- 20 March, 2025
- 0 Comment(s)
- 84 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ।
এখন রাত দুটো বাজে। এখনো শুক্লপক্ষের দ্বাদশীর চাঁদ ক্লান্ত ভাবে জেগে রয়েছে। ছাদের চিলেকোঠার ঘুণ ধরা কাঠের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হালদার বাড়ির বউ মঞ্জীরা চাঁদের দিকে আনমনে চেয়ে ছিল। আকাশের তারাগুলো আজ বড্ড বেশি উজ্জ্বল। এমন সময় পায়ের শব্দ শুনে মঞ্জীরা চমকে উঠলো। সে অনুভব করলো নিচের থেকে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে শব্দটা ছাদের দরজার সামনে এসে একবার থামলো তারপর অন্ধকারাচ্ছন্ন ছাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো জমাটবাঁধা অন্ধকারের মত একটা মানুষের অবয়ব। মঞ্জীরা নিজের প্রতিটা ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে তুললো। সেই অবয়বটা মঞ্জীরার দিকে এগিয়ে এসে বললো, ‘মঞ্জীরা ভয় পেয়ো না, আমি কঙ্কণা।’ কঙ্কণা হল মঞ্জীরার ননদ। মঞ্জীরা একটা ছোটো নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘তুমি এখনো ঘুমাওনি?’ কঙ্কণা বললো, ‘তুমিই বা এত রাতে এখানে কী করছো?’ মঞ্জীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো, ‘ঘুম আসছিল না তাই ছাদে হাওয়া খেতে এলাম। মাঝে মাঝেই রাতের বেলা এমন ছাদে চলে আসি, খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালে মনটা নিমেষে হালকা হয়ে যায়।’ কঙ্কণা বললো, ‘তোমার আজকে ঘুম আসবে না জানতাম। আমারও ঘুম আসেনি তাই ভাবলাম তোমার সঙ্গে একটু গল্প করে সময় কাটাবো। তারপর তোমাকে নিচে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ছাদে এলাম।’ মঞ্জীরাকে চুপ থাকতে দেখে কঙ্কণা আবার বললো, ‘আজ সন্ধ্যেয় তোমার সঙ্গে যেটা ঘটেছে তাতে আমার কোনো সমর্থন ছিল না।’ মঞ্জীরা বললো, ‘তবে কেন তুমি কোনো প্রতিবাদ করোনি?’ কঙ্কণা বললো, ‘আসলে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভাবতেও পারিনি যে মা তোমার ওপর চেঁচামেচি করতে করতে ওরকম ভাবে তোমার গায়ের উপর কাপ থেকে গরম চা ঢেলে দেবে। তুমি আমার ওপর রাগ কোরোনা প্লিজ।’ মঞ্জীরা বললো, ‘ না আমি রাগ করিনি। শুধু তুমি কেন শাশুড়ি মার ওপরেও আমার কোনো রাগ নেই।’ কঙ্কণা একটু অবাক হয়ে বললো, ‘ রাগ নেই! তবে তুমি মাকে অমন শক্ত শক্ত কথা শোনাচ্ছিলে কেন?’ মঞ্জীরা সামান্য হেসে বললো, ‘তখন ঐটুকু প্রতিবাদ না করলে আমার চলছিলো না। আচ্ছা, তোমার সেদিনটার কথা মনে আছে যেদিন তুমি তোমার কোন এক বন্ধুর জন্মদিনের রাতের পার্টিতে যাওয়ার জন্য একটা সুন্দর ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে বাড়িতে কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপিসারে পালিয়ে যেতে গিয়ে বাবার কাছে ধরা পড়ে যাও আর তারপর মা তোমাকে বাবার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে নিজে বকাঝকা করে তোমাকে একটা ঘরে আটকে রেখে দিয়েছিলেন? সেদিনও তুমি চুপ ছিলে।’ কঙ্কণা বললো, ‘বলেই বা কী লাভ হবে? উলটে আমার অবস্থাও ঐ তোমার মতই হত।’ মঞ্জীরা বললো, ‘আর কতদিন চুপ থাকবে? তুমি তো কোনো দোষ করনি।’ কঙ্কণা বললো, ‘তুমিও কি কোনো দোষ করেছিলে? ভদ্র বাড়ির বউ হয়ে পাড়ার বসন্ত উৎসবে গিয়ে নাচ করাটা যে অসভ্যতা তা আমি মনে করি না। যদি দোষের মধ্যে কিছু হয়ে থাকে তবে তা হলো বাড়ির কাউকে কিছু না জানানো। অবশ্য জানালেও কেউ তোমাকে অনুমতি দিত না। শেষে আমার মতই তোমাকেও ঘরে আটকে রাখতো।’ মঞ্জীরা বললো, ‘তবে আমার শাশুড়ি মার ওপর একটুও রাগ নেই। তিনি নিমিত্ত মাত্র। আসলে কি জানো যুগযুগান্তর ধরে পুরুষেরা মেয়েদের মধ্যে একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে বড় ভালবাসে। তারা নিজেদের সাধু বলে প্রমাণ করে এইটা দেখানোর চেষ্টা করে যে মেয়েরাই মেয়েদের পরম শত্রু। এই কারণে আমাদের ক্ষুদ্র ও খণ্ড প্রতিবাদকে ভেঙ্গে ফেলা তাদের কাছে খুব সোজা। ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি।’ কঙ্কণা বললো, ‘মেয়েরা একে অপরকে ভীষণ ঈর্ষা করে।’ মঞ্জীরা বললো, ‘ঠিক। তবে এই ঈর্ষা জিনিসটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েদের নিজস্ব নয়, এটা পুরুষতন্ত্রের আমদানি।’ হঠাৎ ওদের মাথার ওপর দিয়ে একটা চামচিকে উড়ে গেল। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকার পর কঙ্কণা বললো, ‘আজ থেকে আমি তোমার সঙ্গে যোগ দিলাম। মাকেও দলে পাবো আশা করি।’ মঞ্জীরা বললো, ‘মা কবে যোগ দেবেন সেটা সময় বলবে। আসলে অনেক বছর ধরে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে থাকতে মায়ের মন এবং মস্তিষ্ক পর্যন্ত দাসীবৃত্তির উপযুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা সব মেয়েরা যদি কোনোদিন এক হতে পারি তবে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিঃসন্দেহে আরও জোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবো।’ কঙ্কণা বললো, ‘অবশ্যই, এখন আর আমাদের কোনো বাধা নেই, কোনো ভয় নেই। রাত শেষ হতে চলল, চলো নিচে যাওয়া যাক। মনে হচ্ছে এবার আমাদের গভীর ঘুম আসবে।’
0 Comments
Post Comment