মা (চতুর্থ কিস্তি)

  • 06 May, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 126 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
প্রায়শই দেখা যায়, একজন প্রলুব্ধকারী পুরুষ নিজেই সেই মহিলাকে রাজি করান সন্তান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য। নয়তো-বা সেই মহিলাই আভিজাত্যের সঙ্গে চান প্রলুব্ধকারী পুরুষের কাছ থেকে নিজের অসম্মান লুকিয়ে রাখতে। মাঝেসাঝে দেখা যায়, কোনোরকম অনুশোচনা ছাড়াই-যে সেই মহিলা তাঁর সন্তানকে পরিত্যাগ করতে পারছেন--তেমনটা নয়। এর কারণ, হয় গর্ভপাত করানোর সিদ্ধান্ত তিনি অবিলম্বে নিতে পারেননি, অথবা যে-সব জায়গায় গর্ভপাত করানো হয় সেই সব জায়গার কোনো ঠিকানাই তাঁর জানা নেই, না-হয় খরচ করার মতো টাকা তাঁর হাতে নেই।

তারপর তিনি একজন অধ্যাপকের গৃহে বাচ্চার আয়া হয়ে চার বছর ছিলেন।

সেই সময় এক ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ পেয়ে আমি খুশি ছিলাম। ভালোবাসা-সমেত নিজের সমস্ত কিছুই আমি তাঁকে দিয়ে দিই। সেই সম্পর্কের পরিণতি-স্বরূপ চব্বিশ বছর বয়সে আমি এক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শিশু-সন্তানের জন্ম দিই। আমার ছেলের এখন দশ বছর বয়স। গত সাড়ে নয় বছর ধরে আমি আমার সন্তানের বাবাকে দেখিনি ...  যেহেতু পঁচিশশো মার্ক[1] আমার কাছে অপর্যাপ্ত মনে হয়েছিল আর তিনি যেহেতু সন্তানকে নিজের পদবি দেওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং নিজের পিতৃত্বকে অস্বীকার করেছিলেন, ফলত আমাদের মধ্যে সব কিছুই শেষ হয়ে যায়। সেই থেকে আর কোনো পুরুষ আমার ভেতরে ইচ্ছা জাগায়নি।  

প্রায়শই দেখা যায়, একজন প্রলুব্ধকারী পুরুষ নিজেই সেই মহিলাকে রাজি করান সন্তান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য। অথবা, সেই মহিলাকে গর্ভবতী দেখেই প্রলুব্ধকারী পুরুষ তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যান। নয়তো-বা সেই মহিলাই আভিজাত্যের সঙ্গে চান প্রলুব্ধকারী পুরুষের কাছ থেকে নিজের অসম্মান লুকিয়ে রাখতে। অথবা সেই প্রলুব্ধকারী পুরুষের কাছ থেকে তিনি কোনো সাহায্যই পান না। মাঝেসাঝে দেখা যায়, কোনোরকম অনুশোচনা ছাড়াই-যে সেই মহিলা তাঁর সন্তানকে পরিত্যাগ করতে পারছেন--তেমনটা নয়। এর কারণ, হয় গর্ভপাত করানোর সিদ্ধান্ত তিনি অবিলম্বে নিতে পারেননি, অথবা যে-সব জায়গায় গর্ভপাত করানো হয় সেই সব জায়গার কোনো ঠিকানাই তাঁর জানা নেই, না-হয় খরচ করার মতো টাকা তাঁর হাতে নেই এবং অকার্যকর ওষুধ ব্যবহার করে তিনি সময় নষ্ট করে ফেলেছেন। গর্ভাবস্থার তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম মাসে পৌঁছে তিনি সন্তানের থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্যোগ নেন। ফলত, প্রথম কয়েক সপ্তাহের তুলনায় গর্ভপাত তখন আরও বহু গুণে বিপজ্জনক, বেদনাদায়ক এবং আপসের হয়। একজন মহিলাও কিন্তু বিষয়টি জানেন। তা সত্ত্বেও যন্ত্রণা আর হতাশা থেকে নিজেকে তিনি মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন। গ্রামের দিকে, ক্যাথিটারের ব্যবহার পরিচিত নয় বললেই চলে। যে-কৃষাণী ‘পাপ করেছেন’, নিজেকে তিনি চিলেকোঠার মই থেকে পড়ে যেতে দেন। সিঁড়ির ওপর থেকে নিজেকে তিনি ছুঁড়ে ফেলেন। নিজে তিনি আহত হলেও প্রায়শই দেখা যায় যে, এত কিছু করেও লাভের লাভ কিছু হয় না। এমনও দেখা যায়, ছোটোখাটো গাছের বেড়া, ঝোপঝাড় বা পায়খানা যাওয়ার নালির মধ্যে শ্বাসরোধের ফলে মরে যাওয়া ছোটো ছোটো শিশুর লাশ। তবে, শহরের মহিলারা একে-অপরকে সাহায্য করে থাকেন। যদিও অপ্রশিক্ষিত কারোর ওপর ভরসা করাও সবসময় সহজ নয়। আরও কম সহজ হল প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা জোগাড় করা। এই পরিস্থিতিতে একজন গর্ভবতী মহিলা হয় কোনো একজন বন্ধুর শরণাপন্ন হন, নাহলে নিজেই নিজের অপারেশন করে ফেলেন। এই সব দ্বিতীয় শ্রেণির মহিলা শল্যচিকিৎসকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কম দক্ষ হন। কোট হ্যাঙ্গার বা সূঁচ দিয়ে নিজেদেরকে তাঁরা তাড়াতাড়ি ছিদ্র করে ফেলেন। একজন ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন -- এক অজ্ঞ রাঁধুনি চেয়েছিলেন নিজের জরায়ুতে ভিনেগার ইনজেকশন করতে। যদিও ভুল করে তিনি মূত্রাশয়ের মধ্যে ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছিলেন। এর ফল তাঁকে ভয়ংকর ভুগতে হয়েছিল। এই কাজ নৃশংসভাবে করা হলে এবং খারাপভাবে চিকিৎসা হলে গর্ভপাত প্রায়শই একটি সাধারণ প্রসবের চেয়ে বেশি বেদনাদায়ক হয়ে থাকে। কারণ, সেই গর্ভপাতের সঙ্গে যুক্ত থাকে নানান স্নায়বিক ব্যাধি--যা থেকে মৃগীরোগের সংকট পর্যন্ত হতে পারে। কখনো-সখনো সেই গর্ভপাত গুরুতর অভ্যন্তরীণ অসুস্থতাকে উসকে দিতে পারে,  মারাত্মক রক্তক্ষরণ পর্যন্ত ঘটাতে পারে। ‘গ্রিবিশ’ বইতে কোলেত বর্ণনা করেছেন মায়ের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া মিউজিক-হলের একটি ছোট্ট নৃত্যশিল্পীর কঠোর যন্ত্রণার কথা। একটি চলতি প্রতিকার হিসাবে তাঁর মা বলেন, সাবানের ঘনীভূত দ্রবণ পান করার পর মিনিট পনেরো দৌড়োদৌড়ি করতে হবে। আর এই চিকিৎসার ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মা-কে মেরে সন্তানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া হয়। আমাকে এমন একজন টাইপিস্টের কথা বলা হয়েছে যিনি রক্ত-মাখা অবস্থায় নিজের ঘরে চারদিন থেকেছেন কিছুই না-খেয়ে বা পান করে যেহেতু কাউকে ডাকার সাহস তাঁর হয়নি। যে-ধরনের অপরাধ এবং লজ্জার সঙ্গে মিশে থাকে মৃত্যুর হুমকি, তার চেয়ে বেশি ভয়ানক পরিত্যক্ত অবস্থা কল্পনা করা কঠিন। দরিদ্র বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে এই অগ্নিপরীক্ষা কম কঠোর। কারণ তাঁরা তাঁদের স্বামীর নির্দেশ মোতাবেকই কাজ করে থাকেন। ফলত অনর্থক বিবেশ-দংশনের দ্বারা তাঁরা পীড়িত হন না। একজন সমাজকর্মী আমাকে বলেছিলেন, ‘দরিদ্র পাড়ার’ মহিলারা একে-অপরকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। একে-অপরকে তাঁরা যন্ত্রপাতি ধার দেন এবং ধার নেন। এমনভাবে তাঁরা একে-অপরকে সাহায্য করেন যেন বিষয়টি পা থেকে কড়া তুলে ফেলার মতো। তবে, তাঁরাও প্রবল শারীরিক কষ্ট ভোগ করেন। যে-সমস্ত মহিলার মিসকারেজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে, তাঁদেরকে গ্রহণ করতে হাসপাতালগুলি বাধ্য থাকে। তবে, তাঁদেরকে দুঃখজনভাবে শাস্তি দেওয়া হয় তাঁদের যন্ত্রণার সময় এবং কিউরেটার্জের চূড়ান্ত অপারেশনের সময় কোনো ব্যথা কমানোর ওষুধ না-দিয়ে। যেমনটা আমরা দেখতে পাই, জি সারো-র সংগৃহীত সাক্ষ্যগুলির অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে--এই সব অত্যাচার কিন্তু যন্ত্রণা-সহ্য-করতে-অত্যন্ত-বেশিমাত্রায় অভ্যস্ত মহিলাদের মধ্যে কোনো ক্ষোভ তৈরি করে না। তবে, তাঁদেরকে যে অপমান করা হয় তা তাঁরা বোঝেন। আসল কথা হল, যে-অপারেশনটি করা হয়েছে তা গোপনীয় এবং অপরাধমূলক। এই অপারেশন বিপদকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয় এবং নিজেকেই একটি জঘন্য ও কষ্টদায়ক চরিত্র দেয়। যন্ত্রণা, অসুস্থতা, মৃত্যু সেখানে শাস্তির রূপ ধারণ করে। আমরা জানি, দুর্ভোগ আর নির্যাতনের মধ্যে দূরত্ব কতটা। জানি, দুর্ঘটনা আর শান্তির মধ্যে দূরত্বের পরিমাপ। একজন মহিলা যে যে ঝুঁকি বা বিপদকে অনুমান করেন, সেই সব ঝুঁকি বা বিপদের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় নিজেকেই তিনি দোষী ভাবতে থাকেন। ব্যথা আর দোষের এই ব্যাখ্যাই বিশেষভাবে বেদনাদায়ক।  

 

 

[1] আগেকার দিনে, মূলত জার্মানিতে ব্যবহৃত মুদ্রার একটি একক।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment