মহাবিশ্বে ‘মহাকাশে’ মহাকাল মাঝে!

  • 08 March, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 773 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে জ্যোতির্বিদ জোহানেস হেভেলিয়াস ‘মেশিনা কোলেস্টিস’ বলে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটিতে তিনি তাঁর গবেষণাগারে ব্যবহৃত সমস্ত যন্ত্রের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। বইটিতেই দুটি হাতে আঁকা ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে, বিশালাকৃতি দুটি অক্ট্যান্ট এবং সেক্সট্যান্টের দুপাশে দাঁড়িয়ে এলিজাবেথ এবং জোহানেস মহাকাশ পর্যবেক্ষণে রত। সম্ভবত এটিই প্রথম কোনও প্রামাণ্য ছবি যেটিতে একজন নারীকে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যাচ্ছে। নারীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে ধারাবাহিক (পর্ব ১১)

এডুইন হাবল, যাঁর নামে হাবল টেলিস্কোপ— তাঁর ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ ঘাঁটতে গিয়ে বিশিষ্টজনেরা একটি বিশেষ বইয়ের সন্ধান পেয়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত সেই বইটিতে বিশেষ করে যা ছিল, তা হল সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন দশাতে, জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস হেভেলিয়াসের আঁকা চন্দ্রপৃষ্ঠের একেকটি পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র। শোনা যায় যে, এর আগেও থমাস হ্যারিয়ট এমনকি গ্যালিলিও গ্যালিলেইয়ের মতো ব্যক্তিত্ব চন্দ্রপৃষ্ঠের মানচিত্র আঁকতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সেই কাজে তাঁরা অল্পবিস্তর সাফল্যও পেয়েছিলেন। কিন্তু জোহানেসের সেই মানচিত্রগুলিই সেই সময়ে তো বটেই এমনকি তার পরেও বহুকাল অবধি চন্দ্রপৃষ্ঠের সবচাইতে নিখুঁত এবং বিস্তারিত বিবরণ হিসেবে গণ্য হয়েছিল। নিয়তির পরিহাসে জোহানেস হেভেলিয়াসের নিজস্ব প্রায় সমস্ত নথিপত্রই এক ভয়াবহ আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল। তবু তার মধ্যে থেকেও যে একেকটি রত্নকে পরবর্তীতে খুঁজে পেতে পাওয়া গিয়েছিল, তাই থেকে যে কেবল তাঁর পাণ্ডিত্য বা প্রতিভার হিসেব মিলেছিল তাই নয়, জানা গিয়েছিল আরেক ইতিহাসের ইতিবৃত্ত। ইতিহাসের আলোকিত মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এলিজাবেথ ক্যাথারিনা কুপম্যান হেভেলিয়াস, জোহানেস হেভেলিয়াসের সহধর্মিণী। কিন্তু বিজ্ঞানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর নিজস্ব পরিচয়টুকুই বোধকরি তাঁর ক্ষেত্রে যথেষ্ট।

টাইকো ব্রাহে প্রয়াত হয়েছেন ১৫৯৯-তে। ১৬৪৩-তে প্রয়াত হয়েছেন বোন সোফিয়াও। সোফিয়ার সার্থক উত্তরসূরি হিসেবেই ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এলিজাবেথ কুপম্যান, পরবর্তীতে যাঁর নাম হবে এলিজাবেথ হেভেলিয়াস। আর এই ১৬৪৭ সালেই প্রকাশিত হয় ‘সেলেনোগ্রাফিয়া’, সেই বইটি যাতে চন্দ্রপৃষ্ঠের মানচিত্র এঁকে রাতারাতি জগদ্বিখ্যাত হয়ে পড়েন জোহানেস হেভেলিয়াস। সেই বছরেই জন্ম হয় এলিজাবেথের। পোল্যান্ডের ডানজিগ শহরে পাশাপাশি তিনটি বিশাল এস্টেটকে একসঙ্গে জুড়ে নিয়ে মানমন্দির তৈরি করেছিলেন জোহানেস হেভেলিয়াস। শোনা যায় যে কিশোরী বয়সেই একবার পরিবারের সঙ্গে এই মানমন্দির দেখতে এসে জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এলিজাবেথ। ‘তারা ভরা আকাশে’র রহস্য জানতে উন্মুখ এই কিশোরীকে জোহানেস লক্ষ্য করেছিলেন। তখনও তিনি জানতেন না যে কালক্রমে এই এলিজাবেথের সঙ্গেই তাঁরও জীবন একসূত্রে মিশে যাবে। তিনি এলিজাবেথকে বলেছিলেন সময় পেলেই মানমন্দিরে চলে আসতে। ‘তারা ভরা আকাশে’র রহস্যকে উন্মোচন করতে তিনি স্বয়ং তাকে সাহায্য করবেন। আলাপ থেকে ক্রমশ বন্ধুত্ব, অসমবয়স্ক কিন্তু গভীর সেই বন্ধুত্ব। ১৬৬২-তে বাহান্ন বছর বয়সী জোহানেসের প্রথম স্ত্রী প্রয়াত হলে, তাঁর সঙ্গে ষোড়শী এলিজাবেথ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের একটি পুত্রসন্তান হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে শেষ অবধি বাঁচেনি। তিনকন্যার জনক ও জননী হিসেবে জোহানেস ও এলিজাবেথের জীবন কাটতে থাকে। এর আগে থেকেই এলিজাবেথের ধৈর্যশীলতা এবং জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহ সম্পর্কে জোহানেস ওয়াকিবহাল ছিলেন। পরিণয়ের পরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বামীর গবেষণার কাজে অন্যতম সহকারী হিসেবে এলিজাবেথ আত্মপ্রকাশ করেন। শুরু হয় নতুন এক ইতিহাস।

তখনকার দিনে নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের জন্য দূরবীনের পাশাপাশি সেক্সট্যান্ট, কোয়াড্র্যান্ট, অক্ট্যান্ট ইত্যাদি সমস্ত যন্ত্রের ব্যবহার করা হতো। আকাশের গায়ে তারাদের অবস্থান সম্পর্কে নির্ভুল গাণিতিক ধারণা পেতেই এই যন্ত্রগুলিকে ব্যবহার করা হতো। ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে জোহানেস হেভেলিয়াস ‘মেশিনা কোলেস্টিস’ বলে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটিতে তিনি তাঁর গবেষণাগারে ব্যবহৃত সমস্ত যন্ত্রের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এই বইটিতেই দুটি হাতে আঁকা ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে, বিশালাকৃতি দুটি অক্ট্যান্ট এবং সেক্সট্যান্টের দুপাশে দাঁড়িয়ে এলিজাবেথ এবং জোহানেস মহাকাশ পর্যবেক্ষণে রত। সম্ভবত এটিই প্রথম কোনও প্রামাণ্য ছবি যেটিতে একজন নারীকে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যাচ্ছে। অথচ এরই মধ্যে ভয়াবহ একটি ঘটনা ঘটে যায় ডানজিগের মানমন্দিরে। এলিজাবেথ তখন তাঁর কাজে রীতিমতো পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। বিশুদ্ধ ল্যাটিনে তিনি নিজে যোগাযোগ রাখছেন, বক্তব্য আদানপ্রদান করছেন অন্যান্য ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে। ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মে ডানজিগে হেভেলিয়াসদের মানমন্দিরে অতিথি হিসেবে আসেন এডমন্ড হ্যালি স্বয়ং, যাঁর নামে আজকের হ্যালির ধূমকেতু, সেই ধূমকেতুর আবিষ্কর্তা। হেভেলিয়াস দম্পতির সঙ্গে তাঁর আলাপ জমে ওঠে। পরে, জোহানেস হেভেলিয়াসের মৃত্যু হলে পরে স্বামীর অপূর্ণ কাজগুলিকে সম্পন্ন করতে গিয়ে হ্যালির সহায়তা পাবেন এলিজাবেথ। যদিও, অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই তাঁকে আরও অজস্র অসুবিধারও সম্মুখীন হতে হবে। আসলে মেয়েদের চলার পথটা যে কোনকালেই পুরোপুরি মসৃণ হয় না। কারোরই হয় না, কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীতে বা এমনকি এখনকার সময়ে দাঁড়িয়েও মেয়েদের সম্পর্কে এমন সরাসরি মন্তব্য করাটা অন্তত অতিশয়োক্তি কিছু নয়। উদাহরণ যে আমাদের চারপাশেই অঢেল।

২৬শে সেপ্টেম্বর ১৬৭৯, এলিজাবেথ এবং জোহানেস দুজনেই কোনও একটি কাজে বেরিয়েছিলেন। মনে করা হয় সেই সময় অসাবধানতাবশত কোনও এক গাড়ির গাড়োয়ান মানমন্দিরের আস্তাবলে সামান্য একটি মোমবাতিকে মনের ভুলে জ্বলন্ত অবস্থাতেই ফেলে রেখে চলে যায়। সেই থেকেই এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে যায় হেভেলিয়াসদের গবেষণাগার-সহ সমস্ত নথিপত্র। পরে এলিজাবেথ কন্যা ক্যাথারিনার বয়ান থেকে জানা যায় যে, তারা অতিকষ্টে পারিবারিক হাতে লেখা কিছু নথিপত্র-সহ একটি হাতে লেখা ক্যাটালগ (ক্যাটালোগাস স্টেলারাম ফিক্সেরাম), যার মধ্যে হেভেলিয়াস দম্পতির এতদিনকার প্রায় সমস্ত আবিষ্কৃত নক্ষত্রের বিবরণ লিপিবদ্ধ ছিল, সেটিকে কোনোক্রমে বাঁচাতে পেরেছিলেন। এখানে বিশেষ এই ক্যাটালগটিরও একটি ইতিহাস উল্লেখ না করে পারছি না। কেবল মানমন্দিরের আগুনই নয়, পরবর্তীতে ১৭৩৪-এ ডানজিগের ভয়াবহ যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ডানজিগের উপরে মিত্র ও অক্ষশক্তির গোলাবর্ষণ এসব কোনোকিছুই হাতে লেখা এই অমূল্য পাণ্ডুলিপিটিকে নষ্ট করতে পারেনি। বিজ্ঞানীদের কথায় প্রায় ‘ফিনিক্স পাখি’র মতোই আগুন এবং যুদ্ধের কবল থেকে বেঁচে ফিরতে ফিরতে অবশেষে ১৯৭১ সালে ব্রিঘ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে এটি ঠাঁই পায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এ এক অমূল্য সম্পদ।

এই ঘটনার পরে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেও জোহানেস এবং এলিজাবেথ তাঁদের কাজ চালিয়ে যান। এই অগ্নিকাণ্ডের পরেপরেই নিজের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক তথা পোল্যান্ডের রাজা চতুর্দশ লুইকে লেখা একটি চিঠিতে জোহানেস তাঁর সহকর্মী হিসেবে এলিজাবেথের কথা প্রশংসার সঙ্গে উল্লেখ করেন। এমনকি, অগ্নিকাণ্ডে জোহানেসের মৃত্যু হয়েছে এমনটা গুজব কানে পৌঁছলে পরে জ্যোতির্বিদ এডমন্ড হ্যালিও এলিজাবেথের কাছ থেকে চিঠির মাধ্যমে জোহানেসের খবর নেন। জানুয়ারি, ১৬৮৭-তে জোহানেস হেভেলিয়াস প্রয়াত হন। তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলির ভার নেন এলিজাবেথ। একটি বা দুটি নয়, তিন তিনটি অসমাপ্ত গ্রন্থের প্রকাশে পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা নেন এলিজাবেথ। এই সময়, নভেম্বর ১৬৮৭-তে তিনি গ্রন্থগুলির প্রকাশে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির সাহায্য চাইলে সেখান থেকে প্রত্যাখ্যাত হন। পরে একে একে তাঁর হাতেই ১৬৮৭, ১৬৯০ এবং ১৬৯০-তে প্রকাশিত হয় যথাক্রমে স্টেলারাম ফিক্সেরাম, ফিরম্যামেন্টাম সোবিস্কিয়ানাম (৫৬টি নতুন নক্ষত্রপুঞ্জের বিবরণ রয়েছে এতে) এবং প্রোদ্রোমাস এ্যাস্ট্রোনমি। শেষোক্ত বইটিতে অন্যূন ১৫৬৪টি নতুন নক্ষত্রের বিবরণ রয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ৬০০টি আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এলিজাবেথের নিজস্ব অবদান রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে ৪৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন এলিজাবেথ হেভেলিয়াস, জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে যার নাম চিরটাকাল অজর অমর হয়ে থাকবে।

[একশো বছরেরও বেশী সময় ধরে পৃথিবীতে নারী দিবস পালিত হচ্ছে — আজ, তেমনই একটি দিন। প্রতি বছরের মতো এই দিনটিতেও আমরা মিলিত হবো বিভিন্ন মঞ্চে, বিভিন্ন জায়গাতে। অংশ নেবো দীর্ঘ আলোচনায়, তাত্ত্বিক সেমিনারে, পদযাত্রায়। আমাদের কি এলিজাবেথ হেভেলিয়াসকে মনে থাকবে ? ... আজকাল শুনেছি নারী দিবসের পাশাপাশি, বিজ্ঞানের মঞ্চে নারী দিবস (ইন্টারন্যাশনাল উইমেনস ডে ইন সায়ান্স) বলেও আরও একটি দিন পালিত হচ্ছে। তাতে সচেতনতা বাড়ছে, পরিসর বাড়ছে। আকাশ সমৃদ্ধ হচ্ছে, প্রসারিত হচ্ছে। এলিজাবেথ-জোহানেসের সেই মহাকাশ পর্যবেক্ষণের হাতে আঁকা প্রামাণ্য ছবিটার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। নিশ্চিত জানি, এই সময়ে দাঁড়িয়ে যদি কেউ এলিজাবেথকে জিজ্ঞেস করতেন, “কি দেখছিলেন দূরবীনের প্রতিবিম্বতে?” এলিজাবেথ নিশ্চিত ভাবেই উত্তর করতেন, “ভবিষ্যৎ!”]

সূত্রঃ

[১] মেরিলিন অগিলভি, ‘এলিজাবেথ কুপম্যান হেভেলিয়াসঃ উইমেন ইন সায়ান্স’, এম আই টি প্রেস, ১৯৮৬

[২] ই. ওয়ালজ, ‘দ্য স্টার হান্ট্রেস’, র‍্যান্ডম হাউজ

[৩] এলিজাবেথ ল্যান্ডাউ, ‘দ্য সেভেন্টিন্থ সেঞ্চুরি এ্যাস্ট্রোনমার হু মেড দ্য ফার্স্ট এ্যাটলাস অব দ্য মুন’, স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন, ডিসেম্বর, ২০১৮

ছবি: (বাদিকে) সেক্সট্যান্টের  এবং (ডানদিকে)  অক্ট্যান্টের  দুপাশে দাঁড়িয়ে এলিজাবেথ এবং জোহানেস মহাকাশ পর্যবেক্ষণে রত। (মাঝে) এলিজাবেথ ক্যাথারিনা কুপম্যান হেভেলিয়াস

লেখক: প্রযুক্তি বিদ্যার গবেষক, প্রাবন্ধিক

0 Comments

Post Comment