- 10 April, 2022
- 0 Comment(s)
- 374 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
[২৯]
সুমনরা মরে তবু হারে না : কমলিকা
দরজায় চাপা টকটক শব্দ শুনে অয়ন ভয় পায়। এত গভীর রাতে কে এলো?
আমি। কমলিকা ব্যানার্জি। ফিসফিস কণ্ঠ।
শার্ট শরীরে ফেলে নিঃশব্দে দরজা খুলে বের হয় অয়ন। লাল টকটকে সিল্কের শাড়ি পরে আছে কমলিকা ব্যানার্জি। অয়ন ধাঁধাঁয় পড়ে যায়। এত রাতে এই বয়সে লাল টকটকে সিল্কের শাড়ি পরনে কেন? কোন ভৌতিক বিষয়-টিষয় না তো? আগেকার দিনে গ্রামের বাড়িতে গভীর রাতে কেউ বাইরে থেকে আসলে চিমটি কেটে দেখা হত মানুষ নাকি ভূত-জিন।
মধ্যরাতের চূড়ান্ত সুনসান নীরবতা চলছে। আকাশে বাটির মতো চাঁদ বেদম দৌড়াচ্ছে পশ্চিমে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে অয়ন বসে গেল কমলিকা ব্যানার্জির পায়ের কাছে এক সিঁড়ি নিচে।
তোমার বুঝি ঘুম আসছে না, ছেলে?
অয়ন লম্বা শ্বাস ফেলে মাথা হেলিয়ে ছোট্ট করে বলে, হু।
তুমিই বোধ হয় এখন সুমনের একমাত্র বন্ধু। তুমিই আবার বড় শক্রও। দূরে তাকিয়ে বলে কমলিকা ব্যানার্জি।
অয়ন শিউরে ওঠে, কিভাবে জানলেন আপনি?
ওর কাছের মানুষ এখন সবাই শত্রু। ওর ধারণা ওকে খুন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তুমিও।
অয়ন মুখ নিচু করে বলে, হ্যাঁ ।
এ দলে আছি আমিও। তক্কে তক্কে থাকে রিমা আমাকে কিছু বলে কি না। রিমা ঢাকা গেল আমার পরামর্শে। নইলে এতদিনও সুমন বাঁচত না। রিমার যে কি হত ভাবতে পারছি না। ওর কাছে কিন্তু পিস্তল আছে।
পিস্তল! অয়ন চমকে ওঠে।
ভয় পেয়ো না। এই পিস্তল দিয়ে সুমন কারও কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমন মনোবল ওর নেই এই মুহূর্তে। ক্ষতি যা করার ওর নিজেরই করবে।
পিস্তলের খবর আপনি জানলেন কী করে? অয়নের কণ্ঠ কাঁপছে আতঙ্কে।
সুমন দিনে একবার করে বাইরে বেরোয়। দরজা খুলেই বেরোয়। পাউরুটি কিনে আনে গলির মোড় হতে। তখন আমি রুমে ঢুকি। প্রায় দিনই ঢুকি। একদিন দেখি গুলিভর্তি ছোট্ট একটা পিস্তল বিছানায়। আমি হাতে নিতেই সুমনের পায়ের শব্দ কানে আসে। ফেলে আসি বাইরে। এখন আর খুঁজে পাই না। তুমি একটু তালাশ করে দেখো তো।
অয়ন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
সুমনের চকরিটা বোধ হয় থাকছে না। কমলিকা ব্যানার্জির চোখ ছলছল করছে জলে। কিছু মানুষের জন্মেই লেখা থাকে আজন্ম পরাজয়। যেমন : সুমন। যেমন : শফিক। শফিক নামটা মুখ দিয়ে বের করতে কমলিকা ব্যানার্জির খুব কষ্ট হল। তার ভেতরে একটা হিমকষ্ট যেন বরফ হয়ে আছে। সম্ভবত, সেই কষ্টের সাথে সুমনের কষ্ট মিলিয়ে সে তার কষ্টকে তাজা রাখতে চায়। তার ভেতরে বন পোড়ার মতো করে দাউদাউ করে জ্বলছে। সে পোড়ার আঁচ যেন অয়ন অনুভব করে। মানুষের ভেতরে কত রকমারি কষ্ট। বাইরে থেকে মনে হতে পারে কত না সুখি। চিরদিনই এই নিয়মের বাঁধা সংসারে এক টুকরো বৈশাখী মেঘ সামান্য দূরে ঘোরেফেরে। সময় সুযোগ পেলেই ঝড় উঠে লণ্ডভণ্ড করে দুমড়েমুচড়ে উপড়ে ফেলে শেকড়সহ। কত বড় ঝড় বয়ে গেছে কমলিকা ব্যানার্জির জীবনে, কে জানে? জীবন সায়াহ্নে এসে বুঝি এই মানুষটি আর হিসাব মেলাতে পারছে না ঠিকঠাক। তাই এত বিমর্ষ।
পদ্মার বুক হতে উঠে আসা ঠাণ্ডা বাতাস ছুঁয়ে যায় অয়নের শরীর। জীবনে এমন কঠোর নীরবতা কখনই দেখেনি। গা ছমছম করছে। বুকে ভয় নিয়ে সুমনের সাথে নির্ঘুম ভয়ের রাত কাটানোর চাইতে সিঁড়িতেই বরং রাত কাটুক। যদিও কমলিকা ব্যানার্জির বুক ফাটা নিশ্বাস কিছুটা অস্থিরতার মধ্যে ফেলছে।
ঘন গম্ভীর আলাপেরই সময় এখন। পোড় খাওয়া মানুষ এই ব্যানার্জি। বলুক না তার কষ্টের কথা।
কিছু মনে করো না যেন। আমার নিজের প্রয়োজনেই তোমাকে এসব কথা বলছি। আমার এসব কথা জানে এমন কেউ জীবিত নেই এখন। আমার আশ্রিতারাও জানে না কিছুই।
বলুন। কাউকে বলব না প্রমিজ করছি। অয়ন আস্থা দেয়।
কমলিকা ব্যানার্জি ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ভার্সিটির ছাত্র ছিল। সে সময়ে একজন বাঙালি ললনাকে বহু পথঘাট পেরিয়ে তবে পা রাখতে হত ভার্সিটিতে। খুবজোর গোটা পঞ্চাশেক ছাত্রীর খোঁজ মিলত সম্পূর্ণ ক্যাম্পাসে জরিপ চালিয়ে। স্বভাবতই কমলিকা ব্যানার্জির মতো সুন্দরী মেয়ের পেছনে চীনের প্রাচীরের মতো লম্বা লাইন থাকবে, কিন্তু প্রথম হতেই করণীয় ঠিক করে নিয়েছিল সে। মহিলা হোস্টেল হতে কলাভবন, কলাভবন হতে লাইব্রেরি— একটি সরল সোজা রাস্তা ধরে ছিল কমলিকা ব্যানার্জির বিচরণ ক্ষেত্র। ছেলেরা যে যার সামর্থ্যরে সবটুকু করেও যখন মেয়েটার মনের হদিস পায়নি তখন আঙুল ফল টক বলার মতো গেঁয়োভূত, আনসোস্যাল ইত্যাদি অকথিত ভাষায় গালিগালাজ করে সরে পড়েছিল। এভাবে না হয় ছেলেদের ঠেকানো গেল। আর একদলকে ঠেকাবে কী করে? যুবক শিক্ষকের দল। তারা বড় একরোখা। কমলিকাকে তাদের চাই-ই। তাদের একজন বিবাহিতও ছিল। কমলিকা অফিসে এসো, কমলিকা দেখা করবে। যুবক টিচারদের এসব ডাকাডাকিতে রীতিমত তটস্থ থাকত কমলিকা। নিদেনপক্ষে এড়িয়ে চলত যুবক টিচারদের। এভাবে নিজেকে যখন প্রায় থিতু করে এনেছে সেই মুহূর্তেই তীরে এসে তরী ডুবানোর মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল।
পড়ন্ত বিকেল। লাইব্রেরিতে বসে টানা নোট লিখে নেওয়ায় চোখে হালকা অন্ধকারের পর্দা পড়েছে। চোখ কচলিয়ে যেই না লাইব্রেরি থেকে বের হয়েছে, আচমকা এক ছেলে পেছন থেকে দৌড়ে আসে এই মেয়ে এই মেয়ে ডাকতে ডাকতে।
পিলে চমকে ওঠে কমলিকার।
তুমি সীমা না? শ্বাসকষ্ট রোগীর মতো বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ে ছেলেটা।
খানিকটা বিরক্তির কণ্ঠেই জবাব দিল কমলিকা, না, আমি সীমা নই। আমি কমলিকা ব্যানার্জি।
ওহ্, তাহলে আমার-ই ভুল। অবিকল সীমার মতো দেখতে। বড় টানে এমন জোরে নিশ্বাস ফেলছে ছেলেটা, কমলিকার বুকের ওড়না নড়ে নড়ে উঠছে। কে সীমা? কী ভেবে কমলিকা পাল্টা প্রশ্ন করে বসে। ছেলেটা কাঁদো কাঁদো মুখভঙ্গি করে ভাঙা কণ্ঠে বলে, পাষাণী! এক পাষাণীকে আমি খুঁজে ফিরি দিবানিশি। নিদারুণ বিলাপ মুখে নিয়ে নদী ভাঙনে সর্বস্ব খোয়ানো মানুষের মতো বুক চাপড়ে বিদায় নিল ছেলেটা।
কমলিকা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। রুমে ফেরার পরেও গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো ক্রমাগত কানে বেজে চলছে ছেলেটার আর্তিভরা অসহায় কণ্ঠ—পাষাণী! এক পাষাণীকে আমি খুঁজে ফিরি দিবানিশি।
পরদিন ক্লাস হতে বের হচ্ছিল কমলিকা। সিঁড়িতে বিমর্ষ চেহারা করে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। পাশ কাটিয়ে নিচে নামতে গিয়ে খেয়াল করে, কেমন বিপন্ন চোখে তাকাচ্ছে ছেলেটি। কিছু বলবে ভেবে দু-পা এগিয়ে গিয়েছিল কিন্তু মনের দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
তিনদিন পরের ঘটনা। কমলিকা লাইব্রেরি করে ফিরছিল। ছেলেটা আম গাছে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শূন্যে। নিজের মধ্যে একটু কৌতূহল বোধ করে কমলিকা। এ আবার কোন দেবদাস রে বাবা! কৌতূহলের অনিরুদ্ধ টানে এক পা দুই পা করে ছেলেটার মুখোমুখি দাঁড়াল কমলিকা। বোধ করি আমি-ই আপনার ঘুমন্ত কষ্টটাকে নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছি। আমি সরি। আমি তো ইচ্ছে করে আপনার সীমার মতো দেখতে হইনি, কি বলুন? আমার এই দেহ তৈরির জন্যে তো আমি কোন কারিগর নিয়োগ করিনি। প্রাকৃতিকভাবেই পেয়েছি।
ছেলেটা মমির মতো নীরবে দাঁড়িয়েই রইল। রা শব্দটাও করেনি। কমলিকা চরম বিরক্ত। ছেলেদের এসব ন্যাকামো আমার একদম অপছন্দ। বিড়বিড় করে ছেলেটার সামনে থেকে সরে আসে। কিন্তু রুমে ফিরে অস্থির হয়ে ওঠে। কোথাকার মেয়ে সীমা? ছ্যাকা দিয়ে পথে ছেড়ে দিয়েছে ছেলেটাকে! কমলিকার মায়া হয় ছেলেটার জন্যে। এই মায়া দেখাতে গিয়ে-ই ছেলেটার পাতা ফাঁদে পড়েছে। পরে বিজলিবেগে ঘটে গেছে যা সর্বনাশ ঘটার! একটু একটু করে একদিন দু’দিন করে মন লেনাদেনা চালাতে চালাতে কবে যে দেহের ক্ষুধায় পেয়ে বসেছিল কমলিকার! সব ঘটে গেল।
বোবা চাপা গুমড়ানো কান্নার নহর বইছিল কমলিকার ভেতরে সেদিন হতে যেদিন জেনেছিল ছেলেটি মুসলমন। শফিক নাম। খুলনার ছেলে। বাবা মুসলিম লীগের লোকাল লিডার। খুব দাপুটে। অবিশ্বাস্য ঠেকছে কমলিকার কাছেই। কেন ছেলেটার পরিচয় জানতে চায়নি? কী এমন যাদু করল! সব বিলিয়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে তারপরে সব জানল। এখন সে ফিরবে কী করে? ভেঙেচুরে কেঁদে কেটে যতবারই ডিসিশন নিল এখানি দাড়ি টানবে, ঠিক তক্ষুণি টনটনে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে মঙ্গাপীড়িতের মতো ছুটে গেছে ছেলেটার কাছে। শেষে বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও রাখেনি মনে। হাতে তো রং মাখেনি যে মুছে ফেলবে। এ যে জীবনে জীবন যোগ।
ইতোমধ্যে বিভাগের এক ইয়াং টিচার অধৈর্য হয়ে ওঠে। রুমে ডেকে নিয়ে কোন লুকোছাপা না করে ডাইরেক্ট বলে, কমলিকা আমি বিয়ে করব তোমাকে। ডিসিশন ফাইনাল। আতঙ্কে কমলিকার বুক কাঁপে। সেদিন কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফিরে আসে। শফিককে সব ঘটনা খুলে বলে। শফিক তুড়ি মেরে সব উড়িয়ে দেয়, বলুকগে, কমলিকা তুমি ঠিক থাকলেই সব ঠিক। কিন্তু ভয় কমলিকার মনের ভেতের দৌড়ে বেড়ায়। কী হতে চলেছে কে জানে। ঠিক চারদিন পরে ফের ডেকে পাঠায় টিচার। জলে বাস করে কুমিরের সাথে বিবাদ করে টিকতে পারবে না ভেবে বুকে সাহস নিয়ে কমলিকা গেল টিচারের চেম্বারে। সাথে নিল শফিককে। ভাবল, সব বৃত্তান্ত বলে হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করলে টিচার সদয় হবে নিশ্চয়।
দরজার বাইরে দাঁড়াল শফিক। ভেতরে ঢুকেছে কমলিকা। আদাব দিয়ে এক নিশ্বাসে বলে গেল, স্যার, আমি একজনকে কথা দিয়েছি, তাকেই বিয়ে করব। সরি স্যার, আপনার প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারছি না। হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি। শফিকের নামটা গোপন করে গেল। তবু টিচার নাছোড়। আশা ছাড়ে না। দেনদরবার চলে একমাস ধরে। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণে ক্রমেই টিচারেরর মধ্যে আকর্ষণ বাড়ে বৈ কমে না। কিছুতেই যখন কিছু হয় না, শফিক বায়না ধরে বসে, চলো বিয়ে করি। না হয় পিছু ছাড়বে না। ও শালা সমুন্দির বাচ্চা হুলোবিড়ালের মতো জাত ছ্যাঁচর!
কমলিকার সমস্ত অন্তরাত্মা খামচে ধরেছে তখন একটা শঙ্কা। শফিক কি তাকে মুসলমান বানাতে চাইবে? সে বলে, আমাদের বিয়ে কোনকালেই হবে না, শফিক।
শফিক লাফিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, হোয়াট!
কমলিকার মুখে শ্লেষের হাসি।
শফিক শান্ত হয়ে রইল।
ফের টিচারের ডাক পড়ে একদিন। ডিসিশন নিল কমলিকা। এবার চূড়ান্ত চেষ্টা। টিচার যদি গোঁ ধরেই থাকে তবে বলে দেবে সোজা, আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে পরের দিন সিঁথিতে সিঁদুর পরে হাজির হবে।
শফিককে দরজায় দাঁড় করিয়ে কমলিকা ভেতরে ঢোকে বুকে থু-ফুঁ দিয়ে। রুমে ঢুকেই ঝটপট করে বলে ফেলল, স্যার, আমরা বিয়ের ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি।
হা হা করে এমন করে ভিলেনি হাসি দিল টিচার, ভয়ে কমলিকার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার উপক্রম। পরক্ষণেই শান্তসৌম্য চেহারা করে বসতে ইশারা করে। মনের মধ্যে আনন্দের হুল্লোড় চলছে সেই মুহূর্তে কমলিকার। কিন্তু কিছুই না বলে শুধু শুধু বসিয়ে রাখল কেন! অন্যরকম এক ভয়ও ঢুকে গেল মনে। স্যার আমি উঠি, বলে উঠতে যাচ্ছিল কমলিকা, ঠিক তখনই পেছন থেকে জাপটে ধরে টিচার। কমলিকা চেঁচিয়ে ওঠে শফিক নাম ধরে। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ছিল শফিক। দরজা ঠেলে রুমে ঢুকেই চিতাবাঘের মতো এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়ল টিচারের উপরে। হাত-পা ছেড়ে দিয়ে লুটিয়ে পড়ল টিচার। বুকের উপরে ডান পা তুলে দিয়ে মুখে কুকুরের বাচ্চা বলে চেঁচিয়ে ওঠে বিকট গর্জন করে সর্বশক্তি দিয়ে মাটির সঙ্গে প্রায় পিষে ফেলে টিচারের শরীর। বুকের হাড় ভাঙার মটমট শব্দ হয়। সদ্য জবাইকরা পশুর মতো হাত পা আছড়াতে লাগল টিচার।
এ কী করলে শফিক! এ কী করলে তুমি! কমলিকা চিল্লিয়ে ওঠে শফিকের হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে আসে।
শফিক ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে, ঠিকই করেছি। ছাত্রীর শরীর ধরে! এই কুত্তার বাচ্চার মুখে আমি মুতে দেবো বলে ফের যেতে উদ্ধত হয়। সব শক্তি দিয়ে জাপটে ধরে কমলিকা। কমলিকার চিল্লানো শুনে পাশের রুম থেকে বিভাগের অন্য টিচার সাজ্জাদ শেখ ছুটে আসেন। দেখেন, তার সহকর্মী সদ্য বলি দেওয়া পাঠার মতো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
কমলিকা কাতর কণ্ঠে বলে, স্যার এখন কী করব? আমাদের কী হবে?
পালাও মেয়ে। এখনি পালাও। তারপর দেখছি। সাজ্জাদ শেখ বললেন।
কোথায় পালাব স্যার? কমলিকা বলে।
আপাত পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে সোজা আমার বাসায় চলে যাও। আর এক মুহূর্ত দেরি নয়। সর্বনাশ হয়ে যাবে। এখনি দৌড়াও।
শফিককে নিয়ে নিরাপদেই গেট দিয়ে বের হতে পারে কমলিকা।
সহকর্মীকে উদ্ধার করতে গেলেন না সাজ্জাদ শেখ। নিজের রুমে তালা দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জানাজানি হয়। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় টিচারকে। পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে শফিককে। সেদিন বিকেলেই টিচারের চ্যালা চামচারা মিছিল করে ঘোষণা করে, যেখানে শফিককে পাবে সেখানেই খতম করা হবে।
সেই রাত সাজ্জাদ শেখে বাসায় ছিল ওরা। কাকডাকা ভোরে সাজ্জাদ শেখ ও তার স্ত্রী স্টেশন পর্যন্ত এসে উঠিয়ে দিলেন খুলনার ট্রেনে। সাজ্জাদ শেখ বললেন, তোমাদের এখানে থাকার উপায় নেই। অনার্স ডিগ্রিটা শেষ করতে পারলে না বুঝি? তোমরা কোন পথে পা বাড়াচ্ছো? তোমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? আমি ভাবতে পারছি না। সাজ্জাদ শেখের চোখের কোণে জল টলমল করছে। তার স্ত্রী বার কয়েক আঁচলে চোখ মুছলেন।
শফিকের বাড়িতে পা ফেলতেই বিশাল অভ্যর্থনা পেল কমলিকা। শফিকের পরিবারের যেন পূর্ব প্রস্তুতিই ছিল। ছেলে বউ নিয়ে ফিরবে। মুহূর্তের মধ্যে কী করে ধান-দুর্বা যাবতীয় জোগাড়জান্তি হয়ে গেল! গ্রাম ভেঙে আসতে লাগল নতুন বউ দেখতে। ছেলের বউ ভার্সিটি পড়া মেয়ে, আবার রূপবতী, শফিকের মার গর্ব আর দেখে কে?
এসব দেখে কমলিকা মরমে মরতে লাগল প্রতি মুহূর্তে। সংসারের কোন কাজেই বাড়ির বউকে হাত লাগাতে দেয় না। কমলিকাও কোন কাজে হাত দেয় না। ঘরে বসে থাকে চুপচাপ। এতগুলো ভালো মানুষে বিশ্বাস নাড়াবার চেষ্টা না করাই মঙ্গল। শফিক প্রাণান্ত চেষ্টা করে কমিলকা যেন ওদের সাথে মিশে ওদের মতোই ঘরগৃহস্থালিতে মন দেয়। শাশুড়ি নাম জিজ্ঞেস করলে শফিক-ই উত্তর দেয়, ওর নাম কমলা।
এভাবেই চলে দিন। এরিমধ্যে শফিকের অস্তিত্ব আস্তানা করে নেয় কমলিকার রক্তে। আড়াল করে রাখতে চাইলেও ঠেলে আসা বমিই প্রমাণ করে দিল। হায় রে ভগবান! এখন কোথায় পালাব? সারা গ্রামে মিষ্টি বিতরণের ধুম ফেলে দেয় শফিকের মা। গ্রামজুড়ে কী যে আনন্দের হুল্লা চলছে! রাত গভীর হলেই শফিকের হাত-পা ধরে বেহুঁশের মতো কাঁদে কমলিকা, চলো পালাই। আজ না হয় কাল সত্য ফাঁস হবে-ই। তখন কী পরিণতি হবে ভাবতে পারছো না তুমি?
কমলিকার কোন অনুরোধ-ই শফিক আমলে নেয়নি।
এভাবেই কেটেছে আরও দুই মাস। তারপর আর গোপন রইল না। ইউনিয়ন বোর্ডের এক মেম্বার শফিকের বাবাকে বুঝিয়েছে, টানা তিন মাস ছেলে বাড়িতে। নিশ্চয় এর মধ্যে কিন্তু আছে। শফিকের বাবার টনক নড়ে। গোপনে লোক পাঠিয়ে সব সত্য জেনে যায়। যেদিন জেনেছে সেদিনই গভীর রাতে মরণাপন্ন রোগীর মতো হাত পা ছেড়ে বেহুঁশ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। পরিবারের সকলেই দৌড়ে গেল। শফিক গেল। পাছে পাছে কমলিকাও গেল। শফিকের বড় ভাই, ভাইয়ের বউ, আরও যারা যারা ছিল তারাও এলো দৌড়ে। শফিকের মা’র কানে কানে কিছু একটা বলে শফিকের বাবা। মহিলাও হাত পা ছেড়ে দিয়ে বেহুঁশ! কমলিকার ভেতরে তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। শফিকের বাবা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তোমরা যে যার ঘরে যাও।
বিষয়টা কেউ মার্ক করতে পারল না। কমলিকাও না। ঘরে ঘরে গেল সবাই। চারদিকে ঘেরা বাড়ির। শফিকের ঘরটা ছিল দক্ষিণ ভিটায়। অন্য সব ঘর হতে কিছুটা দূরেও। প্রায় মিনিট বিশেক পরেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। কমলিকা বড় বড় চোখ করে তাকাল শফিকের দিকে। দরজা খুলে দেখে শফিকের বাবা-মা। শফিকের বাবার অগ্নিরূপ দেখে কমলিকার দেহজুড়ে থরকম্পন।
চোখের পলকে শফিকের ঘাড় ধরে পায়ের সেন্ডেল দিয়ে ঠাস ঠাস করে পিটাচ্ছে আর বলছে শফিকের বাবা, মালোয়ানের পয়দা আমার ঘরে কেন রে? বল হারামজাদা! মালোয়ানের পয়দা আমার ঘরে কেন?
কমলিকা শফিককে জড়িয়ে ধরে, ওর কোন দোষ নেই বাবা, ওর কোন দোষ নেই, সকল দোষ আমার, আমাকে শাস্তি দিন। শফিকের মা পেছন থেকে কমলিকার চুল টেনে ধরে উল্টে ফেলে দিল। শফিক চিৎকার দিয়ে ওঠে, মা, কমলিকার পেটে বাচ্চা। আমার সন্তান। ওর শরীরে হাত দিও না। এ কথাতেই শফিকের বাবার মাথায় খুন চেপে গেল। শুয়োরের মতো ঘড়ঘড় শব্দ করতে করতে ঘর হতে বেরিয়ে গেল।
মাটিতে লুটিয়ে পড়া কমলিকাকে তুলতে হাঁটু ভাঁজিয়ে বসেছে কেবল শফিক। ঠিক তক্ষুণি পেছন হতে লাফিয়ে ঘরে ঢুকে শফিকের বাবা। এলোপাতাড়ি চাকু চালাতে লাগল বসে থাকা শফিকের বুকে-পিঠে। লুটিয়ে পড়ল শফিক। কমলিকা কমলিকা বলে চিৎকার করেছে দু’বার। তারপরেই নীরব হয়ে গেল। শফিকের মা এক চিৎকার দিয়েই অজ্ঞান। মুহূর্তেই শফিকের বাবা ঝাঁপিয়ে পড়ে কমলিকার উপরেও। পেটের উপরে পা তুলে মোচড় দিতে দিতে জখম জানোয়ারের মতো বিকট শব্দে চিৎকার করে, মিয়াবাড়ির বীজ হিন্দুর পেটে রাখতাম না। হিন্দুর পেটে মিয়াবাড়ির বীজ রাখতাম না!
মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্তের বন্যা বয়ে গেল।
কমলিকা ব্যানার্জি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ব্যথায় কুঁকিয়ে ওঠে হাতে চাপ দিয়ে ধরে তলপেট। যেন এখনো পেটে পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে শফিকের বাবা!
কোনমতে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছি। এক বছর বন্ধ ছিল। ফের ভার্সিটিতে যাই। সুমন আসা অবধি নিত্য রাত শফিককে ভাবি। এই শাড়ি পরে এখানে বসে রাত কাটাই। প্রাণধর্মে সুমনরা একেক জন দেবতা। সমাজ-ধর্মের সম্ভ্রম রাখেনি বলে সমাজ-ধর্ম ওদেরকে এমনভাবে নিষ্ঠুর নৃশংস কামড় বসায় তখন ওরা হারতে বাধ্য হয়।
মুখে বিদ্রূপের হাসি টেনে এনে উঠে যাবার সময় দুইবার করে বাতাসে থুতু ছিটিয়ে গেল কমলিকা ব্যানার্জি।
[চলবে...]
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ)
0 Comments
Post Comment