‘‌তুই কুমার, তোর মা দত্ত কী করে?’‌

  • 21 June, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1174 view(s)
  • লিখেছেন : রোশন কুমার
পদবি থেকে মানুষের অরিজিনটা জানা যায়, কিন্তু সমস্যা হয় সেখানে— যখন এই পদবি আর তার সঙ্গে জড়িত জাতপাত, ধর্ম, পেশা ইত্যাদি বৈষম্যের বাতাবরণ তৈরি করতে থাকে সমাজে।

পদবি নিয়ে বড় বিপদ। সোজা কথায় বললে, ‘‌ঝামেলা’‌। কী ঝামেলা? পদবি হল নামের পরের অংশ, মানে যেমন আমার ‘‌কুমার’‌। এই নামের পরের ছোট লেজুড়টি বড় ঝামেলার কারণ। দু-‌একটা ছোট উদাহরণ: ‘‌এই কুমার না কুমারি?’‌, ‘‌আচ্ছা, কুমার মানে তোরা ঠিক কোন জাত?’‌, ‘‌তুই কুমার, তোর মা দত্ত কী করে?’‌

এই ঝামেলা একটা নয়, অনেক। উপরের উক্তিগুলি থেকেই আশা করি পরিষ্কার হচ্ছে কী কী ঝামেলা তৈরি হয়। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, পদবি থেকে মানুষের অরিজিনটা জানা যায়, আর সেই নিয়ে কোনো ঔৎসুক্য থাকলেই বা সমস্যা কোথায়? না সেখানে সমস্যা নেই, সমস্যা হয়— যখন এই পদবি আর তার সঙ্গে জড়িত জাতপাত, ধর্ম, পেশা ইত্যাদি যখন ডিসক্রিমিনেশনের কারণ হতে থাকে। একটা ছোট ঘটনা—আমি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেছি। সেখানেই আমাদের বিভাগের এক সহপাঠীর নাম ‘‌রাহুল মণ্ডল’‌। রাহুল পড়াশোনায় বেশ ভাল ছিল। আমাদের বিভাগে প্রথম ৫ জনের মধ্যেই থাকত। রাহুল উন্নত মানসিকতার এবং খুবই জ্ঞানসম্মৃদ্ধ ছিল। প্রথম তিন-‌চার মাস ইতিউতি শুনলাম, ‘‌রাহুল তো ভালই করছে রে, যদিও না করলেই বা কি? ওতো এস সি, এমনিও হবে ওর।’‌ তারপর ইদের দিনের সোশ্যাল মিডিয়ায়, রাহুলের নতুন পাঞ্জাবি পরা ছবি দেখেই কিছু সহপাঠীর চক্ষু চড়কগাছ! —‘‌এই ও যে মুসলমান, সেটাতো বুঝিনি।’‌

সহপাঠীরা কী করত বুঝলে? আগে জানলে? ও পড়াশোনাতে ভাল, ও সংরক্ষণের জোরে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছে না সেটা মানত? না বোধহয়। উল্টে আগে থেকেই ‘‌কী রে তোর পুজোয় কটা জামা হল’‌-র পরিবর্তে ‘‌তোর  ইদে কটা জামা হল?’‌ জিজ্ঞেস করত। এর থেকেই স্পষ্ট হচ্ছে যে, পদবি থেকে যে জাতপাতের ইঙ্গিত আসে সেটা সমাজে একটা বৈষম্যের বাতাবরণ তৈরি করে। 

এবার আসি মূল আলোচনায়, উদাহরণ হিসেবে দেওয়া শেষ উক্তিটিতে।
‘‌তুই তো কুমার, তোর মা কী করে দত্ত?’ এই আলোচনার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আমি বোধ করছি না। প্রাসঙ্গিক হল কে, কেন, এবং কীভাবে এই প্রশ্ন করছে। আমি প্রথম এই কথা শুনেছিলাম, একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তির পরীক্ষা দিতে গিয়ে। বাবা-‌মায়ের নাম জিজ্ঞাসা করা হলে আমি বলি, আর তাতেই এই প্রশ্ন উড়ে আসে আমার দিকে। আমি কিছু উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। প্রসঙ্গত, গোটা বিশ্বেই বিয়ের পর মহিলাদের পদবি পরিবর্তনের একটা রীতি-‌রেওয়াজ আছে। 

কেন এই রীতি-‌রেওয়াজ? একটি পরিবারে মেয়েটি জন্মেছে, বিয়ে করে যাবে অন্য পরিবারে, তাই সে এবার থেকে তার নামের সঙ্গে বহন করবে তার স্বামীর পরিবারের পরিচয়। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—বহু মহিলা এবং পুরুষ ভাবেন, মহিলাদের বিয়ের পরে পদবি পরিবর্তন করতেই হবে। আমি নিজে ম্যারেজ রেজিস্ট্রির সময় দু/একজনকে জোর করতেও দেখেছি পদবি পরিবর্তনের জন্য। বলা বাহুল্য এ ধারণা ভুল, শুধু তাইই নয়, ভারতে এমন কোনো নিয়ম বা আইন কোনোদিনই ছিল না। এবার আরো বড়ো সমস্যা হল এই ভুল ধারণাটা সেই মানুষগুলি শুধু নিজেদের মধ্যেই রেখে দেননা, ছোটদের জানান, এবং কিছুটা জোর করেই মাথায় ঢুকিয়ে দেন। 

এবার আসা যাক তাদের কথায়, যারা আবার মানেন— বিয়ের পর মেয়েদের পদবি পরিবর্তন না করলেও হয়। এই ধরনের উক্তি থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার হয় যে, পদবিটা পরিবর্তন করলেই ভাল! এ ছাড়াও এ নিয়ে সমাজে নানা মন্তব্যই শোনা যায়— ‘‌আজকাল তো বিয়ের পরে পদবি পরিবর্তন করে না মেয়েরা’‌, অথবা ‘‌এখন তো না করলেও হয়, আগে করাটা বাধ্যতামূলক ছিল।’‌
প্রশ্ন হল, এই আগেটা কবে? উত্তর, কোনোদিনই না। বাংলার মানুষ সতীদাহ রদ থেকে শুরু করে বিধবা বিবাহ, বাল্যবিবাহরদসহ অনেক সংস্কারই এনেছেন। আর এ সবের কথা মাথায় রাখলেই, এখনও পদবি নিয়ে গোঁড়ামি করা এবং এই নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়াটা খুবই নিন্দনীয়। 

এবার আরো একটা কথায় আসি। কী হবে পদবি পরিবর্তন করলে আর না করলে? উল্লেখ্য, বিখ্যাত অনেক মহিলারা তাঁদের বিবাহপূর্বক পদবিতে বিখ্যাত হলে সেটাই রাখেন, আর বিবাহের পরে স্বামীর পদবি যদি বেশি বিখ্যাত হয়, তাহলে রেখে দেন সেই পদবি। যেমন জয়া বচ্চন (অমিতাভ বচ্চন), আবার ঐশ্বর্য রাই (নিজের পদবি)। তবে এখানে আরও জটিল একটা ব্যাপার ঢুকে যায়, সেটা হল, জোর করে স্বামীর পদবি নামের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া। এরকমটা হামেশাই হয়ে থাকে আমরা কারুর স্ত্রীকে আর জিজ্ঞেস না করেই স্বামীর পদবিকেই ধরে নিই। যেমন, অনেকেই জানেন না যে, ইনস্টাগ্রামে আয়ুষ্মান খুরানার স্ত্রী রয়েছেন তাহিরা কাশ্যপ নামে। ওটাই তাঁর চিরকালীন নাম। চিরাচরিত ভাবনার দোষে শুধু নামটা জেনে স্বামীর পদবি বসিয়ে খুঁজলে পাওয়া যাবে না! 

এমনিতেই ভারত তথা গোটা বিশ্বে অমুকের মেয়ে, অমুকের স্ত্রী, অথবা অমুকের মা হিসেবে মহিলারা পরিচয় পান। এমনটাও হয় যে, কোনো মহিলা নিজের ক্ষমতায় নিজেকে তৈরি করেছেন, নাম করেছেন, তবু তাঁর বিয়ে যদি স্বল্প পরিচিত কারুর সঙ্গেও হয়, ওমনি অমুকের স্ত্রী বলে  তাঁর পরিচিতি শুরু হয়। বড় উদাহরণ ‘‌জয়া ভাদুড়ি’‌। উনি যথেষ্ট প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগেও। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই উনি ‘‌অমিতাভ বচ্চনের বউ’‌ হয়ে গেলেন। 

মহিলাদের পদবি পরিবর্তন করতে হয় চাপের মুখে, বা অনেকেই দীর্ঘকালীন রেওয়াজের সামনে প্রতিবাদ না করে পদবি পরিবর্তন করে ফেলেন। কিন্তু কেন?  পিতৃতান্ত্রিক সমাজে, পুরুষই মূলত সন্তান এবং পরবর্তীতে  পুরুষই এগিয়ে নিয়ে যাবে পরিবার অথবা বংশের নাম। মহিলারা বিয়ে করে যাবেন পুরুষদের বাড়িতে/পরিবারে।  তাই সেই পুরুষের পরিবারের পদবি গ্রহণ করবেন বিয়ে হয়ে আসা মহিলা। তবে এখন সমাজে এই ভাবনার পরিবর্তন হয়েছে বেশ কিছুটা। এখন কেউ কাউকে জোর করে না (অবশ্য সব ক্ষেত্রে না), মহিলারা নিজেরাই পরিবর্তন করে নেন, আবার অনেকে করেন না। কথা হচ্ছে, বিয়ে করলাম, স্বামীর পরিবারের পদবিও নিলাম না। বেশ, খুবই ভাল। এতে কি আমার, মানে একজন মহিলা হিসেবে, আমার পরিচয় আমি ধরে রেখে দিতে পারলাম? 

আমি রোশন কুমার, আমার বাবার নাম ছিল শীতল চন্দ্র কুমার, আমি বিয়ে করে পদবি পরিবর্তন না করলেই বা কি? কুমারটাও তো আমার বাবা মানে এক পুরুষেরই পদবি! আমার মা নিজের পদবি পরিবর্তন করেননি। তবে কি তার নিজের, একজন মহিলা হিসেবে পরিচয়টা টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন? মায়ের পদবি দত্ত। এটাও তার বাবার পরিবারের পদবি। তাহলে? কোথায় মহিলার পরিচয়? কোথায় মায়েরা? কোথায় মেয়েরা? 

পদবি পরিবর্তন করলেও বা না করলেও, নারীর পরিচয় যদি তার কাজে না হয়, অন্য পুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের ভিত্তিতে হয়, তাহলে সেটাও নির্ভরশীলই থাকা হল। অমুকের স্ত্রী, মা, দিদি, বোনের বাইরে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তবেই সেটা এগোনো হবে, নচেৎ মহিলাদের ক্ষেত্রে, ‘‌নিজের পদবিটাও কিন্তু আরেকটা পুরুষেরই।

প্রতীকী ছবি

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী

0 Comments

Post Comment