- 04 April, 2021
- 0 Comment(s)
- 722 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
এ বছর দোলের রঙের সঙ্গে ভোটের রং যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই শহরের প্রত্যেকটা ফাঁকা দেওয়াল বিভিন্ন পার্টির রঙে রেঙে উঠেছে। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ আরও কত কী...চারদিকে আকাশে উড়ছে নানা রঙের পতাকা। ভোটের পোস্টারে-ব্যানারে ঢেকে গেছে শহরের মুখ। সুমিতার এখন অনেক কাজের চাপ। সামনে ভোট। চিন্তায় ঠিক করে রাতে ঘুমোতে পর্যন্ত পারে না আর বাকি সারাদিনই কেমন একটা ঝিমুনি ঝিমুনি ভাব থাকে। কলেজের ইউনিয়নে সুমিতা নাম লিখিয়েছে দু-বছর হল। বাবা-মা পার্টি-পলিটিক্স খুব বেশি পছন্দ করেন না। সুমিতা নিজে জেদ করেই ইউনিয়ন গ্রুপে নাম লিখিয়েছিল। এখন কলেজ বন্ধ। ভোটের আগে আর খোলার সম্ভাবনাও নেই। তাই অনলাইনেই বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড চলতে থাকে।কখনো-সখনো দাদা-দিদিরা ডেকে পাঠালে আলাদাভাবে ইউনিয়ন রুমে গিয়ে দেখা করে আসতে হয় সুমিতাকে। আজ দুপুরে ইউনিয়ন রুমে গিয়ে সুমিতা দেখলো কৌশিক একা একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে। গরমকাল। ঢিকঢিক্ করে ফ্যান ঘুরছে মাথার উপর। সুমিতাকে দেখে কৌশিক বললো, 'রিঙ্কুদি বললো তোমার নামে নাকি অনেক কমপ্লেন আছে।'
সামান্য হেসে সুমিতা বললো, 'কেন, আমি আবার কী করলাম কৌশিকদা?'
-'তা আমি জানি না।'
কৌশিক খুবই শান্ত নম্র স্বভাবের ছেলে। স্বাস্থ্য খুব বেশি ভালো নয়। খুবই কম কথা বলে। সুমিতার থেকে এক বছরের সিনিয়র। ইউনিয়নে একটাই ওর অক্ষমতা বাকি ছেলেদের মতো অশ্রাব্য ভাষায় গালি ওর মুখ থেকে সহজে বেরোয় না। এই নিয়ে ইউনিয়নের বাকি ছেলেগুলো কৌশিকের পিছনে লাগে।এমনকি অতিরিক্ত ভদ্র হওয়ার জন্য মাঝে মাঝে বকাও খেয়েছে দাদা-দিদিদের কাছে। সুমিতার ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার অন্যতম কারণ এই কৌশিক। ছেলেটিকে সুমিতার খুবই পছন্দ। কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা বলার সাহস এতদিনেও জোগাতে পারেনি। তবে কৌশিকের মনে তার জন্য সেই বিশেষ জায়গাটি এখনও তৈরি হয়নি বলেই সুমিতার মনে হয়। কৌশিকের পাশে একটা চেয়ার টেনে এনে সুমিতা ফ্যানের নীচে বসলো। গরমে কপাল থেকে গাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে।একটু নড়েচড়ে বসে মুখের থেকে বিরক্তিভরে মাস্কটা খুলে ফেললো সুমিতা।কিছুক্ষণ ওরা দু-জনে চুপচাপ বসে রইল। একটু পরেই কয়েকজন মেম্বারকে সঙ্গে নিয়ে রিঙ্কুদি ঢুকলো ইউনিয়ন রুমে। বয়েজ কাট চুল চোখে মুখে সর্বদাই বিরক্তির ভাব স্পষ্ট। সবুজ চেক শার্টটা ব্ল্যাক জিনসের সঙ্গে ইন করে পরা।দু-কানে ফুটো থাকলেও দুল পরেছে এক কানে। ঘরে ঢুকেই সুমিতাকে দেখে রিঙ্কুদি গর্জে উঠলো, 'এই মেয়ে এদিকে শোন্'। সুমিতা এগিয়ে গেল রিঙ্কুদির দিকে। রিঙ্কুদি বললো, 'তোরা কি করতে ইউনিয়নে আছিস রে? কাজকর্মের বালাই নেই খালি টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। সুবিধাখোর কতগুলো মেয়েছেলে ইউনিয়নে ঢুকে বসে আছে। ওইসব অ্যাটেন্ডেন্সের নাম্বার মুফৎ-এ ফেসিলিটি এখান থেকে পাওয়া যাবে না বুঝেছ। ইউনিয়নে থাকতে হয় তো কাজ করতে হবে। ঝাণ্ডা হাতে একটু এদিক ওদিক ঘুরতে হবে। ঘরে বসে বসে ঘুমালে চলবে না। সামনে ভোট বহুৎ কাজ আছে।' রিঙ্কুদি এরপর কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললো, 'তোকে যে কাজটা দিয়েছিলাম করেছিস?'
-'হ্যাঁ আকাশদার কাছে দিয়েছি প্রিন্ট আউটটা।'
-'আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে এখানে এখনও অবধি বসে আছ কেন বাবু? ফোটো এখান থেকে।'
কৌশিক কোনো কথা না বলে চুপচাপ মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেল। সুমিতা কিছু একটু ভেবে নিয়ে রিঙ্কুদিকে বললো, 'দেখো রিঙ্কুদি আমি আর ইউনিয়ন করবো না সেটাই তোমাকে জানাতে এলাম। এদিক ওদিক মিছিলে গিয়ে মাথা ফাটানো আমার দ্বারা হবে না। তুমি অন্য লোক খুঁজে নাও। আমাকে আর ডেকো না।'
-'কেন, অন্য কোনো পার্টিতে যোগ দিয়েছিস নাকি আবার। এখন তো যা সব রং বদলের দিন এসেছে।'
-'না, আমি পার্টি করছি না আর করবোও না। আচ্ছা আসছি এখন।' এই বলে সুমিতা বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। এই দু-বছরে ও বুঝেছে এই পার্টি বলে জায়গাটা ওর জন্য একেবারেই ঠিক নয়। এখানে এত কেচ্ছা এত গালাগালি এত অপমান ওর একেবারেই ভালো লাগে না। ভদ্র মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে সুমিতা।কৌতূহলবশেই ইউনিয়নে নাম লিখিয়েছিল। বন্ধুদের কাছে শুনেছিল ইউনিয়নে নাম লেখালে নাকি অনেক সুযোগ সুবিধে পাওয়া যায়, কলেজের প্রোগ্রামগুলোতে অনায়াসে পার্টিসিপেট করতে পারবে, একটু বেশি কামাই হলেও অ্যাটেন্ডেন্স নিয়ে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে এখানে একবার যোগ দিলে দুর্ভোগের শেষ নেই। সুবিধার থেকে ওর মতো শান্ত স্বভাবের মেয়ের অসুবিধাই বেশি। প্রতি মাসে রিঙ্কুদিকে তিনশো টাকা করে চাঁদা দেওয়াটা নিয়ম। তার পাশাপাশি এই ভোট উৎসবে রাত নেই দিন নেই আকাশদা ফোন করে করে ডাকা-হাঁকা শুরু করে দিয়েছে। আজ কোথায় রাস্তার মোড়ে বিক্ষোভ দেখাতে যেতে হবে, কাল অন্য জায়গায় গিয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে ধর্নায় বসতে হবে, পরশু পার্টির কোনো নেতা বক্তৃতা দিতে আসবে তার জন্য দলে দলে ঝাণ্ডা হাতে করে পিছন পিছন দৌড়োতে হবে। এই সমস্ত ঝামেলা তার মধ্যে সিমেস্টারের চাপ সব মিলিয়ে সুমিতার হুলুস্থূল অবস্থা। এই টেনশন ওর রাতের হালকা ঘুমটুকুকেও কেড়ে নিয়েছে। মাঝে লকডাউনে বাবার প্রাইভেট ফার্মের চাকরিটা চলে যায়। অনলাইনে কলেজের পরীক্ষা হবে শুধু এই রক্ষে। দু-একটা টিউশনি করে জমানো টাকা থেকেই নিজের পড়াশোনার খরচ আর হাত খরচা চালাতে হয়। বাবা অন্য একটা প্রাইভেট ফার্মে ইদানিং কাজ পেয়েছে বটে তবে সেই টাকাতে সংসার খরচ চালানোই দায় হয়েছে। এই সময় ইউনিয়ন থেকে একমাত্র কৌশিকদা-ই হাত বাড়িয়েছিল সাহায্যের জন্য। কৌশিকের থেকে টেক্সট বুক, নোটগুলো নিয়ে সুমিতা সিমেস্টারের পরীক্ষাটা ঠিক ভাবে দিতে পেরেছে।সেই দিন বিকেলে কৌশিক ফোন করলো সুমিতাকে। সুমিতা ফোনটা রিসিভ করে বললো, 'বলো কৌশিকদা।'
-'তুমি যে অতগুলো কথা রিঙ্কুদিকে শুনিয়ে গটগট করে বেরিয়ে এলে তারপরের নাটকটা তো তোমার দেখা হয়নি। রিঙ্কুদি সেই হাউমাউ করে ইউনিয়নের বাকি মেম্বারগুলোকে ডেকে আনলো, তারপর তোমার নামে অনেক খিস্তি গালিগালাজ করেছে। ওরা সন্দেহ করছে তুমি বোধহয় অন্য কোনো পার্টিতে ঢুকেছ। একটু সাবধানে থেকো সেই জন্যেই ফোন করলাম। পার্টি ছেড়ে দিয়েছ বলে ওরা কিন্তু তোমার ফ্যামিলির ওপরেও অনেক চোটপাট করতে পারে।'
-'তোমাকে দেখলাম আগেই বেরিয়ে গেলে এগুলো কখন দেখলে আবার?'
-'আরে আমি ইউনিয়ন রুম থেকে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ পর্যন্ত কলেজ ক্যাম্পাসেই ঘুরঘুর করছিলাম। যা দেখলাম সেটাই তোমাকে জানালাম। যাই হোক, সাবধানে থেকো। ভোটের মুখে এবারে বড়সড় গণ্ডগোল লাগার একটা চান্স আছে। ভালো থেকো। গুড নাইট।' বলে কৌশিক ফোনটা কেটে দিল। গরমকাল তবে আজ আকাশটা পরিস্কার আছে। কালো আকাশের গায়ে জ্বলছে মিটমিট করে দু-একটি তারা। দক্ষিণ দিকের খোলা জানলাটা দিয়ে হালকা ঠাণ্ডা একটা হাওয়া ঘরের ভিতর আসছে। তার সঙ্গে ভেসে আসছে সরু সরু প্রচুর মশাও। রাত সাড়ে ন-টা নাগাদ রিঙ্কুদি ফোন করলো সুমিতাকে। ফোনটা ধরেই সুমিতা বুঝতে পারলো রিঙ্কুদি এখন আর কর্কশ ভাবে ওর সঙ্গে কথা বলছে না। মিষ্টি গলায় রিঙ্কুদি বললো, 'সুমিতা তুই কি সত্যিই ইউনিয়ন ছেড়ে দিলি? দ্যাখ, ইউনিয়নে ঢুকেই তো আর বড় নেতা হওয়া যায় না। তার জন্য অনেক সবুর করতে হয়। সকলেই প্রথম দিকে ইউনিয়নে ঢুকে ঝাণ্ডা হাতে এদিক ওদিক দৌড়েছে। এই দ্যাখ না এত দিন হল আমরা এখনও পর্যন্ত তোদের সঙ্গেই দৌড়োচ্ছি। দ্যাখ বোন, ছোটোখাটো ঝামেলা এরকম হয়েই থাকে তার জন্য কেউ আবার মনে রাগ পুষে ভোটের মুখে পার্টি ছেড়ে চলে যায় নাকি?কাল একবার দেখা করিস সবটা মিটমাট করে নেওয়া যাবে।'
-'দেখো রিঙ্কুদি আমার যা বলার তা আমি বলে দিয়েছি এখন আর আলাদা করে দেখা করার কিছু নেই। আর তোমার ওপর রাগ করে মোটেও আমি পার্টি ছাড়ছি না। পরে না হয় আবার জয়েন করে যাব। আমার কিছু পার্সোনাল ম্যাটারের জন্য এখনকার মতো ছাড়ছি। ওকে বাই।' এই বলে সুমিতা ফোনটা কেটে দিল। সুমিতার বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না যে রিঙ্কুদি সিনিয়র নেতার কাছ থেকে আজ ওর দলত্যাগ নিয়ে অনেক কটু কথা শুনেছে তাই আবার ওকে দলে টানার চেষ্টা করছে। ইউনিয়নে লোক সংখ্যা এমনিতেই কমে যাচ্ছে। সুমিতার মতো অনেকেই দল ছেড়ে দিচ্ছে। এদের কেউ কেউ আবার অন্য দলে গিয়ে নাম লিখিয়েছে। ওদের দলেও অন্য পার্টির কয়েকজন সদস্য ঢুকেছে। তবে নতুন লোকেদের পুরোপুরি বিশ্বাস করা খুব কঠিন। রাজনীতি বলতে সেটা এখন শুধুই গুণ্ডাবাজি আর তোলাবাজিতে পরিণত হয়েছে। পলসায়েন্সের ছাত্রী সুমিতা রাজনীতিটাকে কেবল 'রাজার নীতি' ভেবেই ইউনিয়নে যোগ দেয়। সুমিতা বাবা-মায়ের কাছে ওর দলত্যাগের বিষয়টি গোপন রাখলো না। যতই বাইরে সাহস দেখাক না কেন মনের ভিতরে একটুখানি ভয়ের আভাস যেন ও পেয়েছে।রাতে খেতে খেতে সুমিতার বাবা বললেন, 'নিজের ইচ্ছাতে যখন পলিটিক্সে ঢুকেছিলে তখন তো আমাদের মত নিতে চাওনি তাহলে এখন নিতে এসেছ কেন?'
মা বললেন, 'ছেড়ে যখন দিয়েছিস তখন তো আর কিছু করার নেই আবার ফিরে গেলে ওদের কাছে কথা শুনতে হবে।'
সুমিতা বললো, 'রাজনীতি করতে ঢুকেছিলাম মা, কোনো গুণ্ডানীতি নয়। ওরা যা সমস্ত খারাপ কাজ করে বা করতে বলে আমি তাতে সামিল হয়ে আর পাপের ভার বাড়াতে চাই না। তা ছাড়া, আমার তো একটা ফিউচার আছে। সারা জীবন ওদের সঙ্গে গুণ্ডাগিরি করে গেলে তো হবে না। তাই ছেড়ে দিলাম।'
বাবা বললেন, 'আগেই বলেছিলাম মেয়েদের এই পার্টি-পলিটিক্স করতে নেই। ভদ্র মেয়েরা ওই জায়গায় বেশি দিন টিকতে পারে না। আর তাই হল। এখন তুই একা মেয়ে ব্যাপারটা নিজে সামলাতে পারবি কি না দেখিস। না হলে একটু অপমান গায়ে মেখে নিয়ে নয় আবার ওদের কাছেই ঢুকে যাস।'
সুমিতা বললো, 'বাবা এই ভয়ের রাজনীতিকে আমরা যতদিন প্রশ্রয় দেব ততই ওরা মাথায় উঠে নাচবে। আমি মেয়ে বলেই তোমার যত চিন্তা তাই না? ছেলে হলে হয়তো এতটা হতো না।'
বাবা বললেন, 'সেটা নয়। ছেলে হলেও চিন্তা হত। কিন্তু ছেলেদের হয় শুধু মাথা ফাটতো অথবা হাত-পা ভাঙতো। হসপিটালে গিয়ে তাকে ঠিক করে আনা যেত।কিন্তু মেয়েদের যে ক্ষতিটা ওই গুণ্ডা ছেলেগুলো করে সেটা সারা জীবনের মতো একটা ক্ষত হয়ে যায়। সেই মেয়ের না কোনো সামাজিক মর্যাদা থাকে, আর না কোনো ভালো ঘরে তার বিয়ে হয়। তাদের জীবনের গতি এক জায়গাতেই থেমে যায়। জীবনের সমস্ত দুয়ার তাদের জন্য বন্ধ। বাবা-মা মাথা ফাটিয়েও তখন কিছু করতে পারে না।'
সুমিতা বললো, 'এইগুলো সমাজের লোকেরা ভাবে বাবা। যে মেয়েগুলি ধর্ষিত হয় তারা না। তাদের জোর করে এইসব বাজে কথা ভাবতে শেখানো হয় যে তারা চিরতরে অপবিত্র, অচ্ছুত হয়ে গেল। আমি এইসব কথা ভাবি না। যে অপরাধী, অপরাধ তার। জীবনের গতি সেই ধর্ষকের রুদ্ধ হওয়া উচিত, কোনো নির্দোষ মেয়ের নয়।'
বাবাকে অতগুলো কথা বলে আসার পর সুমিতার মনটা যেন অনেকটা হালকা লাগছিল। সেই দিন রাতে অনেক দিন পর ভালো ভাবে ঘুমাতে পারলো সুমিতা।
পরদিন সকালে কৌশিক এল সুমিতার বাড়িতে। সুমিতা কৌশিককে বাড়ির ভেতরে ডেকে না এনে দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলতে আরম্ভ করলো। কৌশিক একটু আমতা আমতা করে সুমিতাকে বললো, 'রিঙ্কুদি আমাকে পাঠালো তোমার বাড়িতে কৈফিয়ত চাইতে।'
-'কৈফিয়ত চাওয়ার তো কিছু নেই। যা বলার আমি কাল রাতেই বলে দিয়েছি।'
-'রিঙ্কুদি তোমাকে সরাসরি আরেকবার দেখা করে কথা বলতে চাইছে।'
-'ঠিক আছে। এগুলো বলতেই কি এসেছিলে?'
-'তোমার যদি কোনো সাহায্যের দরকার লাগে তো আমাকে বলতে পারো। কাল তোমার কথা শুনে রিঙ্কুদি ইনসাল্ট ফিল করেছে। যেভাবে ইউনিয়নের এগেন্সটে ফট করে চলে গেলে তাতে কিন্তু বিপদ বাড়তে পারে। ভালো থেকো।' এই কথা বলে কৌশিক চলে গেল। সুমিতার মনে হল ইউনিয়নের সবাই ওর বিরুদ্ধে চলে গেলেও একজন ওকে এখনও সাহায্য করতে চাইছে। তবে কৌশিকদাও কি সুমিতাকে ভালোবাসে? তারও কি চিন্তা হয় সুমিতার জন্য? কিন্তু সুমিতা যেখান থেকে একবার বেরিয়ে চলে এসেছে সেখানে আর ফিরে যেতে মন চাইছে না। এর জন্য যদি ওর ভালোবাসায় ছেদ পড়ে তো পড়ুক।
কলেজ বন্ধ থাকলেও এবছর কলেজের বসন্ত উৎসব বন্ধ হবে না।ছোটো করে হবে এবারের অনুষ্ঠানটা। এই খবরটা কৌশিক ফোন করে সুমিতাকে জানায়। কৌশিক বলেছিল সুমিতাকে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। প্রতি বছরের মতো এবছরেও ওকে গান গাইতে আসার জন্য অনুরোধও করেছিল। কিন্তু সুমিতা রাজি হয়নি। অন্যান্য বছর দোলের এক সপ্তাহ আগে থেকে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা রঙের উৎসবে মেতে ওঠে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণের ভয়ে কেউ কোনো আনন্দ করতে পারছে না।দোলটাও যেন এবছর কেমন মনমরা, বিধি নিষেধের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। ভোটের পরে আবার লকডাউন হওয়ার একটা গুজবও দোলের গরম শুকনো হাওয়ায় ধুলোর সঙ্গে উড়ে বেড়াচ্ছে। সেইদিনকার ঘটনার পর থেকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সুমিতা রাস্তায় বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছে। দোলের আগের দিন রাতে সুমিতা ওদের বাড়ির গলির কাছেই রাস্তার ওপর একটা রঙের দোকান থেকে আবির কিনতে গেল। রাত ন-টা বাজে। শহরের রাস্তা পুরো শুনসান। স্ট্রিট লাইটের সাদা আলো স্থির ভাবে এসে পড়েছে ধূসর রাস্তার ওপর। একটা নীল রঙের প্রাইভেট কার হুসহুস শব্দে ফাঁকা রাস্তার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। গলির ভিতর থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। সুমিতাকে আবির দিয়েই দোকানি দোকান গোটাতে আরম্ভ করলো। এখন থেকেই রাস্তার উলটোদিকের মদের দোকানে লাইন পড়ে গেছে। দূরে কোথাও থেকে হালকা সুরে ভেসে আসছে দোলের বলিউডি গান। দোলের আগের দিন রাতে রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো থাকে না বলে সুমিতার মা ওকে বাইরে বেরোতে বারণ করেছিলেন। এই সময় লোকচক্ষুর আড়ালে কোনো বড় ধরনের অপরাধ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।টিউশনি থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলেও সুমিতা ফেরার সময় রং কিনতে ভুলে যায়। তাই একপ্রকার জোর করেই বেরিয়েছিল আবির কিনতে। সুমিতা লাল আবিরের প্যাকেটটা তাড়াতাড়ি করে নিয়ে দাম চুকিয়ে জোরে হাঁটতে শুরু করলো বাড়ির দিকে। হঠাৎ দূর থেকে একটা কালো স্পোর্টস বাইক আওয়াজের ঝড় তুলে দ্রুত এগিয়ে এল সুমিতার দিকে। সুমিতা বাড়ির গলিতে ঢোকার আগেই বাইকটা পিছন দিক থেকে এসে জোরে ধাক্কা মারলো সুমিতাকে। ধাক্কা খেয়ে সুমিতা ছিটকে গেল ফুটপাথের দিকে। বাইকের হ্যান্ডেলটা লেগে ওর বাঁ হাতটা ফুলে উঠেছে। তার সঙ্গে শুরু হল অসহ্য যন্ত্রণা। সুমিতা ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো বাইক থেকে কালো হেলমেট পরা একটা ছেলে নেমে ওর দিকে এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো। সুমিতা ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে এল দু-পা। ছেলেটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সুমিতার দিকে। সুমিতা পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে ওর পিঠ ঠেকে গেল ল্যাম্প পোস্টে। ছেলেটি সুমিতার গলা থেকে ছোঁ মেরে ওড়নাটা নিতে চেষ্টা করতেই সুমিতা খামচে ধরলো ছেলেটার হাত। ছেলেটা সুমিতার থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। ছেলেটির হাতের দিকে চোখ যেতেই সুমিতার চোখে পড়লো তার সেই চিরপরিচিত কৌশিকের নাম লেখা ট্যাটুটা আর সেই রূপোয় বাঁধানো চৌকো পান্নার আংটি। এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সুমিতা। ছেড়ে দিল ছেলেটার হাত। সুমিতা হাত ছেড়ে দিতেই ছেলেটা ছিটকে গেল রাস্তার দিকে। সুমিতার মাথায় তখন আগুন জ্বলছে। সুমিতা ছুটে ছেলেটির দিকে এগিয়ে গিয়ে টিশার্টের কলার ধরে জোরে ঝাঁকাতে আরম্ভ করলো। তারপর ছেলেটার পেটে সজোরে একটা লাথি মেরে এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে ঢুকে গেল বাড়ির গলির ভিতর।
কৌশিক যখন বাড়ি ফিরলো তখন রাত পৌনে এগারোটা। সেদিন রাতের খাবারটা ওর ঠিক মতো খাওয়া হল না। ঘুমোতে যাওয়ার আগে আয়নার সামনে নিজেকে যখন দাঁড় করালো তখন মনের ভিতর অনেক প্রশ্ন জমে উঠেছে।কৌশিক কি সত্যিই সুমিতাকে ভালোবাসতো? নাকি পুরোটাই মিথ্যা। সুমিতাকে বারবার সাবধান হতে বলার মধ্যে কি একটা প্রচ্ছন্ন হুমকিও লুকিয়ে ছিল?সুমিতাকে যদি ভালোবেসে ফেলেই থাকে তবে এমন কাজ করলো কেন? পার্টির গুণ্ডাদের হাত থেকে শুধু নিজেকে আর নিজের পরিবারকে বাঁচাতে, এতটাই স্বার্থপর! কৌশিক বুঝতে পারলো পার্টি করতে গিয়ে ওর মন থেকে ভালোবাসার লাল রংটা একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। না, আর কিছু ভাবতে পারছে না কৌশিক। রাতের গাঢ় অন্ধকারটা মাথার ভেতর ঢুকে গিয়ে চোখের সামনের সমস্ত কিছুকে যেন ডুবিয়ে দিল কুচকুচে কালো রঙের জলে।
দোলের দিন সকালবেলায় একটা পার্সেল এল কৌশিকের নামে।পার্সেলটা পাঠিয়েছে সুমিতা। কৌশিক পার্সেলটা খুলে দেখলো একটা লাল আবিরের বাক্স। ঠিক সেই মুহূর্তে সুমিতার ফোন এল কৌশিকের কাছে। কৌশিক ফোনটা ধরতেই সুমিতা বললো, 'অবাক হচ্ছো আমি তোমাকে লাল আবির কেন পার্সেলে পাঠিয়েছি? ভালো করে দেখো কৌশিকদা এটা সেই লাল আবির যেটা কাল রাতে তোমার সঙ্গে ধস্তাধস্তির জন্য রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল।'
মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল কৌশিকের মুখ। ইতস্তত করে কৌশিক বললো, 'ক-কাল রাতে ধস্তাধস্তি মানে?'
-'এমন ভাব করছো যেন ভাজা মাছটাও উলটে খেতে জানো না। কাল রাতে যে আকাশদার বাইক নিয়ে আমাকে অত জোরে ধাক্কা মারলে আর একটু হলে আমার হাতটাই পুরো ভেঙে যেত। তোমার জন্য হাতে এখন আইসব্যাগ লাগিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। ভালো ভাবে দোলটাও খেলা হবে না এবারে শুধুমাত্র তোমার জন্য।'
-'আমি কাল রাতে বাড়ি থেকে বেরোয়নি তো। এসব কখন হল?'
-'একদম মিথ্যে কথা বলবে না কৌশিকদা। তোমার হাতের ট্যাটুটা দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম। তোমার এত বড়ো সাহস তুমি আমার এলাকায় ঢুকে আমার সঙ্গেই শয়তানি করতে আসো! ভেবেছিলাম ইউনিয়নের সঙ্গে শত্রুতা হলেও তুমি অন্য রকম। দু-বছর ধরে দূর থেকে ভালো বেসেছিলাম সেটা বুঝতেও পারোনি।তোমাকে একরকম রক্ষক ভেবে বসেই আমি সব থেকে বড়ো ভুলটা করে ছিলাম। বুঝতে পারিনি শেষকালে রক্ষকই ভক্ষক হয়ে বসবে।'
-'আমি নিজের থেকে কিছু করতে চাইনি। আকাশদা-রিঙ্কুদি ওরা চাপ দিয়েছিল করার জন্য।'
-"আর তুমি তোমার প্রাণ আর মান বাঁচাতে ওদের অপরাধে সামিল হয়ে গেলে?বাহ্! সকালে এক রং দেখাও আর বিকেলে আর এক। কিন্তু তোমার মতো গিরগিটির আসল রংটা যে আমার সামনে এত দেরিতে হলেও ধরা পড়েছে তাতেই মঙ্গল। কান খুলে একটা কথা শুনে রাখো আর তোমার রিঙ্কুদি-আকাশদাকেও শুনিয়ে দিও যে আমি কিন্তু এরপর নেক্সট স্টেপ নিতে বাধ্য হব। পুলিশের কাছে ইনফর্ম করে দেব পুরো ব্যাপারটা। যাদের তোমরা কেবলমাত্র শোষণের যোগ্য বলে মনে করো, সেই সাধারণ মানুষও প্রয়োজনে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। ভোটের আগে জনতাই জগদীশ্বর। সো, বি কেয়ারফুল। আর সত্যি কথা বলতে গেলে আমি মন থেকে চাই না যে তোমার মতো অপরাধীদের দোলটা ভালো কাটুক। অন্যায়ের পথ বেছে নিয়ে তোমরা সকলেই জীবনের বাকি অনুভূতির রংগুলোকে একেবারেই মুছে ফেলেছো। তাই 'হ্যাপি হোলি'টা নয় না বলাই থাকলো।"
লেখক : শিক্ষার্থী, গল্পলেখক।
ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট।
0 Comments
Post Comment