সাহিত্যে নারীত্বের নির্মাণ (পর্ব-৩)

  • 27 August, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 814 view(s)
  • লিখেছেন : তামান্না
ইন্দির ঠাকরুন বিধবা তাই পুনরায় বিয়ে করতে পারেননি। পরিবার ও সমাজের কাছে বিধবারা কোন মর্যাদা পেতেন না। আবার সর্বজয়ার চরিত্র চিরন্তন মমতাময়ী মায়ের। দারিদ্র্যের সংসারে ইন্দির ঠাকরুনকে বাড়তি মনে করেছেন। সর্বজয়া পুত্র অপূর্বর প্রতি একটু বেশি পক্ষপাত করেছেন। তাকে পাঠশালা পড়তে পাঠিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে দুর্গা মেয়ে বলে তার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছেন। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে কেবলমাত্র দারিদ্র্যের কারণেই কী এই পুত্র-কন্যার বিভেদ? নাকি পিতৃতন্ত্র মানসিকতার ফল?

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নারীচরিত্রগুলির মধ্যে স্বতন্ত্রতা লক্ষ্য করা যায়। তাঁর চরিত্ররা বেশিরভাগ পল্লীগ্রামের স্নিগ্ধ, কোমল, মমতাময়ী নারী। সমাজের সহায় সম্বল অসহায় গৃহবধূ, বিধবা, কিশোরীদের সঙ্গে লেখক আমাদের তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর রচনায় সর্বজয়া,অন্নপূর্ণা, ইন্দির ঠাকরুন, ক্ষেন্তি, দুর্গা, সুনন্দার মত চরিত্ররা স্বমহিমায় উপস্থিত হয়েছেন। এই সকল নারীদের মধ্যে আমরা দেখেছি মায়া মমতা। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে দুর্গা ভাই অপুকে মুষল বৃষ্টির সময় পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরেছে।

 

পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চরমতম দিকটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। হরিহরের দূর সম্পর্কের বিধবা দিদি ছিলেন ইন্দির ঠাকরুন। একজন বিখ্যাত কুলীনের সঙ্গে ইন্দির ঠাকরুনের বিয়ে হয়েছিল কিন্তু অল্পবয়সে তিনি বিধবা হন। তারপর তাঁর শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়িতে ঠাঁই হয় না! বিধবা নারীদের নিদারুণ কষ্টের চিত্র লেখক সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছিলেন। ইন্দির ঠাকরুন বিধবা তাই পুনরায় বিয়ে করতে পারেননি। পরিবার ও সমাজের কাছে বিধবারা কোন মর্যাদা পেতেন না। আবার সর্বজয়ার চরিত্র চিরন্তন মমতাময়ী মায়ের। দারিদ্র্যের সংসারে ইন্দির ঠাকরুনকে বাড়তি মনে করেছেন। সর্বজয়া পুত্র অপূর্বর প্রতি একটু বেশি পক্ষপাত করেছেন। তাকে পাঠশালা পড়তে পাঠিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে দুর্গা মেয়ে বলে তার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছেন। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে কেবলমাত্র দারিদ্র্যের কারণেই কী এই পুত্র-কন্যার বিভেদ? নাকি পিতৃতন্ত্র মানসিকতার ফল?

ইন্দির ঠাকরুন, সর্বজয়া, দুর্গা—তিন প্রজন্মের প্রতিনিধি। উপন্যাসে আমরা দেখছি এই তিন প্রজন্মই দুঃখ- দুর্দশা-দারিদ্র্য অবহেলার শিকার হয়েছেন।

 

 

‘পুঁইমাচা’ গল্পে বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথার মত সমাজের কুৎসিত দিকগুলি তুলে ধরেছেন বিভূতিভূষণ। বছর চল্লিশের পাত্রের সঙ্গে কিশোরী ক্ষেন্তির বিয়ে হয়। ক্ষেন্তির অসহায় বাবা  সহায়হরি যৌতুকের টাকা একবারে শোধ করতে পারেননি। তিনি ধীরেসুস্থে টাকা পরিশোধ করছিলেন। এরফলে ক্ষেন্তির শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচার বাড়তে থাকে। এর কিছুদিন পর ক্ষেন্তির বসন্ত রোগ হয়, তারপর সে মারা যায়। ক্ষেন্তি অসুস্থ হলে তার গয়না খুলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাঁকে এক আত্নীয়ের বাড়িতে রেখে আসে। সাধারণ একটি পরিবারের কাহিনি অসাধারণ ভাবে লেখক লিখেছেন। সমাজের কুপ্রথার ফলে এরকম হাজার হাজার অসহায় ক্ষেন্তি মারা গেছে।

 

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নারী চরিত্রগুলি সৃষ্টি করেছিলেন যত্নের সঙ্গে, তাঁর গল্প উপন্যাসে গ্রাম বাংলার অতি সাধারণ বাস্তব নারীরা এসেছেন। তিনি খুব ভাল ভাবে জানতেন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কতটা অবহেলিত, সেইকারণে তিনি তাঁর গভীর বোধ দিয়ে স্বতন্ত্র নারী চরিত্র আঁকতে চেয়েছিলেন। ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে অসহায় নারীদের অবহেলার পাশাপাশি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই উপন্যাসে আবার সুখী নারীদের দেখাও মেলে। অনিরুদ্ধের স্ত্রী পদ্ম, দেবুর স্ত্রী বিলু, রাঙাপিসি, পাতুর স্ত্রী সকলেই সুখী। বিয়ের পরে শাশুড়ির অত্যাচারে দুর্গা জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। সে সুখী ছিল না। তারপরে দেখা যায় দুর্গা একসময় স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছে। সে তাঁর প্রেমিক নির্বাচন করেছে।

 

তারাশঙ্কর মোট তিনটি গল্প রচনা করেছিলেন স্বর্ণকে নিয়ে। প্রথমটি প্রকাশিত হয় ‘ডাইনির বাঁশি’ শিরোনামে ভারতবর্ষ পত্রিকার ১৩৪০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায়। এছাড়া পরের দুটি গল্পেরই শিরোনাম ‘ডাইনি’। একটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪০ সালে প্রবাসী পত্রিকার আষাঢ় সংখ্যায়। শেষ গল্পটি প্রকাশিত হয় ১৯৫১সালে মৌচাক পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায়।

‘আমার সাহিত্য জীবন রচনায়’ ‘ডাইনির বাঁশি’ গল্প নির্মাণের উল্লেখ পাওয়া যায়- “বাড়ি ফিরলাম। ফিরে আবার বসলাম কাগজ কলম নিয়ে। লিখলাম ‘ডাইনির বাঁশি’ বলে একটি গল্প। এ গল্পটি সত্যকার একটি ভাল গল্প। আমাদের গ্রামে ছিল গন্ধবণিকদের মেয়ে – নিঃসন্তান বিধবা – স্বর্ণ; লোকে বলত সে ডাইনি। সনা ডাইনি ! আমাদের বৈঠকখানা বাড়ির সংলগ্নশাল-পুকুরের উত্তর পূর্ব কোণে অশ্বত্থতলায় ছিল তার বাড়ি।” (তথ্যসূত্রঃ আমার সাহিত্য জীবন, প্রথম পর্ব, পৃ-৮৭)

সমালোচকরা  আবার ‘ডাইনি ’ শিরোনামে মৌচাকে প্রকাশিত শেষ গল্পটিকে ‘ডাইনির বাঁশি ’ গল্পের উৎস হিসাবে গণ্য করেন। “আমার অনেক বয়স  পর্যন্ত স্বর্ণ বেঁচেছিল। আমরা স্বর্ণপিসী বলতাম। বেচারী গ্রামের ভদ্রপল্লী থেকে দূরে – জেলে পাড়ার মোড়ে একখানি ঘর বেঁধে বাস করত। সে পথে যেতে-আসতে দেখেছি, বুড়ি ঘরের মধ্যে আধো-আলোর মধ্যে বসে আছে। চুপ করে বসে আছে। কথা বড় কারও সঙ্গে বলত না। কেউ বললেও তাড়াতাড়ি দু-একটা জবাব দিয়ে ঘরে ঢুকে যেত। তার শেষ কালটায় আমি বুঝেছিলাম তার বেদনা। মর্মান্তিক বেদনা ছিল তার। নিজেরও তার বিশ্বাস ছিল, সে ডাইনি । কাউকে স্নেহ করে সে মনেমনে শিউরে উঠত। কাউকে দেখে চোখে ভাল লাগলে সে সভয়ে চোখ বন্ধ করত…”(তথ্যসূত্র-আমার কালের কথা, দশম খণ্ড,পৃ-৩৮৬) ‘ডাইনির বাঁশি’ গল্পের শেষে ফুটে উঠেছে ‘ডাইনি’ অপবাদে কলঙ্কিত নারীর প্রতি তারাশঙ্করের সহানুভূতি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী

ছবি : সংগৃহীত

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment