাস এক কথায় রাজি। ছেলেরাও আমার সিদ্ধান্তে খুশি। তাই আবার এখানে আসা”।
মৃদু হেসে রোহিনী তার কথা শেষ করল।
সবার সাথে আমিও রোহিনীর ইচ্ছাশক্তিকে কুর্নিস না জানিয়ে পারলাম না।
( চলবে)
লেখক : কথাসাহিত্যিক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment