রায়াদির ক্লিনিক (পর্ব-৫)

  • 01 August, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 465 view(s)
  • লিখেছেন : রুমেলিকা কুমার
ফিরে আসেনি। ফিরে এলে কি লিখতাম, কি বলতাম জানিনা। ফিরে যখন আসেনি তখন নিশ্চিন্ত মনে বাড়তি ঝামেলা ঝেড়ে ফেলে  সুস্থ মনে বাড়ি ফেরা যায়। ফিরে যখন আসেনি উত্তর দিতেই হবে এরকম কোন দিব্যি থাকে না। বাসে ফেরার সময় মাথায় ঘোরে খানিক। নিরাপদ কম্ফোর্ট জোনে মানুষজনের ভিড়ে হারিয়ে যায় সে।

ফিরে আসেনি। ফিরে এলে কি লিখতাম, কি বলতাম জানিনা। ফিরে যখন আসেনি তখন নিশ্চিন্ত মনে বাড়তি ঝামেলা ঝেড়ে ফেলে  সুস্থ মনে বাড়ি ফেরা যায়। ফিরে যখন আসেনি উত্তর দিতেই হবে এরকম কোন দিব্যি থাকে না। বাসে ফেরার সময় মাথায় ঘোরে খানিক। নিরাপদ কম্ফোর্ট জোনে মানুষজনের ভিড়ে হারিয়ে যায় সে।

দু সপ্তাহ আগে একবারই এসেছিল। মাঝে মাঝে কিছু না বলেও অনেক কিছু বলা যায় হয়তো। তখন ঘরটা আপনাআপনি ফাঁকা হয়ে যায়। ঘরে দুজন মানুষ দু দিকে বসে থাকে। শান্তি অশান্তিতে। এক দু মিনিট কেটে যায়। তারপরই বোধহয় গল্প শুরু হয় …।

তখনও ঘর ফাঁকা হয়ে গেছিল।  অন্য বারের শূন্যতায় দ্বিধা কাটে। এই ফাঁকায় দ্বিধা দ্বন্দ্বে তখনও বাতাস ভরপুর। খান এক দু মিনিট পরে -  আগের মাসে মাসিক হয়নি। প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়েছে। নেগেটিভ এসেছে।

ইউ এস জি করাতে পারবে? পাশে একটা সরকারি হাসপাতাল আছে। ওখানে গিয়ে করিয়ে নাও একবার।    

চুপ করে রইল।

জিগ্যেস করলাম - কিছু সমস্যা আছে?

হাসপাতালে গেলে বাড়ির লোক জেনে যাবে।

বাড়ির লোককে নিয়েই যেও। যেতে সমস্যা থাকলে বাইরে থেকেও করিয়ে নিতে পারো। কাছের কোনো জায়গা থেকে?

বাড়িতে জানাতে চাইছি না। বাইরে করালে জানাতে হবে। এই টেস্টে হবে না?

বাজারে এরকম ইউরিন প্রেগ্ন্যান্সি টেস্ট(UPT)-এর ছড়াছড়ি। মাতৃত্বের আনন্দের সাথে দুদাগের সম্পর্ক নিয়ে অ্যাড ও মাঝেমধ্যেই সিরিয়ালের মাঝে দিব্যি চোখ পড়ে।  গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে  B-HCGর মাত্রা কম থাকলে অনেক সময় ফলস নেগেটিভ চলে আসে। মিথ্যে রিপোর্ট কিন্তু সত্যি। অগত্যা উপায়??

উপায় একসপ্তাহ পরে আবার টেস্ট করানো। শুরুর দিকে একসপ্তাহেই হরমোনের মাত্রা বাড়ে প্রায় দ্বিগুণ। তাই একসপ্তাহ পরে করালে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রিপোর্ট পজিটিভ আসে।

-হবে না নয়। তবে ইউ এস জি করে নিলে বেশি ভাল হত। ঠিক আছে এক কাজ করো। এক সপ্তাহ পরে আরেকবার করে আনো। পরের সপ্তাহে আমাকে জানিও কি হল।

এরপরের নিস্তব্ধতা বোঝালো গল্প এখনো বাকি। ক্ষনিক পরে বলল – আচ্ছা ম্যাডাম যদি বাচ্চা আসে তো?

তুমি রাখতে চাও।

না।

তাহলে ওষুধ খেতে পারো। তবে সরকারি হাসপাতালে গিয়ে ধুয়ে নেওয়াটা বেশি ভাল ।

ম্যাম আপনি করে দিতে পারবেন না?

এখানে কি করে করব? এখানে এসব তো হয়না। হাসপাতালে যেতে পারবে না কেন? কিছু সমস্যা আছে? 

না। হাসপাতালে গেলে বাড়িতে জানবে। জানলে করতে দেবে না।

কেন?

শাশুড়ি চাইছে আরেকটা বাচ্চা নিয়ে নিতে।

তোমার বাচ্চা আছে?

হ্যাঁ দুই বছরের একটা ছেলে আছে। ওকে নিয়ে সারাদিন চলে যায়। ও বড়োই ছোট। এক্ষুণি আরেকটা বাচ্চা এলে আমি সামলাতে পারব না।

তুমি বাড়িতে বলেছ তুমি চাও না?

বহুদিন থেকে জোর করছে আরেকটা নেবার জন্য। রাগারাগি করছে ওর বাবা। আমি চাই না। ঐজন্যই আপনার কাছে আসা। এখান ছাড়া আর কোথাও যেতে পারব না আমি। আপনি এখানে থেকে কিছু করতে পারবেন না? কোন ওষুধ খেলে হবে না ম্যাডাম? আমাকে লিখে দিন না।

হয়। মেডিকেল পদ্ধতিতে অ্যাবর্শন হয়। কিন্তু এমটিপি করানোর অধিকার সবার নেই। সঠিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার বাদে সেই নির্দেশ কারোর দেওয়ার অধিকার নেই। অতএব? পরের পাঁচ মিনিট কাটল মাথা ধরে বসে থেকে।

ঠিক আছে তুমি আগে পরের সপ্তাহে করিয়ে আনো। তারপর দেখছি কি করা যায়। 

পরের একসপ্তাহ মাঝেমধ্যেই মাথায় এসেছে। কি করব ভেবেছি। সমাধান পাইনি। যে সমাধান পেয়েছি- দিতে চাইনি সেই সমাধান।  ক্লিনিকে ঢোকার মুখে চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়েছি সে এসেছে কি না।

আসেনি। বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।

নিজে নাই বা বাঁচুক। আমাকে বাঁচিয়েছে। পড়েছিলাম অ্যাবোর্শান করতে গেলে শুধু মায়ের কনসেন্টই জরুরি। বইয়ের অক্ষরগুলো মাঝেমধ্যেই তালগোল পাকিয়ে হিজিবিজবিজ হয়ে পেটে খিল ধরায় এখন।

তার কি হল? বাদ দিন। বরঞ্চ একটা চাকরি দিতে পারবেন? বছর ত্রিশের একটা ছেলেকে কেউ একটা চাকরি খুঁজে দিতে পারেন? ছেলেটার দুদিন পরে বিয়ে।।

ছেলেটা  আকাশছোঁয়া ঝকঝকে মলের ফুডকোর্টে রোজ দশ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলে মেয়েরা, প্রেমিক প্রেমিকারা, আত্মীয় পরিবার আসে। ওর চোখের সামনে দাঁড়ায়। ওকে দেখতে পায় না। পিছনে রঙিন খাবারের লিস্টিতে ফোকাস পড়ে ব্লার হয়ে যায় ছেলেটা। যেমন আমার চোখের সামনে ব্লার হয়ে গেছিল ছেলেটার নাম।  ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে যখন ফাঁকতালে বাথরুমের দিকে এগোয় ও, চোখে অন্ধকার পর্দা পড়ে দশ সেকণ্ডের জন্য। মাথা ঝ্বটিকা সফরে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে। দেওয়াল ধরে সামলে নেয় ছেলেটা। চোখে মুখে জলের ফোঁটা গুলো বিন্দু বিন্দু ঘামের সঙ্গে এক হয়ে যায়। পরের কাস্টমারের বিল রেডি করতে থাকে সে …

১১টায় মল থেকে বেরোয় যখন, রাস্তা ত্রিফলা উন্নয়নের নেশায় ঝিমোচ্ছে। একদিক থেকে সুবিধা। হঠাৎ সূর্যের আলো পেয়ে চোখে ঝলক লাগে না। বাড়ি ফেরে। খাবারের বিল বানাতে বানাতে নিজের পাকস্থলী যতই বিদ্রোহ করুক গল্প আড্ডা ব্যস্ততা প্রেমের আওয়াজে মিলিয়ে যায় সেই বিদ্রোহ।  

পাঁজর দিয়ে সরীসৃপ বয়ে যায় রাতে শোবার সময়। চোখের নিচে এতটাও কালি ছিল কি? পরের খাবারের অর্ডারটা চলে এসেছে।

ফিট সার্টিফিকেট নেবার জন্য সামনে বসে আছে ছেলেটা। দুসপ্তাহ আগের ছুটি। হপ্তায় একদিন ছুটি থাকে। বাকি ৬ দিন দশ ঘণ্টা। বুকের চিন চিনটা দিন দিন বাড়ছে। দুদিন অফিস কামাই গেল। উসুল করতে পরের ১৫ দিন ধরে লাগাতার দশ ঘণ্টার প্রতীক্ষার শিফট। ভেতর থেকে ধাক্কা মেরে থামতে বলছে গোটা শরীর। দশ ঘণ্টা একটানা দাঁড়ালে  কি সমস্ত রক্ত নেমে যেতে পারে?

চাকরি বদলাও। এ চাকরি করলে শরীর আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। বছর ত্রিশেক। ক্লাস টেনের পর পড়া হয়নি .- খুঁজছি অন্য চাকরি। পাচ্ছি না।

হোয়্যাটসাপে মেসেজ ঢুকছে। মেডিক্যাল সার্টিফিকেট নিয়ে আজকে সাবমিট করবে। প্রেসক্রিপশন হাতে থ্যাঙ্ক ইউ বলে চলে যায় ছেলেটা। প্রেস্ক্রিপশনে লেখা take adequate rest  টা দেখে হাসতে হাসতে।

একটা জীবন দিতে পারবেন ওকে কেউ ??

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৬ এপ্রিল ২০২২ 

লেখক : চিকিৎসক, সমাজকর্মী

ছবি : সংগৃহীত

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment