- 05 June, 2023
- 0 Comment(s)
- 185 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
শেষ চৈত্রের বিকেলের পড়ন্ত শুষ্ক রোদ সামনের আম গাছটার মাথার ওপরে এসে পড়েছে। সমস্ত দিন সূর্যের তেজের দৌরাত্ম্য সহ্য করার পর কাঁচা আমগুলো ক্লান্ত অবশ শরীরের ভারে থোকায় থোকায় ঝুলে পড়েছে শাখা থেকে। কোথাও থেকে এক নাগাড়ে কোকিল ডেকে চলেছে। একটা শালিক অক্লান্ত ভাবে অনেকক্ষণ এ ডাল থেকে ও ডালে লাফিয়ে বেড়িয়ে একগুচ্ছ ঝাঁকড়া নতুন আম পাতার আড়ালে অন্তর্হিত হল। জানালার কাছে বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে বাইরের এই দৃশ্য দেখছিল মানব। গুমোট গরমের দুপুরের অন্তিম লগ্নের এই একফালি অকেজো সময়টুকুতে তার স্মৃতিতে বেশ কিছু কথা পাক খেয়ে উঠতে শুরু করল। নিজের একটানা বত্রিশ বছরের জীবনে মানব অর্থাৎ থানার সাবইন্সপেক্টর মানবেন্দ্র সমাদ্দার মন থেকে কোন জিনিস চেয়েছে অথচ পায়নি এমন ঘটনা অত্যন্ত বিরল। মানব নিজের আশৈশব লালিত স্বপ্নের চাকরিতে যোগ দিতে পেরেছে, বাবা-মায়ের অঢেল সম্পত্তি ও স্নেহের ওপর একচ্ছত্র অধিকার পেয়েছে, নিজের কর্মক্ষেত্রে কর্তব্য পরায়ণতার জন্য অজস্র সম্মান ও প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং পেয়েছে নিজের প্রিয়তমার ভালোবাসা। তবে এত প্রাপ্তির মাঝেও কেবলমাত্র একটি অপ্রাপ্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে যেন মানবের সৌভাগ্যকে ক্রমাগত পরিহাস করে চলেছে। যেদিন থেকে মানব ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পারে যে এই জন্মে তার কপালে সন্তানসুখ লেখা নেই সেইদিন থেকে তার স্ত্রীর প্রতি অগাধ ভালোবাসার গাঢ় রংও ক্রমশ ফিকে হয়ে পড়েছে। যদিও মানব আজকে শারীরিক অসুস্থতার মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে থানায় যায়নি তবে অসুস্থতা তার শারীরিক নয় মানসিক। কয়েকদিন ধরে ক্রমাগত ঘটে চলা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাপ্রবাহের ধাক্কায় অন্তর থেকে সে বিধ্বস্থ হয়ে পড়েছে। তাই এখন নিজেকে সামলে নিতে তার একটু সময়ের প্রয়োজন। মানবেন্দ্রকে দেখতে সুশ্রী – গায়ের রং ফর্সা, নাক টিকালো, গুম্ফ-শ্মশ্রু বিহিন সৌম্যকান্তি মুখে শান্ত ও গভীর চোখ দুটো যেন আরও শোভা বৃদ্ধি করেছে, পাতলা ঠোঁটের কোণে এক অনমণীয় জেদ সদা প্রকাশিত। নিয়মিত ব্যায়ামাভ্যাসের ফলে সুঠাম দেহসৌষ্ঠব। এহেন রূপের আকর্ষণে নিজেকে ধরা দিতে চায়নি এমন নারীর সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু এসবের মধ্যেও মানবের মানসপটে ধরা থেকেছে কেবল মাত্র একটি রমণীর বিমূর্ত অবয়ব। সর্বাণীর সঙ্গে মানবের কলেজে পড়ার সময় থেকেই আলাপ ও ভালোলাগা ক্রমে ভালোবাসায় পরিণত হয়। মানব নিজের পড়াশোনা শেষ করে খুব তাড়াতাড়ি দক্ষতার সঙ্গে চাকরি সংক্রান্ত যাবতীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে থানার সাব ইন্সপেক্টরের পদে আসীন হয়। এরপর বাড়িতে তার বিবাহ বিষয়ক আলোচনার সূত্রপাত হলে নিজের প্রেমিকা সর্বাণীর কথা সে বাবা কুঞ্জলালকে জানায়। সর্বাণী বর্তমানে একটি কলেজের প্রফেসর। উভয় পরিবারে ওদের ভালোবাসার কথাটি জানাজানি হলে দুইপক্ষের সর্বসম্মতিক্রমে ওদের চার হাত এক হয়।
এরপর চোখের পলকে কেটে গেছে তিনটে বছর। বিবাহ বাসরে মানবের হিতাকাঙ্ক্ষী সহকর্মী ও বন্ধুগন যে পারিবারিক জীবনের অশান্তির বিষয়ে তার কানে সাবধানবাণী বর্ষণ করেছিল তা এতদিন নিজে নিরর্থকতা প্রমাণ করে এসেছে। সর্বাণী কলহপ্রেমী নয় তবে নিজের মুখরা শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণটা সে অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে এতদিন পদে পদে মিলিয়ে এসেছে। ছেলের মুখের দিকে চেয়ে মানবের মা বৈশাখীও এই সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা বাড়াতে চাননি। তবে ইদানিং তিনি সর্বাণীকে একা পেলেই তার কাছে বংশধর আনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন এবং সর্বাণীও ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে সুচারু ভাবে তা এড়িয়ে যায়। বৈশাখী যতই মনে করতেন যে পুত্র ও পুত্রবধূর ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করবেন না ততই তাদের দীর্ঘ নিষ্ফলা জীবন দেখে ব্যথিত হয়ে উঠতেন। বৈশাখী নিজের এই দুশ্চিন্তা আর চেপে রাখতে না পেরে নিজের বাসনার কথা কুঞ্জলালকে জানালেন। দাদু-ঠাকুমার কাছে নাতির মুখ দেখতে চাওয়া কোন অন্যায় আবদার নয়। কিন্তু কুঞ্জলালের কাছে বৈশাখী তেমন কোন আমল পেলেন না। অগত্যা তিনি নিজের পুত্রের ওপরেই তার ইচ্ছাপূরণের ভার ন্যস্ত করলেন। মানব কয়েকদিন ধরে মনের মধ্যে কথাগুলোকে বার বার সাজিয়ে নিয়ে বেশ কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে নিজেকে প্রস্তুত করে একদিন রাতে সর্বাণীর কাছে মায়ের ইচ্ছার ছলে নিজের মনের গোপন সাধটি প্রকাশ করে। সর্বাণী সংক্ষেপে বলে, ‘আমার মনে হয় না আমি মা হওয়ার জন্য এখন মানসিক ভাবে প্রস্তুত। আমার আরও কিছুটা সময় প্রয়োজন।’
মানব ভাবতে পারেনি যে সর্বাণী এভাবে তার আশা ভঙ্গ করবে। সে ক্ষণিকের জন্য কিছুটা অপ্রতিভ হলেও মুহূর্তে নিজের অন্তরের সমস্ত জেদকে চাগিয়ে তুলে বলে ওঠে, ‘সময় তোমাকে দিতে পারব না। লোকলজ্জার ভয় তোমার না থাকলেও আমার ও আমার পরিবারের আছে। কাল বিকেলে ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছি, তোমাকে যেতেই হবে।’
আজ পর্যন্ত কোন কিছুতে নতি স্বীকার করেনি মানব তাই বোধ করি মনের কোণে বেশ কিছুটা অহংকার জমেছিল তার। স্ত্রীর কাছে এই সামান্য ব্যাপারে হেরে গিয়ে মুখ কালো করে সে কিছুতেই মায়ের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তাই সর্বাণীর ওপর একপ্রকার জোর খাটিয়েই তাকে পরের দিন সে গাইনোকোলজিস্টের চেম্বারে নিয়ে গেল। ডাক্তারের পরামর্শ মত সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পর তার রিপোর্ট দেখে মানব ও বৈশাখীর মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। মানবের দিক থেকে সব ঠিকঠাক থাকলেও সেখানে এক জটিল বাধার সৃষ্টি করেছে সর্বাণী। মোট কথা ডাক্তার স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে সর্বাণী কোনোদিনই সন্তান গর্ভে ধারণ করতে পারবে না। নইলে মা ও সন্তান উভয়েরই ক্ষতি অনিবার্য। জীবনে মানব এই প্রথম হেরে গেছে। এর সমস্ত দায় সে সর্বাণীর মাথার ওপর চাপিয়ে তাকে মনে মনে যতটা পারা যায় একেবারে নিষ্পেষিত করে ফেলতে চায়। মানবের কপালে শান্তি আর অখণ্ড রইলো না। তাই নিজেই হাত ধরে জীবনে অশান্তিকে ডেকে আনলো। রোজ রাতে মানব ও সর্বাণীর একপ্রস্থ অহেতুক ঝগড়া যেন নিয়মে পরিণত হয়ে যায়। এই নিয়মের অন্যথা যাতে না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন বৈশাখী। ছেলের কাছে প্রতিনিয়ত বৌমার নামে নানা প্রকার অভিযোগ করে বৌয়ের প্রতি ছেলের রাগটাকে জিইয়ে রাখার দায়িত্ব ছিল তার। রিপোর্টটা দেখার পর সর্বাণীও প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে যায়। তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে সে স্থির করে যে সে একটি সন্তান দত্তক নেবে। বৈশাখী বৌয়ের এই প্রস্তাবে একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, ‘কী, আমাদের বংশে দীপ দেবে কি না একটা বেওয়ারিশ শিশু! যার বাপ-মায়ের ঠিক নেই তোমার কথায় তাকে আমাদের সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করতে হবে? নিজে তো আমাদেরকে নাতির মুখ দেখাতে পারলে না এখন আবার এইসব অনাসৃষ্টি কাণ্ড কেন ঘটাতে চাও বাপু? মানব, যা গিয়ে তোর বউকে বাপের বাড়িতে বসিয়ে দিয়ে আয়। এমন বাঁজা বউমাকে আমার দরকার নেই। আত্মীয়-স্বজন এসব কথা জানতে পারলে আর রক্ষে থাকবে না। তারা কোন শুভ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করা তো দূর এ বাড়ির ছায়াও মাড়াতে আসবে না কোনদিন।’
তা এ ধরনের মুখরোচক সংবাদ আত্মীয় মহলে বেশিদিন চাপা থাকে না। কথাটা পাঁচ কান হতেই সর্বাণীকে তারা কেউ ঘৃণার চোখে দেখে কেউ বা ওর প্রতি অন্তরের গভীরতম সহানুভূতি প্রকাশ করে আবার কেউ কেউ ওর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে পারলেই নিজেকে কৃতার্থ বোধ করে। যাইহোক সর্বাণী হয়তো মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করে নিত, নিত্য প্রাপ্ত লাঞ্ছনা নিত্যই ভুলে চাকরি ও সংসার ধর্মে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতো কিন্তু এ সম্বন্ধে মানবের অস্বস্তিকর নীরবতা জনিত অসমর্থন তাকে ভিতর থেকে ক্রমশ দুর্বল করে দিতে থাকে। চির প্রতিপক্ষকে দুর্বল পেয়ে দিবারাত্র বৈশাখী কটু বাক্যবাণে তাকে আরও জর্জরিত করে দিতে থাকে। তবে এতেই তিনি ক্ষান্ত থাকেন না, নিজ পুত্রবধূর পাপস্খলন হেতু বিশেষ তিথিতে নানাবিধ ব্রত-উপবাস ছাড়াও বেল বট প্রমুখ বনষ্পতির পূজা অর্পণ এবং গুরুদেবের নির্দেশে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে কিছু খাদ্যোপকরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বধূকে পুত্রবতী করার হেতু তার ওপর বহুবিধ হুকুম চালাতে থাকেন। এই সকল রুচিবিরুদ্ধ নির্দেশ মুখ বুজে সর্বাণীর মেনে চলা ছাড়া আর উপায় ছিল না। তবে সব মানুষের মত সর্বাণীরও ধৈর্যের বাঁধ আছে। সেই বাঁধেও চিড় ধরতে আরম্ভ করলো। শান্ত, পরিহাস রসিক সর্বাণী দিনে দিনে খিটখিটে মেজাজের হয়ে উঠতে থাকে। শাশুড়িকে সহ্য করা তার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। শাশুড়ি-বৌমার যে চিরন্তন কলহ প্রথার স্পর্শ থেকে এতদিন মানবের পরিবার বঞ্চিত ছিল তা নিত্যকার প্রথা রূপে চালু হল এই বাড়িতে। সর্বাণী ভাবে পৃথিবীতে মানুষ অপর একটি জীবের জন্ম দিতেই কি কেবল আসে, এতই কি তার অস্তিত্বের সংকট? যদি একটি নারী সন্তানের জন্ম দিতে না পারে তাতে সৃষ্টিকর্মের কোন নিয়মটি লঙ্ঘিত হয়? তাছাড়া মাতৃত্ব লাভের তো এখন অনেক উপায় আছে। একটা অনাথ শিশুর সেবা করে যদি তা পাওয়া যায় তবে তাতে ক্ষতি কী? চিরকাল নিঃসন্তান থাকবে সর্বাণী এই দৈব নির্দেশ মেনে নিয়ে সামলে ওঠা সর্বাণীর পক্ষে সরল ছিল না। তার ওপর উঠতে বসতে সমাজের গঞ্জনা তার হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতি গুলিতে আঘাত করে করে তাকে আরও কঠোর করে তুলেছিল। সর্বাণীর ঠোঁটের কোণে সর্বদা লেগে থাকা হাসিটাও মুছে যেতে শুরু করে। মানব কি তার মনের অবস্থা কিছুই বুঝতে পারছে না? প্রতিদিনই সর্বাণী এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে সকালে শাশুড়িমায়ের হাতের রান্না খেয়ে কলেজে পড়াতে যায় আবার বিকেলে ফিরে এসে সংসারের রান্নাবান্নার কাজে মন বসানোর চেষ্টা করে। অপর দিকে মানবের পিতা হতে না পারার অভিমানটা ক্রমেই সর্বাণীর প্রতি ক্রোধের রূপ নিতে শুরু করলো। রাতে তার ভালো ঘুম আসে না, সকালে কাজের সময় চোখ থেকে ঘুমের রেশ যেতে চায় না। মাথার মধ্যে চলতে থাকা নানা দুশ্চিন্তা কাজের প্রতি তার বিতৃষ্ণা জাগিয়ে তুলেছে। এই অমনোযোগ নিয়ে সহকর্মীদের ঠাট্টা মানবের গা সওয়া হয়ে গেলেও তার প্রধান ভয় থানার বড়বাবুকে নিয়ে। থানার বড়বাবু বড্ড বেশি বদমেজাজি মানুষ। মানবের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে গতকালই সকলের সামনে মানবকে কড়া ভাষায় অপমান করেছেন। আবার সেই বাঘের মত আক্রমণাত্মক মানুষটির সম্মুখস্থ হওয়ার ভীতির কারণে মানব আজকে থানায় যেতে পারেনি।
ঝনঝন করে একটা কিছু ভেঙে যাওয়ার শব্দে মানবের নিরন্তর চিন্তাস্রোতে অকস্মাৎ ছেদ পড়লো। তার মনে হল সর্বাণীর ধৈর্য্যের বাঁধ বুঝি আজ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে। মানবের চোখের সামনে সর্বাণী সশব্দে মাটিতে পা ঠুকতে ঠুকতে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। মানবের দিকে একবারও দৃকপাত না করে খাটের তলা থেকে সে একটা সুটকেস টেনে বার করে নিজের জামাকাপড় এবং যাবতীয় দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করলো। পাশের ঘর থেকে বৈশাখীর কর্কশ কন্ঠস্বর ভেসে এল, ‘এই জন্য লোকে বলে পরের উপকার করতে নেই। গুরুদেবের কাছে আশ্রমে গিয়ে থাকবে না সেটা ভালো ভাবে বললেই হত। তা বলে ঐ ভাবে কেউ সরবতের কাঁচের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে, গুরুর কাছ থেকে অত কষ্ট করে জোগাড় করে আনা মন্ত্রপূত শিকড় বাটা নষ্ট তো হলই তার সঙ্গে অমন সুন্দর কাঁচের গ্লাসটাকেও ভেঙ্গে ফেললো পোড়ারমুখী! মনে পাপ থাকলে…’
মানব নিজের বিস্ময় কাটিয়ে কিছু বলে ওঠার আগেই সর্বাণী তাকে বলে, ‘আমি চললাম যেদিকে দুচোখ যায়। কেন যাচ্ছি সেটা তোমার মায়ের কাছ থেকেই জেনে নিও। যেদিন এই সংসারে আবার ফিরে আসার প্রয়োজন হবে সেদিন ফিরবো।’
সেইদিন মানব সর্বাণীর গৃহত্যাগ আটকাতে পারেনি। কিন্তু এরপর টানা দু’দিন ধরে মানব ব্যক্তিগত ভাবে হন্যে হয়ে খুঁজেও সর্বাণীর কোথাও কোন সন্ধান পেল না। একটা জলজ্যান্ত মানুষ যেন স্রেফ উধাও হয়ে গেছে শহর থেকে। বাপের বাড়িতে সর্বাণী যায়নি এবং সেখানে যে সে যাবে না সেই আন্দাজ মানব আগেই করেছিল। কিন্তু সর্বাণীর কলেজে গিয়ে খোঁজ নিয়েও কোন লাভ হয়নি। সর্বাণীর অনুপস্থিতির কারণ সেখানে কেউ জানেনা। সর্বাণীর এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াতে সব চেয়ে বেশি অপরাধ বোধে ভুগছিলেন তার শ্বশুর কুঞ্জলাল। টানা দুইদিন ধরে ঘরের লক্ষ্মী নিখোঁজ। কোথায় সে আছে কীই বা করছে তার কোনও খবর নেই। কৌশলে সর্বাণীর বাবাকে কুশলবার্তা জানতে চাওয়ার নাম করে ফোন করার পর তার কথাবার্তার ধরনে কুঞ্জলাল বুঝতে পারেন যে সর্বাণী ঐ বাড়িতে ফিরে যায়নি। পুলিশের বাড়ি থেকে এভাবে পুলিশের বউ যে একেবারে বেপাত্তা হয়ে যাবে তা তার ধারণারও বাইরে ছিল। কুঞ্জলালের সমস্ত অভিমান কেন্দ্রীভূত হয় তার স্ত্রী বৈশাখী ও পুত্র মানবের ওপর। সর্বাণীর হারিয়ে যাওয়ার তিনদিন পর আর মানবের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে সকালে মানবের থানায় বেরনোর পূর্বে কুঞ্জলাল নিজেই থানায় ডায়েরি লেখাতে যাওয়ার জন্য উদ্যোগী হন। মানব বৈশাখীর সহায়তায় কোনোমতে বাবাকে এই অঘটন ঘটানোর হাত থেকে নিরস্ত করে। সর্বাণীর নিখোঁজের বিষয়টা বড়বাবুর কানে গেলে মানবের আর চাকরি থাকবে না। বৈশাখী স্বামীর এই হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতা দেখে বলেন, ‘নিজের ছেলের মঙ্গলের চেয়ে ঐ মেয়েই তোমার কাছে বড় হল? কী জাদু করেছে ওই পেত্নী কে জানে?’
তবে মানব তার মায়ের কথা চাপা দিয়ে কুঞ্জলালের হাত দুটো ধরে শান্ত ও দৃঢ় স্বরে বলল, ‘তুমি আমার ওপর বিশ্বাস রাখো বাবা। আমি আমার সমস্ত সোর্সকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। দুইদিনের মধ্যে সর্বাণীকে যেখান থেকে হোক ধরে তোমার কাছে আনবই, কথা দিলাম। সাবইন্সপেক্টর মানবেন্দ্র সমাদ্দারের কথার কোন অন্যথা হয়না। আর যদি সর্বাণীকে খুঁজে না পাই তবে আমিও আর কোনোদিন তোমাকে মুখ দেখাবো না।’
এই বলে মানব মাথায় পুলিশের টুপিটা চাপিয়ে গটগট করে থানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। ছেলের এহেন কথায় বৈশাখীর বুকে যেন শেল বিঁধলো। যে ছেলে এতখানি মাতৃঅন্তপ্রাণ তার মুখে কখনও এমন কথা শুনবেন তা বৈশাখী স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি। কুঞ্জলালের কাছে বরাবরই তার গুরুত্ব কম। কিন্তু নিজের একমাত্র ছেলে যাকে নিজের সর্বস্ব মনে করে এত গর্ব অনুভব করতেন তার কাছেও যে এভাবে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবেন তা তিনি কোনোদিনও ভাবেননি। বিয়ের পর ছেলেরা হয়ত সত্যিই বদলে যায়। তা এতদিন তিনি অনুভব না করলেও আজ তার ছেলে তাকে সেই অনুভব করিয়ে ছেড়েছে। সর্বাণীর এই দু’দিনের অনুপস্থিতিতে মানবেন্দ্র সত্যিই অনেকখানি বদলে গেছে। কী করে বদলালো তা ঠিক নিজেও জানেনা হয়তো। সহকর্মীদের কাছে তাদের পত্নীপ্রেমের গল্প শুনে কিংবা নিজের অতীতের সুখী জীবনের কথা স্মরণ করে একপ্রকার বদলে গেছে। তার মনে হল সর্বাণীকে এতদিন সমর্থন না করে সে অপরাধ করেছে। সে সন্তানের পিতা হলেও সর্বাণী তো মা, নিজের হঠকারিতার অন্তরালে কি একবারও সর্বাণীর কষ্টটার কথা ভেবে দেখেছে? কেবলমাত্র নিজের ইচ্ছাপূরণ হবে না বলে মানব সহানুভূতির পরিবর্তে সর্বাণীকে শুধু দোষারোপই করে এসেছে। কিন্তু এতে সর্বাণীর দোষ কোথায়? দোষ যদি কারোর থাকে তবে তা একমাত্র মানবের নিষ্ঠুর নিয়তির যা সর্বাণীকে আজ তার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। দুঃসময়ে যে কখনো মানবের হাত ছাড়তো না, সে আজ কোথায়? মানব যদি এখনই সর্বাণীর কাছে ক্ষমা চায় তবে সে কি ক্ষমা করবে না? যেমন হঠাৎ ধুমকেতুর মত মানবের জীবনাকাশে আবির্ভূতা হয়ে আবার মিলিয়ে গেল তেমনিই অকস্মাৎ আবির্ভাব কি তার আর হবে না?
মানবের এই অনুতাপ দেখে এতদিনে বুঝি বিধাতা মুখ তুলে চাইলেন। মানবকে আর বেশি অপেক্ষা করতে হল না। পরের দিনই বিশ্বস্ত সূত্র মারফত মানব সর্বাণীর সঠিক সন্ধান জানতে পেরে যায়। মানব আর সময় নষ্ট না করে ঠিকানা নিয়ে থানা থেকে সর্বাণীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। এই শহরেরই একটা হোটেলে সর্বাণী এসে উঠেছে। হোটেলের রিসেপশনিস্টের ফোন পেয়ে সর্বাণী যখন জানতে পারে যে একজন তার দর্শন অভিলাষী তখন তার আর বুঝতে বাকি থাকেনা যে কে এসেছে। সর্বাণী সেই ব্যক্তিকে তার রুমে পাঠিয়ে দিতে বলে। এত তাড়াতাড়ি সর্বাণী দেখা দিতে রাজি হয়ে যাবে তা মানব আন্দাজ করেনি। মানব সর্বাণীর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে নক করার আগেই বন্ধ দরজা খুলে গেল। মানব ভাবলো এ ঝড়ের আগের পূর্বাভাস। সর্বাণীর ঠোঁটের কোণের সেই অতিপরিচিত হাসিটা এতদিন পর দেখেও মানবের মনে আনন্দের সঞ্চার হল না। তার পরিবর্তে অজানা একটা ভয়ে মানবের বুকটা কেঁপে উঠলো। মানবকে কোনোদিনই কি সর্বাণী ক্ষমা করতে পারবে না, তাই তার হাসিটা কি অমন নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে? মানব কি শত চেষ্টা করেও সর্বাণীর বুকে জমে থাকা তার প্রতি অভিমানের পাহাড়টাকে একটুও টলাতে পারবে না?
‘বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন, ভিতরে এসে বসো।’
মানবের হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। সে কোনো রকমে সর্বাণীর আজ্ঞা পালন করতে ঘরের ভেতরে ঢুকে সোফায় বসলো। সর্বাণী ঠোঁটের কোণে হাসিটা তেমন ভাবে রেখেই বলল, ‘ঐ দেখ আমার নতুন অতিথি।’
সর্বাণীর তর্জনীর নির্দেশ মত মানব চোখ ঘুরিয়ে এতক্ষণে দেখলো কখন তার পাশে সোফার হাতল ধরে একটি তিন কি চার বছরের ছোট মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটার হাসি যেন অবিকল সর্বাণীর মত মনে হল মানবের। সর্বাণী বলে চলল, ‘ও আমার মেয়ে সর্বমঙ্গলা। ভগবান ওকে আমায় পাইয়ে দিয়েছেন। এতদিন ওর কেউ ছিল না এখন আমি আছি। তোমার জ্বালায় কলেজে এই ক’দিন যাওয়ার উপায় ছিল না, স্টুডেন্টদের মুখগুলো দেখতে না পেয়ে দম বন্ধ হয়ে আসতো। সেখান থেকে সর্বমঙ্গলা আমাকে মুক্তি দিয়েছে। এখন থেকে সর্বমঙ্গলাই আমার ছাত্রী, কন্যা, খেলার পুতুল সব।’
মানবের চোখ দুটো জলে ভিজে উঠলো। সে কোনোমতে তার ঠোঁট দুটোকে ফাঁক করে বলল, ‘আর আমার ও কেউ হয় না বুঝি?’
মানবের এই প্রশ্নে সর্বাণী অবাক হয়। সে ভেবেছিল সর্বমঙ্গলাকে দেখার পর মানব ওদের দু’জনকে নির্দ্বিধায় ফেলে রেখে রওনা দেবে। সর্বাণী শুধু বলে, ‘ওর কেউ হয়ে ওঠার পথে তোমার বিস্তর বাধা। এর জন্য তোমাকে অনেক কৃচ্ছসাধন করতে হবে। বাড়ির কেউ কি তোমাদের এই সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেবেন, তোমার মা কি সর্বমঙ্গলাকে মেনে নেবেন?’
মানব এবার একটু পিছিয়ে এল। তার মনে হল সর্বাণী তাকে সহজে ক্ষমা করতে চাইছে না। মানবকে বৈশাখী সর্বাণীর সন্ধান করতে যেতে বারণ করেছিলেন বলেছিলেন, ‘একেবারে ডিভোর্স দিয়ে দে। দেখবি তখন কেমন নিজেই ফিরে এসে তোর কাছে ক্ষমা চাইছে।’
মানব সেইসব নিষেধের তোয়াক্কা না করে নিজের সমস্ত দম্ভ ত্যাগ করে আজ এখানে এসেছে খালি হাতে ফিরে যাওয়ার জন্যে নয়। সে মরিয়া হয়ে উঠে বলল, ‘আর কত অপেক্ষা করাবে আমাকে?’
সর্বাণী শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিল, ‘অপেক্ষা করানোর আমি কে? আমার বাবা বলতেন কন্যার পিতা হওয়া মস্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার। যেদিন নিজের পুণ্যবলে সেই অপার সৌভাগ্য সঞ্চয় করতে পারবে সেদিনই তুমি এই কন্যার জনক হতে পারবে।’
লেখক : শিক্ষার্থী
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment