মাঝবয়সী লোক

  • 08 March, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 124 view(s)
  • লিখেছেন : মীরা কাজী
জানালার কাছে বসেও আজ বাইরে মন দিতে পারছেনা মেঘালী। কিছুক্ষণ পর লোকটা আবার কনুই দিয়ে মেঘালীকে উত্যক্ত করতে শুরু করল। মেঘালী যে নড়ে চড়ে বসবে এখন তারও উপায় নেই। ভিড়ের সুযোগে লোকটা তাকে জানালায় ঠেসে ধরেছে। লোকটার আচরণে মেঘালী অবাক হল, সে একদিকে মেঘালীকে সমানে বিরক্ত করে চলেছে, অন্যদিকে সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর সাথে কথাবার্তাও চালিয়ে যাচ্ছে। মেঘালীর মৃদু  প্রতিবাদ সে গ্রাহ্যই করছেনা।

আজ অনেক দিন পর কলেজ থেকে ফেরার সময় বাসে জানালার কাছে একটা সিট পেয়ে গেল মেঘালী। নাহলে, প্রায় দিনই দরজার কাছে, ভিড়ের মধ্যে কোনো রকমে শরীরটাকে গুঁজে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আজই ব্যতিক্রম। জানালার কাছে সিট পেলে বাস জার্নির মত বিরক্তিকর জার্নিটাও উপভোগ্য হয়ে ওঠে মেঘালীর কাছে। গ্রামের দিকে রাস্তার দুধারে এখনো মাঠ, গাছপালার দেখা মেলে। মেঘালীর মনটা তখন তার কাছ ছাড়া হয়ে জানালার বাইরে সবুজ প্রকৃতি্র ভিতর হারিয়ে যায়। এমনও হয়েছে, তার স্টপেজ় এসে গেলেও সে বুঝতে পারেনি। শেষে কন্ডাকটরের  ডাকে অপ্রস্তুত মেঘালী সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।   

      আজও জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে মেঘালী। হঠাৎ পেটের কাছে একটা খোঁচা অনুভব করল সে। মুখ ঘুরিয়ে দেখল, তার পাশে বসা মাঝবয়সী লোকটার কনুইটা বেঁকে তার পেটের কাছে ঠেকে আছে।

আপনি ঠিক হয়ে বসুন! বলে মেঘালিও একটু নড়ে চড়ে বসল।

    কয়েক মিনিট পরে, আবার তেমনই বিশ্রী স্পর্শ পেল মেঘালী। ভ্রু কুঁচকে লোকটার দিকে তাকিয়ে সে বলল, আপনি হাতটা ওভাবে বেঁকিয়ে না রেখে সঠিক জায়গায় রাখুন! আমার অসুবিধে হচ্ছে!

   লোকটা তাড়াতাড়ি কনুইটা সামান্য সরিয়ে নিল, তবে যথাস্থানে রাখল না। মেঘালী বুঝতে পারল লোকটার মতলব ভাল নয়। সে আবার আগের মতই মেঘালীকে বিরক্ত করবে।

    কিছুদিন হল কলেজের চাকরিটা পেয়েছে মেঘালী। যাওয়া আসার সময় মাঝে মাঝেই এরকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এটা অবশ্য কোনো মেয়ের কাছেই নতুন কিছু নয়। স্কুল, কলেজে পড়ার সময় কতবার তাদের সাথে এমন হয়েছে। বন্ধুরা একসাথে থাকলে সাহস করে তারা প্রতিবাদ করত। এখন সে একা। প্রতিবাদ করার সাহস হয়না। তাছাড়া বাসের মধ্যে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হবে, মেঘালী তাদের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে। এটা ভাবতেই কিছুটা সঙ্কোচ,বা লজ্জা এসে পড়ে। তাই অসহনীয় না হলে ব্যাপারটাকে কোনোমতে সামলে নেবার চেষ্টা করে সে। আজকেও  ভাবল, যাকগে কোনো রকমে বাকি রাস্তাটা পেরিয়ে গেলে হয়। প্রতিবাদের রাস্তায় না গিয়ে নিজেকে জানালার দিকে কিছুটা গুটিয়ে নিল মেঘালী। যাতে লোকটার সাথে তার কিছুটা ফাঁক তৈরি হয়। কিন্তু সে আর কতক্ষণ! ভিড়ের ভিতর থেকে একজন, মেঘালীর কষ্ট করে তৈরি করা ফাঁকটুকুর দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে বলল, একটু ঠিক করে বসলে ওখানে আর একজনের দিব্যি হয়ে যাবে। বলা মাত্রই পাশে বসা মাঝবয়সী লোকটা মেঘালীর দিকে সরে এল।

   জানালার কাছে বসেও আজ বাইরে মন দিতে পারছেনা মেঘালী। কিছুক্ষণ পর লোকটা আবার কনুই দিয়ে মেঘালীকে উত্যক্ত করতে শুরু করল। মেঘালী যে নড়ে চড়ে বসবে এখন তারও উপায় নেই। ভিড়ের সুযোগে লোকটা তাকে জানালায় ঠেসে ধরেছে। লোকটার আচরণে মেঘালী অবাক হল,  সে একদিকে মেঘালীকে সমানে বিরক্ত করে চলেছে, অন্যদিকে সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর সাথে কথাবার্তাও চালিয়ে যাচ্ছে।  মেঘালীর মৃদু  প্রতিবাদ সে গ্রাহ্যই করছেনা।

  এবার আর সহ্য হলনা মেঘালীর। সে সটান উঠে দাঁড়িয়ে সরাসরি লোকটার দিকে তাকিয়ে বেশ  জোর গলায় বলল, আপনি ভেবেছেন আমি কিছু বুঝতে পারছিনা? আপনি অনেকক্ষণ ধরে সমানে আমাকে ডিস্টার্ব করে যাচ্ছেন? অনেক বার আপনাকে বলা সত্ত্বেও আপনি শুনছেন না! আপনি চান আমি পুলিশে ফোন করি?

লোকটা এবার চট করে নিজের কনুইটা মেঘালির পেটের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে  বসল।

  কি হল ম্যাডাম? চেঁচাচ্ছেন কেন? ভিড়ের ভিতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল।

  ওনার গায়ে আমার কনুইটা সামান্য ঠেকে গেছে তাই! মাঝবয়সী লোকটা ভিড়ের দিকে চেয়ে এমন ভাবে বলল, যেন ব্যাপারটা নেহাত মামুলী এবং সে সত্যি কথা বলছে।

  ভিড় বাসে ওরকম হতেই পারে!

  অত বাতিক থকলে বাসে না ওঠাই ভালো।

  একটু গায়ে গা লাগতেই এই! এরা কি ভাবে নিজেকে?

  ভিড় বাসেও উঠব। আবার গায়ে গা ঠেকবে না। আবদার খানা শোনো!      

  গায়ে সামান্য ছোঁওয়া লেগেছে বলে তেতে উঠেছে্ন! কোনো দিন বাসে যাতায়াত করেছেন, নাকি এই প্রথম? দিন কতক যাতায়াত করুন! গায়ের ছাল উঠে যাবে!

  ভিড়ের ভিতর থেকে মেঘালীকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন মন্তব্য ভেসে আসতে লাগল।    

   ছোঁওয়া লেগেছে মানে? আমি কি এতটাই অবুঝ যে ছোঁওয়া লাগলে রেগে যাব? আশ্চর্য তো!  আপনারা এই বাজে লোকটাকে কিছু না বলে উলটে আমাকে দোষ দিচ্ছেন? মেঘালী চিড়বিড়িয়ে উঠল।

এখন কে সত্যি বলছে আর কে মিথ্যা বলছে, বুঝব কি করে বলুন? যা ভিড়! কোনটা নিজের পা সেটাই বুঝতে পারছিনা। সেখানে কারো গায়ে গা লাগছে কিনা সেটা খেয়াল করা যায়? খামোকা মাথে গরম না করে সিট পেয়েছেন। বসে পড়ুন।

    মেঘালী দেখল বাসের একজনও লোকোটাকে দোষারোপ করছেনা। উলটে তার অভিযোগকে  গুরুত্বহীন করে দিতে যাইছে। যেন মেঘালী কোনো হাস্যকর প্রসঙ্গের উত্থাপন করেছে। এই সময় বাসে মহিলা যাত্রী খুব একটা থাকেনা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে কয়জন ছিল, তাদের মধ্যে থেকে দু-একজন মিন মিন করে, মেঘালির পক্ষে কিছু বলতে চেষ্টা করল। তবে অন্যদের কথার তোড়ে তাদের কথা হারিয়ে গেল। মেঘালী এবার বেশ অসহায় বোধ করছে, সেই সঙ্গে অপমানে তার ভিতরটা জ্বালা করছে। এর মধ্যে কোনো একটা স্টপেজে সেই লোকটা নেমে গেছে।

কোথায় নামবেন? মেঘালীকে একজন জিঙ্গেস করল।

    এই লোকগুলোর সাথে কথা বলতে ঘৃণা বোধ হচ্ছে মেঘালীর। তার মনে হচ্ছে, সেই মাঝবয়সী লোকটা শুধু একা নয়, এরা সবাই একই দোষে দোষী। এদের সবার ভিতরেই সেই মাঝবয়সী লোকটার মত কদর্য মানুষ আত্মগোপন করে আছে। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে এসে মেঘালীদের বিরক্ত করে। তাই সেই লোকটার আশালীন আচরণ এদের কাছে দোষনীয় বলে মনে হচ্ছেনা। নিজের মুখে নিজের দোষ স্বীকার করা খুব কঠিন কাজ।    

  পশ্চিম পাড়া। বলব না বলবনা করেও শেষে গম্ভীর গলায় বলল মেঘালী।

  পশ্চিম পাড়ায় কাদের বাড়ি?

দেবকুমার হালদারের---!

দেবকুমার হালদার! মানে দেবুদার বাড়ি? মেঘালীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে একজন বলল।

আপনি দেবুদার মেয়ে? ইস! এতক্ষণ বলবেন তো?

  সে ব্যাটা টুক করে কখন পালিয়ছে! নাহলে তার কলার ধরে বাস থেকে নামিয়ে দিতাম!  একজন উত্তেজিত হয়ে উঠল।

  আমাদের সামনে দেবুদার মেয়েকে অপমান করে গেল? দেবুদা, মানে আপনার বাবা আমাদের কত উপকার করেছেন, আপনি জানেন?

আরে! আমি একবার কলেজের বই কিনতে পারিনি তখন দেবুদা আমার সমস্ত বই কিনে দিয়েছিল।

আমার বোনের পুরো বিয়ের খরচ তো দেবুদাই দিয়েছিল। এ তল্লাটে দেবুদার নুন খায়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

এর পর কোনো কিছু হলে পরিচয়টা আগে দেবেন।‌ তারপর দেখবেন কি হয় আর কি না হয়! 

পশ্চিম পাড়া এসে গেলে মেঘালীকে বাসের দরজার দিকে এগোতে দেখে একজন এগিয়ে এসে বলল, ওদিকের রাস্তাটা অন্ধকার। সাবধানে যাবেন। যদি বলেন, আমি পৌঁছে দিতে পারি।

   তার দরকার হবেনা। আর শুনুন! আমি দেবদত্ত হালদারের কেউ হইনা। দেবদত্ত হালদারের পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকি। কথা কটি তাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে, বাস থেকে নেমে অন্ধকারের ভিতর হন হন করে হাঁটতে শুরু করল মেঘালী।

লেখক : ছোটগল্পকার 

ছবি : সংগৃহীত 

 

0 Comments

Post Comment