- 28 May, 2024
- 0 Comment(s)
- 353 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
সাত থেকে সত্তর সকলের হাতের কাছে বিনোদনের মেশিন রয়েছে। সংসারের কাজ ফুরোলে তবেই টিভি খুলে বাড়ি সুদ্ধ মহোৎসবে বসতে হবে সে যুগও অতীত। মুঠোফোন রান্নাঘরের নিরাপদ স্থানে দাঁড় করিয়ে চোখের আরাম নিতে নিতেই কাজ চলে। রাস্তায় দেখতে পাই, বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা অথবা বাসে ট্রেনে চলতে থাকা যাত্রীরাও মোবাইলে মনোযোগ দিয়ে সময় পার করছেন। কেউ গান শুনছেন, কেউ খবর, কেউবা খেলা দেখছেন। কিন্তু আড়চোখে অন্যের মোবাইলে উঁকি দেওয়া অশোভন হলেও ভিড়ঠাসা যানবাহনের অবস্থানের জন্যই মোবাইল চোখের সামনে দোল খেয়ে যায়। আর দেখতে পায় নিত্যযাত্রীদের চেনাচোখগুলো হাতের মেশিনে গভীর মনোযোগে আটকে আছে। চলছে ‘কার কাছে কই মনের কথা’ ধারাবাহিক। আর উঁকিঝুঁকি নয়। গার্হস্থ্য হিংসার বিরুদ্ধে দলবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানো পাড়ার বউদের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। মনে হল, এই তো এভাবেই পিতৃতন্ত্রের ছককে ভেঙে দেওয়ার পথ নিয়েছে গণমাধ্যম। নায়িকা শিমুলের ওপর শ্বশুরবাড়ি প্রবল অত্যাচার শুরু করেছে। পাড়ার প্রতিবাদী বউরা রুখে দাঁড়াচ্ছে। থানায় অভিযোগ করছে। শিমুল দেখা দিল ব্যক্তিত্ত্বময়ী স্বতন্ত্র নারী হয়ে। মেয়েদের প্রতি চাপানো বঞ্চনা, শোষণের বিরুদ্ধে আত্মমর্যাদাপূর্ণ এক প্রবল কণ্ঠস্বর। শাশুড়ি, দেওর, ননদ, বরের প্রতি কর্তব্য পালনে অটুট থাকতে চেয়েছে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই। শিমুলের প্রতি অত্যাচার তীব্র হল। আজীবন অত্যাচারিত হয়ে বেঁচে থাকা শাশুড়ি একসময় নিজের ভুল বুঝতে পেরে শিমুলকে অত্যাচার করা বন্ধ করল। কিন্তু বর আর দেওরের ষড়যন্ত্রে শিমুল একবার মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে এবং একবার জেলও খাটে। জটিল পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে শিমুলের মুখে নারীবাদের বুলি বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। অপরদিকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যে নারীর জীবনাচরণকে তারিফ করে, আকৃষ্ট হয়, শিমুলের জীবনকে সেই ধারাতেই প্রবাহিত করে দেন পরিচালক।
শিমুলের বর যৌন নির্যাতন করে। অন্য নারীকে ভালোবাসে। শিমুলের কাছে ডিভোর্স চায়। শিমুল ডিভোর্স দেয়। কিন্তু বরের বাড়িতেই থাকে। বরের দ্বিতীয় বিয়েতে শাশুড়ি একা পরিশ্রম করতে পারবে না। তাই নিজ মহত্ত্বে কাজের ভার কাঁধে তুলে নেয়। ননদের বিয়ের দায়িত্ব পালন করে। বিবাহ বিচ্ছেদের পর বরের আশ্রয়ে থেকেই ক্রমশ মা দুর্গার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে থাকে। দশহাতে কাজ করে সমাজের তারিফ যোগাড় করে। কলেজজীবনের প্রেমিক কিন্তু শিমুলকে ভালোবাসে। সে শিমুলকে বিয়ে করতে চায়। শিমুলও পাড়ার বান্ধবীদের কাছে স্বীকার করে সে তার প্রেমিককেই ভালোবাসে। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেছে বলে সব ভুলে বরকে ভালবাসতে চেয়েছিল। নারীবাদ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে কাহিনি শুরু করে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল প্রতিবাদী মেয়েদের মুখগুলোকে। শিমুল দশভুজা হয়ে সব সামলাতে শুরু করে। প্রাক্তন বরের আর বিয়ে দেননি পরিচালক। তাহলে শিমুলের সতীসাধ্বী নারী হয়ে বরের সাথে সাত জনমের সম্পর্ক প্রমাণ করতে পারতেন না। দর্শকের মগজে হিন্দু নারীর আদর্শ ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব হত না। নৃত্য পটীয়সী শিমুল মঞ্চে নাচ দেখিয়ে দর্শককে তাক লাগিয়েছে। কিন্তু নাচকে পেশা হিসেবে নিয়ে আত্মসম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেনি। মাঝে মধ্যে শুনিয়েছে আয়োজকরা টাকা দেয়। অথচ একবারও সে বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে জীবন গড়ার চেষ্টা করেনি। শাশুড়ি অনেক সময় শিমুলের বিপক্ষে গিয়ে ছেলেদের পক্ষ নিয়েছে। তবু ওই আশ্রয় আঁকড়েই পড়ে আছে শিমুল। ভালোবেসেও প্রেমিককে ফিরিয়ে দিয়েছে। দুর্ঘটনায় প্রাক্তন বর পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর আর স্কুলের চাকরিটি করতে পারবে না বুঝে শিমুলকে অনুরোধ করেছে তার চাকরিটি নেওয়ার জন্য। নইলে সংসারে অনটন শুরু হয়ে যাবে। তবে চাকরি নেওয়ার আগে কিছুদিনের জন্য হলেও তাকে আবার প্রাক্তন বরকেই বিয়ে করতে হবে। পিতৃতন্ত্রের ধারক ও বাহক শিমুলের নিজের মান-মর্যাদার কথা ভাবলে তো চলবে না। স্কুলে চাকরি করার যদি যোগ্যতাই থাকে তবে নিজের যোগ্যতাই তাকে কখনও আবেদন করতে দেখা গেল না কেন? যে সবার ত্রাতা হয়ে আর্বিভূত হচ্ছে বারবার, তাকে নিজের ত্রাতা হতে তো একবারও দেখা গেল না। আবার প্রাক্তন বরকে বিয়ে করে তার স্কুলের চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করল। শুধু তাই নয় যেন সাত জনমের সম্পর্কের বরকে পেয়ে সে খুব সুখী। অবশ্য পরিচালক জানিয়ে দিয়েছেন শিমুলের বর পালটে গেছে। সে বুঝতে পেরেছে তার ভুলগুলো। এই ভুল ভাঙতে ভাঙতে শিমুলের জীবনের ওপর দিয়ে কেটে গেল অনেকগুলো অন্ধকার দিন। কখনও রাতের আঁধারে বাড়ির বাইরে বের করে দেওয়া, নাক খত দেওয়ানো, যৌন নির্যাতন, শারীরিক অত্যাচার, বিষ খাওয়ানো, চোর অপবাদ, বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চাওয়ার মিথ্যা অপবাদে জেল খাটানো— সহনশীলতার এতগুলো অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে সাধ্বী নারীর তকমা পেতে চলেছে শিমুল। এমন নারীকেই তো সমাজ বাহ্ববা দেয়। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে, অপমানে জর্জরিত জীবন ত্যাগ করে বেরিয়ে আসা বিদ্রোহিনী নারীকে সমাজ সুনজরে দেখে না। সংগ্রাম করে টিকে থাকা নারী, লড়াকু নারী, প্রতিবাদী নারী পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নজরে বেহায়া, বেয়াদব। তাই সমাজের চোখে-মনে যা সুখ দেয় তাকে দেখানোই যেন এইসব ধারাবাহিকের মহান দায়িত্ব। নারীর ক্ষমতায়ন তৈরির বুলি কপচে নাটক শুরু হয়েই তা বিলীন হল। আর্থিক স্বনির্ভরতা ছাড়া ক্ষমতায়নের বাণী অসত্য। এই ধারাবাহিকের নায়িকা সেই ক্ষমতায়নের বাণী দিয়ে যাত্রা শুরু করে বৈবাহিক জীবনের প্রথাগত পীড়নযন্ত্রে নিজেকে শুদ্ধ করে সমাজের সংক্রমিত মগজকে আরও চাঙ্গা রাখছে।
0 Comments
Post Comment