- 10 December, 2023
- 0 Comment(s)
- 233 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
খাস মুম্বইতে বসে ‘বম্বে ডাক’ চিবোতে চিবোতে কেনই বা বিমলাকে মনে পড়ল সুহাসিনীর তা কেউ বলতে পারবে না। সম্পর্কে সুহাসিনী বিমলার মেয়ে। আজ প্রায় পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে সে মুম্বই-প্রবাসী। এ শহরে কাজের ব্যস্ততার কারণে দম ফেলারও ফুরসত থাকে না। এহেন শুক্র-সন্ধ্যা তাই সুহাসিনীর জীবনে বিরল। বিরল বলেই সন্ধ্যেটাকে সে আলাদা করে ‘পালন’ করতে চায়। আর ঠিক সেকারণেই সুলা’র বোতল সাজানো। ঠিক সেকারণেই ‘বম্বে ডাক’। সামনের জানালাটা সে খুলেই রেখেছে। কেউ মুম্বইতে থাকে মানেই যে তার বাড়ি থেকে আলটপকা যে কোনও জানালা খুলে সামনে তাকালেই জুহু বিচের বালিয়াড়ি দেখা যায়, অথবা হু হু করে সমুদ্রের জোলো বাতাস বয়ে আসে এমনটা নয়। সুহাসিনীর এই ফ্ল্যাটটা নেহাত অনেকটা উঁচুতে বলেই এখানে বেশ একটু আলো-বাতাস খেলতে পায়। নয়তো তার ঠিকানা যে এলাকার, সাধারণ জনগণ তাকে ঘিঞ্জি বলেই মনে করে। নীচে নামলেই বেশ কিছু ঘেঁষাঘেঁষি পাশাপাশি বাজার-দোকান, রাস্তাও তেমন চওড়া নয়। জায়গাটা বস্তির কাছাকাছি। একদিকে একটু এগোলেই বস্তির অবাঞ্ছিত চিৎকার শোনা যায়। কিন্তু তাই বলে জায়গাটা যতখানিও অস্বস্তিকর বলে মনে হচ্ছে, ততখানিও নয়। অন্য একদিকে আরও একটু এগোলেই জমজমাট আধুনিক শহরের এলাকায় এসে পড়তে কারোর সময় লাগবে মেরেকেটে পাঁচ মিনিট। আসলে চাকুরিক্ষেত্রের যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকবে বলেই সুহাসিনী তার কেরিয়রের শুরু থেকে বাসস্থানের ভৌগোলিক অবস্থানের সঙ্গে আপোষ করে এসেছে। সে কাচের গেলাসে চুমুক দেয়। পানীয়ের মৌতাতে বুঁদ হয়ে বসে থাকে আরও কিছুক্ষণ। আরও একটু ‘বম্বে ডাক’ মুখে নিয়ে চিবোয়। এই সময় আবারও তার বিমলার কথা মনে পড়ে।
বাঁধানো উঠোন সামনে। চারপাশে কেয়ারি করা ফুলের গাছ। একতলা বাংলো বাড়ি। বিমলার নিজের। অন্ধকার। গ্রামবাংলায় শীত পড়তে শুরু করেছে। বিমলা গায়ে শাল জড়িয়ে বারান্দায় বসেছিলেন। একটু আগেই তপন এসেছিল। কাছাকাছি এক গ্রামে তার বাস। এই তপনই সপ্তাহে একদিন করে এসে বিমলার বাজার করে দিয়ে যায়। ঠিকে কাজের লোক লক্ষ্মী সকালেই ঘরদোরের কাজ করে দিয়ে গেছে। বিকেলে রান্নার লোক আসে একজন। এছাড়া আছে সুরবালা। বয়স কুড়ি। অনাথা মেয়েটিকে বিমলাই আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেও এখন নয় নয় করে গ্র্যাজুয়েশন পাশ করতে চলেছে। নিজের কেউ নেই বলে সে বিমলার বাড়িতেই থাকে। পড়াশোনা করে। হাতের কাজে বিমলাকে সাহায্য করে। আর সন্ধ্যেয় বসে বিমলার পাঠশালা। সুহাসিনী কাজের সূত্রে বাইরে চলে যাওয়ার সামান্য পরেপরেই এই পাঠশালার সূচনা। যৌবনে বিমলা শান্তিনিকেতনে পড়েছিলেন। এখনও কেউ তাঁর সঙ্গে গল্প করতে এলে পুরনো শান্তিনিকেতনের কথা, আশ্রমের কথা, সেখানকার মাস্টারমশাইদের কথা, যেন বা বৃষ্টিদিনের টগর ফুলের মতোই তাঁর ভিতর থেকে টুপটুপিয়ে ঝরে পড়তে চায়। সেই শিক্ষা থেকেই বোধহয় বিমলা যখন সব ছেড়েছুড়ে উত্তরবঙ্গের এই তরাই অঞ্চলের জনপদে এসে ঘর বাঁধলেন, তখন থেকেই তাঁর মাথায় ছিল মেয়ে সুহাসিনী একটিবার স্বাবলম্বী হয়ে উঠলে পরেই তিনি এখানকার মানুষের জন্য কিছু করবেন। অতটুকু মেয়ে নিয়ে বিমলা তখন দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করছিলেন।
সুহাসিনী মুম্বই পাড়ি দেওয়ার পর তিনমাসও কাটেনি। বিমলা তখন থেকেই এই আনন্দ-পাঠশালার ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। আশেপাশের গ্রাম থেকে চাষী-জেলে, চা’বাগানের কুলি-কামিন, এদের ছেলেপুলেরা ঝেঁটিয়ে তাঁর পাঠশালায় আসতে শুরু করে। ক্লাস এইট অবধি অঙ্ক-বাংলা-ইংরেজি-ইতিহাস, আরও যা যা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে বিমলা নিজেই সেগুলি পড়াতে শুরু করেন। মধ্যে মধ্যে খবর পেয়ে কাছাকাছি কলেজের এক-আধজন ছেলেমেয়েও কখনও-সখনও তাঁর কাছে এসেছে। আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু পড়ার চাপ, বাড়ির কাজের চাপ অথবা হয়তো কেবল সদিচ্ছের অভাবেই (বিমলা মনে করেন), কেউই কখনও সেভাবে এই পাঠশালায় সময় দিয়ে উঠতে পারেনি। বিমলা একাই তাঁর পাঠশালা চালিয়েছেন।
অন্যদিকে এই পাঠশালা শুরুর সময়ে কোনও এক বছরে তিস্তার বন্যাতে, নদীর জলে অনাথা সুরবালা মেয়েটিকে অজ্ঞান অবস্থায় ভেসে আসতে দেখা যায়। তখন সে সাত-আট বছরের বোধহয়। উদ্ধারের পর একমাস ভয়ে-আতঙ্কে সে কোনও কথাই বলেনি। বিমলাই তার নাম দিয়েছিলেন সুরবালা। সুহাসিনীর নামের সঙ্গে কিঞ্চিৎ আদল মিলিয়ে। সেই সুরবালা আজ গ্র্যাজুয়েশনের গণ্ডি পেরুবে। বিমলার পাঠশালায় তাই দ্বিতীয় আরেকজন মাস্টারনীরও অভাব ঘুচেছে। এক-এক দিনে দু’দুটি করে ক্লাস নেন সুরবালা ও বিমলা। সন্ধ্যের সময় তাঁদের বাড়ি-বারান্দা-উঠোন গমগম করতে থাকে। বিমলা কোনওদিনও আর নিজেকে একলাটি বলে মনে করেন না। তাঁর ঈশ্বর তাঁকে দু’হাত ভরে দিয়েছেন। এমনই বিশ্বাস তাঁর। যদিও সেই ঈশ্বরে বিশ্বাস নিয়েই মেয়ের সঙ্গে তাঁর লেগে যায় মাঝে মাঝেই। ঘোর নাস্তিক সুহাসিনী সময়ে সময়েই কান্ট-হেগেল-মার্ক্স আউড়িয়ে ঈশ্বরের অসারতা প্রমাণ করতে চায়। বিমলা মনে মনে হাসেন। বিপ্রতীপ ভাবনার সহাবস্থানেই যে কোনও ভাবনার পুষ্টি, এই উপলব্ধি তাঁর চিরকালের। বিমলা মোবাইল টেলিফোনটাকে হাতে তুলে নিয়ে দেখেন। সুহাসিনীর ফোন। বিমলা কথা বলেন।
সুহাসিনী এর মধ্যে একবার উঠে ঘরে যায়। দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো বিরাট ওয়ার্ডরোবটাকে খুলে দেখে। চেনা অনেক কিছুকেই সেখানে সে দেখতে পায় না। কেবল অদ্ভুৎ মন কেমন করা গন্ধ এক, ওয়ার্ডরোবের সবকিছুতে তার ছোঁয়াচ ফেলে গিয়েছে। সুহাসিনী আবেগতাড়িত নয়। সে হাতের গেলাসে চুমুক দেয়। বিমলাই তাকে শিরদাঁড়া সোজা রাখতে শিখিয়েছেন। গেলাস নামিয়ে রেখে সে ফোন করে। অনেক দূরেকার কোনও উঠোন-বারান্দায়।
-“রেজিগনেশন দিয়ে দিয়েছি মা। ওরা এ্যাকসেপ্টও করে নিয়েছে,” সুহাসিনী এপাশ থেকে বলে।
-“খুব ভালো খবর। কিন্তু তার মানে এখন আপাতত বেকার?” ওপাশ থেকে বিমলার গলা ভেসে আসে।
-“ঠিক তা নয় মা, সরকারের সঙ্গে স্যাফ্রন ইণ্ডাস্ট্রিজের বিহাইণ্ড দ্য ডোর ডিলিংসগুলোকে নিয়ে যে স্টোরিটা পিচ করেছিলাম সেটা ‘প্যারালাল কেবল’ পোর্টালে বেরুবে। কিছু টাকা পাব তার জন্য। যদিও এই স্টোরিটা বেরুলে স্যাফ্রন ইণ্ডাস্ট্রিজ অথবা সরকারের লোকেরা আমাকে কতটা ছেড়ে কথা বলবে জানি না। আমার খুব ক্লান্ত লাগে একেকসময় জানো,” সুহাসিনীর গলাটা কেমন নিস্তেজ হয়ে আসে, “এইভাবে একের পর এক মিডিয়া হাউজ ঘুরপথে সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া। আমাদের কাগজটা অন্তত এত তাড়াতাড়িও বিক্রি হয়ে যাবে ভাবিনি। নিউজ এডিটর বিকাশ স্যর কত পছন্দ করেছিলেন জানো এই স্টোরিটা আমার? বলেছিলেন, এই আর্টিকল একমাত্র ‘সন্দেশা স্বাভীমান’ই পারে বের করতে। স্যরও জানতেন না একমাসের মধ্যেই স্যাফ্রন ইণ্ডাস্ট্রিজ ‘সন্দেশা স্বাভীমান’কে কিনে নেবে। ততদিনে বোধহয় উপরমহলে বিক্রির ডিলিংস হয়ে গিয়েছিল বলেই এমন চমৎকার স্টোরিটা তিন সপ্তাহ ধরে ওরা প্রসেস না করে ফেলে রেখে দিয়েছিল। প্রুফ বা লে-আউটটুকুও তৈরি করতে দেওয়া হয়নি,” সুহাসিনী আজ যেন একটু বেশিই কথা বলছে। বিমলা একটু আশঙ্কা বোধ করেন।
-“বিকাশ কুরুপ এখন কি করবেন?” বিমলা শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করেন।
-“উনিও চেষ্টা করছেন। হাতে-গোণা এখনও যে কয়েকটা ইণ্ডিপেণ্ডেণ্ট হাউজ আছে সেগুলোর সঙ্গে কথা বলার। নয়তো ওনার যা এক্সপিরিয়েন্স, উনি দেশের বাইরেও চলে যেতে পারেন,” সুহাসিনী জবাব দেয়।
-“আর নিখিল? সে কি বলছে?” বিমলা জিজ্ঞেস করেন। ওপাশ থেকে একটা নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কেবল জানালা দিয়ে হু হু বাতাসের শব্দ শোনা যায়।
সুহাসিনী ভাবতে পারেনি নিখিল, তার এত প্রিয়, এত সাহসী নিখিল – গত পাঁচ বছর ধরে যে সুখে-দুঃখে, সময়ে-অসময়ে, দিনে-রাতে, সুহাসিনীর সঙ্গে থেকে এসেছে, সে এভাবে তার একটামাত্র স্টোরির জন্য, সবকিছুকে এভাবে একেবারে এক সপ্তাহের ভিতর, ভেঙেচুরে ছত্রখান করে দিয়ে চলে যেতে পারবে। সম্পর্কগুলো কি তাহলে সত্যিই এখন এতটাই পলকা – এতখানিই ঠুনকো হয়ে এসেছে? সুহাসিনী নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে চায়। সুহাসিনী বা নিখিল তো বিয়ের আইনি জটিলতায় বাঁধা পড়তে চায়নি। তারা প্রত্যেকে পরস্পরকে তাদের সম্পূর্ণ পরিসরটুকুই দিতে চেয়েছিল। বিশ্বাসটুকুই সম্বল ছিল তাঁদের। সম্পর্কে জড়ানো অথবা বিচ্ছেদ সুহাসিনীর জীবনে নতুন নয়। কিন্তু সাহসী নিখিল, স্পষ্টবাদী নিখিল – যে কি না সুহাসিনীকে সাংবাদিক বলে, সর্বোপরি তদন্তমূলক সাংবাদিক বলে ভালোবেসেছিল, বিপরীতে সুহাসিনীরও কি তাহলে নিখিলের তরফে সেই সাহসের বাগাড়ম্বরকে নেহাতই মুখের কথা বলে ভেবে নেওয়া উচিত ছিল? সুহাসিনীর কাছে এর কোনও উত্তর নেই। একথা সত্যি স্যাফ্রন ইণ্ডাস্ট্রিজের কেলেঙ্কারিটা নিয়ে তার যে স্টোরিটা ‘প্যারালাল কেবল’এ আর কিছুদিনের মধ্যেই বেরুতে চলেছে, সাংবাদিক জীবনে অন্তত এতখানিও স্পর্শকাতর কোনও স্টোরি সে আজ অবধি করেছে বলে তো সুহাসিনীর মনে পড়ছে না। তবুও একদিন না একদিন এমন চ্যালেঞ্জ তো তাকে নিতেই হত। আজ নয়তো কাল। একজন সাংবাদিক তো এভাবেই তার পেশাকে উদযাপন করে। নিজেকে সেই পেশার যোগ্য করে তুলতে চায়। নিখিল সত্যিই কি এসব বোঝেনি? সবটাই কি তাহলে তার অভিনয় ছিল একেবারেই?
বিমলা নিশ্চুপে এপার থেকে শোনেন। অথচ বিমলা বা সুহাসিনীর কিন্তু জানার কথা নয়, কেমন ভাবে হুমকির স্রোত নেমে এসেছিল নিখিলের উপর। সাহস অত সস্তা নয়।
তবুও গ্রাম বাংলার শীতার্ত কোনও রাত, সেই রাত নেমে আসার যে অন্ধকার, বিমলা নিশ্চুপে সুহাসিনীর কথা শোনেন। সুহাসিনী নিজেকে সামলিয়ে নেয়। সে জানে তার মা এসবে আরোই শক্তিধর। শক্তিধর না হলে তিনি আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের সময়ে, আত্মঘাতী স্বামী দুর্নীতিগ্রস্ত এই অপমান মাথায় করে নিয়ে, ভিটেমাটি ছেড়ে একা হাতে মেয়ে মানুষ করতে পারতেন না। অনেকবছর পর আদালতের রায়ে সুহাসিনীর বাবা যখন বেকসুর ঘোষিত হন, তখন সেকথা শুনে যাবার মতো তাঁর সৌভাগ্য ছিল না। সততার আদর্শ রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন কারোর মৌচাকে ঢিল মেরেছিলেন বলেই নির্দোষ সুহাসিনীর বাবার কপালে ‘চোর’ তকমা জুটেছিল। চাকরি তো গিয়েছিলই, উপরন্তু মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেন। কোলের মেয়ে সুহাসিনীকে নিয়ে সমতল ছাড়েন বিমলা। সেই থেকে তিস্তাপারের বিস্তীর্ণ জনপদেই ঠিকানা তাঁর।
-“এদিকে ফোনের ভিতর চিবিয়ে চিবিয়ে কুড়মুড় করে কি খাচ্ছিস রে পাজিটা?” কথা ঘোরাতে বিমলা জিজ্ঞেস করেন।
-“ফ্রাই খাচ্ছি গো মা, ফ্রাই – আসল বম্বে ডাক,” অল্প হেসে সুহাসিনী জবাব দেয়।
-“তাই বল, সঙ্গে নিশ্চয়ই ঢুকুঢুকুও চলছে?” বিমলা জিজ্ঞেস করেন, “বল দেখি তাহলে লোটের মতো একটা সাধারণ মাছকে ওরা ‘বম্বে ডাক’ বলে নাম দিল কেন?” শান্ত, বয়স্কা মায়ের আটপৌরে চেহারা ফুঁড়ে তখন শান্তিনিকেতনের ছাত্রী, পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাস গ্র্যাজুয়েট, অনার্স পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড বিমলা সেহানবিশেরই এক অন্যরূপ ফুটে বেরিয়ে আসতে চায়। সুহাসিনীও এক চুমুকে গেলাসের পানীয়টাকে শেষ করে ফেলে। গড়গড় করে সে এক নিঃশ্বাসে বলে যায়,
“আদতে মহারাষ্ট্র উপকূলে প্রাপ্ত বিশেষ এক ধরনের লোটে মাছের প্রজাতিকেই ‘বম্বে ডাক’ বলে অভিহিত করা হয়। স্যর টবি রেণ্ড্র্যাগ ছদ্মনামে এক বিলিতি কবির কাব্যগ্রন্থে ১৮২৯এ, এমনকি তারও আগে ১৮১৫ সালেরও কোনও কোনও সরকারি রচনায় এই ‘বম্বে ডাক’ নামটির উল্লেখ মেলে। সেই সময় থেকেই ‘বম্বে ডাক’ মাছটিকে ধরে শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করার পদ্ধতি বাজারে চালু ছিল। এই মাছ সেই সময়ে বিপুল পরিমাণে মহারাষ্ট্র থেকে বাংলায় রফতানি করা হতো। চলতি ভাষায় ডাকগাড়িতে বা বম্বে মেইলে করে মাছটিকে কলকাতার বাজারে আনা হত বলে, লোকমুখে এর নাম হয়ে যায় ‘বম্বে ডাক’। সেই থেকেই বোধহয় বাঙালী লোটের ‘ঝুরো’র আন্তর্জাতিকতাপ্রাপ্তি!” একদমে পুরোটা বলা শেষ করেই সুহাসিনী হো হো করে হেসে ওঠে। ফোনের এপারে বিমলা দেবীও আর না হেসে পারেন না। ভয়ের বিপরীতে শিরদাঁড়া সোজা রাখার জন্য হাসির চেয়ে ভালো প্রতিষেধক আর কোথায়!
দুজনের হাসির শব্দে কেউই খেয়াল করে না সুহাসিনীর ঘরের দরজায় তখন খুট করে একটা শব্দ হয়।
একই সময়ে অরলি সেতুর উপর ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে নিখিল ওয়াঘমারে তার দামী বিদেশী গাড়িটাকে দাঁড় করায়। দরজা খুলে সে রেলিংয়ের কাছে নেমে আসে। এত রাত্তির হয়ে গিয়েছে যে এই ব্যস্ত সেতুর উপরেও তেমন একটা যানবাহন নেই। সে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে।
ফোন কেটে যায়। যে লোকটা ঘরে ঢুকে এসেছিল, কাজ সেরে সে আবারও বেরিয়ে যায়। মেঝের উপর পানীয়ের গেলাস আর অবশিষ্ট লোটের টুকরোগুলোই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এপাশে-ওপাশে পড়ে থাকে। বিমলা দেবী আকাশের দিকে তাকান। মেঘমুক্ত আকাশে আজ স্পষ্ট ছায়াপথ দেখা যাচ্ছে।
0 Comments
Post Comment