- 17 June, 2021
- 0 Comment(s)
- 639 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
তবে শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রান্সের ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকাররা ধর্মবোধের পুণ্য সম্পর্কে কম আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। বালজাকের চেয়ে আরও বেশি সাহসের সঙ্গে, খুঁজেপেতে, সবচেয়ে মানবিক পদ্ধতিতে, তাঁরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিলেন বৈবাহিক সুখকে। বৈধ প্রেমের সঙ্গে ইরোটিসিজমকে একীভূত করার সম্ভাবনাকে তাঁরা বিবেচনার মধ্যে এনেছিলেন। Amoureuse গ্রন্থে পোর্ত্রিশ নিশ্চিত করেছিলেন যৌন প্রেম আর বাড়ির জীবনের মধ্যে অসংগতিকে। স্ত্রীর যৌন আকুতি এবং ব্যগ্রতায় নিঃশেষিত হয়ে স্বামী শেষে শান্তি খুঁজেছেন আরও বেশি সংযমী উপপত্নীর কাছে। তবে পল অ্যারভিউয়ের প্ররোচনাতে আমরা কোডের মধ্যে লিখি যে, ‘ভালোবাসা’ হল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটি কর্তব্য। মার্সেল প্রেভস্ট যুবক স্বামীদের উপদেশ দিয়েছিলেন নিজেদের স্ত্রীর সঙ্গে উপপত্নীস্বরূপ আচরণ করতে। বৈবাহিক সুখানুভবকে তিনি বেশ বিচক্ষণতার সঙ্গে কামপূর্ণ পরিভাষায় আহ্বান করেছিলেন। নিজেকে বৈধ প্রেমের নাট্যকার হিসাবে চিহ্নিত করেছেন বার্নস্টেইন। নীতিহীন, মিথ্যাবাদী, কামুক, চোর, দুষ্ট স্ত্রীর কাছে স্বামী প্রতীয়মান হন একজন জ্ঞানী এবং উদার মানুষ হিসাবে। তাঁর মধ্যে আমরা খুঁজে নিই একজন শক্তিশালী এবং বিশেষজ্ঞ প্রেমিককে। ব্যভিচারী রোমান্সের প্রতিক্রিয়া হিসাবে বিয়ের জন্য অনেক রোমান্টিক ক্ষমাপ্রার্থনা উপস্থিত হয়। এমনকি l’Ingénue libertine গ্রন্থে কোলেতও এই নৈতিকতার তরঙ্গে নিজেকে অর্পণ করেছিলেন, যখন দেখা গেল একজন আনাড়ি পলাতক যুবতী কনের কুৎসিত অভিজ্ঞতা বর্ণনার পর তিনি স্থির করেন স্বামীর বাহুতেই ধরা দিয়ে সুখানুভব পরখ করবেন। একইভাবে মঁসিয়ে মার্ত্যা মরিস, তাঁর কিছুটা হইচই ফেলে দেওয়া বইতে, চতুর প্রেমিকের শয্যায় সংক্ষিপ্ত অভিযানের পর নিয়ে এসেছেন স্বামীর খাটে যাতে স্ত্রী নিজের অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হতে পারে। অন্য নানা কারণে, অন্যভাবে, আজকের দিনের মার্কিনরা, যারা একইসঙ্গে বৈবাহিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, তারা বিবাহের মধ্যে যৌনতাকে একীভূত করার প্রচেষ্টাকে বহুগুণিত করেছে। প্রত্যেক বছর অসংখ্য বই প্রকাশিত হয় বিবাহিত জীবনের সূচনায় স্বামী-স্ত্রীর কীভাবে একে-অপরকে মানিয়ে চলতে হয় সেই বিষয়ে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে এবং শুধুমাত্র স্বামীদের শিক্ষা দেওয়া হয় কীভাবে স্ত্রীর সঙ্গে আনন্দপূর্ণ সামঞ্জস্য সৃষ্টি করা যায় সেই বিষয়ে। মনোসমীক্ষক এবং ডাক্তাররা এক্ষেত্রে ‘বিবাহ পরামর্শদাতা’-র ভূমিকা পালন করে। এটা মেনে নেওয়া হয়েছে যে, শারীরিক সুখানুভবে মহিলাদেরও অধিকার আছে এবং পুরুষদের অবশ্যই জানা উচিত স্ত্রীকে এই সুখদানের সমর্থ কৌশলগুলি। তবে আমরা দেখেছি যে, যৌন সাফল্য শুধুমাত্র এই কৌশলের ওপর নির্ভর করে না। কোনো যুবাপুরুষ যদি এই বিষয়ে ‘প্রত্যেক স্বামীর যা যা অবশ্যই জানা উচিত’, ‘বৈবাহিক আনন্দের রহস্য’, ‘ ভীতিহীন ভালোবাসা’ ইত্যাদি ২০টি ম্যানুয়েলও পড়ে থাকেন, তাহলেও তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন না যে, তিনি তাঁর স্ত্রীর ভালোবাসা পাবেন কি না। আসলে নানারকম মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতির সমাহার একত্রে কাজ করে। আর এই প্রথাগত বিবাহ মেয়েলি যৌনতা জাগ্রত এবং বিকশিত করার উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করার থেকে বহু দূরে অবস্থান করে।
অতীতকালে মাতৃতান্ত্রিক সম্প্রদায়গুলিতে, নববিবাহিতা স্ত্রীর কাছ থেকে কৌমার্য দাবি করা হত না। এমনকি কিছু অলৌকিক কারণে সাধারণত বিয়ের আগে তাঁর কুমারীত্ব নষ্ট করে দেওয়া হত। ফ্রান্সের কিছু কিছু গ্রামাঞ্চলে, আমরা এখনও পুরাকালের কিছু অনুমতির জীবিত থাকা পর্যবেক্ষণ করতে পারি। সেখানে যুবতী মেয়েদের কাছ থেকে প্রাক্বৈবাহিক সতীত্ব দাবি করা হয় না। এমনকি ‘খুঁতযুক্ত’ এবং কুমারী-মায়েরা কোনো কোনো সময় অন্য মেয়েদের থেকে অনেক সহজে স্বামী খুঁজে পায়। অন্যদিকে, যে-সমস্ত গোষ্ঠীতে নারীমুক্তিকে স্বীকার করা হয়, সেখানে ছেলেদের সমান তাদেরও যৌনস্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়। যদিও পিতৃতান্ত্রিক নৈতিকতা অপরিহার্যভাবে দাবি করে বাগ্দত্তাকে কুমারী হিসাবে অবশ্যই স্বামীর কাছে প্রেরণ করা। স্বামী আসলে নিশ্চিত হতে চান যে, তাঁর স্ত্রী যেন নিজের বুকে অন্য কোনো অজানা পুরুষের বীজ বহন না করে। তিনি চান তাঁর স্ত্রীর শরীরের সম্পূর্ণ এবং একচেটিয়া অধিকার, যাতে সেই শরীরকে তিনি নিজের করে তুলতে পারেন। কুমারীত্বকে এখানে নৈতিক, ধর্মীয় এবং এক রহস্যময় মূল্যবোধের পোশাক পরানো হয়। এই মূল্যবোধ আজও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। ফ্রান্সে এমন অনেক অঞ্চল আছে যেখানে বরের বন্ধুরা বিবাহকক্ষের পিছনে হাসিঠাট্টা এবং গান করতে করতে ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ না বিজয়ীবেশে বর বেরিয়ে এসে তাদের চোখের সামনে মেলে ধরেন রক্তের দাগ-লাগা বিছানার চাদর। বরের বাবা-মাও সেই চাদর প্রতিবেশীদের দেখান পরদিন সকালবেলায়। ‘বিবাহরাতের এই রীতি’ একটু কম নির্মমভাবে এখনও বেশ পরিব্যাপ্ত। এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয় যে, এর থেকে অনেক অশ্লীল সাহিত্যের জন্ম হয়েছে। সামাজিক এবং জান্তব সত্তার পার্থক্যই অপরিহার্যভাবে জন্ম দেয় অশ্লীলতার। একজন নৈতিক মানবতাবাদী দাবি করেছেন--সমস্ত জ্যান্ত অভিজ্ঞতারই একটি মানবিক অর্থ থাকে এবং তা স্বাধীনতার দ্বারা অধ্যুষিত থাকে। একটি খাঁটি নৈতিক ইরোটিক জীবনে বাসনা এবং সুখানুভব সম্পর্কে একটি স্বাধীন ধারণা রয়েছে। অথবা রয়েছে যৌনতার মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনের করুণ সংগ্রাম। তবে এটা তখনই সম্ভব যখন ভালোবাসা বা বাসনার মধ্যে অন্যের একক স্বীকৃতি সম্পন্ন হয়। যৌনতা যখন আর স্বতন্ত্র ব্যক্তি দ্বারা বাঁচে না, কিন্তু ভগবান অথবা সমাজ সেই যৌনতাকে ন্যায়সংগত বলে দাবি করে, তখন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আর পাশব সম্পর্কের অতিরিক্ত কিছু থাকে না। আমরা বুঝতে পারি যে, সঠিক চিন্তাভাবনা করা বিবাহিত স্ত্রীলোকেরা কেন বিরক্তির সঙ্গে দেহ-মাংসের প্রতি স্বামীদের অভিযানের কথা বলেন : সেই অভিযানের কথা শেষ হয় পায়ুক্রিয়াতেই। বিবাহের প্রীতিভোজের সময় এই কারণেই আমরা এত চিৎকার করে হাসতে শুনি। নিষ্ঠুর বাস্তবতার জান্তব ক্রিয়ার জন্য জাঁকজমক অনুষ্ঠানকে একেবারে ওপর থেকে আরোপ করা হল এক ধরনের অশ্লীল কূটাভাস। বিবাহ এইভাবেই নিজের সার্বজনীন ও বিমূর্ত তাৎপর্য প্রকাশ করে ফেলে : একজন পুরুষ এবং একজন নারী মিলিত হয় সকলের চোখের সামনে প্রতীকী প্রথা অনুসারে। কিন্তু শয্যার গোপনীয়তার মধ্যে নির্দিষ্ট এবং একক ব্যক্তিরাই পরস্পরের সম্মুখীন হয় এবং সমস্ত চোখই তাঁদের আলিঙ্গনের সময় সরে যায়। তেরো বছর বয়সে কোনো এক কৃষক পরিবারের বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে কোলেত ভয়াবহভাবে হতাশ বা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যখন তাঁর বন্ধু তাঁকে নিয়ে গিয়ে বিবাহকক্ষটি দেখিয়েছিল।
নববিবাহিতদের শয়নকক্ষ ... অ্যানড্রিনোপল পর্দার নীচে ছোটো এবং উঁচু খাট। খাটটি পাখির পালক এবং নরম বালিশে ঠাসা। এই খাটে এসেই শেষ হয়েছে সমস্ত দিনের ধূমায়িত ঘাম, ধূপকাঠির গন্ধ, পশুদের শ্বাস-প্রশ্বাস, শসের বাষ্প ... কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছোবেন নবদম্পতি। এই সম্পর্কে আমি ভাবিনি। এরপর এই নরম পালকের মধ্যে তাঁরা ডুবে যাবেন। এরপর তাঁদের মধ্যে হবে এই অস্পষ্ট লড়াই যার ওপর আমার মায়ের বলিষ্ঠ সরলতা এবং পশুদের জীবন আমাকে অনেক কিছু এবং খুব সামান্য শিখিয়েছে। এবং তারপর? এই শয়নকক্ষ ও শয্যা সম্পর্কে আমার ভয় তৈরি হয় যার সম্পর্কে আমি আগে কখনও ভাবিনি।
লেখক: অধ্যাপক,প্রাবন্ধিক
ছবি : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment