আলোকপ্রাপ্তি

  • 23 October, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 195 view(s)
  • লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
চিরন্তনী নির্জনে বারান্দার পাঁচিল ধারে এসে দাঁড়ালো। সত্যিই কি কেবলমাত্র পরের কথায় কান দিয়ে নিজেকে ক্ষুদ্র মান-অপমানের গণ্ডিতে সে এতদিন আবদ্ধ রেখেছে? কৌশাম্বীর মত করে তো কোনোদিন ভেবে দেখেনি। নিজের মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অপরাধ বোধ কাজ করছে। পরের কথা শুনে সে নিজের জীবনের শান্তি অযথা নষ্ট করেছে আর কৌশাম্বীকেও বিনা কারণে অপমান করে চলেছে। পাশের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ ভেসে এল। রাতের আঁধার জমে চেপে বসার আগে থেকেই চলছে সেই আঁধার দূর করার প্রস্তুতি।

দোতলার ঠাকুরঘরের খোলা জানলা দিয়ে দূর আকাশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছেন চৌধুরী বাড়ির গিন্নি চিরন্তনী। চারদিক ঘন করে সন্তর্পনে সন্ধ্যার ছায়া নামছে। দূরে কোথাও কালীপুজোর ঢাক বেজে উঠেছে। এখন হেমন্ত কাল। সূর্য অস্তমিত হওয়ার সুযোগ নিয়ে হালকা হিমেল হাওয়া সন্ধ্যার বাতাসে হু হু করে অনুপ্রবেশ করছে। পুরোপুরি শীত নামতে যদিও এখনও অনেক দেরি। চিরন্তনীর মনের আকাশের ঠিক মাঝখানে একটা ঘন মেঘ অনেক খানি জায়গা জুড়ে চেপে বসে রয়েছে। তার মাথার মধ্যে চিন্তাগুলো সব পাক খাচ্ছে তার পুত্রবধূ কৌশাম্বীকে কেন্দ্র করে। চিরন্তনীর একমাত্র পুত্র মৃন্ময় নিজের প্রেমিকাকে বিয়ে করে ঘরে আনে মায়ের অমতে। তা সেই ছোটবেলা থেকে কোন দিনই বা মায়ের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছে সে? চিন্ময়ের এই ঔদ্ধত্যের পিছনে যে সম্পূর্ণ ভাবে তার বাবার আশকারা রয়েছে তা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে চিরন্তনী। আর কিছু করুক কি না করুক অন্তত বিয়ের সময় যদি চিন্ময় একবার মায়ের কথাটা শুনত তাহলে আজ আর এভাবে আত্মীয় স্বজনদের কাছে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে বেড়াতে হত না। কৌশাম্বী মেয়েটি এমনিতে ভাল। আচার-ব্যবহার-কথাবার্তা সবই যথেষ্ট ভদ্র, গৃহকর্মে নিপুণা, মুখশ্রী সুন্দরই বটে, কলকাতায় খবরের কাগজের অফিসে চাকরিও করে। এমন বৌমাকে পেয়ে তার তো গর্ব হওয়ার কথা! এমনকি আজ এই কালীপুজোর দিনেও বৌমা কাজে ছুটি নেয়নি। কৌশাম্বীর একমাত্র খুঁত হল তার গায়ের চাপা রঙ। আজও চিন্ময়ের বৌভাতের দিনে নিজের খুড়তুতো বোনের করা কটূক্তিগুলো কানে খট্‌খট্‌ করে বাজে চিরন্তনীর। সেদিন তার খুড়তুতো বোন নতুন বৌকে দেখে নাক সিঁটকিয়ে বলেছিল, ‘এ কেমন বৌ আনলি রে দিদি? একেবারে অমাবস্যার রাতের মত কালো। ছেলেটার জীবন একেবারে নষ্ট করে দিলি।’

শুধু তাই নয়, কৌশাম্বীকে কেন্দ্র করে এমন অনেক গুঞ্জনই সেদিন উঠেছিল আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী মহলে। চিরন্তনীর বড্ড অসহায় মনে হয়েছিল সেই দিন। বউয়ের যদি কোনো খুঁত থাকে তবে কথা শুনতে হয় শাশুড়িকে। তাই যখনই বাড়িতে কোনো আত্মীয় আসে চিরন্তনী কৌশাম্বীকে তাদের সামনে আসতেই দিতে চায় না। সেই বিয়ের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই এই নিয়ে খিটিমিটি লেগেই থাকে শাশুড়ি-বৌমার মধ্যে। চিরন্তনী ঝগড়া করে তার যাবতীয় রাগ, অস্বস্তিকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে কৌশাম্বীর ওপর। প্রথম দিকে চিন্ময় ও তার বাবা এই অশান্তি দূর করার চেষ্টা করত বটে, কিন্তু তারাও শেষ পর্যন্ত অসফল হয়ে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। তবে কৌশাম্বীকে নিজের গাত্র বর্ণ বিষয়ে আর পাঁচটা মেয়ের মত কখন আক্ষেপ করতে শোনেনি চিরন্তনী। তার রঙ নিয়ে মুখে যে যাই বলুক না কেন, সে যে অতিষ্ঠ হয়ে বেশ ঝাঁঝালো কোনো প্রত্যুত্তর প্রতিপক্ষকে দিয়েছে এমনও নয়। কেবলমাত্র একটা তীক্ষ্ণ হাসি প্রতিপক্ষের দিকে শানিত ছুরির মত ছুঁড়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই সে করে না। এমন সময় নীচে ডোরবেল বেজে উঠে চিরন্তনীর দীর্ঘক্ষণের চিন্তায় ছেদ পড়ল। কৌশাম্বীর অফিস থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। চিন্ময় বাড়িতে ছিল, সেই দরজা খুলে দিল। চিরন্তনী জানলা থেকে সরে এসে ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে মেঝেতে একটা হাত রেখে পা মুড়ে বসল। শুনতে পেল সিঁড়ি বেয়ে দুরদার করে কেউ নীচ থেকে ছুটে আসছে এই ঘরের দিকে। ঘরের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে কৌশাম্বী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘মা, তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। আমার পিসি শাশুড়ি আজ বিকেলে আমাদের বাড়ি আসছেন। আমাকে দুপুরে ফোন করে জানিয়ে ছিলেন।’

চিরন্তনী বিব্রত হয়ে বলল, ‘এখনই তো এসে পড়বেন তাহলে! তুমি ওকে যা হোক একটা মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে আসতে বারণ করে দিতে পারতে। এই উৎসবের দিনেও কি আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না?’ কৌশাম্বী একবার চোখ বুজে নিয়ে বলল, ‘আর কত দিন আত্মীয়দের অপমানের ভয়ে তুমি পালিয়ে বেড়াবে মা? আচ্ছা, আমি যে কালো তাতে আমার তো কোনো সমস্যাও নেই, দুঃখও নেই। এতে কার কী আসে যায়, তা জেনে কী লাভ? মানুষের রঙরূপ— এ সবই ঈশ্বর প্রদত্ত, তাতে তার নিজের কোনো হাত নেই। আর তাছাড়া যে রূপের বড়াই লোকে করে তা আজ আছে, কাল নেই। চিরদিন কারোর কাছে থাকেও না।’

চিরন্তনী কৌশাম্বীর চোখের ওপর দৃষ্টি রেখে বলল, ‘এই কথা তুমি জানো আর আমি মানি কিন্তু সমাজ? সে এত কিছু মাথায় রেখে কথা বলে না। এখনই আমার ননদ এসে সকলের সামনে তোমাকে দুটো কথা আমায় বলবে। তখন তুমি কি তাকে এসব কথা বুঝিয়ে তার মুখ বন্ধ করতে পারবে? যদি পেরেও থাকো তবে বাকীদের মুখ বন্ধ করবে কীভাবে?’

—‘মা, আসলে আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বড় অভাব রয়েছে। আমরা ভাবি লোকে আমাদের নিয়ে যা বলে, সে সবই সত্যি। অন্যের দৃষ্টিতে নিজেদের পরখ করে থাকি সবসময়। কিন্তু কখন নিজের দিক দিয়ে অন্যকে ভাবতে শেখায় না। আসল সৌন্দর্য আমাদের রূপে নয়, আত্মায় বিরাজ করে। মোট কথা মানুষের অন্তরটা যদি সুন্দর হয় তবে সব সুন্দর আর সেটা না হলে সবই খারাপ। ছোটবেলায় আমার মা যখন আমার গায়ের রঙ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন তখন বাবা মুখে মুখে একটা ছড়া কেটে প্রায়ই মাকে শোনাতেন, ‘কালী কালো, কৃষ্ণও কালো/ কালোই জগতের আলো।/ রাত কালো, চুলও কালো/ তবে, কালো নয় কেন ভালো?’ একথা বলে কৌশাম্বী মৃদু হেসে চলে গেল।

চিরন্তনী নির্জনে বারান্দার পাঁচিল ধারে এসে দাঁড়ালো। সত্যিই কি কেবলমাত্র পরের কথায় কান দিয়ে নিজেকে ক্ষুদ্র মান-অপমানের গণ্ডিতে সে এতদিন আবদ্ধ রেখেছে? কৌশাম্বীর মত করে তো কোনোদিন ভেবে দেখেনি। নিজের মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অপরাধ বোধ কাজ করছে। পরের কথা শুনে সে নিজের জীবনের শান্তি অযথা নষ্ট করেছে আর কৌশাম্বীকেও বিনা কারণে অপমান করে চলেছে। পাশের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ ভেসে এল। রাতের আঁধার জমে চেপে বসার আগে থেকেই চলছে সেই আঁধার দূর করার প্রস্তুতি। সামনের বাড়িগুলোর ছাদে, উঠোনে, জানালায়, বারান্দায় সারি দিয়ে জ্বলে উঠেছে প্রদীপ, মোমবাতি। আশে-পাশের বাড়িগুলো আপাদমস্তক সেজে উঠেছে টুনির আলোয়। উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিরন্তনী দেখে তারা ফোটার আগেই অজস্র আতস বাজি গোটা আকাশময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেটে চলেছে। আকাশ জুড়ে অবিরত আলোর ঝরণা ঝরে পড়ছে। একদিকে আলো নিভিয়ে যেতে যেতে আবার অন্যদিকে বাজি ফেটে আলোময় করে তুলল চারিদিক। গলির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত সর্বত্র আজ আলো আর আলো। গোটা এলাকা যখন আলোর উৎসবে রঙ-বেরঙের আলোতে সেজে উঠেছে তখন তার বাড়িই বা অন্ধকারে ডুবে থাকবে কেন? না, তার বাড়িও অন্ধকার নেই। নিটোল একটি হাত চুড়িতে কন্‌কন্‌ শব্দ তুলে পাঁচিলে সারি দিয়ে রাখা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে গোটা বারান্দা সাজিয়ে চলেছে। প্রদীপের মৃদু আলোয় কৌশাম্বীকে দেখে চিরন্তনী। কৌশাম্বীর পরনে লাল শাড়ি, কপালে ছোট্ট লাল টিপ, সিঁথি ভরা সিঁদুর। কৌশাম্বীর অন্তরের সমস্ত সৌন্দর্য যেন আজ প্রদীপের এই ম্রিয়মান আলোয় তার মুখে ফুটে উঠেছে। সেই মুখের দিকে চিরন্তনী বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ মনটা অনেক হালকা মনে হচ্ছে তার। আজ তার মাথার ওপর থেকে সব মেঘ কেটে গিয়ে মন জুড়ে এক চরম প্রশান্তি খেলা করছে। আজ আর কোনো ক্লেশ নেই, দ্বিধা নেই। আর সে অপমানের ভয়ে কারোর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াবে না। এখন থেকে জগতের সকলের সামনে সে বুক চিতিয়ে বলতে পারবে, ‘বৌ কালো তাতে কী? কালী কালো, কৃষ্ণও কালো। কালোই জগতের আলো।’

এমন সময় নিচে ডোরবেল বেজে উঠল। চিরন্তনী একটা বুক ভরা শ্বাস নিয়ে বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘চিন্ময়, দরজাটা খুলে দে, আমার ননদ এসেছে। আর ওদের বল নীচে বসতে, আমি বৌমাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছি।’ 

লেখক : শিক্ষার্থী

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment