- 23 April, 2023
- 0 Comment(s)
- 1032 view(s)
- লিখেছেন : সাইদুর রহমান
দিদির যখন বিয়ের প্রস্তাব এল তখন দিদি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। বোন রূপতাজ সবে সপ্তম শ্রেণির। মাত্র বারো বছর বয়সেই রূপতাজ বুঝে গিয়েছিল আঠারো বছর বয়সের আগে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। বাবা-মাকে বোঝাতেও পেরেছিল সে। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দিদির বিয়ে। কিন্তু বোঝাতে পারেনি পিতৃতান্ত্রিকতার জঠরে লালিত পাত্রকে। ওইটুকু বাচ্চার এত দেমাক! অতএব। অ্যাসিড ঢেলে ঝলসে দেওয়া হয়েছিল বছর বারোর কিশোরী রূপতাজের প্রতিবাদী মুখ। সমাজের চোখে অ্যাসিড পোড়া রূপতাজ অদম্য জেদ আর প্রতিবাদী মানসিকতার জোরে এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে সফলতার পর সংবাদ মাধ্যমে খবরও হয়েছিল সে। কিন্তু, এরপর! আমরা আর খবর রাখিনি। এবং আমরা খবর রাখিনা। আর এভাবেই তারা হারিয়ে যায়। যেমন হারিয়ে গেছে আয়েসা।
আয়েসা যখন ফার্স্ট ইয়ার, এক তরুণের প্রেমে পড়ল। মাঝপথে জানতে পেরেছিল ছেলেটি ড্রাগাসক্ত। সম্পর্ক চুকিয়ে দিতে সময় নেয়নি আয়েসা। সরে এসেছিল সে। একদিন কলেজ যাওয়ার পথে এক কাপ অ্যাসিড আছড়ে পড়েছিল তার ডান গালে। বুক পর্যন্ত মাংস দলা পাকিয়ে গেল। অন্ধ হল ডান চোখ। কেউ কেউ চেঁচিয়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু তারা এটাও বলেছিল, ‘সব দোষ ওই ছুঁড়িটার! ছেলেদের সাথে ওইভাবে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরতে লজ্জা করে না!’
একইভাবে হারিয়ে গেছে বেঙ্গালুরুর আর এক একাদশ শ্রেণির সোনালি, তামিলনাড়ুর সফটওয়্যার কর্মী বিনোদিনী, হাসিনা, মাবিয়া, লক্ষ্মী আগরওয়াল, মহুয়া, মনীষা পৈলান, সঞ্চয়িতা যাদব, ঝুমা সাঁতরা, মনিকা মণ্ডল, পম্পা দাস প্রামাণিক, সুনীতি কর্মকার, পলি দেবনাথ, সাহানারা খাতুন, বিপ্লবী, সুহানা— আরও অনেক অনেক, কয়েক শত, হাজার। নামগুলো ক্রমে সংখ্যায় পরিণত হয়। শুধু মনে থেকে যায় তাদের দলা পাকানো মুখগুলো।
ভাবা গিয়েছিল সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অ্যাসিড আক্রান্তের সংখ্যা দেশে কমে যাবে। ভাবনায় ভুল ছিল। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশে অ্যাসিড আক্রান্তের সংখ্যা ক্রম ঊর্ধ্বমুখী। শেষ পাঁচ বছরে ভারতে প্রায় দেড় হাজারের মতো অ্যাসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে। তালিকায় সবার উপরে আমাদের রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ। দ্বিতীয় স্থানে উত্তর প্রদেশ। অবশ্য উত্তর প্রদেশও মাঝে মাঝে প্রথম স্থান দখল করে। এরপরেই একে একে এসে পড়ে উড়িষা, পঞ্জাব, বিহার, কর্ণাটক প্রভৃতি রাজ্যগুলির কথা।
অ্যাসিড ছোঁড়ার পেছনে পারিবারিক বিবাদ, দাম্পত্য কলহ, ব্যক্তি সম্পর্কের টানাপোড়েন, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়া— এসব থাকলেও আসলে এটি এক ধরনের প্রতিশোধস্পৃহা। প্রতিহিংসা থেকে এর উৎপত্তি। এর শিকার হতে হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের। নারী শরীরের প্রতি অধিকার বোধকে জাগিয়ে তোলার অদম্য বাসনা, অন্য কাউকে ভোগ করতে দেব না— পিতৃতন্ত্রের এই অন্যায় অধিকার বোধ থেকেই প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম নেয়। এর পেছনে থাকে যুগ যুগ ধরে পুরুষের ক্ষমতার ঔদ্ধত্য, আত্মগরিমা। তোর চেয়ে আমার ক্ষমতা কত বেশি— আত্মকেন্দ্রিক পিতৃতন্ত্রের শারীরিক ক্ষমতার এই পাশবিক দম্ভ একজন পুরুষকে উত্তেজিত, ক্রমে হিংস্র করে তোলে।
এবং পিতৃতন্ত্রের ক্ষমতার এই অসম লড়াইয়ের মাঠে কিন্তু ওই ‘অ্যাসিড পোড়া’ মেয়েটি সম্পূর্ণ একা। ওই লড়াই তাঁর একেবারে নিজস্ব। সেই লড়াই তাঁর সমাজের সাথে, পরিবারের সাথে এবং নিজের সাথে নিজের। এতদিনের চেনা পৃথিবীটা হঠাৎ করেই যেন পালটে যায়। স্কুলে, কলেজে, অফিসে, আদালতে, পরিবারে, বন্ধু-বান্ধবীদের মাঝে— সবাই আড়চোখে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। কিংবা তাকিয়ে থাকেনা— ভয়ে কুঁকড়ে যায় অনেকেই। পাড়ার শিশুরা ভয়ে মায়ের কোলে মুখ লুকায়। সব দিক থেকে একসাথে ভেসে আসে— ‘ওই মেয়েটি অ্যাসিড পোড়া’। কেউ বা বলে ‘বাচ্চাদের সামনে ওইভাবে এসোনা বাছা’। ফলে নিজের সাথে নিজের, নিজের সাথে সমাজের, কোথাও বা নিজের সাথে রাষ্ট্রের— প্রতিনয়ত লড়াই করতে করতে কখন কোনও এক সময় সে হারিয়ে যায়।
অথচ, আমরা একটু সচেতন হলে, আমাদের সরকার সঠিক ভাবে আইন বলবৎ করলে অ্যাসিড ছোঁড়া এতটা সহজ হত না। সুপ্রিমকোর্ট এক আইন বলে অ্যাসিড বিক্রির উপর নানা শর্ত আরোপ করে প্রকাশ্যে অ্যাসিড বিক্রি একপ্রকার বন্ধ করার কথা বলেছে। অথচ সেই আইনের কঠোর প্রয়োগ সেভাবে হচ্ছে না। কে কেন অ্যাসিড কিনছে, যে অ্যাসিড কিনছে— তার নাম, ঠিকানা, বয়স, যোগাযোগ করার সমস্ত কিছু লিখে রাখলে খুব ভাল হত। অ্যাসিড আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও এখনও প্রকাশ্য, খোলা বাজারে অ্যাসিড বিক্রি হচ্ছে। প্রশাসন দেখেও দেখছে না। খোলা বাজারে অ্যাসিড বিক্রি বন্ধ হলে দেশে মেয়েদের উপর অ্যাসিড হামলা অনেকটাই কমে যেত। এছাড়াও অপরাধীর কঠোর শাস্তি হওয়া খুবই জরুরী। কিন্তু সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে সরকার ভীষণই উদাসীন। অপরাধী তার অপরাধ করে প্রকাশ্য রাস্তায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক অ্যাসিড আক্রান্ত মহিলা সঠিক সময়ে, সঠিক ভাবে ক্ষতিপূরণের টাকা পর্যন্ত পাচ্ছে না। এবং এখানেই সমাজের সমস্ত মানবাধিকার কর্মী থেকে সমাজকর্মী— সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার। তবে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র যদি তার দায়িত্ব পালন না করে, এগিয়ে আসতে হবে সমাজকে, সমাজের ভুক্তভোগীদেরকে। তাই সমস্ত ভুক্তভোগী, প্রতিবাদী হাত আজ এই দুঃসময়ে এক হোক।
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১২ অক্টোবর ২০২০
প্রতীকী ছবি সংগৃহীত
লেখক : শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক ও সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment