- 26 May, 2020
- 0 Comment(s)
- 1472 view(s)
- লিখেছেন : শহীদুল ইসলাম
গত ১০ মে মুখ্যমন্ত্রীদের ভিডিও বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন গ্রামে যেন করোনা সংক্রমণ না ছড়ায়। গ্রামের কথা ভাবার জন্য ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীকে। ২০১১-র সেনসাস অনুযায়ী ভারতে গ্রামের সংখ্যা ৬,৩৮,৩৬৫। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৯ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৯১,৮০,৮৩,৪০১ জন বাস করে গ্রামে। তাই গ্রামে যদি গোষ্ঠী সংক্রমণ একবার শুরু হয়, তিনি জানেন রোখা বড় কঠিন হবে। গ্রামের একশো কোটির কাছাকাছি মানুষের ভয়াবহ জীবনযাপনের কথা আমরাও অল্পবিস্তর সবাই জানি।
প্রাইমারি স্কুলে যখন পড়তাম, সেইসময় গ্রাম সম্পর্কে পড়ানো হতো। গ্রামের ছবি আঁকা থাকতো। মাটির দেওয়াল, খড়ের চালের ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট বাড়ি, রাস্তায় শস্য বোঝায় গরুর গাড়ি, ক্ষেতে চাষের কাজ চলছে, পুকুরে হাঁস সাঁতার কাটছে, কিছু মানুষ স্নান করছে, বাচ্চারা জলে দাপাদাপি করছে আর পুকুর ঘাটে মহিলারা থালা-বাসন মাঝছে। সাদা-কালোয় আঁকা মনোরম একটা ছবি। আমরা সেটাকে রাঙিয়ে তুলতাম নানা রঙে। তবে এখনকার গ্রামের ছবি অনেকটাই পালটে গেছে। ঢুকেছে আধুনিকতা। বিদ্যুৎ, মোবাইল, নেটের ছড়াছড়ি। এখানেই প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘আধুনিক’ গ্রাম কি দুর্দশামুক্ত হয়েছে? আমি কেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিলক্ষণ জানেন গ্রামের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কথা।
আমরা যারা শহরে বাস করি, তাদের বাড়িতে আছে কি একটা উঠোন, উঠোনের এক প্রান্তে রান্নাশালা, আরেক প্রান্তে গোয়াল ঘর, খড়ের গাদা, ধানের গোলা, হাঁস-মুরগির ঘর? গ্রামের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত— সব অর্থনৈতিক অবস্থানের মানুষের বসবাসের চিত্রটা প্রায় একই। গবাদি পশু, প্রকৃতির সঙ্গে সহবাস শহরের ক জন মানুষ করে? পরিসংখ্যানের তালিকায় খুঁজেই পাওযা যাবে না। এই অবস্থায় গ্রামের মানুষজনের পক্ষে করোনা রোখার জন্য লকডাউনের সব বিধি-নিষেধ মেনে চলা কখনই সম্ভব নয়। কয়েকটি চিত্র তুলে ধরছি
সামাজিক দূরত্ব: গ্রামের কৃষকদের মাঠে যেতেই হয়। ফসল কেটে বা তুলে বোঝা বেঁধে মাথায় কিংবা গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে বা শস্য গোলায়। একটা বোঝা বেঁধে মাথায় তোলা একা মানুষের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। কমপক্ষে দুজন মানুষের দরকার। এবং প্রায় শরীর-ছোঁয়া কাছাকাছি এসে তবেই কারও মাথায় বোঝা তোলা যায়। সামাজিক দূরত্ব নিয়ে টিভিতে, খবরের কাগজে, সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষজ্ঞদের কত মতামত— হেন করবেন, তেন করবেন। তাঁদের কাছে প্রশ্ন— গ্রামের কৃষক, চাষী, শ্রমিকরা (ফিরছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা) কীভাবে ‘শহুরে’ সামাজিক দূরত্ব পালন করবেন ভেবেছেন কি? থাক, কুল পাবেন না। কারণ কৃষি-ভারত যন্ত্র চালিত নয়। এটা বিলক্ষণ জানেন প্রধানমন্ত্রী।
মাস্ক: মন্ত্রী-সান্ত্রী, নেতা-নেত্রী এবং ‘টিভি-পণ্ডিত’দের চেতাবনি— অবশ্যই মাস্ক পরুন। মাস্ক পরা কেন জরুরি এতদিনে গ্রামের দিন আনি দিন খাই মানুষগুলো নিশ্চয় জেনেছেন। কিন্তু এর বৈজ্ঞানিক ব্যবহার সম্পর্কে এঁরা কতটুকু জেনেছেন যথেষ্ট সংশয় আছে। সেই সঙ্গে রয়েছে অর্থনীতিও। মাস্ক কেনার পয়সা কোথায়? সেখানে পাতলা বুননের গামছা, অনেক দিনের আকাচা শাড়ির আঁচল কিংবা ওড়নায় সই।
স্যানিটাইজেশন: গাল ভরা কথা। বাবুমশাইরা একটু আগেই গ্রামের বাড়ির মোটামুটি একটা চিত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কাঁচা উঠোন গোবরে নিকোলেই বাড়ি জীবাণুমুক্ত হবে তো? WHO কিংবা বিশেষজ্ঞরা কী বলেন ওঁদের জানা নেই। গবাদিপশুকে জাবনা দেওয়া, গায়ের দুধ দোয়া— নানা কাজে সারাদিনে অনেক বার গোয়ালঘরে যেতে হয় বাড়ির মহিলা-পুরুষদের। গোয়াল ঘর জীবাণুমুক্ত করার উপায় ওঁদের জানা নেই। সর্বোপরি নিজের শরীরকে জীবাণুমুক্ত করার উপায় কী? দামি হাতশুদ্ধি দূরঅস্ত, অত সাবান কেনার পয়সা কোথায়? যদিও বা সাবান জোগাড় করা গেল, হাত-গা ধোবেন কোথায়? বাড়িতে কলের জল নেই, নেই টিবওয়েলও। পাইপ লাইনে জল সরবরাহের ব্যবস্থা না বলাই ভাল। নামমাত্র কোনও কোনও গ্রামে সরকার জলের ট্যাঙ্ক তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই জল বাড়ি বাড়ি পৌঁছায়নি। ফলে কলতলায় দীর্ঘ লাইন এবং সেই পুকুরই ভরসা। যেখানে শৌচ থেকে আরম্ভ করে গবাদিপশুর স্নান সব চলে।
গ্রামের এই রকম হাজারো দুর্দশার কথা আমরা অনেকেই জানি। বিলক্ষণ জানেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তাই তো তাঁর আশঙ্কা। ধন্যবাদ। কিন্তু সমাধানের পথ দেখালেন না। হয়তো কোনও ‘মিরাকেল’ জানা নেই। এটাও বুঝেছেন থালা বাজানো, আলো জ্বালানোর চমকে আর কাজ হবে না। তবে আমরা আশাবাদী, গ্রামের মানুষ নিজেরাই এই যুদ্ধ জয় করবেন।
প্রতীকী ছবি
লেখক সাংবাদিক এবং সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment