আরও তিন ‘কাদম্বিনী’

  • 26 July, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 851 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
খনা কিংবা লীলাবতীর যুগ পেরিয়ে এতদিন কেটে গেলেও ভারতীয় অথবা বাঙালী নারীদের কাউকেই তো তেমন ভাবে এই ধারাবাহিকের পাতায় তুলে আনতে পারিনি। কাদম্বিনীকে দিয়ে যখন, সেই শূন্যতার বিপরীতে সামান্য বালির বাঁধটুকুও দেওয়ার চেষ্টা করলাম তখন সেই কাদম্বিনীর পাশে পাশেই এসে দাঁড়ালেন আরও তিন মহীয়সী। এ্যানি জগন্নাথন, রূপাবাই ফার্দুনজী, আনন্দীবাই গোপালরাও যোশী। সময়কাল মোটামুটি ভাবে সকলেরই এক, কেবল দীর্ঘায়ুর দিক থেকে অনেকটা বেশী সময় পেয়েছেন কাদম্বিনী। আজ তাঁদের গল্প। নারীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে ধারাবাহিক (পর্ব ২১)

এ্যানি জগন্নাথন। এনার কেবল নামটুকুই পাচ্ছি। ১৮৮৮ সালে যখন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এল. এম. এস. সার্টিফিকেট নিয়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে প্রথম এশীয় মহিলা চিকিৎসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন, সেই একই সময়ে আমরা এ্যানি জগন্নাথনেরও হদিস পাচ্ছি। মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে পাশ্চাত্য চিকিৎসাপদ্ধতির উপরে একটি সার্টিফিকেট কোর্স করেছিলেন। পরে কাদম্বিনীর মতোই তিনিও ইংল্যান্ডে গিয়ে স্কটিশ কলেজ থেকে তিনটি বিষয়ে ডিপ্লোমা লাভ করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে। ১৮৯২ সালে তিনি ভারতবর্ষে ফিরে আসেন, এবং মুম্বাইয়ের কামা হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু কাদম্বিনীর মতো সৌভাগ্য তাঁর কপালে ছিল না। মাত্র দুবছরের মধ্যেই যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে এ্যানি জগন্নাথনের জীবনাবসান হয়। ইতিহাসের পাতায় তাই তাঁর আঁচড়টি দীর্ঘায়িত হল না। তিনি সেই আড়ালেই থেকে গেলেন।

লিখতে লিখতে মনে হচ্ছিল, সেই খনা কিংবা লীলাবতীর যুগ পেরিয়ে আসতে আসতে – সেসবের পরে এতদিন কেটে গেলেও ভারতীয় অথবা বাঙালী নারীদের কাউকেই তো তেমন ভাবে এই ধারাবাহিকের পাতায় তুলে আনতে পারিনি। এখন - এই যে বিশাল শূন্যতা, ভাবতে পারিনি – কাদম্বিনীকে দিয়ে যখন, সেই শূন্যতার বিপরীতে সামান্য বালির বাঁধটুকুও দেওয়ার চেষ্টা করবো, তখন সেই কাদম্বিনীর পাশে পাশেই এসে দাঁড়াবেন আরও তিন মহীয়সী। এ্যানি জগন্নাথন, রূপাবাই ফার্দুনজী, আনন্দীবাই গোপালরাও যোশী। সময়কাল মোটামুটি ভাবে সকলেরই এক। কেবল দীর্ঘায়ুর দিক থেকে অনেকটা বেশী সময় পেয়েছেন কাদম্বিনী, অনেকদিন ধরে কর্মক্ষম থেকেছেন। তাঁর অবদান রেখেছেন অসীম দক্ষতায়। ... আর বাকিরা হারিয়ে গিয়েছেন ইতিহাসের অতলে

টুকরো টুকরো পাতাকে ইতিহাস খুঁড়ে তুলে আনতে আনতেই, তাঁদের বিষয়ে যতটুকুও বা জানবার ছিল – কতটুকুই বা তার সঞ্চয় করতে পেরেছি ? এ্যানি জগন্নাথন কেবল কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর বিষয়ে লেখা গবেষণাপত্রের, এক কোণের একটি ‘রেফারেন্স’ হয়েই থেকে গেছেন। বাকিদের অবস্থাও প্রায় তেমনই বলা চলে। তবে কিনা এ্যানির চেয়ে অন্তত, তাঁদের অবস্থা সামান্য কিছুটা হলেও আশাপ্রদ; আর সেই তালিকাতেই প্রথম নাম, রূপাবাই ফার্দুনজী।

ভারতবর্ষে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম চেতনানাশক হিসেবে ক্লোরোফর্মের ব্যবহার শুরু হয় দক্ষিণের শহর হায়দ্রাবাদে। সেই হায়দ্রাবাদের ষষ্ঠ নিজাম, নবাব মীর মহবুব আলি খান বাহাদুরের তত্ত্বাবধানে ১৮৮৮ এবং ১৮৯১ সালে, প্রথম এবং দ্বিতীয় হায়দ্রাবাদ ক্লোরোফর্ম কমিশন গঠন করা হয়েছিল। এই কমিশনগুলির উদ্দেশ্য ছিল যন্ত্রণাহীন শল্যচিকিৎসার প্রয়োজনে মানুষকে সংজ্ঞাহীন করতে যখন ক্লোরোফর্মকে চেতনানাশক হিসেবে ব্যবহার করা হবে, তখন সেই ক্লোরোফর্মের তীব্রতাকে পরিমাপ করা। এছাড়াও ক্লোরোফর্ম ব্যবহারের কারণে মানবশরীরে কোনও প্রকার বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে কি না, সেটিকে অনুধাবন করাও এই কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল। বিশিষ্ট স্কটিশ শল্যচিকিৎসক ডাক্তার এডওয়ার্ড লরির উদ্যোগে তখনকার দিনে এই কমিশনগুলির প্রতিষ্ঠা হয়। সেই সময় জগদ্বিখ্যাত ল্যানসেট পত্রিকায়, ১৮৮৮ সালের প্রথম ক্লোরোফর্ম কমিশনের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টটি গবেষণা প্রবন্ধের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৮৯১তে দ্বিতীয় ক্লোরোফর্ম কমিশনের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টটি নিজামের রাজকীয় তহবিল থেকে একটি বইয়ের আকারে প্রকাশ করা হয়। এই দুটি ক্লোরোফর্ম কমিশনেরই অন্যতম সদস্য, এবং একমাত্র মহিলা সদস্য ছিলেন রূপাবাই ফার্দুনজী। তাঁর জন্মতারিখ সম্পর্কেও নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। হায়দ্রাবাদের এক অবস্থাপন্ন পার্সি পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই রূপাবাই’ই ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, পৃথিবীর প্রথম স্বীকৃত মহিলা এ্যানাস্থেটিস্ট। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে, আরও চারজন মহিলার সঙ্গে তিনি অন্যতম প্রথম মহিলা ছাত্রী হিসেবে হায়দ্রাবাদ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৮৮৯তে তিনি সেই কলেজ থেকেই ‘হাকিম’ বা চিকিৎসকের সমতুল একটি উপাধি লাভ করেন।

এরপর তিনি বাল্টিমোরের জন হপকিন্স হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রের বিষয়ে আরও একটি বিশেষ ডিগ্রি কোর্সের পাঠ্যক্রমে নিজের নাম নথিভুক্ত করেন। ১৯০৯ সালে এ্যানি বেসান্তের উৎসাহে, রূপাবাই এডিনবার্গে আসেন। সেখানেই তিনি এ্যানাস্থেশিয়া বা মানবশরীরে চেতনানাশক প্রয়োগের বিষয়ে আরও পড়াশোনা শুরু করেন। মানবশরীরে চেতনানাশকের প্রভাব সম্পর্কে জানতে গিয়ে তিনি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রিরও কয়েকটি কোর্স করেছিলেন। কেবল ১৮৮৮ ও ১৮৯১ সালের ক্লোরোফর্ম কমিশনই নয়, বিদেশযাত্রার সময়গুলিকে বাদ দিলে – ১৮৮৯ থেকে ১৯১৭ অবধি তিনি হায়দ্রাবাদের ব্রিটিশ রেসিডেন্সি হাসপাতাল (বর্তমানে সুলতানবাজার হাসপাতাল), আফজলগঞ্জ হাসপাতাল (যা কিনা বর্তমানে ওসমানিয়া জেনারেল হাসপাতাল) এবং ভিক্টোরিয়া নারী হাসপাতালে সুনামের সঙ্গে এ্যানাস্থেটিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯২০ সালে হায়দ্রাবাদের চাদরঘাট হাসপাতালের অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

এখন এই রূপাবাই ফার্দুনজী অথবা কাদম্বিনী গাঙ্গুলী প্রমুখের নামের সঙ্গে, সমসাময়িক যে আরও একটি নামের বিষয়ে এখানে একইরকম গুরুত্ব সহকারে আজ আলোচনা করতে চাইব, সেই নামটি হল আনন্দীবাই গোপালরাও যোশী। মহারাষ্ট্রের কল্যাণে তাঁর জন্ম, ৩১শে মার্চ, ১৮৬৫। মৃত্যু ২৬শে ফেব্রুয়ারী, ১৮৮৭। হ্যাঁ, তখনও কাদম্বিনীর এল. এম. এস. পাওয়া হয়নি। এখানে কেউ কেউ বিতর্ক তুলতে পারেন যে, তাহলে তো কাদম্বিনীকে প্রথম এশীয় মহিলা চিকিৎসকের মর্যাদা দেওয়া চলে না। এর উত্তরে বলব, কাদম্বিনী এই ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত প্রথম স্বীকৃত মহিলা চিকিৎসক। আনন্দীবাইয়ের শিক্ষা এদেশে হয়নি। তিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যয়ন সম্পন্ন করেছিলেন বিদেশের মাটিতে। এছাড়াও, খুব সত্যি করে বলতে গেলে – সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন চুলচেরা তারিখের বিশ্লেষণ করতে যাওয়াটাও পণ্ডশ্রম বই তো নয়। আমরা কাদম্বিনীর উত্তরাধিকারকে দেখেছি। তাঁর দীর্ঘ অবদানকে স্মরণ করেছি। আনন্দীবাইয়ের স্বল্পায়ু জীবনেরও আমরা উদযাপন করি আসুন। কে আগে বা কে পরে, এই বিতর্ক নিয়ে সময় নষ্ট করাটা অনুচিত।

জন্মের সময় আনন্দীবাইয়ের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘যমুনা’। মাত্র ন’বছর বয়সেই যমুনার বিবাহ হয় ঊনত্রিশ বছর বয়সী গোপালরাও যোশীর সঙ্গে। বিবাহের পরে এই গোপালরাওই যমুনার নাম দেন আনন্দী। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী যেমন ভাবে সমাজের বিরুদ্ধে প্রাকার হয়ে দাঁড়িয়ে কাদম্বিনীর স্বপ্নকে সাকার করতে চেষ্টা করেছিলেন, আনন্দী ওরফে যমুনা’র গোপালরাও’ও ছিলেন ঠিক তেমনই একজন মানুষ। শোনা যায় যে, কোনও একদিন পড়াশোনার সময় আনন্দীকে উঠে গিয়ে রান্নাঘরের কিছু কাজ করতে দেখে গোপালরাও অগ্নিশর্মা হয়ে তাঁকে রীতিমতো শাসন করেছিলেন। স্ত্রীর প্রকৃত শিক্ষা এবং জীবনে তাঁর উন্নতির বিষয়ে, গোপালরাওয়ের কড়া নজর ছিল। চৌদ্দ বছর বয়সে আনন্দীর কোলে সন্তান আসে। দশদিনের মাথায় সেই সন্তানের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুই আনন্দীবাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গিকে চিরতরে বদলে দিয়েছিল। আনন্দী সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁকে পড়াশোনা করতে হবে, এবং বিনা চিকিৎসায় সন্তানের মৃত্যুকে মেনে নিতে না পেরে তিনি বিশেষ ভাবে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

সেই সময় মহারাষ্ট্রে স্ত্রীকে কোনও মিশনারি স্কুলেও ভর্তি করতে না পেরে গোপালরাও স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতা থেকেই আনন্দীর পড়াশোনা শুরু হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতি স্ত্রীর আগ্রহ দেখে গোপালরাও ১৮৮০ সালে, রয়্যাল ওয়াইল্ডার নামে এক আমেরিকান মিশনারিকে পত্র-মারফত যোগাযোগ করেন। রয়্যাল ওয়াইল্ডার গোপালরাওয়ের সঙ্গে তাঁর এই কথোপকথনকে, তাঁর নিজস্ব পত্রিকা প্রিন্সটন’স মিশনারি রিভিউতে প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাটির মাধ্যমেই থিওডিসিয়া কার্পেন্টার নামে এক সহৃদয় ভদ্রমহিলা গোপালরাও দম্পতির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একই সময়, থরবর্ন নামের এক চিকিৎসক দম্পতি উইমেনস মেডিকেল কলেজ, পেনসিলভেনিয়াতে আনন্দীর ভর্তির ব্যাপারে উদ্যোগী হন। ইতিমধ্যে কলকাতা ও সমকালীন সমাজে আনন্দীর এই সম্ভাব্য বিদেশযাত্রার খবর জানতে পেরে আলোড়ন পড়ে যায়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে দুর্বল আনন্দী তখন কলকাতা ছেড়ে শ্রীরামপুরে গিয়ে থাকছিলেন। এই আলোড়নের মধ্যেই, ১৮৮৩ সালে শ্রীরামপুর কলেজের প্রেক্ষাগৃহে আনন্দীবাই যোশী একটি দুঃসাহসী বক্তৃতার মাধ্যমে নিজের বক্তব্যকে সমাজের সামনে তুলে ধরেন। বক্তৃতাটির মধ্য দিয়ে তিনি সমাজে মহিলা চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রাঞ্জল ভাষাতে বর্ণনা করেন এবং চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের প্রয়োজনে নিজের সম্ভাব্য বিদেশযাত্রার কথাও ঘোষণা করেন। এই বক্তৃতাটি তৎকালীন সমাজে যথেষ্টই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, এমনকি আনন্দীর বিদেশযাত্রার খরচ যোগাতে নানা মহল থেকে অর্থ-সংগ্রহ করা হতে থাকে।

সব বাধাবিপত্তিকে টপকিয়ে অবশেষে দুই মহিলা মিশনারির সঙ্গে জুন, ১৮৮৩তে স্বামীকে ছাড়াই একাকিনী আনন্দী নিউ ইয়র্ক শহরে পা রাখেন। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন থিওডিসিয়া কার্পেন্টার। ১৮৮৬ সালে আনন্দীবাই গোপালরাও যোশী, ফিলাডেলফিয়া রাজ্যের উইমেনস কলেজ অব মেডিসিন, পেনসিলভেনিয়া থেকে এম. ডি. ডিগ্রির পরীক্ষাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে উইমেনস কলেজ অব মেডিসিন, পেনসিলভেনিয়ার এই ডিগ্রি পাঠ্যক্রমটি সারা পৃথিবীতে মহিলা চিকিৎসকদের জন্য স্বীকৃত দ্বিতীয় পাঠ্যক্রম ছিল। ১৮৮৩তে, আনন্দীবাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পাঠ্যক্রমে কেই ওকামি (জাপান) এবং সাবাত ইসলামবুলি (কুর্দিস্তান, সিরিয়া) যথাক্রমে জাপান এবং সিরিয়া থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত প্রথম মহিলা চিকিৎসক হিসেবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেই বছর ছিল নিঃসন্দেহেই এক ইতিহাসের বছর। দু’বছর পর, ১৮৮৮তে কলকাতার বুকে ইতিহাস গড়বেন আরেক বাঙালিনী কাদম্বিনী। মেয়েদের জয়যাত্রার সেই ইতিহাসকে কেবল বুকে ধরে রাখতে চেষ্টা করবে ভবিষ্যৎ।

স্ত্রীর এই সম্মানের সময় গোপালরাও নিজেও আমেরিকাতে এসে পৌঁছন। ১৮৮৬র শেষভাগে আনন্দীবাই দম্পতি বিরাট এক স্বাগত অভ্যর্থনার মাধ্যমে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আনন্দীবাইকে কোলাপুরের এ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালের নারী বিভাগের ইন-চার্জ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। যদিও তাঁর হাতে আর বেশীদিন সময় ছিল না। একবছরেরও কম সময়ের মধ্যেই ২৬শে ফেব্রুয়ারী, ১৮৮৭ তারিখে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র বাইশ বছর বয়সে আনন্দীবাই গোপালরাও যোশী পুনা শহরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মাত্র দুই থেকে তিন মাস সময় পেয়েছিলেন আনন্দীবাই, যে সময়ে ডাক্তার হিসেবে তিনি প্র্যাকটিস করতে পেরেছিলেন। কিন্তু আরও অনেক সোপানকে পেরুবার আগেই তাঁকে চলে যেতে হল। নিউ ইয়র্ক থেকে থিওডিসিয়া কার্পেন্টার তাঁর প্রিয় আনন্দীর চিতাভস্ম চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। নিউ ইয়র্কের একটি গ্রামীন গোরস্থানে (পোকিপ্সি রুরাল সেমেট্রিতে) আনন্দীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি ফলক আজও প্রোথিত রয়েছে।

... ল্যাটিটিউড ৫.৫ ডিগ্রি উত্তর, লঙ্গিচিউড ২৮৮.৮ ডিগ্রি পূর্ব – শুক্র গ্রহের এই স্থানবিন্দুতে অবস্থিত বিশাল একটি আগ্নেয়গহ্বরের নামকরণ করতে গিয়ে সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা সেটির নাম দিয়েছেন ‘যোশী’ ... বিশাল সেই মহাকাশের বুকে যেন সেই হার না মানা আনন্দীবাইয়ের উদ্দেশ্যেই আমাদের তরফে, ভাবীকালের বিজ্ঞানীদের তরফে - এই একটুকরো স্মৃতিজ্ঞাপন। এমন একেকজন মহীয়সীর অবদান সম্পূর্ণ সৌরজগতের বিশালত্বের চাইতেও আরও বিশাল বলে মনে হয়। তাঁরা ভাবীকালকে উৎসাহিত করেছেন। নিজেদের উৎকর্ষকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমরা সেই উৎকর্ষের উদযাপন করেছি। সেই প্রাণশক্তিকে প্রাণভরে কুর্নিশ জানিয়েছি কেবল।

সূত্রঃ

[১] ডক্টর মোহাম্মদ নাজিব, ‘ক্লোরোফর্ম এ্যান্ড হাও মডার্ন মেডিসিন কেম টু হায়দ্রবাদ’, দ্য এশিয়ান এজ, জুলাই, ২০২০

[২] এন. আলা ও অন্যান্য, ‘ডক্টর মিসেস রূপাবাই ফার্দুনজী ওয়ার্ল্ডস ফার্স্ট কোয়ালিফায়েড লেডি এ্যানাস্থেটিস্ট’, ইন্ডিয়ান জার্নাল অব এ্যানাস্থেশিয়া, খন্ড ৫৪, ২০১০

[৩] এম. আলি, এ. রামাচারী, ‘হিস্ট্রি অব এ্যানাস্থেশিয়া এ্যান্ড হায়দ্রাবাদ ক্লোরোফর্ম কমিশন’, ব্যুলেটিন অব দ্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন, খন্ড ১৯

[৪] স্যর আসমান জাহ, ‘রিপোর্ট অব দ্য হায়দ্রবাদ ক্লোরোফর্ম কমিশন’, ১৮৯১

[৫] মল্লিকা রাও, ‘মিট দ্য থ্রি ফিমেল মেডিকেল স্টুডেন্টস হু ডেস্ট্রয়েড জেন্ডার নর্মস এ সেঞ্চুরি এগো’, হাফিংটন পোষ্ট, এপ্রিল, ২০১৪

[৬] দীপঙ্কর নস্কর, ‘সাম উইমেন অব ইন্সপিরেশনঃ এ গ্লান্স অন উইমেন এম্পাওয়ারমেন্ট এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন ইন্ডিয়া’, গ্লোবাল জার্নাল অব হিউমান সোশ্যাল সায়েন্সঃ ডি, হিস্ট্রি, আর্কিওলজি এ্যান্ড এ্যানথ্রোপলজি, খন্ড ১৪, সংখ্যা ৫, ২০১৪

[৭] ‘হোয়াই ইজ এ ক্রেটার অন ভেনাস ইজ নেমড আফটার ইন্ডিয়াজ ডক্টর আনন্দীবাই যোশী’, দ্য কুইন্ট, ২০১৮

লেখক : প্রযুক্তিবিদ্যার গবেষক, প্রাবন্ধিক

ছবি: (বাঁ দিকে) রূপাবাই ফার্দুনজী, (ডান দিকে) আনন্দীবাই গোপালরাও যোশী। সংগৃহীত।

0 Comments

Post Comment