- 19 October, 2022
- 0 Comment(s)
- 282 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
এঁর সম্পর্কে জেনেছিলাম কাজেরই সুবাদে। একটি চিঠি অনুবাদ করতে গিয়ে। যদিও কাজটি কিয়দর্থে নিজে থেকেই যেচে নিয়েছিলাম বলা যায়। ২০২১এ সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভের নোবেল প্রাপ্তির পরেপরেই তাঁর কাগজ ‘নোভায়া গ্যাজেটা’র বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী হয়ে পড়ি। সাম্প্রতিক ইউক্রেন সংঘাতের সময়ও সেই নোভায়ারই রিপোর্টিংয়ের উপর ভরসা রেখে চলেছি। যদিও রাশিয়াতে এ কাগজ নিষিদ্ধ। এমনকি বৈদ্যূতিন মাধ্যমেও। বোধহয় ইউরোপেরই অন্য কোনও একটি দেশে আশ্রয় নিয়ে মুরাতভ ও তাঁর সঙ্গীরা এই কাগজ বের করে চলেছেন। সেখানেই দেখলাম গত ৭ই অক্টোবর জনৈক সাংবাদিক আনা পোলিতকোভস্কায়াকে উদ্দেশ্য করে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন গণিতবিদ ও মানবাধিকার কর্মী একজন। শ্বেতলানা গানুশকিনা তাঁর নাম। তাঁর সম্পর্কে দেখতে গিয়েও অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম তিনি একাধারে গণিতবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তদুপরি মানবাধিকার কর্মী। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিভিন্ন ভেঙে যাওয়া দেশগুলিতে, এমনকি রাশিয়ার অভ্যন্তরেও যখন হানাহানি শুরু হল, তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত সেসমস্ত এলাকার মানুষ, শরণার্থী, তাদেরকে নিয়েই কাজ করতে করতে শ্বেতলানার মানবাধিকার কর্মী হয়ে ওঠা। পৃথিবীতে তাঁর কাজ এতটাই সমাদৃত হয় যে, ২০১০ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য অবধি বিবেচিত হয়েছিলেন। শেষ অবধি নোবেল না পেলেও, রাশিয়ার শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অত্যন্ত পরিচিত নাম এই গানুশকিনা। অন্যদিকে তিনি চিঠি লিখছেন প্রয়াত সাংবাদিক আনা পোলিতকোভস্কায়াকে। চিঠি লিখছেন তাঁরই মৃত্যুদিনে, ৭ই অক্টোবর। ২০০৬ সালের ৭ই অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে নিহত হন আনা। ৭ই অক্টোবর, এই তারিখটিরও বিশেষ একটি তাৎপর্য আছে। ক্রমশ সেই কথায় আসব।
আনা পোলিতকোভস্কায়া, জন্ম ৩০শে আগস্ট ১৯৫৮। রুশ সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী। ১৯৯৯ থেকে ২০০৫, দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের সময়ই তিনি তাঁর সাংবাদিকতার মাধ্যমে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। আমরা বলব, হলিউডি সিনেমার চাইতেও ভয়াবহ তাঁর জীবন। এতটুকুও অত্যুক্তি করছি না। তাঁর জীবনের গল্প থেকেই উঠে আসবে সেসব। তাঁর মা বাবা দুজনেরই জন্ম ইউক্রেনে। কর্মসূত্রে তাঁরা রাষ্ট্রপুঞ্জে সোভিয়েত ইউনিয়নের তরফে কূটনীতিক ছিলেন। আনার বড় হয়ে ওঠা মস্কো শহরে। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির স্কুল অব জার্নালিজম থেকে ১৯৮০ সালে তিনি স্নাতক হন। এই সময়ের পর থেকেই কখনও, কোনও অবস্থাতেই তিনি একাধিক সপ্তাহের বেশি রাশিয়ার বাইরে কাটাননি। এমনকি যখন তাঁর জীবন সংশয় হতে শুরু করেছিল, তখনও নয়। মনে রাখতে হবে, তাঁর বৈধ মার্কিন পাসপোর্ট ও মার্কিন নাগরিকত্ব ছিল। কিন্তু আমৃত্যু তিনি তাঁর রুশ নাগরিকত্বকে পরিত্যাগ করেননি।
কেরিয়রের শুরুতে বিভিন্ন কাগজে সাংবাদিকতা করলেও, ১৯৯৯ সালের জুন মাসে আনা নোভায়া গ্যাজেটা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। এই কাগজ সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়ার বিবিধ মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘটনাকে তদন্তমূলক সাংবাদিকতার মাধ্যমে সামনে তুলে আনার জন্য ও সর্বোপরি নির্ভীক সাংবাদিকতার জন্য সুপরিচিত ছিল। জুন, ১৯৯৯এর পর থেকে আমৃত্যু আনা নোভায়া গ্যাজেটারই সাংবাদিক ছিলেন। ইতিমধ্যে তাঁর বিবাহ হয়, তিনি দুই সন্তানেরও জন্ম দেন। কাজ করতে করতেই তিনি সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়ার প্রশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে একাধিক বই লেখেন। পুতিন’স রাশিয়া নামক বিখ্যাত বইটি তিনিই রচনা করেন। কিন্তু আনা পোলিতকোভস্কায়া বিখ্যাত হয়ে ওঠেন চেচেন যুদ্ধের সাংবাদিকতায়। ১৯৯৯ সাল থেকে দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ শুরু হলে পরে আনা প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক হিসেবে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে সফর করেন। শরণার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শন করেন ও উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কথা বলেন। রুশ সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ও চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তরফেও মানবাধিকার বিরোধী সমস্ত সন্ত্রাসের ঘটনা, দুইই একই সঙ্গে তাঁর সাংবাদিকতায় উঠে আসে। এই কাজের ফলে একাধিক বার তাঁর জীবন বিপন্ন হয়। কখনও কখনও এই সমস্ত সফরে পূর্বে যাঁর নাম বলে এসেছি, সেই শ্বেতলানা গানুশকিনাও আনার সফরসঙ্গী হতেন। একাধিক বারে এমন ঘটনা ঘটে যে, তাঁরা কোনও একটি এলাকায় খবর সংগ্রহের জন্য গিয়েছেন – তাঁরা সেই এলাকা থেকে সরে আসার মুহূর্ত মাত্র পরেই সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হানা হয়েছে অথবা বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে। এতদসত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের খবর সংগ্রহের কাজ থেকে সরে আসেননি। চেচেন জঙ্গিদের নৃশংসতা, রুশ বাহিনীর অত্যাচার, ভুয়ো সংঘর্ষের মাধ্যমে নিরীহ চেচেন যুবকদের হত্যা, ও একইসঙ্গে পুতিন-পন্থী চেচেন নেতা আখমাদ কাদিরভ ও তার পুত্র রামজান কাদিরভ (যাকে কি না তিনি ‘চেচনিয়ার স্তালিন’ বলে সম্বোধন করেছিলেন), তাদের তরফে চালানো একনায়কতন্ত্র, এবং এই সবকিছুর মাঝে পড়ে সাধারণ মানুষের অবস্থা – এই সবই আনার রিপোর্টে দ্বর্থ্যহীন বর্ণনায় উঠে আসতে শুরু করে। স্বভাবতই ক্ষমতায় থাকা সকলেরই কাছে আনা চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন।
২০০১ সালের গোড়ার দিকে চেচনিয়ার খাট্টুনি গ্রামের কাছে রুশ সেনাবাহিনী আনা পোলিতকোভস্কায়াকে গ্রেপ্তার করে। সেই সময় তিনি ওই এলাকাতে ভূমিপুত্র চেচেনদের উপর রুশ মদতপুষ্ট যৌথবাহিনী যে অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিষয়ে তদন্ত করছিলেন। সেখানে নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ধাঁচে শিবির গড়ে তোলা হয়েছিল। পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সকলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অস্ত্র প্রয়োগ করা হত। এই সময় তিনি এক চেচেন বৃদ্ধার সাক্ষাৎকার নেন যাঁর উপরে কি না তার আগে ১২দিন ধরে বন্দি করে রেখে অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়েছিল। বৈদ্যুতিক শক দিয়ে অথবা একাকী গভীর কুয়োতে ফেলে রেখে তাঁর উপর অত্যাচার চালানো হয়েছিল। রুশ সেনাবাহিনী আনাকে আটক করার পর তাঁকেও নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে মারা হয় ও তাঁর উপর তীব্র মানসিক অত্যাচার চালানো হয়। আনাকে তাঁর সন্তানেদের ছবি দেখিয়ে তাদের সঙ্গে কি করা হবে সেই বর্ণনা শুনিয়ে শুনিয়ে তাঁকে মানসিক ভাবে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হতে থাকে। শারীরিক ভাবেও, শরীরের বিভিন্ন জায়গাতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তাঁকে আঘাত করা হয়। শেষ অবধি তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই বলে তাঁকে রাতের অন্ধকারে চোখ বেঁধে একটি মাঠের উপর নিয়ে গিয়ে দাঁড় করানো হয়। ফায়ারিং স্কোয়াডের মতোই চিৎকার করে হুকুম দেওয়া হয়। আনার কথায়, “সেই হুকুম আমার কানে আসা মাত্রই, আমি প্রচণ্ড এক গোলার শব্দে জ্ঞান হারাই। আমার মনে হয়েছিল আমার জীবন শেষ।” কিন্তু বস্তুত তাঁকে একটি বিশাল ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকারী যন্ত্রের তলায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করানো হয়েছিল, এবং সেই অবস্থাতেই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। প্রবল এই মানসিক চাপে, মৃত্যুর মুখোমুখি তাঁকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে আনার মনোবল ভেঙে দেওয়াই রুশ বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য ছিল। (এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই হয়তো আনার ঘটনার সঙ্গে ফিওদর দস্তয়েভস্কির জীবনেরও বিশেষ একটি ঘটনার মিল পেতে পারেন। তাঁকেও এমনই এক নকল মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, এবং সেই ঘটনার পর থেকেই দস্তয়েভস্কির মনে অন্যরকম এক সংবেদনশীলতার ছাপ পড়তে শুরু করে) আনারও নিপীড়ন এখানেই শেষ হয়নি।
অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে, ২০০২ সালে মস্কোর একটি থিয়েটারে পণবন্দি সংকট তৈরি হয়। সে সময় চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ও রুশ প্রশাসনের মধ্যে মধ্যস্থতায় আনা অনেকাংশে সহায়তা করেন। এরপর ২০০৪ সালে বেসলানের একটি স্কুলে একই রকমের পণবন্দি সংকট তৈরি হলে পরে তিনি সেখানেও মধ্যস্থতা করতে চেয়ে মস্কো থেকে বিমানে বেসলানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বিমানেই বিষপ্রয়োগে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। পাঠক কি ২০২০ সালের আগস্টে রাশিয়ার আরেক বিরোধী রাজনৈতিক নেতা এ্যালেক্সেই নাভালনিকে মাঝআকাশে বিষ প্রয়োগে হত্যার যে প্রচেষ্টা হয়, তারই সঙ্গে এর মিল দেখতে পাচ্ছেন? সেই ২০০৪ সালেই পুতিনের হাতের পুতুল, চেচনিয়ার তৎকালীন ‘প্রধানমন্ত্রী’ রামজান কাদিরভের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার চলাকালীন, কাদিরভের এক সহযোগী আনাকে সম্বোধন করে বলে ওঠে, “তোমাকে মস্কোতেই গুলি করে মারা উচিত, যেমনটা মস্কোতে (ওরা) মেরে থাকে ...” কাদিরভ নিজেও এই বক্তব্যকে সমর্থন করে বলে ওঠে, “সত্যিই, তুমি আমাদের শত্রু – গুলিই তোমার জন্য সঠিক উপহার ...”
মৃত্যুর দিন আনার তরফে এই কাদিরভেরই ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী ও তাঁদের অত্যাচারের বিবরণ সম্পর্কে একটি দীর্ঘ তদন্তমূলক রিপোর্ট জমা করার কথা ছিল। এছাড়াও চেচেন স্কুলছাত্রদের উপর রাসায়নিক অস্ত্রপ্রয়োগের মতো কিছু ঘৃণ্য ঘটনার বিষয়েও তিনি খবর সংগ্রহ করতে শুরু করেছিলেন। ৭ই অক্টোবর, ২০০৬, নিজের আবাসনেই লিফটের ভিতর গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি নিহত হন। আট বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে ৫জন ভাড়াটে অপরাধীকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কারাবাসের দণ্ড শোনানো হয়। কিন্তু আজ অবধি জানা যায়নি, কে বা কারা এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল। অনেকে রামজান কাদিরভের নাম বলে থাকেন। কেউ কেউ বা আবার সন্দেহ করেন রুশ গোয়েন্দা সংস্থাকেই। কেবল মজার কথা হল, একই সঙ্গে রুশ প্রশাসন তথা পুতিন, অথবা রুশপন্থী একনায়ক কাদিরভ পরিবারেরও যিনি চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন – সেই আনা পোলিতকোভস্কায়াকে যেদিন হত্যা করা হল, সেদিনই ছিল রুশ একনায়ক ভ্লাদিমির পুতিনের জন্মদিন। জন্মদিনের উপহার হিসেবেই কি তবে সাহসী এই সাংবাদিককে সেদিন যূপকাষ্ঠে নিক্ষেপ করা হল? এর উত্তর হয়তো কোনও দিনও জানা যাবে না। কিন্তু মস্কোর রাস্তায় যুদ্ধবিরোধী কোনও বিক্ষোভে আমরা আবারও দেখব, ভবিষ্যতের কোনও ৭ই অক্টোবর তারিখে আরও কোনও দৃপ্ত একাকী নারীর হাতে উঁচিয়ে ধরা লিখন – যাতে কি না লেখা রয়েছে, “আজ পুতিনের জন্মদিন নয় – আজ আমাদের আনার মৃত্যুদিন!” ইতিহাস আনাকে এভাবেই মনে রাখুক ...
[আরও পড়তে চাইলে, আনাকে লেখা শ্বেতলানা গানুশকিনার যে খোলা চিঠি তার অনুবাদটিকে পড়ার জন্য যে লিংক - সেটিকে নীচে দিলামঃ
https://www.4numberplatform.com/?p=31928]
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার
ছবি : সংগৃহীত (বাঁদিকে আনা পোলিতকোভস্কায়া, ডানদিকে শ্বেতলানা গানুশকিনা)
0 Comments
Post Comment