- 10 March, 2023
- 0 Comment(s)
- 493 view(s)
- লিখেছেন : শাম্মা বিশ্বাস
জন্ম -১৮৩১, ৩ জানুয়ারি। মৃত্যু - ১৮৯৭, ১০ মার্চ।
আমাদের সমাজে নারীশিক্ষায় যাদের নাম স্মরণীয় তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন সাবিত্রীবাঈ জ্যোতিরাও ফুলে। বেথুন,বিদ্যাসাগরের অনেক আগে দলিত পরিবারের মেয়েদের নিয়ে স্কুল খুলেছিলেন সাবিত্রীবাঈ ফুলে। তিনি ছিলেন ভারতীয় সমাজ সংস্কারক,শিক্ষক ও কবি। সাবিত্রীবাঈ ১৮৩১ সালের ৩ জানুয়ারি বোম্বে প্রেসিডেন্সির নাইগাঁওতে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৪০ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে সাবিত্রীবাঈ এর বিয়ে হয় ১২ বছর বয়সী জ্যোতিরাও ফুলের সঙ্গে। তাঁদের কোন সন্তান ছিল না। কিন্তু তাঁরা এক ব্রাহ্মণ বিধবার পুত্র যশবন্ত রাওকে দত্তক নেন।
বিয়ের সময় সাবিত্রীবাঈ- এর প্রাথমিক শিক্ষাটুকু ছিল না। সেই সময় ব্রাহ্মণপ্রথার বাড়বাড়ন্ত ছিল,তাই নীচু জাতের মানুষদের পড়াশোনা করার অনুমতি ছিল না। কিন্তু জ্যোতিরাও ফুলে স্ত্রীকে শিক্ষিত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাই বাড়িতেই স্ত্রীকে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ দিতে শুরু করলেন। শুধু তাই নয় সাবিত্রীবাঈকে শিক্ষকতার পাঠও দিতে থাকলেন। নিজস্ব পড়াশোনা ও শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ শেষে সাবিত্রীবাঈ আশেপাশের কম বয়সী মহিলাদের পড়াতে শুরু করলেন এবং বিভিন্ন সমাজ সংস্কারক কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে লাগলেন।
১৮৪৮ সালে সাবিত্রীবাঈ ও জ্যোতিরাও মহারাষ্ট্রের পুণের ভিডেওয়াড়াতে মেয়েদের জন্য প্রথম বালিকা বিদ্যালয় চালু করেন। সেখানে তিনি প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য তিনি ও জ্যোতিরাও ১৮ টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যা ভারতীয় শিক্ষা জগতে এক যুগান্তকারী ঘটনা। সাবিত্রীবাঈ এর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে কোন ধর্মের ভেদাভেদ ছিল না। সেখানে সমস্ত জাত ধর্মের মেয়েরা পড়তে আসতো। এইজন্য তাঁকে সমাজের কাছে কম হেনস্তা হতে হয়নি। ১৮ বছরের প্রধান শিক্ষিকা ঘর থেকে বেরোতেন ব্যাগে বাড়তি শাড়ি নিয়ে। কারণ রাস্তায় লোকে এত কাদা ছুঁড়তো তাঁর দিকে যে স্কুলে এসে তাঁকে শাড়ি বদলাতে হত। তবে শুধু কাদা নয় লোকে পাথরও ছুঁড়তো। সাবিত্রীবাঈ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন," তোমাদের গোবর,পাথর - আমার কাছে ফুল।"
শুধুমাত্র স্কুল নয়, ধর্ষিতা ও অসহায় মহিলাদের জন্য তিনি একটি সেবাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন যেখানে অসহায় বিধবা মহিলাদের সেবা প্রদান করা হত। গ্রামীণ নারীদের মধ্যে সচেতনতা জাগাতে ও তাদের অধিকারের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য সাবিত্রীবাঈ এর উদ্যোগে 'মহিলা সেবা মণ্ডল' স্থাপিত হয়। সাবিত্রীবাঈ চেয়েছিলেন এক কুসংস্কারমুক্ত সমাজ। তাই তিনি নিজের বাড়ির কুয়ো সবার জন্য খুলে দিয়েছিলেন, যেখানে উঁচু নীচু সব জাতের মানুষ জল নিতে পারতেন। শুধু তাই নয় আরো একটা চমকে দেওয়ার মত কাজ তিনি করেছিলেন, সেই সময় নিজের ভাবি পুত্রবধূ লক্ষ্মীকে তিনি নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন। এই থেকে বোঝা যায় তিনি কতটা মুক্তমনা নারী ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে তিনি ফতিমা বেগম শেখকে নিয়োগ করেছিলেন। ফতিমা জ্যোতিরাও ফুলের বন্ধু উসমান শেখের বোন ছিলেন। এই ফতিমা ছিলেন দেশের প্রথম মুসলিম নারী শিক্ষিকা। সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাবিত্রীবাঈ অনেক কবিতা রচনা করেন। তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ হল - ' 'কাব্য ফুলে' এবং 'বভন কাশি সুবোধ রত্নাকর'।
জীবনের শেষদিন অবধি তিনি মানুষের সেবা করে গেছেন। সেইসময় প্লেগ তখন মহামারী। প্লেগে আক্রান্তদের সেবা করার জন্য সাবিত্রীবাঈ তাঁর ছেলে যশবন্তকে নিয়ে ১৮৯৭ সালে পুণে শহরে একটি ক্লিনিক চালু করেছিলেন। এক মাহার পরিবারের ছেলেকে পিঠে করে ক্লিনিকে নিয়ে এলেন সাবিত্রীবাঈ। ফলে নিজের শরীরে বাসা বাঁধলো এই ছোঁয়াচে রোগ। আর তাতেই ১৮৯৭ সালের ১০ই মার্চ প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন সাবিত্রীবাঈ জ্যোতিরাও ফুলে।
সাবিত্রীবাঈ জ্যোতিরাও ফুলে ছিলেন মাঝারি গড়নের,শান্ত মানুষ। তাঁকে কেউ কোনদিন রাগতে দেখেনি। তিনি যা করেছেন সবসময় হাসিমুখে করে গেছেন। কিন্তু কি অবাক ব্যাপার এই মহিলা প্রায় আড়ালেই রয়ে গেলেন। সাবিত্রীবাঈ জ্যোতিরাও ফুলে এখনো তাঁর যোগ্য সম্মান পাননি। যদিও তাঁর সম্মানে পুণে সিটি কর্পোরেশন ১৯৮৩ সালে একটি স্মৃতি স্মারক স্থাপন করেন এবং ২০০৫ সালে পুণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'সাবিত্রীবাঈ ফুলে পুণে বিশ্ববিদ্যালয়'। কিন্তু এটাই কি তাঁর যোগ্য সম্মান? যে মারাঠি নারী মেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য সারাজীবন লড়ে গেলেন আজ তিনি প্রায় বিস্মৃত। এখনো সাবিত্রীবাঈ জ্যোতিরাও ফুলে সমাজের অন্তরালে রয়ে গেছেন।
লেখক : বাচিকশিল্পী
0 Comments
Post Comment