- 06 March, 2022
- 0 Comment(s)
- 410 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
[২৪]
বাবা, তুমি প্রতারক-ভীরু-কাপুরুষ : সুমন
বুকের ভেতরের অবরুদ্ধ কথাগুলো ভাষা হয়ে বের হওয়ায় প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলে সুমন। সোফায় মাথা হেলিয়ে চোখ বুঁজে বিড়বিড় করে, তুই তো রিমার মতো শঙ্খিনী মেয়েদের চিনিস না অয়ন! ওরা কত লোভী! আমাকে নিঃশেষ করে তোকে খাবে। অতঃপর তোর আমার মতোই আর একজন। দশ-বিশটা পুরুষের মগজ চিবিয়ে খেয়ে বিড়ালের মতো হাত-পা মুছে নিজেকে সতী সাধ্বী জাহির করে, এমনি জাত ওরা! একই মনের কত যে রূপ! আম নারীজাতির প্রতি ঘৃণায় থুতু ছিটায় সুমন। নাক দিয়ে হিস্ হিস্ করে, আর তটস্থ হাতে প্যান্ট-শার্ট খুলে উদোম করে ফেলে শরীর। পরনে মাত্র আন্ডারওয়ার। হাত পা ছিটিয়ে ফ্লোরেই শুয়ে পড়ে। টেবিলে ভাত তরকারি আছে। খেতে ইচ্ছে করে না। ফ্যানের অবিরাম ঘূর্ণন অপলক চোখে দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ গেল ছবিতে। যত্ন করে দেয়ালের কাঁটায় টাঙিয়ে দিল ছবিটা। ফের ফ্লোরে চিৎ হয়ে শুয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল ছবির যুবতীকে। কী করে ছবিটা পরিত্যক্ত বাড়িতে এলো? এত ভাঙন, ঝড়ঝাপটার মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কথা ছিল, কী করে অক্ষত রইল! সুমনের বিস্ময় কাটে না। কোমল মোলায়েম হাসি ঠোঁটে। হাসিতে রহস্য আছে। চমৎকার মায়াবি চাহনি। চোখে মোনালিসার চোখের মতো গাঢ় বিষাদের রেখা টানা। সুমন বিড়বিড় করে, এই অস্ত্র দিয়েই তো ওরা পুরুষকে লোভী করে তোলে। আর তখন রাম-রাবনের যুদ্ধ থেকে শুরু করে ট্রয় নগরী পর্যন্ত পুড়ে খাক হয়। সম্রাট শাহজাহানের মতো শালার বউনেওটারা তখন লাখো মানুষের রক্ত পানি করে তাজমহল বানায়! নিজে চেয়ারে বসে পা দোলায় আর চোখ বোঁজে প্রেমের মৌতাতে। তাজমহলের একটা ইট গেঁথেছে শালা!
চুল, ফেসকাটিং, ভ্রূ, দাঁড়িয়ে পোঁজ দেবার ভঙিমায় আভিজাত্য আছে। অভিজাত পরিবারের মেয়ে নিশ্চয়। বিবাহিত ছিল না বোধহয়। সিঁদুর থাকার কথা ছিল সিঁথিতে। যুবতী ডাকসাইডের কোন দেহপসারিণীও হতে পারে। সুমনের ভাবনায় আসে। বাবা আবার...। ধ্যাত্ এসব বাজে চিন্তা মগজে ঢুকাচ্ছি কেন? বাবারাও মানুষ তো!
যুবতীর রহস্যভরা কোমল মায়াবী হাসির উষ্ণ পরশ লাগে সুমনের হৃদয়ে। নিদারুণ বিস্ময় আর গভীর মুগ্ধতার চোখ দিয়ে নিষ্পলক চেয়ে থাকে যুবতীর দিকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। শিশুর ক্ষুদ্র পদক্ষেপের মতো ধীরে ধীরে অন্ধকার প্রবেশ করছে ঘরে। ধেয়ে আসা অন্ধকারে তলিয়ে যায় ঘর, দোর, দেহ সবই। তবু উঠার তাগিদ অনুভব করে না সুমন। সুমনের মোবাইলে তেমন কল আসে না। ব্যস্ততার ফাঁক ফোকরে অয়নটা কল দিত। এখন আর করে না। উপযাচক হয়ে কারও সাথে সম্পর্ক তৈরি করা, এমনকি কথা বলার স্বভাব ওর ধাতে নেই।
টানা দুইমাস ডিপার্টমেন্টে অনুপস্থিত সুমন। কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছেন চেয়ারম্যান। প্রত্যুত্তর না পেয়ে সশরীরে উপস্থিত হয়েছেন। বলে গেছেন, তার পক্ষে আর সুমনের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টা সিন্ডিকেটে উঠছে অচিরেই। এসবের তোয়াক্কা করে না সুমন গাঙ্গুলি, জানিয়ে দিয়েছে চেয়ারম্যানকে। সে যে খুন হবে—এ সিরিয়াস বিষয়টি নিয়ে বিভাগের কারও কোন মাথাব্যথা নেই। আমাকে দেখলেই মুখ টিপে হাসাহাসি করে, আমি কি বুঝি না? শালার এমন চাকরির গুষ্টি কিলাই! এসব কথা চেয়ারম্যানকে বলে সুমন সেদিন মুক্তির আনন্দে নেচেছিল।
সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হয়ে রাত নামে। রাত গভীর হয় ধীরে ধীরে। এখন দুপুর রাত। রাতের শেষ প্রহরে গিয়ে সুমনের ক্লান্ত শরীর হার মানে। তখন আর জেগে থাকা সম্ভব হয় না। শরীরটাই নিথর নিস্তব্ধ মমির মতো পড়ে থাকে, কিন্তু মন জেগেই থাকে। কখনই নিবিড় ঘুম ঘুমায় না। যুদ্ধের সেনানির মতো কান সতর্ক ও প্রস্তুত থাকে শত্রুপক্ষের আক্রমণের ভয়ে। ঘুমালেই খুন করবে রিমা। গভীর ঘুমের মধ্যে মৃত্যু ভয় জেগে ওঠে। দুঃস্বপ্নে জাগা শিশুর মতো লাফিয়ে ওঠে। এই বুঝি কোন আততায়ীর হাতে তাড়া খেয়েছে। রিমা বাসায় নেই। কিন্তু বলা যায় না, ঢাকায় যাওয়াটা ওর বাহানাও হতে পারে। আশেপাশেই আছে। পেশাদার কোন কিলারকে পাঠিয়ে দিতে পারে। সুমন প্রার্থনার ভঙ্গিতে ধ্যানমগ্ন হয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। পাগলের মতো মাথা নাড়িয়ে বলে, হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছি। দিব্যজ্ঞানী চোখের উপরে ভাসছে—একজন নয়, দুইজন কিলার আমার দিকে ছুটে আসছে। সুমন লাফিয়ে উঠে বসা থেকে। ছোটাছুটি শুরু করে দিল। এখন আমি কি করি? আমাকে বাঁচতেই হবে, যেভাবেই হোক, এনি হাউ। রিমার বালিশের নিচে হাতড়ায়। ছুরিটা? ছুরিটা কোথায় গেল! নিশ্চয় নিয়ে গেছে। দৌড়ে গিয়ে ঘরের সিঁটিকিনি পরীক্ষা করে নিল ঠিক-ঠাক আছে কি না। লুকানোর জন্য একটু জায়গা খোঁজে হন্যে হয়ে। খাটের নিচে লুকানো যায়। রান্নাঘরের সানসিটে পুরানা জিনিসপত্রের মধ্যে লুকিয়ে ফেলা যায় শরীরটাকে। ফুটবল খেলোয়াড়ের মতো টানা দেড়ঘণ্টা দৌড় থামায়নি। মনের জোর অঁটুট, কিন্তু ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত শরীর লুটিয়ে পড়ে বিছানায়।
ঘুমায়নি সুমন। ঘুম-জাগরণের সন্ধিক্ষণে। কানে ঠেকল নারী কণ্ঠের ফিস্ফিসানি। থেকে থেকে গাঢ় গরম নিশ্বাস ফেলছে। নিশ্বাসের গরম বাতাস সুমনের শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে। সুমনের মনছবিতে একজন নারীর ছায়া হেঁটে বেড়াচ্ছে। গৃহস্থ ঘরের গিন্নির মতো ঘরের এটা-ওটায় হাত দিচ্ছে। সুমনের ঠোঁট কাঁপে ভয়ানক। ভেতর থেকে গোঙানি উঠে আসে আ-বা-বা-বা-রি-রি-রি শব্দে। নড়ার ক্ষমতারহিত শরীর লাশের মতো নিথর। বুকের ভেতরে গোঙানির আওয়াজ এখন যমদূতের থাবা পড়া শরীর থেকে বের হওয়া গোঙানির শব্দের মতো শোনায়।
এই ছেলে, তোমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? ফ্যান চলছে, পরিবেশটাও ঠাণ্ডা। তোমার নিশ্বাস নেবার বাতাসের এত টানাটানি!
সুমনের মন কেঁপে ওঠে। এত রিমার কণ্ঠ নয়? কে এ নারী? রিমা কি কণ্ঠ পাল্টে ফেলেছে?
নীরব ঘর কাঁপিয়ে খলখল করে হেসে ওঠে নারী, অবিকল শংকরের মতো লাজুক! ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কথা বলে। ঠোঁটগুলি ঠিক শংকরের নকল। ওর ঠোঁট এভাবেই কাঁপত।
কে! কে! ঐ কে আপনি? রিমা কোথায়? বিকট চিৎকার দিয়ে উঠে বসে সুমন। কণ্ঠনালীর ব্যারিকেটে আটকে গেল আওয়াজ।
মূর্তিমান এক যুবতী খাটের উপরে ওর দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছে। অবিকল ছবির যুবতীর মতো। সুমনের মাথার ভেতরে চিন্তার হিজিবিজি। গভীর ও নিবিষ্ট চোখে তাকার যুবতীর দিকে।
যুবতীর ওর দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সংসারের জিনিসপত্রের দিকে এলোমেলো চোখ ফেলছে। হঠাৎ ক্ষিপ্রবেগে সুমনের দিকে তাকায়। সুমনের শরীর নড়ে ওঠে। উঠে পড়ো, কিছু খাওনি মনে হয়। খাবার টেবিলে সাজানোই আছে। যুবতী ত্রস্ত পায়ে খাবার টেবিলে গেল। চেয়ারে বসতে বসতে বলে, আসো, আসো, দেরি করো না, হাতে সময় নেই, রাত শেষ প্রায়। না খেয়ে শরীরের এ কী হাল! এভাবে না খেয়ে থাকলে তো মারা যাবে?
এমনিই মারা যাবো আমি। সুমনের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।
যুবতী কপাল ভাঁজিয়ে প্রশ্নচিহ্নিত চোখে তাকায়।
সুমন পরিষ্কার কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ, আমি খুন হবো।
যুবতীর প্রতিক্রিয়া নেই। নির্বিকারভাবে খাবার প্লেটে বাড়ছে।
সুমন চরম হতাশ। একজন মানুষ খুন হবে। আপনি জানতে চাইবেন না? কে খুন করবে? কেন খুন করবে? আপনি আজব প্রাণী তো!
যুবতী নীলবর্ণ ধারণ করে ফেলেছে ।
ভয়ে সুমনের শরীর জমে ওঠে।
বিজয়ানন্দ ইন্দ্রের রাজসভার নর্তকীর মতো নেচে ওঠে যুবতী। একে একে ছুঁড়ে ফেলে টেবিলের থালা-বাটি। মুখে হা হা শব্দের বিকট হাসি।
কে? কে? কে আপনি? ভয়ার্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল সুমন। শেষ রাতের নিস্তব্ধতা কেঁপে ওঠে।
সুমনের উদোম শরীর। ঘাম ঝরছে অবিরল। নিষ্প্রাণ বস্তুর মতো নিথর শরীর। কাঠ পিপাসায় ঠুকরে উঠছে বুক। ধুক্ ধুক্ করে যেন বাজছে সুমনের শিরা উপশিরা। আর চেঁচাতেও পারছে না। তবে কি রিমাই যুবতীর রূপ ধারণ করে এসেছে খুন করতে? হ্যাঁ, অবশ্যই, এ আর কেউ নয়, রিমা, নির্ঘাত রিমা-ই। যুবতীর ছদ্মবেশে এসেছে যেন আমি চিনতে না পারি। সুমন এবার চিৎকার করে, আমার বন্দুক, আমার বন্দুক কোথায়? কিন্তু চিৎকার ভেতরেই পাক খেয়ে মরছে। এখনি আমাকে খুন করবে রিমা? কেঁদে ওঠে সুমন। আমার ছেলেটার মুখ আমার সন্তানের মুখ একবার দেখব না? তোমাকে কথা দিচ্ছি, ছেলেটার মুখ এক নজর দেখার পরেই আমি খুন হব। তোমার হাতেই খুন হব। হাতজোড় করে সুমন। আমার এ অনুরোধটুকু রাখো রিমা। বড় বিশ্বাস নিয়ে তোমার সাথে ঘর বেঁধেছিলাম। এই অনুরোধ তুমি রাখবে না? কিন্তু সুমনের এ অনুরোধ নিজের ভেতরেই ঘুমকাতুরে কুকুরের মতো গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল।
নিস্তব্ধতার পাথর চাপা পরিবেশ কাঁপিয়ে যুবতী হঠাৎ হুঁ হুঁ শব্দে কেঁদে ওঠে। বদ্ধ পাগলির মতো চুল এলোমেলো করে টেনে ধরে, তুমি হেরে গেছো শংকর! তুমিও হেরে গেছো!! দেখে যাও, তোমার রক্ত এখন সমাজের পুঁজ। নর্দমার কীটতুল্য। কেউ নিতে চাইছে না তোমার রক্তের উত্তরাধিকার। ডাস্টবিনের বিকট গন্ধে নাক সেটে আসা পথচারীর মতো যুবতী এলোপাতাড়ি থুতু ছিটায়।
যুবতীর থুতু ছিটানোর ছেৎ ছেৎ শব্দে চমকে চমকে উঠছে সুমন। যেন থুতু উড়ে এসে পড়ছে ওর শরীরেই। কৃষ্ণগহবরের অন্ধকারের মধ্যে পড়ে গেছে সুমন। কে উদ্ধার করবে? কেউ নেই আশেপাশে। দুঃসময়ে মানুষ সুপারশক্তির কাছে, তার ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে, মুক্তি চায়, কিন্তু সুমন তা পারে না। কেননা ভগবান অলীক, অবাস্তব, অক্ষমের সৃষ্ট বলে চরম অবজ্ঞা করে প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন সেই শক্তির কাছে, ভগবানের কাছে বাঁচার আর্তি জানাতে পারে না সুমন। যত নিষ্ঠুর খেলাই খেলুক তাকে নিয়ে। সুমনের বিশ্বাসের চর পদে পদে ভেঙে যেতে যেতে এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। চারদিকে জালপেতে সুমনকে গুটিয়ে এনেছে সেই সুপার শক্তিমান।
আত্মমগ্ন সুমন সহসা চোখ মেলে। এবং চমকে ওঠে। দু-হাঁটুর মাঝখানে মাথাগুঁজে ভেঙেচুরে বিড়ালকুণ্ডলি পাকিয়ে যুবতী বসে আছে মেঝেতে।
সকল ভয়ডর উবে গেল সুমনের। ঘর্মাক্ত শরীর শীতল হতে হতে এখন প্রায় বরফের মতো ঠাণ্ডা। বেশ আস্থার কণ্ঠে বলল, কে আপনি? এভাবে কাঁদছেন কেন?
সুমনের দিকে তাকিয়ে চমকাল যুবতী। যেন সুমনকে ভয় পেল। আমি তোমার মা!
সুমন ভ্রু কুঁচকে বলে, হোয়াট? আপনি আমার মা মানে?
হুঁ! যুবতী গাঢ় লম্বা নিশ্বাস ফেলে।
সুমন ভড়কে গেল।
তোমার বড় মা ।
খোলাসা করে বলুন।
শুনতে চাও।
অবশ্যই। সুমন জোর দিয়ে বলে।
আমি হালকা হব। তোমার কষ্ট বরং বাড়বে। যুবতীর কণ্ঠ স্বাভাবিক হয়ে আসে।
সুমন মুখে শ্লেষের হাসি। যে কোন মুহূর্তে খুন হবে যে মানুষ তার কোন কষ্ট থাকে না। আপনি বলুন।
যুবতীর প্রতিটি কথা-ই সুস্বাদু খাবারের মতো যেন গোগ্রাসে গিলছে সুমন।
যুবতীর বাড়ি উঠোনের ঠিক মাঝখানে একটা কামরাঙার গাছ ছিল। বাংলা ঘরে বসে আনমনে যুবতী একটা কামরাঙ্গা খাচ্ছিল লবণ লাগিয়ে লাগিয়ে। হুট করে একটা ছেলে জানালা দিয়ে ধবধবে ফর্সা হাত ঢুকিয়ে বলে, আমাকে একটা কামরাঙা দাও না। খেতে খুব ইচ্ছে করছে। ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে যুবতী। যুবতীর মা দৌড়ে আসে। একটা ছেলে বগল দাবা করে একগাদা বই নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে জানালা ধরে। কাঁচুমাচু করে ক্ষমা চাচ্ছে, মাফ চাই, আমার ভুল হয়ে গেছে। হো হো করে হেসে ওঠে যুবতীর মা। ছেলেকে ডেকে আনে বাড়ির অন্দরে।
যুবতীর তখন কী লজ্জা!
মায়ের আশকারা আর যুবতীর লজ্জা-এই দুই-ই কাল হল। এরপর কাঠের খোলা জানালায় এলোচুল ছড়িয়ে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে থাকে যুবতী। কখন আসবে তার রাজপুত্র। ছেলেটাও থমকে দাঁড়ায় এখানে এসে। যুবতীর মা বিষয়টা আঁচ করতে পারে। ছেলেকে ডেকে আনে বাড়ির মধ্যে। একটু একটু করে ছেলেটা যুবতীর মাকে জয় করে। মায়ের প্রশ্রয়ে অবাধ বিচরণ ঘটে মেয়ের অন্দরমহলেও। য্বুতী তার মার কাছে প্রায়ই নানিদের বাড়ির পাশের বাড়ির রথীন্দ্রনাথ নামে একজনের গুণকীর্তন শুনতো। সে তখন মস্ত বড় ডাক্তার। ঢাকায় থাকে। খোঁজ খবর নেয় না। অথচ ছোটবেলায় একসাথে খেলার সময় ওকে কেউ খেলতে নেয়নি। খর্বাকৃতির ছিল। কালো, খাটো, পেট মোটা, ছাগলের মতো চিকোন চিকোন হাত-পা—কে নিতো ওকে খেলায়? আমি জোবেদাই নিতাম একা জেদ করে! ও এখন বড় ডাক্তার হয়েছে! মানুষ এমন নিমকহারাম কম-ই হয়। একদিনও খোঁজ নিল! ইত্যাদি ইত্যাদি বলে যুবতীর মা কেমন আনমনা হয়ে যেত। চাপা কষ্ট দেখতে পেত যুবতী তার মায়ের মধ্যে। সে বুঝতে পারে না, ঢাকায় থাকে যে মস্ত বড় ডাক্তার, কী এমন দরকার তার মা’র খোঁজ নেবার? মার-ই বা কিসের এত জেদাজেদি তার সাথে!
ফাঁকে ফাঁকে যুবতী সুমনকে দেখে নিচ্ছে। সুমন ধরতে চাচ্ছে যুবতী কতটুকু সত্য বলছে। বাবার মধ্যেও লুকানো একটা কান্না টের পেত। একটা জীর্ণ কালচে বাক্স তালা দিয়ে খাটের তলায় রেখেছিল যক্ষ্মের ধনের মতো। কালেভদ্রে বের করত। সুমনকে ধরতে দেয়নি কখনই। সে নিজেও বাবার এ বিষয়টাতে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। ভেবেছে, মায়ের কোন স্মৃতি হয়ত আগলে রেখেছে বাবা। তবে কি এই ছবি ছিল বাবার গোপন বাক্সে? এই যুবতীকে-ই বাবা ...। ওহ্! ভাবতে পারছি না বলে মাথা ঝাঁকিয়ে ওঠে সুমন।
ভাবছো, সত্য মিথ্যা মিশাল দিয়ে বলছি । এক তিলও না। তাছাড়া মিথ্যে বলে লাভ কী? আমি এখন তোমাদের কেউ না। যুবতী লঘু নিশ্বাস ফেলে।
কেউ না মানে! সুমন চমকাল।
এখনো টের পাওনি।
না। তারপর! তারপর কী হল? দ্রুত বলুন! তটস্থ সুমন।
যুবতী ভেতরে ভেতরে কাঁপছে। সুমন টের পায়। নিশ্বাস ফেলছে যেন বুক ফাটিয়ে। সুমনের মধ্যেও চরম উত্তেজনা। যুবতীর গল্পের নায়ক স্বয়ং পিতা শংকর গাঙ্গুলি। কষ্ট করে দম ফেলে বুকে বাতাস ঢুকিয়ে কথা বলছে যুবতী। সুমনের মায়া হচ্ছে।
সিগারেটে সুখটান দেবার মতো যুবতী বুকভরে নিশ্বাস নিয়ে ফের বলতে লাগল—আবোল তাবোল বয়স তখন আমার। মাও কেন জানি সায় দিল। দিনে দিনে তিল তিল করে আমরা কাছে আসছি। এত কাছে এসেছি কী করে নিজেই টের পায়নি। মা শংকিত হয়ে উঠল তখন। নিজের অপরাধের জন্য ভেতরে ভেতরে পুড়ে মরছিল। কী এক অদৃশ্য কারণে শংকরকে বাড়িতে আসতে বাধা দেয়নি! আমাকেও কিছু বলেনি মুখ ফুটে। কেবল আমার ভবিষ্যৎ কতদূর ভয়ানক হতে পারে ভেবে আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদত। আমি তখন ওকে ঘিরে পার মাতাল। মা তলে তলে এতটা পুড়ছে তা বুঝিনি। ধীরে ধীরে শংকর বেয়াড়া হয়ে ওঠে। ওর ডাক পেয়ে আমার শরীর অবাধ্য হয়ে ওঠে। প্রচণ্ডভাবে ওর দিকে ধাবিত হই। ধীরে ধীরে আমাদের সম্পর্ক মনে-দেহে এক হয়ে গেল
মা একদিন ঠিকই টের পায়, আমাদের সম্পর্ক আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই।
বর্ষাকাল। তুমুল বর্ষণ বাইরে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শংকর এলো ভরা সন্ধ্যা। রক্তের টান—না এসে পারে! আমাদের দুজনকে ডেকে নিজের ঘরে নিল মা। পাশাপাশি বসিয়ে নিজের হাতে তৈরি পিঠা খাওয়াল শংকরকে। আমি পাশেই বসে আছি। আচমকা আমার হাত টেনে ধরে শংকরের হাতের উপরে রাখল মা। ভূমিকম্পের মতো কাঁপছে আমার শরীর।
তোমাদের আমি বিয়ে দিয়ে দিলাম। ধর্ম মানবে না, সমাজ মানবে না, কিন্তু আমি মা, আমি মানি। এখন থেকে তোমরা স্বামী-স্ত্রী।
এ ঘটনার তৃতীয় দিনে জানা গেল, শঙ্করের বাবা মেয়ে দেখছে। এদিকে একবারের জন্যও আর আসেনি শংকর। মা গিয়েছিল ওদের বাড়ি। ঘরে ঢুকতে দেয়নি। উঠান থেকেই তাড়িয়ে দিল। মুসলমান ঘরে ঢুকলে ঘর অপবিত্র হবে। লেপামোছার ঝামেলা। যা বলবে বাইরে থেকেই বলতে হবে। মা চরম অপমানবোধ করে। ফিরে আসে।
ভীষণ উত্তেজনায় অধৈর্য হয়ে ওঠে সুমন। যুবতীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলা তার পছন্দ হচ্ছে না। চেঁচিয়ে ওঠে, এক বাক্যে বলুন, এক বাক্যে। শেষ কী? বাবা বাড়ি ছিল না?
হ্যাঁ। শংকর তখন বাড়িতেই ছিল। ও বের হয়নি ঘর থেকে। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে বিছানা নিল মা। বাবা তখন বুঝতে পারে ঘটনা। মা সত্যটাই বলে বাবাকে। আমার সহজ সরল বাবা বোবার মতো সরল চোখে একবার আমার দিকে একবার মার দিকে তাকায়। তার চোখ ভরে ওঠে জলে।
ওর বিয়ের দিন কী তুলকালাম কাণ্ড! বাদ্য বাজনা, লোক, আর্তি ফার্তি মিলে এলাহি কাণ্ড। ওর বিয়ের সানাইয়ের সুর কানে আসলে মা অস্থির হয়ে ওঠে। হাত-পা ছেড়ে ভয়ানক বিলাপ করে। শেষে অভিশাপ দিল—নিমকহারাম বেঈমান! অভিশাপ দিয়ে গেলাম তুই সুখি হবি না! তোর ঘরে আগুন জ্বলবে! আমার মেয়েকে তিলে তিলে মারলি তুই! তোর বউ মরবে! তোর সন্তানকেও অভিশাপ দিলাম। তুই নির্বংশ হবি...
শংকরের বিয়ের তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় মা মারা গেল। মাকে বাড়ি থেকে বের করার মুহূর্তেই আমার ভেতর থেকে ঠেলে উঠে আসতে লাগল বমি। সর্বনাশ টের পেলাম।
শংকরকে ধাওয়া করে ফিরি। কোনমতেই আমার সামনে আসে না। এভাবে চার মাস হয়ে গেল। লজ্জায় বাইরে বের হই না। খাওয়া-নাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। এদিকে ওর বাড়িতে বিশাল আয়োজন করে ঢাকডোল পিটিয়ে খবর দেওয়া হল, ওর বউয়ের পেটে বাচ্চা এসেছে। আমার পেট ফুলে উঠছে ধাই ধাই করে। কোনমতেই ঢেকে রাখতে পারছি না। তখন বিষের বোতল হাতে নিয়ে দু’হাত তুলে শেষ প্রার্থনা করেছিলাম, আমার সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখতে পায়নি। ওর সন্তান যেন ...
কাঁধে বাঘের থাবা পড়লে হরিণ যেভাবে আর্তনাদ করে ওঠে, ঠিক একইভাবে আর্তনাদ করে ওঠে সুমন। মরণ চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে লুটিয়ে পড়ে যুবতীর পায়ের কাছে। যুবতী পা সরিয়ে নিল। চেয়ারে লেগে কপাল ফেটে গরগর করে রক্ত বের হচ্ছে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে গলা কাটা লাশের মতো গড়াগড়ি খাচ্ছে সুমন।
যুবতী এক পা তুলে দিয়েছে সুমনের শরীরে। অন্য পায়ে নাড়ছে সুমনের রক্ত।
দরজার খটখট শব্দে চেতন ফেরে সুমনের। নিস্তেজ দেহ টেনে দরজার সামনে পৌঁছায়। কর্কশ গলায় বলে, কে? কী চাই?
একটা বয়সী শংকিত কণ্ঠ, আমি বাবা! পাশের ফ্লাটের তোমার কাকিমা। তোমার চিৎকার কানে ঠেকল।
না, কিছু না কাকিমা। দরজা না খুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সুমন।
কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে চলে গেল বৃদ্ধা।
রাতের নীরবতা কাঁপিয়ে বেজে ওঠে মোবাইল। মোবাইল রিসিভ করে সুমন। বিপরীত প্রান্তে নারীকণ্ঠ, সুমনদা, আমি চৈতি।
চৈতি তাতে কি? এত রাতে কল করা কেন?
কী যে দুর্বিপাকের মধ্যে ফেলেছেন আমাকে!
সুমন উত্তেজিত হয়ে বলে, মধ্যরাতে ব্লাকমেইল করতে চাইছো? একজন খুন করার জন্য ঘুরছে। তুমি এই সুযোগে ব্লাকমেইচল করছো, অ্যা? তোমাদের সবার পেটে পেটে সম্পর্ক। তুমি যে রিমার সাথে নেই, আমি বিশ্বাস করব কী করে?
প্লিজ সুমনদা, ফালতু কথা বলবেন না। আমি বড় বিপদে...। চৈতির অসহায় কণ্ঠ।
শরীরে বিষের জ্বালা কামড়ে ধরেছে বুঝি? অ্যা! তাই এত রাতে...
সুমনদা, আমার পেটে বাচ্চা !
আমাকে বলছো কেন?
এটা আপনার...
হোয়াট! সুমন চেঁচিয়ে উঠল।
চেঁচাচ্ছেন কেন? আমি কি মিথ্যা বলছি? চৈতির কণ্ঠ ঝাঁঝাল।
ননসেন্সের মতো কথা বলো না। কার না কার সাথে পেট ঘষে আমার উপর দায় চাপাচ্ছো? ভাবছো, এ লোকটা বড় অসহায়। শেকড়হীন। ঘাড় মটকে ধরতে সবাই প্রস্তুত। বিশ্বাস করাতে কষ্ট করতে হবে না। সুমন হে হে করে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে বলে, নিজের স্ত্রী যাকে খুন করার জন্য তোড়জোর চালাচ্ছে। তাকে তুমি এসব গুলতাপ্পি দিয়ে কী করবে বলো? বলো চৈতি? বরং নামজাদা বা মালদার কারো নাম বলে মামলা ঠুকে দাও। মোটা অঙ্কের সম্মানি পাবে। কথাগুলো এক নিশ্বাসে শেষ করেই খুকখুক করে একচোট হাসল সুমন।
ছি! আপনি এতটা নিচে নেমে গেছেন? এত অধঃপতন! এত ন্যারো মাইন্ড আপনার?
কথাগুলো তো তোমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
তার মানে?
কার না কার সাথে মৌজ করে পেট বাঁধিয়ে আমাকে ব্লাকমেইল করছো মধ্যরাতে।
কান্না বিজড়িত মিনতির কণ্ঠে বলে চৈতি, সুমনদা, আমার সাথে এমন হেঁয়ালি করবেন না। আমি এখন জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি ।
সুমন চুপ থাকে।
কথা বলেন সুমনদা। আমার হাজব্যান্ড কানাডা থেকে দেশে আসছে তিনদিন পরে। এসে যদি দেখে আমার পেটে অন্য পুরুষের বীজ। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল চৈতি।
কট করে লাইন কেটে দিল সুমন। লক করে দিল মোবাইল।
মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো চাকা চাকা রক্তের দিকে তাকিয়ে ভয়ে আঁতকে ওঠে সুমন। শরীরে লোম সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠেছে। এসব আমার রক্ত! কিন্তু এত রক্ত কপাল ফেটে বের হল কেন? লুকিং গ্লাসের সামনে দাঁড়াল। দুই হাতে মুখ ঢাকে। সমগ্র শরীরে রক্তের দাগ!
[চলবে...]
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ)
0 Comments
Post Comment