- 25 June, 2023
- 0 Comment(s)
- 1198 view(s)
- লিখেছেন : গোলাপসা খাতুন
‘পিতৃতন্ত্রের’ উৎস ল্যাটিন শব্দ “প্যাটার” (Pater) থেকে। সাধারণ অর্থে পিতৃতন্ত্র বলতে বোঝায় পিতার শাসনকে। কিন্তু নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা পিতৃতন্ত্র বলতে বুঝিয়েছেন, ‘পুরুষের আধিপত্যবাদকে’ যা প্রতিক্ষেত্রেই নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এই আধিপত্যবাদের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় পরিবারের চৌহদ্দিতে এবং এর বাইরে অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, যেমন – শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রের বিস্তৃত পরিসরে। পিতৃতন্ত্র প্রণয়ন করেছে বিপুল পরিমাণ আইন বা বিধিবিধান। যেগুলির বেশির ভাগ অংশই সুপরিকল্পিতভাবে বানানো হয়েছে নারীদের পীড়নের জন্যে। নারীবাদী তাত্ত্বিক সিলভিয়া ওয়ালবি তাঁর “Theorising Patriarchy” (1990) গ্রন্থে বলেছেন “পিতৃতন্ত্র হচ্ছে সামাজিক কাঠামো আর রীতিনীতির এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে পুরুষ নারীকে নিয়ন্ত্রণ করে, নিপীড়ন করে এবং শোষণ করে।” তিনি পিতৃতন্ত্রকে একটি ‘system’ বা ‘ব্যবস্থা’ হিসাবেই দেখেছেন। তাঁর মতে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত থাকে একটি মতাদর্শ যা পুরুষকে নারীর তুলনায় শক্তিশালী ও দক্ষ বলে মনে করে, নারীর ওপর পুরুষের প্রাধান্যকে অনুমোদন করে, এবং নারীকে পুরুষের সম্পত্তি বলে মনে করে। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস তাঁর ‘The Origin of Family Private Property and State’ গ্রন্থে বলেছেন, “মাতৃস্বত্ব যেদিন পরাভূত হয় সেদিনই পৃথিবীর ইতিহাসে নারীর পরাজয় ঘটে। গৃহের কর্তৃত্বও পুরুষের হাতে চলে যায়, নারীর মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এবং নারীদের দাসত্বের সূচনা হয়।”
পিতৃতন্ত্র নারীর জন্য যে পেশাটি রেখেছে তাহল বিয়ে ও সংসার, এটিই পিতৃতন্ত্রের নির্ধারিত নিয়তি। এরই মাধ্যমে নারীকে বিস্তৃত জীবন থেকে সংকুচিত করে, তার মনুষ্যত্ব ছেঁটে ফেলে, তাকে পরিণত করা হয় সম্ভাবনাশূন্য অবিকশিত প্রাণীতে। এঙ্গেলস পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রতিষ্ঠাকে বলেছেন “স্ত্রীজাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়”। তাঁর মতে বিয়ে মোটেই স্ত্রী ও পুরুষের সদ্ভাব সূত্রে দেখা দেয় নি, দেখা দিয়েছে ‘নারী পুরুষের একজন কর্তৃক অপরের উপর আধিপত্য হিসাবে, আর পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে স্ত্রীই হল প্রথম ঘরোয়া ঝি’। ইহুদি ও খ্রিষ্টান সন্তদের কাছে নারী হচ্ছে ‘শয়তানের খেলার মাঠ’, ‘বিষ্ঠার ছালা’। লুথার বলেছেন, “নারী কখনো নিজের প্রভু নয়, ঈশ্বর তার দেহ তৈরি করেছে পুরুষের জন্য, সন্তান ধারণ ও লালনের জন্যে। নারীকে সন্তান বিয়োতে বিয়োতে মরতে দাও, এজন্যই তাদের তৈরী করা হয়েছে।” [দ্র মাইলস ১৯৮৮, ৭৬-৮০]
বাইবেলের একটি অনুশাসন হল ‘মনুষ্য আপন পিতামাতাকে ত্যাগ করিয়া আপন স্ত্রীতে আসক্ত হইবে এবং তাহারা একাঙ্গ হইবে’ [আদিপুস্তক, ২ : ২৪]। আইনে এর তাৎপর্য হচ্ছে স্ত্রীর ‘ব্যবহারিক মৃত্যু’। স্বামী-স্ত্রী এক ব্যক্তি, স্ত্রীর কোনো ভিন্ন সত্তা নেই। স্বামীর শরীরে বিলীন হয়ে গেছে স্ত্রীর সমগ্র অস্তিত্ব। স্ত্রীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় স্বামীর অস্তিত্বের মহাসমুদ্রে [মনুসংহিতা, ৯১ : ২২]। স্বামীর শরীর বা অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় না। বিলুপ্ত হয় নারীর শরীর ও অস্তিত্ব। স্বামী হয় প্রভু। বিয়ের অনুষ্ঠানেই বধূটিকে দীক্ষা দেওয়া হয় যে, ঈশ্বরের প্রতি সে যেমন অনুগত থাকবে তেমনই অনুগত থাকবে স্বামীর প্রতি। পুরুষই বিয়ে ও সংসারের কর্তা, সে-ই সংসারে সার্বভৌম, তার বিধানই সংসারে ধ্রুব ধর্মগ্রন্থ, নারীটি ওই সংসারের পরিচারিকা। বাড়ির দাসীর সঙ্গে স্ত্রীটির পার্থক্য হচ্ছে দাসীটিকে যৎসামান্য বেতন দেওয়া হয়, আর স্ত্রীটিকে বেতন না দিয়ে কখনো কখনো মর্যাদা ও বিলাসে রক্ষিত হয়। রক্ষণশীল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ‘প্রাচীনা ও নবীনায়’ (১৮৮৭, ২৫১) বলেছেন, ‘পুরুষ প্রভু, স্ত্রী দাসী, স্ত্রী জল তুলে রন্ধন করে, বাটনা বাটে, কুটনা কাটে। বরং বেতনভাগিনী দাসীর কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা আছে, কিন্তু বণিতা দুহিতার তাহাও ছিল না।’ হিন্দু মতে পতি পরম গুরু, সে স্বামী, পতি বা ঈশ্বর, মুসলমান মতে স্বামীর পায়ের নিচে বেহেস্ত, স্বামী প্রায় সেজদার উপযুক্ত, খ্রিষ্টান মতে স্বামীই নারীর ঈশ্বর। বিয়ের জন্য দরকার পুরুষ ও নারী দুজনকেই। তবে বিয়েতে তাদের ভূমিকা সমান নয়, পুরুষ বিয়ে করে আর নারীকে বিয়ে দেওয়া হয় বা নারীর বিয়ে হয়। পুরুষ সক্রিয় নারী নিষ্ক্রিয়। পুরুষ স্বাধীন সম্পূর্ণ ব্যক্তি, সে উপার্জন করে, উপার্জনই তাকে প্রতিষ্ঠা করে ব্যক্তি হিসাবে, নারী করে গৃহস্থালি ও গর্ভধারণের কাজ যা কখনো তাকে পুরুষের সমকক্ষ করে তোলে না। মনু [৯ : ৩] বলেছেন, ‘নারীকে কুমারী কালে পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা করবে, নারী কখনই স্বাধীন থাকার যোগ্য নয়।’ এটাই সব পিতৃতন্ত্রেরই বিশ্বাস। বিয়ে নারীর জন্যে অবধারিত, এর প্রথম কারণ সমাজের জন্যে তাকে সন্তান, বিশেষ করে পুরুষ উৎপাদন করতে হবে, তাকে মা হতে হবে, মানুষ প্রজাতিটিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব তাকে পালন করতে হবে। বিয়ের আগে মেয়ের দেহটিকে নানাভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। অলঙ্কারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রোকেয়া (রোর, ১৯ – ২০) বলেছেন, “এই অলঙ্কারগুলি দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ। কারাগারে বন্দীগণ পায়ে লৌহ নির্মিত বেড়ী পরে, আর আমরা স্বর্ণরৌপ্যের বেড়ী পরি। উহাদের হাতকড়ি লৌহ নির্মিত, আমাদের হাতকড়ি স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত চুড়ি।” গো স্বামী বলদেব নাসিকা বিদ্ধ করিয়া ‘নাকাদড়ী’ পরায়, এদেশে আমাদের স্বামী আমাদের ‘নোলক’ পরাইয়াছেন। ঐ নোলক হইতেছে স্বামীর অস্তিত্বের (সধবার) নিদর্শন। ওলস্টোনক্র্যাফ্টের এ ভিণ্ডিকেশন অফ দ্য রাইটস অফ উইমেন গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদের নাম ‘Observations on the state of Degradation to which Woman is Reduced by Various Causes’. নানা কারণে নারীর যে অবনতি ঘটেছে, সে সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ। ওলস্টোনক্র্যাফট দেখিয়েছেন নারীকে বন্দী করার পর তার মানসিক শক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, নারীকে শেখানো হয়েছে তুচ্ছ রূপ, বিনোদন, ভাবাবেগ প্রভৃতিতে মেতে থাকতে, আর তারাও বোধ করেছে ‘নিকৃষ্টতায় মহিমান্বিত’। বিয়ের আগে পুরুষটিকে সুখাদ্য খাইয়ে করে তোলা হয় কামশক্তিমান। বিয়েতে পুরুষের কামই প্রধান, বিয়ের বাইরে নারীর কামের পরিতৃপ্তি নিষিদ্ধ। পুরুষ বিয়ে না করলেও সমাজে গৃহীত হয় কিন্তু নারী শুধু বিয়ের মধ্য দিয়েই গৃহীত হতে পারে সমাজে। বিয়ে না হলে তার জীবনই নষ্ট। তাই তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্যে ব্যগ্র থাকে পিতামাতা, তাতে তার মত আছে কি না তাতে কেউ আগ্রহ বোধ করে না, সমাজ ধরেই নেয় বিয়ের জন্যে প্রস্তুত থাকাই নারীত্ব।
প্রসব, পালন ও সংসারের কাজে নিয়োজিত থেকে নারী প্রজাতির সংরক্ষণ করে এবং নিজে থেকে যায় অপরিবর্তিত। পিতৃতন্ত্র তার জন্য তৈরি করেছে চিরন্তন নারী চিরন্তনী, শাশ্বতী প্রভৃতি ছক। সে ঘরের সীমার বাইরে গেলেও ঘর ও বাইরের মধ্যে তার সেতু হয়ে থাকে স্বামীটি। দেশের বিখ্যাত নারীটিরও পরিচয় স্বামীর স্ত্রী হিসাবে। পিতৃতন্ত্র যে সব নারীকে স্বাকৃতি দেয়, তারাও স্বামীর পরিচয় দিয়েই বোধ করে গৌরব। বিয়ে আজও পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথাগত ব্যাপারগুলোর একটি চলেছে প্রথাগত রীতিতেই।
বিয়ে সংসার নারীকে দেয় দুটি ভূমিকা – গৃহিণী ও জননী। প্রথাগতভাবে নারী এ দুটি ভূমিকা সম্পন্ন করতে পারলেই নারীর জীবন সার্থক বলে গণ্য করা হয়। এই দুটিকেই আদর্শায়িত করেছে পিতৃতন্ত্র। সমস্ত ধর্ম সমাজ সংস্কৃতি নারীর এ দুটি ভূমিকার স্তবগানে মুখর। তবে নারীর এই দুটি ভূমিকায় নারীর মুক্তির প্রতিবন্ধক, সাম্যের বিরোধী। এই দুটি ভূমিকাই নারীকে পালন করতে হয় গৃহ বন্দীত্বের মধ্যে মানবিক সমস্ত ক্রিয়াকলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, এই দুটিই নারীকে বহিষ্কৃত করে সভ্যতা থেকে।
পিতৃতান্ত্রিক এই দৃষ্টিভঙ্গির দুটি বিভাজন বিদ্যমান – ব্যক্তিগত পরিসর এবং গণ পরিসর। ব্যক্তিগত পরিসরে দেখা যায় আবেগের প্রাধান্য অপরদিকে গণ পরিসরে যুক্তির প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম অনুসারে পরিবারের চৌহদ্দি নারীর নিজস্ব ক্ষেত্র এবং পরিবারের বাইরে বিস্তৃত পরিসর পুরুষের ক্ষেত্র। নারীবাদীরা যদিও এটি মানেন না। তাঁদের মতে যদি ব্যক্তিগত পরিসর শুধুমাত্র নারীর নিজস্ব ক্ষেত্র হয় – তাহলে তা কি নারীর নিজস্বতা বা স্বাধীনতা রক্ষা করতে বা দিতে সক্ষম। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায় পরিবারের চার দেওয়ালের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নারীর ওপর যে অনুশাসন থাকে, তা সবসময়ই নারীর নিজস্বতা, স্বাধীন ইচ্ছা বা অভিরুচির ওপর বাধা আরোপ করে। এই দিক থেকে বিচার করলে এই দুই পরিসরের বিভাজন গড়ে তোলা যুক্তিহীন। ১৯৬০ ও ৭০ দশকে সংঘটিত নারীবাদী আন্দোলনের শ্লোগান ছিল ‘Personal is Political’ অর্থাৎ ব্যক্তিগত ক্ষেত্রও রাজনীতি বহির্ভূত নয়। বৈপ্লবিক নারীবাদী তাত্ত্বিক কেট মিলেট স্মরণ করিয়ে দেন যেখানেই ক্ষমতার সম্পর্ক বিরাজমান সেখানেই রাজনীতির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। পরিবার ব্যক্তিগত পরিসর হলেও, পরিবার হয়ে উঠেছে ক্ষমতার সম্পর্কের উদাহরণ, যেখানে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য বা প্রাধান্য বর্তমান।
জন্মমুহূর্তে মানুষ শারীরিক যৌন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায় ঠিকই, কিন্তু তারজন্য সে নারী বা পুরুষ হিসাবে চিহ্নিত হয় না, সমাজে বাস করতে করতেই সে ক্রমে ক্রমে সামাজিক অর্থে নারী বা পুরুষ হয়ে ওঠে। নারীর ভূমিকার এই সামাজিক নির্মাণ নিশ্চিতভাবেই মনে করিয়ে দেয় সিমোন দ্য বোভয়ার অমোঘ উক্তি “One is not born but rather becomes a woman” অর্থাৎ কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, বরং নারী হয়ে ওঠে। Role expectation বা প্রত্যাশিত ভূমিকা বলে সমাজে একটা কথা আছে। পুরুষ ও নারীর কাছ থেকে আমরা কোন ভূমিকাটা প্রত্যাশা করি। কোন ভূমিকাটা কাকে বেশি মানায়, এটা কিছুটা দৈহিক শক্তি ও মানসিক প্রবণতার ওপর নির্ভর করে। কিছুটা হয়তো আমরা হাজার হাজার বছর ধরে ভাবতে অভ্যস্ত বলেই এমনটা ভাবি। প্রথাসিদ্ধভাবে নারীর জ্ঞান ও নৈপুণ্য ঘরকন্না, রান্নাবান্না, সূচিশিল্প, গানবাজনা, কৃষিকাজ ও পশুপালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর বাইরে নারীর নৈপুণ্যকে অন্যদিকে বিকশিত করার সুযোগ কম নারীই পায়। কারণ দৈহিক শক্তিতে পুরুষ শ্রেষ্ঠ, সে বীর। সে জয় করতে পারে পররাজ্য এমন কী রাজকন্যাকেও।
নারীর ভাবমূর্তি সর্বদাই প্যাসিভ। রূপকথার রাজকন্যা দৈত্যপুরীতে শুধু ঘুমিয়ে থাকে। রাজপুত্র পক্ষীরাজের পিঠে চড়ে উড়ে গিয়ে তাকে উদ্ধার করবে সেই আশায়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা উপন্যাসে নারী চরিত্র উঁকি মারে, তবে সে ব্যোমকেশের স্ত্রী সত্যবতী। তার স্থান বাড়ির ভেতরে। রামায়ণ, মহাভারত বা ইলিয়াডের মতো মহাকাব্যেও নারীর চরিত্র নিষ্ক্রিয়। সীতাকে হরণ হতে হয়েছিল কারণ তিনি অবলা। রামায়ণ মহাভারতে কোথাও পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে নারীকে যুদ্ধ করতে দেখা যায়নি। বানররাও যুদ্ধ করেছে কিন্তু নারীরা কেউ অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে আসেনি। পঞ্চস্বামীর সঙ্গে সহবাস করার প্রস্তাবকে দ্রৌপদীও ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করতে পারেনি।
শত শত হিন্দু বিধবা স্বামীর চিতায় পুড়ে মরেছে বা পুড়ে মরতে বাধ্য হয়েছে কিন্তু খুব কম নারীই মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে থাকার জন্য পালিয়ে গিয়েছে। পালাতে যে পারেনি তার কারণ তারা জানত সমাজে একা নারীর স্থান নেই। স্বামী মারা গেলে সেই বাকী জীবন শ্বশুর বাড়িতে লোকেদের হাতে নিগ্রহ। স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একজন নারীর ঘটে সামাজিকভাবে মৃত্যু। তাঁর জীবন থেকে সমস্ত রং কেড়ে নিয়ে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় সাদা রং। এটাই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নিয়ম। অনেক সময় তাদের জায়গা হয় পতিতালয়ে।
পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে চিহ্নিত করে এসেছে যৌনতার প্রতিমূর্তি হিসাবে। এই যৌনপুতুলকে কে বা কারা অধিকার করবে সেই নিয়েই তো পুরুষের পাওয়ার পলিটিক্স। নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যৌনতা হচ্ছে একটি শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিফলন লক্ষ করা যায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও। অনেক কাজের ক্ষেত্রে দেখা যায় মেয়েরা পুরুষদের তুলনায় কম পারিশ্রমিক পায়। কর্মক্ষেত্রে নারী নানাভাবে যৌন হেনস্থা ও যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও চিরাচরিত ধারণা প্রচলিত যে নারী পুরুষের তুলনায় কম দক্ষ। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় যে আদর্শে বিশ্বাস রাখা হয় তা হল যে নারীর জীবনে মাতৃত্ব হচ্ছে সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা, কারণ নারী সন্তানের জন্ম দেয় এবং প্রতিপালন করে। ফলে নারী সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয় এবং মূলত গৃহকর্মে পূর্ণ সময়ের জন্যে নিযুক্ত হয়। অন্যদিকে সামাজিক উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে পুরুষ কর্মরত থাকে এবং পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করে। ফলে জীবনধারণের জন্যে অর্থনৈতিক ভাবে নারীকে পুরুষের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। এইভাবেই পিতৃশাসন নারীকে অর্থনৈতিক ভাবে পরাধীন করে রাখে। তাছাড়া নারীর গার্হস্থ্য শ্রমের কোনো অর্থনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।
রোকেয়ার মতে নারীর পুরুষাধীনতার দুটি প্রধান কারণ – শরীর ও অর্থনীতি। তাঁর মতে পুরুষ নারীকে প্রথমে শারীরিক শক্তিতে পরাভূত করেই বন্দী করেছে, শেষে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে বের করে দিয়ে করে তুলেছে অসহায়। তিনি বিশ্বাস করতেন শারীরিক শক্তিতে নারী কখনও পুরুষের সমান হবে না, এমনকি দরকার আছে বলেও তিনি মনে করতেন না। তবে তাঁর মতে যদি অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে ঘুচবে নারীর স্বাধীনতা। স্বামীর সংসারে নারী বেতনহীন দাসী। তিনি বলেছেন, “কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক।” কিন্তু আজো কন্যাগুলোকে সুশিক্ষিত করা হয়নি, আর যাদের করা হয়েছে তারা কর্মক্ষেত্রের স্বাধীনতার থেকে পছন্দ করে শুভবিবাহের শিকল।
প্রথম উচ্চশিক্ষিত বাঙালি তরুণীদের অনেকেই বিয়ে করেননি, বা অনেকে বিয়ে করেছিলেন বেশি বয়েসে – চন্দ্রমুখী বসু, ভার্জিনিয়া মেরি মিত্র, কামিনী রায়, সরলা, কুমুদিনী বিয়ে করেন তিরিশ পেরোনোর পর এবং যাঁরা বিয়ে করেছিলেন তাঁদের কারো কারো জীবনে শিক্ষা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম দিকের স্নাতক কামিনী রায় বিয়ের আগে কবিতা লিখতেন, বিয়ের পর বিয়ের সুখে এতো পাগল হয়ে যান যে আর কবিতা লেখেননি, আবার লিখেছিলেন যখন স্বামীর মৃত্যুতে সংসার সুখ থেকে মুক্তি পান। ষাটের দশকেও শিক্ষিত তরুণীরা বিয়ে সংসার এসবের বাইরে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করত, কিন্তু এমনকি ইসলাম ধর্মের শরীয়া আইনে বিবাহের সাক্ষীর ক্ষেত্রেও বলা হয়েছে দুজন নারী একজন পুরুষের সমান সাক্ষী। এক্ষেত্রেও রয়েছে ক্ষমতার বৈষম্য।
তবে সবশেষে একথা স্বীকার করতেই হয় যে নারী পুরুষের বৌদ্ধিক কোনো তফাত নেই। নারী ক্রিকেট টিম তৈরি হয়েছে, কুস্তি লড়ছে, যুদ্ধ করছে, পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে কাজ করছে, ট্রাফিক পুলিশ রোদ বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রাস্তায় ট্রাফিক সামলাচ্ছে, নারী প্লেন চালাচ্ছে, শুধু তাই নয় কল্পনা চাওলা ও সুনীতা উইিলয়মের মত মেয়েরা মহাকাশে যাচ্ছে। নারীরা সব পেরেছে। বেদের সুক্ত ও যেমন রচনা করেছে তেমনি মুসলিম নারী বোরখা খুলে রেখে যুদ্ধও করেছে। ইন্দিরা গান্ধীই তো ইতিহাসে একমাত্র রাজনীতির পুরুষচক্র ভাঙেননি। সুলতানি আমলে সুলতানা রাজিয়া ওমরাহদের চল্লিশের চক্র ভেঙ্গেছিলেন।
নারী যখন নিজে ক্ষমতায়িত হয় তখন সে শুধু নিজে নয়, আরও অসংখ্য নারীকে ক্ষমতায়িত করে। যেমন মাদার টেরেসার নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা শুধু তাঁরই নিরলস মানব পূজার পুরস্কার ছিল না এতে গোটা বিশ্বের নারী সমাজই অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
তবে নারীও আজও তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত নয়। তাই তার অটোনমির জন্য আন্দোলন আজও শেষ হয়নি। প্রকৃতিই তাকে অর্ধেক মানবী করে গড়েছে। বোভোয়ার ভাষায় দ্বিতীয় লিঙ্গ। তবে সবশেষে একথা স্বীকার করতেই হয় যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বেড়াজালে নারীরা সম্পূর্ণ শক্তিহীন নয়। যদি সমাজে ক্ষমতার বিভাজন সর্বত্রই বিদ্যমান একথা অস্বীকার করা যায়। নারীবাদীদের মতে নারীর নিজের শরীর, যৌনতা, কামনা-বাসনা এবং প্রজনন সবকিছুর ওপরেই নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। এমনকি যৌনকর্মে পুরুষের সমান নারীও অংশ নিতে পারবে। কিছু কিছু নারীবাদীরা বিপরীত লিঙ্গের প্রতির আকর্ষণ হওয়ার বিষয়টিকে উপেক্ষা করে সমকামিতাকে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁদের মতে এই সমকামিতা হচ্ছে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ।
বিশ্বজুড়ে নারীর জন্য পুরুষ যে আলাদা সংস্কৃতির স্টিরিও টাইপ তৈরি করে এসেছে তার জন্যই নারী হয়ে উঠেছে তাদের পছন্দের চাহিদা মেটাবার জন্য তাদের মনের মতো। নারীর নিজস্ব ক্ষমতা নেই, থাকলেও পুরুষের তুলনায় তার কম ক্ষমতা। নারী পুরুষের চেয়ে অনেক কম সম্পদের মালিক। সে পুরুষের তুলনায় চাকরিতে অনেক বেশি পরিশ্রম করে, আবার তাকে অনেকটা সময় বাড়ির কাজে দিতে হয়। পুরুষের তুলনায় তার আয়ও কম। সে স্বীকার করে নিয়েছে পুরুষের তুলনায় কম মর্যাদা তার। বাধ্য হয়েছে, বাধ্য হয়েছে সে ‘More Co-operative less dominant’ ভূমিকা পালন করতে। এর ওপরে বাবা মায়ের আছে প্রভাব। মেয়ে যেই ছোট থেকে বড়ো হয়ে উঠল অমনি তার ইচ্ছামত বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল, একা বেরুতে বারণ, সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়ির বউ কোথায় যাচ্ছে শাশুড়িকে বলে যাবে, হুট হাট করে বাপের বাড়ি যাওয়া যাবে না। নারীর জন্য উঠতে বসতে নিয়ম। পুরুষের জন্য কোনো নিয়ম নেই। অভিভাবকদের কাছে নারীর ভবিষ্যৎ মানে তাকে ভাল পাত্রের হাতে তুলে দিতে হবে, মানে বিয়ে দিতে হবে। পড়াশোনা করে চাকরি পেলেও বিয়েতেই তার সামাজিক সম্মান। বিয়েই নারীর মোক্ষ। লেখাপড়া শেখানোই হয় ভালো পাত্র পাওয়ার জন্য। আবার চাকরিও করছে তার থেকে আরও ভালো পাত্র পাবার জন্য। কারণ এখন পাত্রপক্ষ রূপের সাথে রোজগেরে গুণী গৃহ কর্মে সুনিপুণা পাত্রী চাই। আবার বেশি লেখাপড়া শেখানোর ফলে অনেক মেয়ের উপযুক্ত পাত্র জুটছে না। মেয়েদের চাকরি করাটা যে তার ক্ষমতায়নের জন্য দরকার এই চেতনা অভিভাবক দূরে থাক কটা মেয়েই বোঝে।
একটা মেয়েকে যদি তার মতো করে থাকতে দেওয়া হয়, তার নারী সুলভ সহজাত গুণগুলি যদি পুষ্পের মতো নিজ থেকেই বিকশিত হয় তাতে ক্ষতি কী ? প্রকৃতিই তাকে সৃষ্টি সুখের উল্লাস প্রাণ ভরে গ্রহণ করার মত তৈরি করেছে। প্রত্যেক মেয়েদের সার্বজনীন শিক্ষার বাইরেও লিঙ্গ সদৃশ শিক্ষারও প্রয়োজন আছে। এতে তাদের লিঙ্গগত সহজাত প্রবণতাগুলি আর একটু সতেজ হবে। এগুলো তো মূল্যবোধেরও অঙ্গ। মেয়েরা যে কোনো পেশা গ্রহণ করতে পারে। তাতে কোনো সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায় না।
শুধু তাই নয় বিয়েতে স্বামী স্ত্রীর যে প্রথাগত ভূমিকা রয়েছে তারও বদল ঘটা দরকার। স্ত্রীকেই যে দেখতে হবে সংসার, এটা অবধারিত মনে করার কারণ নেই। যদিও নারীর শিক্ষা, কাম ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যাকে বলা হয় ‘ইত্রসই ফ্যাক্টর’ বদলে দিচ্ছে বিয়ে ও সংসারের চরিত্র। প্রথাগত বিয়ের বদলে দেখা দিচ্ছে উন্মুক্ত বিয়ে, বহুজনীয় বিয়ে, একত্রবাস এবং বদলে যাচ্ছে পরিবার সংস্থা। এই ভাবে একদিন প্রথাগত বিয়ে হয়ে উঠবে অতীতের ব্যাপার। একই সাথে পুরুষের সঙ্গে নারীর যে ক্ষমতার বৈষম্য সমাজে বিদ্যমান সেটিও ঘুচবে কালের নিয়মে। “Men and women live heir assigned roles, equal in importance. The play cannot go on without both kinds of performers. Neither of them ‘contributes’ more or less to the whole; neither is marginal or dispensable. But the stage set is conceived; painted; defined by men. Men have written the play, have directed the show, interpreted the meaning of action. They have assigned themselves the most interesting, most heroic parts, giving women the supporting roles.” এই সমস্ত কিছুই পুরুষের দ্বারা নির্ধারিত। পরিশেষে এককথায় বলা যায় ইতিহাসের কালের গতিতে এক সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যেমন অন্য একটি সমাজ ব্যবস্থা এসেছে অন্য কথায় বলতে পারি যেমন রাত যতই অন্ধকার হোক না কেন দিনের আলোতে সেই অন্ধকার ঘুচবেই, তেমনি মেয়েরা যখন এতটা পথ এগিয়েছে নিজেদের অধিকার আদায়ের দাবিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তেমনি তারা একই সাথে প্রমাণ করেছে যে তারা ক্ষমতাহীন নয়। তারা অর্ধেক মানবী, দ্বিতীয় লিঙ্গ, others বলে গণ্য হলেও সেই দিনও আসবে শীঘ্রই যেদিন তারা মানুষ হিসাবে সমাজে পরিচিতি লাভ করবে। প্রতিষ্ঠিত হবে লিঙ্গসাম্য। যেখানে স্ত্রী পুরুষ সকলেই সমান ক্ষমতার অধিকারী হবে এবং অধিকার ভোগ করবে উভয়েই সমান ভাবে।
গ্রন্থপঞ্জী
চক্রবর্তী, বাসবী। ২০১১। নারী পৃথিবী : বহুস্বর। কলকাতা : উর্বী প্রকাশন।
চন্দ, পুলক। ২০০৮। নারী বিশ্ব। কলকাতা : গাংচিল।
বাগচী, যশোধরা। ২০১২। নারী ও নারী সমস্যা। কলকাতা : অনুস্টুপ।
মুখোপাধ্যায়, অধাপক দুলাল, ড. উদয়শঙ্কর কবিরাজ ও তারিণী হালদার। ২০১৭। লিঙ্গ প্রসঙ্গে বিদ্যালয় ও সমাজ। কলকাতা : আহেলি পাবলিশার্স।
Biswal, Tapn. 2006. Human Rights Gender and Enviroinment : Delhi : Viva Books Pvt. Limited.
Ghosh, Arunabha. 2010. Women in India. Kolkata : Mitram.
রায়, ভারতী। ২০১৪। নারী ও পরিবার বামাবোধিনী পত্রিকা। কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স।
সেনগুপ্ত, মল্লিকা। ১৯৯৪। স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ। কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স।
সরকার, কল্যাণ কুমার। ১৪২৫। নারীবাদ, লিঙ্গ রাজনীতি ও নারীর ক্ষমতায়ন। কলকাতা : এবেনেল প্রেস।
সিংহ, কঙ্কর। ২০১৪। সিমোন দ্য বোভোয়ার : দ্বিতীয় লিঙ্গ, কলকাতা : র্যাডিক্যাল।
0 Comments
Post Comment