চাবি

  • 06 February, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 265 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
 নকবা’র পর এমন অনেকেই যাঁরা স্বদেশভূমি প্যালেস্তাইন ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন কোঁচড়-ভরা স্মৃতি। যতটুকু পারেন। তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন ফেলে আসা, চিরতরে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা কোঠাবাড়ির সদর-অন্দরের চাবির থাক। রুমালে বাঁধা মখমলি ফুল। যে ফুল শুকিয়ে খাক হয়ে আসবে অনেক দিন। যে চাবির দরজাগুলোকে বারুদে ওড়াবে ইজরায়েলি ট্যাঙ্ক। মরিয়মরা তবু চাবি আঁকড়িয়ে থাকবেন। অটুট বিশ্বাস তাঁদের। একদিন তাঁরা আবারও স্বদেশে ফিরবেন। মাটির স্পর্শ জুটবে তাঁর।

আমাল খুঁজছিল। খুঁজে না পাওয়া জিনিসটা এত সহজেও কোথাও হারানোর নয়। জিনিসটা দরকারি। অনেক মূল্য তার। অন্তত আমালের কাছে না হলেও বসবার ঘরের আরামকেদারায় যে মানুষটি চিরঘুমে শুয়ে আছেন তার কাছে সে জিনিসের মূল্য অনেক। তাই আমালের কাছেও এর মূল্য রয়েছে। আমাল খুঁজছিল। সে তোলপাড় করে ফেলল তার শোবার ঘর। ছোট বসবার ঘরটাকেও। কোথাও নেই। এদিকে দেহ কফিনে পোরার লোক এসে পড়েছে। আত্মীয়স্বজনেরাও। বিদেশ-বিভুঁই হলেও এই মহল্লায় কুড়িয়ে বাড়িয়ে আমালদের পরিচিত অনেক। আমালরা যে পাড়ার বাসিন্দা সেখানে পরস্পর পরস্পরের প্রতি আপনিই আকৃষ্ট হয়। গোষ্ঠীবদ্ধতা এঅঞ্চলের অত্যন্ত স্বাভাবিক এক বৈশিষ্ট। স্বদেশের মানুষ এই চত্বরে খুব বেশি না থাকলেও আমালদের আত্মীয় দু’একজন বেরিয়েই যায়। এ ব্যতীত এই অঞ্চলটিকে প্রায় সারা পৃথিবীরই এক ক্ষুদ্রতর মানব-মিলনক্ষেত্রের উদাহরণ বলা চলে। সকলেই এখানে সকলের পাশে দাঁড়ায়। কারণ উদ্বাস্তু পরিচয়েই এখানে সকলের অবস্থান।

 

বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আমালের এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, এ কেমন পরিহাস। যে মানুষটি ভালোবাসতেন রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ আর ঢেউ খেলিয়ে যাওয়া বিস্তৃত ভূমিরূপ – তাঁরই কি না শেষনিঃশ্বাস পড়ল আধুনিক এই কংক্রিটে মোড়া ইমারত-শোভিত শহরের শেষপ্রান্তের এক ঘিঞ্জি বস্তিতে। স্যাঁতসেঁতে ভেজা এক প্যাচপেচে বাদলার দিন। বাইরে বৃষ্টির তেজ ক্রমশই বেড়ে উঠছিল। আবার কখনও-সখনও তা কমেও আসছিল। আমাল দরজার দিকে তাকায়। তাকে সাজানো সবকটা জুতোই ভিজে সপসপ করছে। বাইরে থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের পায়ে পায়ে সমস্ত কার্পেটটুকুই ভিজে ছোপ ছোপ হয়ে রয়েছে। সেসবের মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই এখন। আমাল কি আফতাবকে খুঁজে না পাওয়া জিনিসটার বিষয়ে জিজ্ঞেস করবে? পরক্ষণেই তার মনে হয় আফতাবেরই বা কি দায় পড়েছে ছোট্ট ওই জিনিসটাকে নিয়ে কোথাও সরিয়ে রাখার? সবচেয়ে বড় কথা বিয়ের প্রথম রাত্তিরেই কম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল আমাল-আফতাবকে, সামান্য সেই জিনিসকে নিয়েই? আমালের মনে পড়ছিল সেসব।

 

১৯৪৮

 

বিবি মরিয়ম যখন প্রথম নকবা’র সময় ঘর ছাড়েন তখন তাঁর বয়স তিন বছর। বিবি হয়ে উঠতেও তাঁর অনেক দেরী আছে তখন। চাবিটা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে, সোনার জল দেওয়া সাধারণ পেতলের তৈরি, পুরনো, খানিক চটে যাওয়া – তবুও সে অসাধারণ এক ইতিহাস। “আমরা তো সত্যিই একদিন ফিরে যাব মা আমার, সে যে আমাদেরই দেশ,” প্রথমদিন কোন ছোটবেলায় আমালকে সেই চাবির গল্প শোনাতে গিয়ে মরিয়ম বলেছিলেন।

 

“সে তো আমাদেরই দেশ। আমাদেরই ভিটে-মাটি, ঘর-বাড়ি। এই চাবিতেই আমাদের ঘর বাঁধা আছে। আমরা তো ফিরবই,” আমালের কান, শরীর, চোখ বুজে আসে। চোখ বুজলে পরে এখনও সে স্পষ্ট দেখতে পায় প্রথম কিছু বছর। কানাডায় তাদের শরণার্থী শিবিরে, বিশেষ এক তাঁবুর ভিতরে ইংরেজি খবরের চ্যানেলে প্যালেস্তাইনের যুদ্ধ দেখানো হচ্ছে। সে কি কান-ফাটানো বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ আর ঢিকঢিক ঢিকঢিক গুলির শব্দ। প্রতি বসন্তেই তাদের ক্যাম্পে উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ত। আর বাড়ত অবাক হয়ে শোনা নৃশংসতার খতিয়ান।

 

টরন্টোতেই আমালের সঙ্গে আফতাবের আলাপ। তারপর ভাব, ভালোবাসা, পরিণয়। সদ্য সদ্য তখন মুক্তি পেয়েছে জেমস ক্যামেরনের টাইটানিক। নবদম্পতি গিয়েছিল ডি-ক্যাপ্রিও’র জ্যাক ডসন আর রোজরূপী কেট উইনস্লেটকে মহল্লার সিনেমায় প্রত্যক্ষ করতে। আরবদেশ হলে হয়তো তা সম্ভব হতো না। তবুও যেন ছোটবেলা, রঙচঙে পুতুল বানানোর দিন, গল্পে শুনে আসা স্বদেশের সেই রুক্ষ-অন্ধকার, হোক না তা বৈষম্যের আগুনে চোঁয়ানো, উদ্বাস্তু শিবিরের মাঝে হলুদ-বাদামী রঙ মাটির তাল, কাদামাটির জীবন – এই সমস্তকিছুকেই বড় বেশি করে সেদিন কেন জানি না মনে পড়েছিল আমাল-আফতাবের। সে যা হোক। সেইদিন রাত্তিরেই হল নবদাম্পত্যের অভিনয় …

 

মা’র কাছে যে কিছুই লুকোত না ‘মা-বলতে-সারা’ আমাল। ততদিনে সেই চাবি কখন সোনালী এক লকেটেরই রূপ ধরে আমালের গলায় ঝুলেছে। আমাল ফিসফিস করে তার আম্মিজানকে বলেছিল, “জানো আম্মিজান, রাত্তিরে যখন আমি আর আফতাব কাছাকাছি … আমার গলায় তখন লকেটটা ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। শুধুই -” এই অবধি বলেই আর কিছু বলতে পারেনি আমাল। ঠাস করে একটা চড় এসে ওর গালে পড়েছিল। “আমাল!” সেই প্রথম আমাল তার আম্মিজানকে অতখানি রাগতে দেখেছিল। “ওটা সাধারণ গলায় পরে দুলিয়ে বেড়াবার নেকলেস নয় আমাল! এটা আফতাবেরও বোঝা উচিত ছিল!” খুব রেগে গিয়েছিলেন বিবি মরিয়ম সেদিন।

 

ফেলে আসা মাটিকে ভালো করে শুকিয়ে,

গুঁড়িয়ে কালো শিকড়ের মতো করে,

তাবিজের মতো পরতে হয়

 

এই আচারের কোন জাত-ধর্ম হয় না।

 

নকবা’র পর এমন অনেকেই যাঁরা স্বদেশভূমি প্যালেস্তাইন ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন কোঁচড়-ভরা স্মৃতি। যতটুকু পারেন। তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন ফেলে আসা, চিরতরে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা কোঠাবাড়ির সদর-অন্দরের চাবির থাক। রুমালে বাঁধা মখমলি ফুল। যে ফুল শুকিয়ে খাক হয়ে আসবে অনেক দিন। যে চাবির দরজাগুলোকে বারুদে ওড়াবে ইজরায়েলি ট্যাঙ্ক। মরিয়মরা তবু চাবি আঁকড়িয়ে থাকবেন। অটুট বিশ্বাস তাঁদের। একদিন তাঁরা আবারও স্বদেশে ফিরবেন। মাটির স্পর্শ জুটবে তাঁর।

 

হঠাৎ হংকং শুনে অবাকই হয়েছিল আমাল। কিন্তু কানাডা থেকে ঝোঁকের মাথায় আরও সচ্ছল আমেরিকায় আসতে গিয়ে আফতাবই তখন সবকিছুতে গোল পাকিয়ে বসেছিল। মার্কিনি মন্দায় আফতাব কোনও কাজ জোটাতে পারেনি। শেষমেশ এক চীনা রিফিউজি বন্ধুর পরামর্শ মতো আমাল আর তার (ততদিনে বিধবা) মা’কে সঙ্গে করে নিয়ে আফতাব একদিন ন্যু ইয়র্ক বন্দর থেকে হংকংয়ের জাহাজে চেপে বসে। সেও আজ কত বছরের ইতিহাস।

 

আমাল তোশকটাকে ভালো করে ঝাড়ে। তুলে উলটিয়ে দেখে। কিছুই তার নজরে পড়ে না।

 

ভেজা, স্যাঁতসেঁতে, কুৎসিত শহর এই হংকং। শুকনো বালির দেশ থেকে আসা মরিয়ম, শেষ বয়সে এই সামুদ্রিক দ্বীপের শহরে ঘ্যানঘ্যানে কাশি আর বুকে জমা কফের সমস্যা নিয়েই জীবন অতিবাহিত করেন। এলাকাটা রিফিউজি বস্তি আর সমাজের আরও নীচেকার কিছু মানুষের বসবাসের জন্য তৈরি। মরিয়ম এখানে আসা মাত্রই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এরই মধ্যে আমাল-আফতাবের কোলে সন্তান আসে। আমালের মেয়ে এখন এলাকারই স্থানীয় এক স্কুলের ছাত্রী। এই মহল্লায় খুঁজলে পরে আরও ৩ থেকে ৪টি এমন পরিবার বেরুবে, যাদেরও স্বদেশ প্যালেস্তাইন। এছাড়াও চীনা, জাপানী, মদ্র, আফগান, সিঙ্ঘলি, সারা পৃথিবীর সমস্ত জাতির সকল উদ্বাস্তুদের তরফেই যেন বা একত্রে গড়ে ওঠা এই চত্বর। এ যেন এক অদ্ভুৎ জগাখিচুড়ি-সদৃশ বাসস্থান। সেই জগাখিচুড়ির বাসিন্দারাই তুমুল এই বৃষ্টির ভিতরেও মরিয়মের মৃত্যুর খবর পেয়ে আমালদের বাসায় এসে হাজির।

 

শেষ অবধি আফতাবকে জিজ্ঞেস করা ছাড়া আমালের আর কোনও উপায় ছিল না। আফতাব এতটুকুও চমকালো না। সে বলল, “আমিই ওটাকে কফিনের মধ্যে পুরেছি। শেষ কয়েক মাস দেখোনি, আম্মিজানও তোমার থেকে ওই লকেটটা চেয়ে নিয়েছিলেন।” এ কথা আমাল অস্বীকার করতে পারে না। শেষ দিকটায় মরিয়মকে বড় বিধ্বস্ত মনে হত। হাতের ভিতরে লকেট অথবা সেই চাবিটাকেই তিনি আঙুল-মুঠো করে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বসে থাকতেন।

 

-“না!” আমাল আপত্তি করে।

 

-“কি বলছ আমাল?” আফতাবের গলায় এতটুকুও আবেগ নেই।

-“কফিন খোলাও, ওই চাবি কবরে যাবে না!” বিপরীতে আমাল প্রায় চিৎকার করে ওঠে।

 

ঘরে একটা মৃদু অস্বস্তির আবহাওয়া তৈরি হয়। আমাল নিজের কল্পনা দিয়ে অনুভব করে। দিগন্তবিস্তৃত সোনাবরণ মাঠ। বালিয়াড়ি। খেজুরগাছ। অথবা গাজা স্ট্রিপের উপকূলে ভূমধ্যসাগরীয় নীল জল। শঙ্খচিল। হাত থেকে কেড়ে নিয়ে যাওয়া খাবার।

 

কফিনের পেরেকগুলো আবারও নতুন করে খুলতে হয়। কড়ক্কড় আওয়াজ হয়। আমাল মনে মনে ভাবে এই টানাহেঁচড়ার ফলে, ধাক্কাধাক্কি লেগে মরিয়মের দেহটা যেন কোনও ভাবে আরও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বাইরে বৃষ্টির বিরাম নেই। সোঁদা হাওয়ার ঝলক ঘরের ভিতরে বসেও টের পাওয়া যাচ্ছে। আমাল আবারও সেই চাবি ফেরত পায়। এই চাবি সে উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে এসেছে। এখন এই চাবিকে কবরে পাঠানোর মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নাগরিক আমালের আদতেই কোনও এক্তিয়ার নেই। এই চাবি আদতে তার ফিলিস্তিনি ঐতিহ্যের পরিচায়কমাত্র।

 

বৃষ্টিভেজা শহর। সমুদ্র খানিক দূর। শবানুগমন করতে করতে আমাল অনুভব করে সেও ভিজতে শুরু করেছে। সে ছাতা বন্ধ করে দেয়। ঝমাঝম বৃষ্টিরই ভিতর প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন মানুষ মরিয়মের কফিনের পিছু পিছু আসেন। আমাল চোখ বোজে আবার। ভূমধ্যসাগর। তারই মুঠোর ভিতরে চাবির গায়ে লেগে থাকা ভিটের শিকড়। আমাল হাত কচলে নেয়। বৃষ্টি হচ্ছে খুব। মরিয়ম ভিজতে ভালোবাসতেন না একেবারেই। তাঁর পছন্দ ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ আর ঢেউ খেলিয়ে যাওয়া বিস্তৃত ভূমিরূপ।

 

তারা এক আমেরিকান ট্যুরিষ্ট পার্টির সামনে পড়ে যায়।

 

আমাল কি কবরে মাটি দেবে?

এই কংক্রিটের শহরে কি আদৌ মাটির ব্যবস্থা আছে?

নাকি আগুনে পুড়িয়ে ছাই হয়ে যাওয়া অস্থিশেষ তারা ভাসিয়ে দিয়ে আসবে সমুদ্রের কোথাও?

 

ট্যুরিষ্ট সাহেবদের প্রশ্নের ঠেলায় যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়, আমাল ঠিক তখনই শুনতে পায়, কফিন কাঁধে নিয়ে ওই অবস্থাতেও যখন তাঁরা টলোমলো পায়ে এগিয়েছে, তখন পিছন থেকে মিহি-চেরা গলায় এক বালক তার মাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে উঠেছে, “মমি, লুক এ্যাট দ্যাট – দ্য হিজাবি টেররিস্টস! দেয়ার দে আর মমি! জাস্ট লুক এ্যাট দ্যাট। দ্য টেররিস্টস!”

 

আমাল আর নড়তে পারে না। না শরীরে, না মনেও। সে কেবল তার মুঠোর ভিতরে উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে আনা সেই পুরনো, রঙ চটে যাওয়া চাবির স্পর্শকেই আরও জোরের সঙ্গে, আরও প্রত্যয়ের সঙ্গে এক বুকভাঙা বেদনার মতো আঁকড়ে ধরতে চায়!

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment