রূপজালাল : বাঙালি মুসলিম মহিলার লেখা প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ

  • 27 March, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1760 view(s)
  • লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার হোসনাবাদ পরগনার লাকশামের কিছুটা দূরে পশ্চিম গাঁয়ে ফয়জুন্নেসার জন্ম। গৃহশিক্ষক তাজউদ্দিনের কাছে বাল্যকাল থেকে বাড়িতেই তাঁকে পড়ানোর ব্যবস্থা হয়। প্রবল ছিল তাঁর জ্ঞানস্পৃহা। বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, পারসি এই চারটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। নিজগৃহে ‘ফয়জন পাঠাগার’ স্থাপন করে সেখানেই বিদ্যাচর্চা করেন।

১৮৭৬ সাল। ঢাকা থেকে প্রকাশিত হল নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর (১৮৩৪-১৯০৩) ‘রূপজালাল’ বইটি। এটি বাঙালি মুসলিম মহিলা রচিত প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। একই বছর কলকাতা থেকে স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘দীপনির্বাণ’ প্রকাশিত হয়। ‘দীপনির্বাণ’ প্রথম বাঙালি মহিলা রচিত উপন্যাস। ১৮৫২ সালে ‘ফুলমনি ও করুণার বিবরণ’ প্রকাশ করে হ্যানা ক্যাথরিন মুলেন্স বাংলা ভাষায় প্রথম   ঔপন্যাসিকের স্বীকৃতি পান। কিন্তু প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী। আর ফয়জুন্নেসার ‘রূপজালাল’ কিছুটা আত্মজীবনীমূলক লেখা। লেখক নিজের বঞ্চিত জীবনের  কাহিনিকে রূপকের আড়ালে এই রচনায় ব্যক্ত করেছেন। এটিকে উপ্যাখ্যান বলে অভিহিত করেছেন সমালোচকগণ। গদ্য-পদ্যের মিশ্রণে কিছুটা আরব্য উপন্যাসের ছাঁচে রচিত। ‘রূপজালাল’-এর ভাষা খাঁটি বাংলা। বিষয় বিচারে এবং আঙ্গিকগত দিক থেকে গ্রন্থটি সমসমসাময়িক অন্য গ্রন্থগুলির পাশে স্থান পেতে পারে।

বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার হোসনাবাদ পরগনার লাকশামের কিছুটা দূরে পশ্চিম গাঁয়ে ফয়জুন্নেসার জন্ম। গৃহশিক্ষক তাজউদ্দিনের কাছে বাল্যকাল থেকে বাড়িতেই তাঁকে পড়ানোর ব্যবস্থা হয়। প্রবল ছিল তাঁর জ্ঞানস্পৃহা। বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, পারসি এই চারটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। নিজগৃহে ‘ফয়জন পাঠাগার’ স্থাপন করে সেখানেই বিদ্যাচর্চা করেন।  ‘রূপজালাল’ লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে ফয়জুন্নেসার কিছু বিবৃতি রয়েছে। তাঁর পিতা আহমদ আলী চৌধুরীর দূর সম্পর্কীয় ভাগনে মহম্মদ গাজী চতুর্ধূরীর পিতা-মাতা ছিলেন না। আহমদ আলী চৌধুরী তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। গাজী চতুর্ধূরী ফয়জুন্নেসাকে ভালবেসে ফেলেন এবং বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ফজুন্নেসার পিতা-মাতা নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দিতে অসম্মত হন। এতে গাজী চতুর্ধূরীর সংসারের প্রতি অনীহা বেড়ে যায়। তখন তাঁকে বুঝিয়ে ব্যবস্থা করা হয় অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার।

ফয়জুন্নেসার পিতার মৃত্যুর পর গাজী চতুর্ধূরীর স্ত্রী থাকা অবস্থাতেও তাঁর মায়ের কাছে আবার  ফয়জুন্নেসাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠান। নানাপ্রকার চেষ্টায় ফয়জুন্নেসার সঙ্গে বিয়ের সম্মতি  আদায়ও  করেন। গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য অংশে ফয়জুন্নেসা লিখেছেন, ‘স্বচক্ষে স্বপত্নী দেখিয়াও জননী আমাকে সলিলে ভাসাইলেন। কিন্তু পরিণয়ের পর কএকবৎসর সুখেই গত হইল। পতি আমাকে আপন প্রাণ অপেক্ষাও ভালবাসিতে লাগিলেন। একমুহূর্তের জন্যও আমাকে চক্ষুর অন্তরাল করিতে পারিতেন না। ইতিমধ্যে বিভুর ইচ্ছায় দুইটী কন্যাও জন্মিল। আমার প্রতি পতির ঈদৃশ অনুরাগ দেখিয়া সতিনীর অন্তঃকরণে বিষম হিংসা জন্মিয়া উঠিল। কিরূপে আমাকে স্বামীর চিত্ত হইতে দূরীভূত করিবে তাহার অনুসন্ধান করিতে লাগিল। গোপনে বহু মুদ্রা ব্যয় করিয়া অনেক তান্ত্রিক দ্বারা, যিনি আমাকে প্রাণাধিক জ্ঞান করিতেন, আমাকে তাহার চক্ষের শূল করিয়া তুলিল। হায়! কুহকের কি আশ্চর্য্য প্রভাব।  তাহার ক্ষণ অদর্শনে দেহ জীবনশূন্য বলিয়া বোধ হয়, তাহারই চির বিচ্ছেদে অভিলাষ জন্মে।’

যৌবনের অবরুদ্ধ প্রেমকে বুকে লুকিয়ে বিপর্যস্ত জীবন নিয়ে শুরু হল ফয়জুন্নেসার নতুন পথে যাত্রা। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন অনেকটা ফুটে উঠল ‘রূপজালাল’ গ্রন্থে। কাহিনির নায়িকা রূপবানু, ফয়জুন্নেসা নিজে। নায়ক জালাল ফয়জুন্নেসার স্বামী গাজী চতুর্ধূরী। নায়ক জালাল রূপবানুকে ভালবাসে। অথচ ঝমঝম রাজের কন্যা হুরবানুকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। গাজী চতুর্ধূরী যেমন নাজমুনকে বিয়ে করেও ফজুন্নেসাকে চেয়েছিলেন, তেমনই জালালও হুরবানুকে বিয়ে করলেও রূপবানুর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। রূপবানু লাভের পর আবার জালালের মন বিষাদে ঢেকে যায় হুরবানুর কথা ভেবে। জালালের এই অস্থিরচিত্ত দেখে ক্ষোভে রূপবানু বলে-

 নাগর গণের সত্য বটে হেন রীতি।

 একজন প্রাপ্ত হলে অন্যে যায় মতি।।

 যদবধি আশার সুসার নাহি হয়।

 সে পর্য্যন্ত প্রাণ পণ করয়ে নিশ্চয়।।

 আশা পূর্ণে প্রাপ্তজনে তুচ্ছজ্ঞান করে।

 নবনব প্রেমাঙ্কুর সদায় অন্তরে।।

জালালের কষ্টের কথা ভেবে রূপবানু পরামর্শ দেয় হুরবানুকে নিয়ে আসার। গ্রন্থের শেষে দেখা যায় রূপবানু আর হুরবানুকে নিয়ে জালাল সুখের সংসার গড়ে তুলেছে। বাস্তব জীবনে কিন্তু ফয়জুন্নেসার স্বামী ফয়জুন আর নাজমুনকে নিয়ে সুখী সংসার গড়ে তুলতে পারেননি।  স্বামীর বহুবিবাহের শাস্তি পেতে হয়েছে ফয়জুন্নেসাকে। গ্রন্থের শেষে এই মিলন হয়তো ফয়জুন্নেসার অবদমিত ইচ্ছারই প্রতিফলন। রাক্ষস, পরী, জিন, শয়তান প্রভৃতি চরিত্রের সমাহারে, দ্বন্দ্বমুখর পরিস্থিতির মাঝে মূল চরিত্রের পরিণতি ঘটেছে।

সতীন সমস্যা নিয়ে কলহ তুঙ্গে উঠলে গাজী চতুর্ধূরীর সঙ্গ ত্যাগ করে ফজুন্নেসা নিজের গ্রাম পশ্চিম গাঁয়ে ফিরে আসেন। ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর আগেই ফয়জুন্নেসার উপর জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে। বুদ্ধির দীপ্ততা আর কর্মদক্ষতায় নিপুণ হাতে জমিদারি সামলেছেন। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে যখন হিন্দু মহিলাদের জন্য সংস্কার আন্দোলন শুরু হল, তখন বেশি প্রচার চলল তাদের শিক্ষার সপক্ষে। অথচ পাশাপাশি মুসলিম সমাজে তখনও স্ত্রী শিক্ষার তেমন কোনো চিত্রই তৈরি হয়নি। শিক্ষা তাদের বাধ্যতামূলক ছিল আরবিতে লেখা কোরান পাঠে। আবদুল লতিফ মুসলিম সমাজে শিক্ষাবিস্তারের চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর রক্ষণশীল মনোভাব ছিল। স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ইংরেজি শিক্ষাকে মেনে নিলেও মুসলিম মহিলাদের জন্য সংস্কারের কট্টর বিরোধিতা করেন। আর নারী শিক্ষার অগ্রনায়িকা ফয়জুন্নেসা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন আধুনিক শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। এবং আধুনিকতার পথে অবশ্যই থাকতে হবে পুরুষের পাশে নারীকেও। ফয়জুন্নেসা কয়েক প্রকারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়লেন। প্রথমত, পশ্চিম গাঁয়ে একটি  অবৈতনিক মাদ্রাসা স্থাপন করেন। পরে এটি উচ্চমাধ্যমিক ইসলামিক কলেজে রূপান্তরিত হয়। দ্বিতীয়ত, ১৯০১ সালে কন্যা বদরুন্নেসার নামে পশ্চিম গাঁয়ে প্রতিষ্ঠা করেন একটি মধ্য ইংরেজি স্কুল। তৃতীয়ত, পশ্চিম গাঁয়ে তৈরি করলেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়াও এগারোটি কাছারির প্রত্যেকটির নিকটে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয়। চতুর্থত, ফয়জুন্নেসা দুটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। কুমিল্লা শহরের নানুয়াদিঘির পাড়ে একটি। আর একটি কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে। নানুয়াদিঘির স্কুলটি পরবর্তীকালে নাম পরিবর্তন করে হয়েছে শৈলরানী বালিকা বিদ্যালয়। ফয়জুন্নেসার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ১৮৭৩ সালে কান্দিরপাড়ে স্থাপন করা স্কুলটি। এটি এখন নওয়াব ফয়জুন্নেসা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় বলে পরিচিত। ইতিহাসবিদ সোনিয়া নিশাত আমিনের মতে, “কান্দিরপাড়ের বালিকা বিদ্যালয়ের মতো কোলকাতায় দ্বিতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি হতে বহু দশক লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিক পর্যন্ত ফয়জুন্নেসার স্কুলে কোনো মুসলমান মেয়ে পড়ত কি না সন্দেহ আছে, তাদের অধিকাংশই ছিল ব্রাহ্ম অথবা হিন্দু।” (সোনিয়া নিশাত আমিন : বাঙালি মুসলিম নারীর আধুনিকায়ন, (অনুবাদ পাপড়ীন নাহার) বাংলা একাডেমী ঢাকা, ২০০২, পৃ ১১৫)। ফয়জুন্নেসার জনহিতকর কাজের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘বেগম’ উপাধিতে ভূষিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘বেগম’ উপাধি তিনি নিতে চাননি। তখন দেওয়া হয় ‘নওয়াব’ উপাধি। সেই সময়ের পক্ষে এক অত্যাধুনিক চিন্তাধারার মানুষ ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী।

 

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ৪ জানুয়ারি ২০২১ 

 

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী

ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট

0 Comments

Post Comment