- 03 August, 2025
- 0 Comment(s)
- 60 view(s)
- লিখেছেন : মৌসুমী দাস
খুব ধীরে ধীরে একটা শীতল হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে, সন্ধ্যের বার্তা বয়ে পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে সূর্য অস্তগামী, গ্রামের ছেলে রামু B.Com. Pass করে বসে আছে। দুই বছর হলো চাষের জমিতে বাবার সাথে হাত লাগিয়েছে। চাকরি আর কোথায়….? আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে বাড়ি ফেরার পথে একটা বট গাছের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় ! দেখতে পায় গাছে হেলান দিয়ে একটা মেয়ে চোখ বুজে বসে আছে। নিঃঝুম রাস্তা….. কাছে এগিয়ে গিয়ে ডাকলো, …. এই … শুনতে পাচ্ছো…! এই মেয়ে, মেয়েটি ডাক শুনে থতমত খেয়ে ভীত দৃষ্টিতে সোজা হয়ে বসে তাকালো, রামু একটু অপ্রস্তুত… মেয়েটি অপরিচিত… এই গ্রামের তো নয় বরং শহুরে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। ক্লান্ত অবসন্ন লাগছে, কাঁপা ঠোঁট দুটি কিছু বলতে চায়, কিন্তু পারছে না। রামু তাকে উঠতে বলে হাত বাড়ায়… সে নীরবে হাত দুটি বাড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। রামু বলে, কাছেই বাড়ি যেতে পারবে? সেখানে তার দুই বোন এক ভাই আর তার আব্বা আছেন।
মেয়েটির নাম বলে অপর্ণা রায়। রামু একটু আনমনা হয়ে বাড়ি নিয়ে যায়। বড় বোন শাহনাজ নীরব প্রশ্ন তুলে দাদার দিকে তাকায়। ইশারায় ভিতরে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে বললো রামু। ভিতরে নিয়ে গিয়ে একটা চৌকিতে বসিয়ে রামুকে জানতে চায় - ‘দাদা কি ব্যাপার?’ রামু বলে, কোন বিপদে পড়েছিল মনে হয়। ওর পোশাক পাল্টে পরিষ্কার হতে বল। তুই কথা বল বোন।’ তাকে কীভাবে কোথায় দেখতে পায় সবই জানায় রামু। শাহনাজ বোন আমিনার হাতে পানি দিয়ে বলে অপর্ণাকে দিয়ে আসতে। রামুর আব্বা একটু রাগ করে বলে, তুমি ওইভাবে একটা মেয়েকে চেনো না, তারপরে হিন্দুর ঘরের শহুরে মেয়ে বাড়ি নিয়ে আসলে?
কোন উচ্চবাচ্য না করে খাওয়া দাওয়া সেরে রামু অপর্ণার সাথে দেখা করে জানলো কীভাবে সে যাকে ভালোবাসে তারজন্য ঘর ছেড়েছিল, সেই ছেলেই তাকে ঠকিয়ে তার শরীরটাকে অপবিত্র করেছে। সে কোনক্রমে পালিয়ে এসেছে। বাড়ি ফেরার মুখ নেই। মরে যাওয়ার কথা ভেবেছিল কিন্তু তাও সে পারেনি, সে হারতে চায় না। সে এই সুন্দর পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ থেকে একটা কুৎসিত মানুষের জন্য চির বিদায় নিতে চায় না। রামু বলল বেশ একটু বিশ্রাম নাও।
অপর্ণা ঠিক করে উঠে বসে বলে না থাক, একটু বসি। আপনার সম্পর্কে কিছু জানিনা চিনি না, তবু আপনি, গলা কেঁপে ওঠে অপর্ণার। রামু অপ্রস্তুত হয়ে বলে, আমার ডাকনাম রামু। আর সবাই চেনে আমাকে জাকির নামে। মানে আমরা মুসলমান… তুমি…। অপর্ণা একটু ম্লান হাসি হাসলো… মনে মনে বলে ওঠে রামুদার পরিবার আমার সম্পর্কে জানলে আমাকেই হয়তো বাইরে ঠেলে দেবে..। আর জাতের বিচার তো মনুষ্যত্ব দিয়েই হয়। আর অমানুষ পশুটা তো তার সব কেড়ে নিয়েছে, অবশ্য সে চিরদিনই মানুষকে তার মনুষ্যত্ব দিয়েই বিচার করে এসেছে, যদিও সে তার প্রাণের মানুষকে চিনতে ভুল করে তার পরিবারকে ছেড়ে যে ভুল করেছে…!
সে যে পুরুষ মানুষকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে, একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেলে রামুর হাত ধরে কেঁদে ফেললো। রামুর বোন শাহনাজ থালায় করে রাতের খাবার ডিম কষা আর রুটি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। রামু তার হাত দুটো অপর্ণার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল।
অপর্ণার খিদে তো পেয়েছে, কিন্তু গলা দিয়ে নামছে না। শাহনাজ পাশে বসে স্নেহ ভরে চেয়েছিল, অপর্ণা আর পারেনা, বলে আমায় তোমরা চেনো না, তবু এই যে আশ্রয় দিলে। না হলে কোথায় যে যেতাম। আমি এই গ্রামের কিছু চিনি না, কত যে দৌড়েছি, হেঁটেছি আর পারছিলাম না… তাই… কেঁদে ওঠে অপর্ণা। শাহানাজ সস্নেহে বলে, নাও খেয়ে শুয়ে পড়ো, পরে শুনবো সব। রামু, শাহনাজ, আব্বু, আর বোন আমিনা কোন কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নিলো, রামুর থেকে মোটামুটি অপর্ণা সম্পর্কে কিছু শুনলো তারা। আব্বু গম্ভীর হয়ে আছে। রামু নিজ ঘরে শুতে গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে অপর্ণা ঘুমিয়ে পড়েছে। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়।
পরের দিন সকালের রোদ্দুর খোলা জানালা দিয়ে রামুর বিছানায় এসে পড়েছে। রামুর ঘুম ভেঙে যায়, পাশে তার আব্বা ঘুমিয়ে এখনো। কালকের কথা মনে পড়ে যায়, আর তাড়াতাড়ি উঠে দরজার দিকে এগোয়। যেন সবটা স্বপ্নের মতো, ঘড়িতে ছটা বাজছে, বাইরে শাহনাজ গোবর জল দিয়ে উঠোন নিকোচ্ছে। ছোট বোন আমিনা কলতলায় মুখ ধুচ্ছে। …অপর্ণা…ও কই? বাইরে বের হতেই কলতলার পাশে স্নান ঘরে জলের আওয়াজ হতেই চমকে উঠলো, বুঝলো অপর্ণা।
স্নান সেরে শাহনাজের সালোয়ার কামিজ পরে বাইরে আসে অপর্ণা। রামুর দিকে তাকিয়ে মাথা নত করে বারান্দা দিয়ে উঠে ঘরে চলে যায়। ভোরের আলোয় অপর্ণাকে বড়োই সুন্দর দেখাচ্ছে। তার চলে যাওয়ার পথে আনমনা হয়ে তাকায়। রামুর বাবা পাশে এসে বলে, কিছু ভাবলি? একটু পরেই পাড়া প্রতিবেশীরা জানতে চাইবে। রামুরও চিন্তা হচ্ছিলো… বললো, আব্বু আমি দেখছি। রামু অপর্ণার কাছে গেলো দরজায় ঠোঁকা দিয়ে ডাক দিলো। অপর্ণা বেরিয়ে এসে বলে কিছু বলবে রামুদা, “হ্যাঁ, কি ভাবছো কোথায় যাবে?” অপর্ণা বিস্ময় ভরা চোখ দুটি তুলে বলে, “কোথায় যাবো…, মানে…? আমি কোথায় যাব রামুদা…, আমি কোন মুখে নিজের বাড়ি যাবো? আমাকে তবে মরতে হবে।” রামু মুখে হাত দিয়ে বলে চুপ করো, “আমি দেখছি, তুমি খাওয়া দাওয়া করে নাও, আমি একটু আসছি,”- অপর্ণা - ‘কেন তুমি কোথায় যাবে? আজ না হয় বাইরে না গেলে, আমার ভয় লাগছে। ছুটে এসে রামুর হাত দুটো চেপে ধরে। সে যেন বড় দুর্বল হয়ে গেছে, “অপর্ণা কি করছো, ছাড়ো আমি একটু পরেই চলে আসবো, বোনরা বাইরে আছে, কি বলবে দেখে?”
“কি বলবে রামুদা! সে ভাবলে তুমি সন্ধ্যেবেলাতে ওই ভাবে জড়িয়ে ধরে বাড়ির ভিতর আনলে কি করে?” ভুল বুঝোনা… তাহলে আমায় মরতে হবে যে!” জোর করে রামু তবু চলে যায়, এক্ষুনি আসবো বলে গিয়েছিল কিন্তু অনেকটাই দেরি করে বাড়ি ফেরে।
শাহনাজ বলে, ‘দাদা এলি, হাত, পা ধুয়ে বোস খেতে দিচ্ছি।’ নিঃশব্দে খেতে খেতে রামুর চোখ দুটি অপর্ণাকে খুঁজছিলো… দেখতে না পেয়ে আমিনাকে বলে, অপর্ণা কোথায়রে?… অপর্ণা দি… খেয়ে ছাদে গেছে, “ওঃ…”
রামু খেয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে ছাদে গিয়ে দেখে অপর্ণা কাঁদছে। পিছন থেকে অপর্ণার গায়ে হাত দিতেই চমকে ওঠে। “ও…আপনি, এক্ষুনি আসছি বলে, সেই তো গেলেন। আমায় বুঝি ভয় পেয়েছেন? ভাবছেন কি ঝামেলায় পড়লাম।’ রামু মুখ নত করে কি বলবে, কি করে বোঝাবে আজ সারাক্ষণ শুধু অপর্ণার কথায় চিন্তা করে গেছে। ভিতরে ঝড় চলছে, অপর্ণা আবেগ ধরে রাখতে পারেনা, রামুর বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যায়। রামুর গেঞ্জি সিক্ত হয়ে যায় অশ্রুজলে। সে যেন লতার মত আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। রামু বোঝার চেষ্টা করে এটা তার দুঃখের কান্না, না সে দেরি করে আশায় তার অভিমান…।
হঠাৎ অপর্ণা ছিটকিয়ে যেন দূরে সরে যায়… চোখে যেন হঠাৎ একরাশ ঘৃণা, অপর্ণা যেন এই পৃথিবীর বাস্তবতাকে ভালোভাবে চিনে নিয়েছে। সে ভাবে মেয়েরা যেন সৃষ্টিই হয়েছে পুরুষদের আনন্দ আর সুখের নিমিত্ত। তার নিজস্ব কোন চাওয়া পাওয়া যেন থাকতেই পারে না। সমস্ত চাওয়া যেন তাদেরই নিমিত্ত। সে মানতে পারে না, ভীষণ একটা প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে অপর্ণার মধ্যে। রামুর সহানুভূতি, করুণাকে সে চরম ঘৃণ্য মনে করে। অপর্ণার উষ্ণ আলিঙ্গন রামুর মধ্যে একটা আলোড়ন জাগায়, ছাদের এক কোণে সরে যায় রামু, অপর্ণা কিছুটা বুঝতে পেরে বিদ্রুপের শব্দহীন হাসি হাসে, আর বিধাতার কথা ভাবে। আবার মন দুর্বল হয়ে ওঠে। মা-বাবা ভাই এর কথা মনে আসে। রামুর দিকে তাকিয়ে বলে, “রামুদা তোমাদের আমি খুব বিপদে ফেলে দিয়েছি, তাই না, হয়তো ভাবছো কি কুক্ষণেই না সেদিন দেখা হয়েছিল। কেন আমায় আশ্রয় দিলে?” রামু ধীরে ধীরে অপর্ণার হাত দুটি ধরে বলে, “অপর্ণা এসব কেন বলছো? সেদিন যখন রাস্তা থেকে তোমাকে আশ্রয় দেবো বলে নিয়ে এসেছি তখন জানবে আমি তোমাকে মরতে দেবো না। জীবনটা এতটা তুচ্ছ ভেবো না। অন্যের জন্য নিজেকে দায়ী করোনা। নিজেকে নতুন করে দেখতে শেখো। আমি তোমার চোখে ঘৃণাকে দেখতে পেয়েছি। অপর্ণা, আল্লাহ জানে আমার কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই, ভুল করো না।” অপর্ণার চোখ জলে ভরে ওঠে, আকাশে অস্তগামী সূর্যকে অপর্ণার অসহ্য লাগে, অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠে, পুরনো যত স্বপ্নগুলোকে নতুন সূর্যের আলোয় আবার রাঙিয়ে তুলতে হবে।
সমাজের কিছু বর্বর পশুদের জন্য সে তার স্বপ্নগুলোকে হারাতে পারবে না, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। ভাবে সেই স্বপ্নের পাশে পাবে কি রামুদাকে…? একরাশ প্রশ্নের বান ছুঁড়ে দেয় রামুর দিকে…তাকিয়ে থাকে…অসহায়ের মতো…। রামু অপর্ণাকে আলতো চাপে চেপে ধরে, দেয় আশ্বাসের স্নেহ ভরা চুম্বন….। অপর্ণা স্বস্তি পায়।।
সমাজের সব পুরুষের কাছে নারী শুধুই আনন্দ-ভোগ্য নয়, স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার আছে। হ্যাঁ, সে বাঁচবে, বাঁচার মতো করে বাঁচবে।
লেখক : গল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment