- 19 April, 2022
- 0 Comment(s)
- 448 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
“সমুদ্রমন্থনকালে প্রথমেই অমৃতের সন্ধান মেলেনি। হলাহল উঠেছিল প্রথমে। সেই বিষের কারণেই শিব নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন। সমাজমন্থনের সময়ে যে হলাহলের নিঃসরণ, তাকে ধারণ করবে কে ?”
গৌরদা প্রায়ই এই কথাগুলো বলত। প্রেসিডেন্সির গৌরদা। মেডিক্যাল কলেজের ক্লাস শেষ করে নবমিতা যখন আকাশ, অরিত্রিকাদের সঙ্গে পার্টির মিটিংয়ে কফি হাউজে গিয়ে বসত – গৌরদা, চুনীদা, সুপ্রকাশ, মেখলা এরাও সব সেখানে থাকত প্রেসিডেন্সির তরফে। একসাথে, এক টেবলে বসে সান্ধ্যকালীন বিপ্লবযাপন। দিনগুলোকে মনে পড়লে আজও নবমিতার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কতগুলো বছর অনায়াসে পেরিয়ে যায়। সেই সব আগুনও স্তিমিত আজ। আজকের নবমিতারা শুধুই বদলি হয়ে যেতে থাকে। শহর থেকে শহরে। মফস্বল থেকে মফস্বলে। এক হাসপাতাল থেকে আরও কোথাও।
হেলথ সার্ভিসের ডাক্তার হিসেবে বাঁকুড়াতে জয়েনিংয়ের পরেপরেই প্রথম যেদিন হাসপাতালের ‘বিশ্বখ্যাত’ আউটডোর ডিপার্টমেন্টে, একজনও সিনিয়র না থাকা অবস্থায় নবমিতার ডিউটি পড়েছিল, স্পষ্ট তার মনে আছে সেদিনের ঘটনা। নড়বড়ে এক বৃদ্ধা এসে নালিশ জুড়ে দিয়েছিল, কোমরে ব্যথা, গায়ে জ্বর, নড়তে চড়তে কষ্ট, মাথায় যন্ত্রণা, প্রবল পেট খারাপ। সঙ্গে বৃদ্ধার ছেলে ছিল। মায়ের মুখ চেয়ে সেও কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মুখে কথা ফোটেনি। দুজনের চেহারাতেই দেশজ দারিদ্রের রূপ প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে প্রকাশিত। দুজনেরই পায়ের অবস্থা দেখলে বোঝা যায় অনেকটা পথ পেরিয়ে আসতে হয়েছে তাদের। নবমিতার এমনতরো অভিজ্ঞতা নতুন নয়। কলকাতায় ইন্টার্নশিপ, হাউজস্টাফশিপের সময়েও এমার্জেন্সিতে, আউটডোরে এমন বহু-বহুবার সে অসহায়তা দেখেছে। নিরাশ্রয়তা-নির্বুদ্ধিতা দেখেছে। কিন্তু এখানে যেন কেউ আগে থাকতেই সেই কালো ছবিটার উপর রংটা আরও দু-পোঁচ মতো গভীর করে রেখেছে। নবমিতা এক হাতে প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতেই আরেক হাতে ড্রয়ার খুলে ফ্রিস্যাম্পলের কিছু সাধারণ ওষুধ বের করে এনে টেবলের উপরে সাজায়। একপাতা ওষুধ হাতে তুলে নিয়ে বৃদ্ধার ছেলেকে তার বিষয়ে বোঝাতে যেতেই বৃদ্ধা মাথা নেড়ে প্রায় চিৎকার করে ওঠে, “উটায় কুনো কাম হবেক লাই গো বিটি, উ সুই হামি লিব লা! হাঁসমণি সরেন উ সুই লিবেক লাই!” নবমিতা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়। বৃদ্ধা আবার হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে ওঠে, “উ রাঙাবরণ সুইতে মোর কুনো কাম হবেক লাই। তু মোকে পিলি সুই দিবি, হরা সুই দিবি। উ রাঙা সুইতে মোর কাম হবেক লাই!” নবমিতা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। লাইনে হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। শেষ অবধি হাঁসমণিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, পিঠে হাত বুলিয়ে - বৃদ্ধার ছেলেকে যখন নবমিতা সমস্ত ওষুধপত্র বুঝিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “সব ভালো করে বুঝে নিয়েছেন তো ? মাকে ঠিক মতো খাওয়াতে পারবেন তো তাহলে ?” লোকটি কেবল দুপাশে মাথা নাড়ে। নবমিতা আরও অবাক হয়ে যায়। হাঁসমণি ফ্যাক করে হেসে ফেলে এবার। “কারে তুই কি বলচিস লো রে বিটি! উ তো জন্মহাবা, জন্মকালা। মরদ উই একখানাই মাত্র ছিল ঘরে তাই সঙ্গে এয়েচে বটেক। জোয়ান মরদ ব্যাটাগুলান আমার সব কাঠকুড়াতে গেছে। উসব ই ব্যাটাকে দিয়া হবেক লাই।” বৃদ্ধা ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে হাসতে লোকটার হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায়। পরের জন হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে আসে। নবমিতাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই।
দানা মাঝির ঘটনা নিয়ে খুব হইচই পড়ে গিয়েছিল। উড়িষ্যার ভবানীপাটনা অঞ্চলের এক হাসপাতালে দানার স্ত্রীয়ের মৃত্যু হয়। প্রবল অর্থাভাবের কারণে দানা গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারেনি। স্ত্রীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়েই সে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিল ১২ কিলোমিটার। দেশবিদেশের সংবাদমাধ্যমে আগুনের মতোই সে খবর ছড়িয়ে পড়ে। গৌরদা এই সব মানুষদের কথা বলত। বাঁকুড়াতে আসার পর নবমিতাও তেমন মানুষ দেখেছে। ঘটনা পরম্পরায় কখনও হয়তো সে তেমন বীভৎসাকেও প্রত্যক্ষ করেনি, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী দারিদ্রের যে রূপ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, কবিতা, সংবাদমাধ্যমের খবর অথবা অন্যান্য পত্রপত্রিকায় উঠে আসে, এখন আর নবমিতার সেগুলোকে চরম অবাস্তব বলে মনে হয় না। এই দেশের এমন অন্তহীন সহিষ্ণুতার প্রতিও তার বুকের ভিতরে বিদ্বেষ জমে ওঠে। হলাহলের প্রভাব শুরু হয়ে গেছে।
সূরযের উপর সন্দেহটা নবমিতার একদিনে হয়নি। বেশ কিছুদিন ধরেই বিশেষ একটা ইঞ্জেকশনের ক্ষেত্রে নবমিতা লক্ষ্য করছিল যেমনটা কাজ হওয়ার কথা তেমনটা হচ্ছে না। এদিকে হাসপাতালের বাইরে সূরযলালের ফার্মেসি থেকে পয়সা দিয়ে যারা ওষুধ কিনে আনতে পারছে, তাদের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যাচ্ছে না। সন্দেহ হতেই তিন ভায়াল ইঞ্জেকশন ঘুরপথে নবমিতা সূরযের দোকান থেকে জোগাড় করেছিল। হাসপাতালের নিজস্ব ফার্মাসির স্টক থেকে নিয়ে আসা স্যাম্পলগুলোর সঙ্গে মেলাতে গিয়েই গরমিল ধরা পড়ে। হাসপাতালের নিজস্ব স্টকে যে ভায়ালগুলো রয়েছে, প্রতিটার গায়ে স্টিকারগুলোকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে সেগুলো পরে লাগানো হয়েছে। সূরযের সঙ্গে ওয়ার্ড-বয়, ট্রলি-বয় এমনকি দু-পাঁচজন নার্সেরও সখ্যতা। স্টক ডিপার্টমেন্টের লালাবাবুর সঙ্গেও তার খাতির রয়েছে। ল্যাবে নিয়ে গিয়ে সমস্ত স্যাম্পলগুলোকে যে টেস্ট করাবে সেই ব্যবস্থা হতে হতেও অনেকটা সময় লেগে যাবে। সন্ধ্যের পর নিজের একচিলতে কেবিনে বসে টেবলের উপরে ভায়ালগুলোকে ছড়িয়ে রেখে নবমিতা চিন্তা করছিল। এই কারবার বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। সুপারকে সে সরাসরি সন্দেহটা প্রকাশ করে দেখেছে। তিনি গা করেননি। হয়তো বা তেমন কোনও একটা গুরুত্বপূর্ণ ইঞ্জেকশন নয় বলেই করেননি। এর ডাইল্যুশনে সমস্যা হলেও বড় কোনও ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সূরযের মতো লোকেরা নিজেদের ব্যবসা বাড়াবে।
একবাক্স মিষ্টি নিয়ে সেদিন হঠাৎই ওয়ার্ড-বয় রাজু হুড়মুড়িয়ে নবমিতার কেবিনের মধ্যে ঢুকে এসেছিল। “সূরযবাবু পাঠিয়েছেন ম্যাডাম। উনি সবাইকে এরকমটা পাঠিয়ে থাকেন। খাবেন প্লিজ। আপনি নতুন লোক। তাই এতদিন খেয়াল করেননি বোধহয়।” নবমিতা কিছু বলার আগেই টেবলের উপর সাদা কার্ডবোর্ডের বড় মিষ্টির বাক্সটা নামিয়ে রেখেই আবারও সে কোথায় উধাও হয়ে যায়। নবমিতা কাঠ হয়ে বসে থাকে। তার গা গুলিয়ে ওঠে। স্লো-পয়জনিং!
বিষ অনেক রকমের হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিষের প্রতিক্রিয়া হয় তাড়াতাড়ি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার বিষের যন্ত্রণায় কাতরাতে হয় বহুক্ষণ। ভারতবর্ষের মানুষ স্লো-পয়জনিংয়ে বিশ্বাসী। এতে মৃত্যু সেভাবে ত্বরান্বিত হয় না, কেবল স্থবির হয়ে থাকে সমাজ। ঘুম ঘুম চোখে নেশা লাগে। লুপ্ত হয় সাড়। কেবল আস্তে আস্তে অক্টোপাসরূপী সূরযেরা নিজেদের সাম্রাজ্য কায়েম করে। বাকিরা সবাই নেশাগ্রস্ত হয়ে বেঁচে থাকে। জরাগ্রস্ত, প্রতিক্রিয়াহীন যযাতির মতো। নবমিতার গৌরের কথা মনে পড়ে। সেই সব চরিত্র কাল্পনিক। এই সময়েই রেণুকা মাঝি তার মা’কে ভর্তি করাতে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
[***]
অনেক রাত। ভাঙচুর থেমেছে। বাইরে এখনও অনেক লোক। সুপারের ঘরে নবমিতা, ডিউটিতে থাকা দুজন নার্স, ওয়ার্ড-বয় স্বপন, স্থানীয় থানার ওসি, দুজন কনস্টেবল, রেণুকা এবং আরও প্রায় পনেরোজন। দরজা পেরিয়ে ভিড় বাইরেটায় গিয়ে পড়েছে। সংবাদমাধ্যমের লোকজনকে বিদেয় করা গেছে। হাসপাতালের বাইরে পুলিশ পাহারা বসেছে।
-“সুগার টেস্ট না করিয়ে গ্লুকোজ ইঞ্জেকশন, তাও আবার ওইরকম হাই ডোজে! কোত্থেকে পাশ করে আসো তোমরা! সামান্য কেস হ্যান্ডল করতে পারো না!” এইবারে ফেটে পড়েন সুপার। নবমিতা মাথা নীচু করে থাকে। অস্ফূটে বলে, “সুগার টেস্ট হয়েছিল, সেই রিপোর্টে ডায়াবেটিস ছিল না।” “তাহলে সেই রিপোর্ট কোথায় ? দেখাও আমায়।” সুপার আরও চিৎকার করে ওঠেন, “সমস্ত সময় সাবোট্যাজ আর ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব না আনলেই কি চলে না তোমাদের! কই! দেখাও সেই রিপোর্ট ?” “পার্টি দেখাতে পারছে না,” নবমিতা আরও আস্তে জবাব দেয়। রেণুকা ভাবলেশহীন মুখে চেয়ে থাকে। ভিড়ের মধ্যে নবমিতা সূরযলালকে দেখতে পায়। তার চোখে কুতকুতে হাসি ফুটে রয়েছে। নবমিতা চোখ সরিয়ে নেয়। জাল ছড়িয়ে যাচ্ছে।
গোধূলির সময়টাকে ভালো লাগত নবমিতার। আজ লাগছে না। ডিসিপ্লিনারি এনকোয়ারি বসেনি। সুপারের সঙ্গে কিসব যেন শলা-পরামর্শ হয়েছিল সূরযের। ট্রান্সফার অর্ডারেই আপাতত ব্যাপারটা মিটেছে। কলকাতায় গৌরদাকেও নবমিতা ফোন করেছিল। ফোন লাগেনি। অন্যান্য সিনিয়রেরা দুএকজন স্বাস্থ্য ভবনের সঙ্গেও যোগাযোগের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছিল। হয়তো বা তাদেরই কেউ শেষ অবধি কথা রেখেছে। এসব নিয়ে আর নবমিতার ভাবতে ইচ্ছে করে না। লড়াইটা একতরফা হয়ে যাচ্ছে। কোথাও গিয়ে যেন একাকীত্ব খুব। খবরের কাগজে সে চিঠি লিখবে ভেবেছিল। সত্যেন্দ্র দুবের ঘটনাটাকে মনে পড়ে যেতেই আর সাহস হয়নি তার। ক্রমশ সেও সহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। নীলকন্ঠ হতে গিয়ে কোথাও, গোটা সমাজটাই যেন সেই নীলের আবহে অসাড় হয়ে গিয়েছে। মন্থন থেমে রয়েছে। নবমিতা জানতে পেরেছিল রেণুকাদের যে গ্রাম, সেই গ্রাম-পঞ্চায়েতেও নাকি সূরযের হাত রয়েছে। তারই কোনও এক আত্মীয় নাকি সেখানে সর্বেসর্বা হয়ে বসে আছে। কাজেই সূরযদের হুকুম অমান্য করাটা রেণুকা বা তার পরিবারের পক্ষে অসম্ভব ছিল। একেকটা করে ফুল ঝরে যায়। চৈত্রের তীব্র উত্তাপে নবমিতা এখন বাঁকুড়া সদর শহরে, জেলা হাসপাতালের এলাকাভুক্ত নিজের কোয়ার্টারে, মস্ত ছাদের উপর একলাটিই দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ দিক থেকে হাওয়া দিচ্ছে। কাল নবমিতাকে শালবনি চলে যেতে হবে। ওখানকার হাসপাতালেই নতুন ডেপুটেশন তার।
[***]
নবমিতা স্বপ্ন দেখছিল। শালবনিতে এসে অবধি তার কলকাতা যাওয়ার সুযোগ হয়নি। মা মাঝে দুএকবার ফোন করেছিলেন। বাঁকুড়া থেকে কলকাতা যাওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। শালবনি থেকে তুলনায় কম। তাছাড়াও ট্রান্সফারের পর এই মুহূর্তে বাড়ি যেতেও নবমিতার ইচ্ছে করছিল না। কলকাতায় দুএকজনের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। হাসপাতালে সারাদিন ডিউটি। এখানে গরম পড়ে দাপিয়ে। জলের সামান্য কষ্ট রয়েছে। তবু ডিসিপ্লিনারি এনকোয়ারির চাইতে ট্রান্সফার অর্ডারই একদিক থেকে ভালো বলে বোধ হয়। নবমিতা এভাবেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে থাকে। রেণুকার সঙ্গে সে একবার দেখা করতে চেয়েছিল। সুযোগ বা অনুমতি মেলেনি। গৌরদাকে পরে যোগাযোগ করে সবটা খুলে বলেছিল সে। গৌরদা জবাবে শুধু বলেছিল ‘দেখছি’। কি দেখবে, কেমন ভাবে দেখবে – এসব আর কিছুই বলেনি। নবমিতা এখন ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে মাঠের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। মনে হয় যেন কতগুলো বছর পেরিয়ে গিয়েছে। প্রচণ্ড গরম আর লু’এর দাপটে ওর মাথা ভোঁ ভোঁ করে। ফোন বেজে ওঠে নবমিতার।
-“গৌর বলছিলাম,” ওপাশ থেকে গলা ভেসে আসে।
-“হ্যাঁ বলো গৌরদা!” নবমিতার গলায় উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে, “কোনও খবর ?”
-“ও রাজি হচ্ছে না রে কিছুতে,” নিস্পৃহ গলায় জবাব আসে। নবমিতার বুকে এতদিন ধরে জ্বলতে থাকা আশার টিমটিমে মোমবাতিটাও ঝুপ করে নিভে গেল হঠাৎ।
-“তোমরা ওকে ভালো করে সবটা বুঝিয়ে বলেছিলে তো ?” সে জিজ্ঞেস করে।
-“সবই করেছিলাম। কিন্তু গ্রামের লোক। বুঝিসই তো ...” ফোনটা ওপাশ থেকে কেটে গেল। নবমিতা মাথা নিচু করে বসে থাকে।
আরও কিছুদিন পর আরেকটা ফোন আসে। তখন রাত। ফোনের ওপারে সুপ্রকাশ। পার্টিতে ইদানীং সুপ্রকাশদের লবির ক্ষমতা বাড়ছে। মফস্বলে থেকেও নবমিতা খবর পায়।
-“নবমিতা, আমি সুপ্রকাশ বলছিলাম। চিনতে পারছিস ?” ওপাশ থেকে গলা ভেসে আসে।
-“হ্যাঁ! চিনব না কেন। কেমন আছিস বল ? হঠাৎ এতদিন পর ?” নবমিতা জিজ্ঞেস করে।
-“আরে ভাই তুই রেণুকা মাঝির কেসটা তো একবার আমায় বলতে পারতিস। গৌরদার মতো হার্ডলাইনারদের দিয়ে এসব কেস তোলা যায় ? এতদিনেও বুঝলি না ?” সোজাসুজি আসল কথায় চলে যায় সুপ্রকাশ।
-“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না,” নবমিতা অবাক হয়, “কেন বল তো ? কি হয়েছে এখন ?”
-“আরে তুই তো বলেছিলি, রেণুকার কেসটা সিমপ্যাথেটিক গ্রাউন্ডসে দেখে যেন ওর সাথে যোগাযোগ করা হয়। মেয়েটা সত্যিই বুদ্ধিমতী। তুই ঠিকই রিড করেছিলি। এ পার্ফেক্ট ক্যান্ডিডেট।” সুপ্রকাশ বলে ওঠে।
-“হ্যাঁ, আমার তো সেটাই মনে হয়েছিল। গ্রাউন্ড লেভেলে এরকম একেকজনকে পার্টিতে আনতে পারলে, ক্যান্ডিডেচার দিতে পারলে পার্টিরই বেস বাড়বে,” নবমিতা এপাশ থেকে বলে। সুপ্রকাশ ওর মুখের কথা কেড়ে নেয়।
-“একদমই তাই। কিন্তু একমাত্র সমস্যা হয়েছিল যে মেয়েটা ওই সূরযের আত্মীয়ের বিরুদ্ধে আপকামিং ইলেকশনে দাঁড়াতেও রাজি, কিন্তু কোনও পার্টির টিকিটে যাবে না। নির্দল হিসেবে লড়তে চায়। এমনি এমনি ওকে বুদ্ধিমতী বলেছি!” সুপ্রকাশ হেসে হেসে কথা বলে।
-“ওহ,” নবমিতা চুপ করে যায়। কি বলবে সে বুঝে উঠতে পারে না। সুপ্রকাশ ওপাশ থেকে বলে ওঠে, “আরেহ, এত চাপ নিস না এখুনি!” সে তখনও হাসছে, “গৌরদারা হার্ডলাইনার হতে গিয়ে এতে রাজি হচ্ছিল না। এদিকে আমি ওপরমহলকে বলে পারমিশন ম্যানেজ করে নিয়েছি। রেণুকা ইন্ডিপেন্ডেন্ট হিসেবেই দাঁড়াবে। আমরা পিছন থেকে ওকে সাপোর্ট দেব। পার্টির সংগঠন একদিনে বাড়ে না। এই যুক্তিতেই হাইকমাণ্ড রাজি হয়েছে।” নবমিতা একটা শ্বাস ফেলে। সুপ্রকাশ আরও অনেক কিছু বলে যায়। হঠাৎ করেই নবমিতার চারপাশটা কেমন ফাঁকা হয়ে আসতে শুরু করে।
এই যে দলাদলি, গোষ্ঠীকোন্দল – এসবও তো নতুন নয়। কলেজ-জীবনে পার্টি করার দিন থেকেই, নবমিতা তো এই সবকিছুকেই নিজের চোখের সামনে দেখে এসেছে। তারপরেও রেণুকাকে হঠাৎ এই কাদা ছোড়াছুঁড়ির বিশ্রী আঙিনাতে কেনই বা সে মুহূর্তের উচ্ছ্বাসে নামিয়ে আনতে গেল ? নিজেকেই প্রশ্ন করে নবমিতা। উত্তর খুঁজে পায় না কোথাও। সে কি সূরযের প্রতি তার ব্যক্তিগত আক্রোশ ? নাকি সত্যিই সমাজ পালটানোর উদ্দেশ্যে একেকজন অপরিণত অথচ সম্ভাব্য যোদ্ধাকে খুঁজে বের করে আনার মানসিকতা ? দো-ধার তলোয়ারের উপরেই সে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে থাকে। হলাহলের তীব্রতা গভীর, তার চেয়েও বেশি পরিমাণে গভীর - যতখানি উপর থেকে সে উপলব্ধি করেছিল। নবমিতার স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। একে আর মন্থন বলা চলে না। নবমিতার মনে হচ্ছে রেণুকাকে সে আরও গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু রেণুকাদের লড়াই চলবে।
... তাদের বিশ্বাস প্রাগৈতিহাসিক অরণ্যের মতোই গভীর। শহরের অন্ধকার তাদেরকে গ্রাস করলেও, সকলকে করতে পারে না। রেণুকা মাঝির চোখে সেই বিশ্বাসকে উপলব্ধি করেছিল একজন। সেই একজনের বিশ্বাস দোলাচলে গেলেও, আমরাও কি আজ রেণুকাদের উপরেই ভরসা করতে পারি না ? হয়তো বা একদিন তাদের এই নির্দলীয়তা থেকেই গড়ে উঠবে আত্মবিশ্বাস। গড়ে উঠবে সংগঠন। গোষ্ঠীকোন্দলের চপারে গৌর অথবা সুপ্রকাশেরা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেও রেণুকাদের তখনও অস্তিত্ব থাকবে। কারণ তারা নির্দলীয়তার শক্তিকে উপলব্ধি করেছে। উপলব্ধি করেছে তাদের ‘নাগরিক’ শক্তিকে। নবমিতাকেও তখন পথ বেছে নিতে হবে। অরণ্যের আত্মবিশ্বাস পথ দেখাবে শহরকে। ইউটোপিয়ান সেই জগতেরই স্বপ্ন দেখছে নবমিতা। আমরাও দেখছি। প্রতিটা রাত ...
0 Comments
Post Comment