- 14 August, 2023
- 0 Comment(s)
- 1098 view(s)
- লিখেছেন : রাজ্যশ্রী ঘোষ
লকডাউনের চোদ্দো দিনের মাথায় প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, একটু দম নিতে ছাদে উঠে দেখি পাশের বাড়ির নতুন বউটাও তাদের ছাদে দাঁড়িয়ে। মাথার উপর বিকেলের আকাশ তখন সদ্য কাচা ফুরফুরে একখানা নীল শামিয়ানা টাঙিয়ে দিয়েছে। মহল্লার যত কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, পলাশের দল তারই নীচে লালের বিভিন্ন শেডে সেজে পোজ দিচ্ছে যেন পোড়-খাওয়া সব সুপার মডেল। বাতাসেও কি আমের বোলের গন্ধ? অন্য সময় আমাদের এই মফস্সলের ছাদগুলো থেকে গাড়ির হর্ন আর নীচে গলির বাজারে মানুষজনের ভিড় থেকে উঠে আসা একটা ভন্ ভন্ শব্দ ছাড়া অন্য কিছু শোনা দায়। আজকাল পাখপাখালির ডাকে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। বউটা অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে হাঁটতে এসে আমাদের দিকের ছাদের রেলিংটায় ভর দিয়ে দাঁড়ালো। পরনে লাল শাড়ি… কপালে, সিঁথেয় ল্যাপটানো সিঁদুর... হাতে সাদা, লাল শাঁখা-পলা... নতুন বউয়ের ইউনিফর্ম ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত।
—কী ভাই, বর বুঝি রাতে ঘুমোতে দিচ্ছে না একদম?
চোখের তলায় ঘন কালো কালি দেখে এইটুকু রসিকতা না করে আর থাকা গেল না৷
আসলে বিকেলের এই সময়টা ছিল আমাদের মজলিশ টাইম। রকবাজ বলতে বাঙালি সমাজে কেন যে উঠতি বয়সের ছেলে-ছোকরাদেরকেই তাগ করা হয় তা ঠিক বুঝি না। আমাদের বাড়ির বনেদি রকে রোজ বিকেলে যে নিখাদ রকবাজিটা চলে সেখানে তো প্রায় সকলেই আমার মত মাঝবয়সী গৃহবধূ। জনা চারেক তরুণীও আছে। কিছু এঁচোড়ে পাকা উঠতি বয়সের মেয়ে বয়ফ্রেন্ড ব্যস্ত থাকলে ‘কি গো কাকিমা’ বলে মাঝে মাঝে এসে জোটে। তবে এরা একনিষ্ঠ সদস্য নয়। তাই ঠিক পাত্তাও পায় না। চা, মশলামুড়ি, তেলেভাজা এবং ততোধিক সুস্বাদু পিএনপিসি সহযোগে আমাদের বৈকালিক আড্ডা রসিয়ে ওঠে। পাড়ার প্রতিটি বাড়ির হাঁড়ির খবর আমাদের নখদর্পণে। লাচ্চুর বউ এমনিতে ক্লাস নাইন ফেল হলে হবে কী এসব ব্যাপারে সে এক পাক্কা রিপোর্টার। পাড়ার যত ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়ে-বউদের এমন সব কেচ্ছার বৃত্তান্ত সে সংগ্রহ করে আনবে যে খবরের কাগজের পেজ থ্রি-ও হার মেনে যায়। যদিও তার আনা সমস্ত খবরের সত্যতা সম্পর্কে আমাদের অনেক সময় সন্দেহ হয়, তবু রসভঙ্গের ভয়ে আমরা কেউ কিছু বলি না। কারণ ওই রসটুকুই তো আমাদের রসদ। আমাদের ছোট্টো নেশার পুরিয়া, যা না থাকলে এই জীবনের একঘেয়েমিতে আমরা পাগল হয়ে যেতাম।
তা এই নচ্ছার করোনার জ্বালায় আমাদের আসর আপাতত লাটে এবং পাক্কা নেশাড়ুদের মতো আমাদের সকলের মধ্যেই অল্পবিস্তর ওই যাকে বলে উইথড্রয়াল সিন্ড্রোম দেখা দিয়েছে। এমন সময় পাশের বাড়ির ছাদে নতুন বউয়ের আর্বিভাবে মনটা হঠাৎ চনমনিয়ে উঠল। কে না জানে, পাড়ার নতুন বউ মানেই গসিপের নতুন টপিক।
কিন্তু অপর পক্ষে কোনো উত্তর নেই কেন? লজ্জা! দেমাক! না কানে কম শোনে! ব্যাপারটা বোঝার জন্য বউটার দিকে একটা শ্যেনদৃষ্টি হানলাম। তখনই লক্ষ করলাম যে তার বয়স বেশি নয়, আমার কলেজ-পড়ুয়া মেয়ের সমবয়সিই হবে। আর লক্ষ করলাম মেয়েটির চোখে জল। একা ছাদে দাঁড়িয়ে সে সম্ভবত কাঁদছিল।
—আরে, এই মেয়ে! কী হয়েছে তোমার! বাড়ির জন্য মন কেমন করছে নাকি?
মেয়েটা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক সেই সময় নীচের তলায় কারও সাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি আঁচলে মুখ-চোখ মুছে সে নেমে গেল।
তবে পরের দিন, তার পরের দিন এবং প্রায় প্রতিদিনই বিকেল বেলায় ছাদে উঠলেই তার সঙ্গে দেখা হতে লাগল এবং কথা হতে লাগল। যদিও বেশিক্ষণের জন্য নয়। ছাদ থেকে শুকনো কাপড়, রোদে দেওয়া মশলা, বড়ি এসব তুলতে তুলতে যতখানি যা। তার মধ্যেও সে সদা-সতর্ক। নীচ থেকে কোনো সাড়া-শব্দ পেল তো অমনি হাওয়া।
বাড়িটা আসলে আগে ছিল দাশ বাবুদের। সম্প্রতি তাঁরা বাড়ি বিক্রি করে কলকাতার ফ্ল্যাটে চলে যাবার পর থেকে এই পরিবারটি আমাদের পড়শি। একে তো নতুন, তার উপর এঁরা কেউই তেমন একটা মিশুকে নন। ফলে এঁদের সম্পর্কে আমাদের কারোরই স্বচ্ছ ধারণা ছিল না, অথচ কৌতূহল ছিল অপার।
বউটির কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে তার সহাবস্থান খুব একটা সুখের হচ্ছে না। লোকজন বলতে স্বামী, শ্বাশুড়ি আর এক অল্পবয়সি বিধবা জা। সংসারের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই জায়ের হাতে। বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন-চারমাস। কিন্তু এরই মধ্যে উদয়াস্ত খেটে ঘরের সমস্ত কাজ সামলাতে হচ্ছে বউটাকে। শাশুড়ি দিনভর পুজোর ঘরে আর জা ব্যস্ত রূপচর্চা, স্মার্টফোন আর টিভি নিয়ে। কর্তা দিনের সিংহভাগ সময় কাটান তাঁর বউদির সঙ্গে। আজ যেমন লকডাউনের মধ্যে তাঁরা দুজনে সারাদিন ঘরে বসে তাস খেলছেন, ল্যাপটপে সিনেমা দেখছেন, গুজগুজ করে গল্প করছেন আর বউটার কাজ হচ্ছে দফায় দফায় চা করে ঘরে গিয়ে দিয়ে আসা। পান থেকে চুন খসলেই তার কপালে জুটবে অকথ্য গালিগালাজ, এমনকি মারধর। জা নাকি কথায় কথায় বউটিকে শাসায়— “বাড়ি থেকে দূর করে দেব”, এবং এ কথার প্রতিবাদ তার স্বামী বা শাশুড়ি কেউই কখনও করেন না। একদিন সহ্য করতে না পেরে বউটা বুঝি উত্তর দিয়ে ফেলেছিল— “তুমি আমাকে দূর করে দেবার কে? এ বাড়িতে তোমার যেমন অধিকার, আমারও তেমনই” এবং সেই অপরাধে তার পতিদেবটি সেদিন নাকি তাকে বেল্ট দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন।
আমি ভেবে দেখেছি, আড্ডার ঠেকে কারোর কেচ্ছা নিয়ে আলোচনার সময় আমরা সম্ভবত মানুষগুলোর জীবনের সমস্যা বা কষ্টের দিকটা খুব একটা অনুভব করে উঠতে পারি না। ধরো, যে বউটা স্বামী সংসার ফেলে অন্য এক পুরুষের সাথে বেরিয়ে গেল, ঠিক কি পরিস্থিতিতে সে এমন সিদ্ধান্ত নিল, বা সে চলে যাবার পর তার পরিবারের বাকিরাই-বা ঠিক কেমন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এসব যেন আমাদের বিবেচ্যই নয়। জলজ্যান্ত ওই মানুষগুলো আমাদের কাছে যেন কোনো সিনেমা বা সিরিয়ালের চরিত্র। আমরা নিত্যদিনের থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি থোড়ে হেজে যাওয়া একটা মন নিয়ে দূরে বসে কেবল দেখব, সাময়িক একটা মজা নেব, তারপর যে যার নিজস্ব খোপে, নিজ জীবনে ব্যস্ত হয়ে যাব। এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই এতকাল হয়ে এসেছে।
তবে এই লকডাউনের মরশুমে একটা কথা খুব শুনছি যে পৃথিবীর নাকি শুদ্ধিকরণ হচ্ছে। মা বসুন্ধরা তার গাছগাছালি সন্তান, তার পশু-পাখি সন্তান, তার জল-জঙ্গল-পাহাড় পর্বত সব নিয়ে দিন দিন আরও সতেজ, আরও রঙিন হয়ে উঠছে। তা সেই শুদ্ধতার আঁচ এই মানুষগুলোর কলজেতেও কি একটু-আধটু এসে লাগছে না? নিশ্চয় লাগছে। নইলে এই কদিনে বউটার থেকে যত হাঁড়ির খবর আমার সংগ্রহে এসেছে তা দিয়ে আমাদের আড্ডার মেয়েদের হোয়াট্সআ্যপ গ্রুপে একটা অনলাইন পিএনপিসি আসর কি আর বসানো যেত না? কিন্তু কে জানে কেন প্রবৃত্তিই হল না। বরং এই সদ্য-চেনা, অনাত্মীয় মেয়েটার কথা ভেবে ভিতরে ভিতরে কেমন যেন একটা কষ্ট হতে লাগল।
—জানো কাকিমা, ফুলতলি আমাদের বাড়ি। কত বড়ো দক্ষিণ-খোলা দোতলা বাড়ি আমাদের। সেখানে আমার নিজেরই তো একটা আলাদা ঘর ছিল। বাড়ির সামনে মোরাম বিছানো রাস্তা... রাস্তার দুই ধারে লম্বা লম্বা ঝাউ, ইউক্যালিপটাস, দেবদারু গাছের সারি। সেখানকার আকাশ সব সময়ই ঠিক এই রকম ঝকঝকে নীল। কেবল বর্ষাকালে দূরে গাছেদের মাথায় কালো মেঘ ঘনিয়ে আসত। তারপর ঝমঝম করে সে কি বৃষ্টি! আর ছিল আমাদের এক আশ্চর্য দক্ষিণের বারান্দা। আমরা সব খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাইবোনেরা মিলে দোতলার সেই টানা বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখতাম। শীতের রোদে বড়ি দিতে দিতে, সোয়েটার বুনতে বুনতে ওই বারান্দাতেই মা-কাকিমাদের গল্প জমে উঠত, গরমকালের বিকেলে সদ্য গা-ধুয়ে ওঠা শরীর জুড়িয়ে দিয়ে যেত দখিনা বাতাস। কত পুকুর ছিল আমাদের! শান পুকুর, তাল পুকুর, খিড়কি পুকুর... নির্জন দুপুরে ইয়াব্বড়ো বড়ো মাছেরা সেখানে ঘাই দিত। বুনো ফুলের গন্ধে মঁ মঁ করত চারিপাশ।
—তা যাও না কেন চলে সেখানে। এই লকডাউন উঠে গেলে গিয়ে দিন কতক কাটিয়ে এসো। শরীর, মন চাঙ্গা হবেখন।
—ধুর! কী যে বলো? সে সব কি আর এখনও আছে নাকি?
খুব পুরোনো হয়ে গিয়েছিল তো। এখান থেকে ওখান থেকে রাত-দিন ঝুর ঝুর করে চুন-বালি খসে পড়ত। অত বড় বাড়ি মেনটেন করা কি আর মুখের কথা? বাবা-কাকারা প্রমোটার ডেকে কবে সে সব বিক্রি-বাটা করে এখন যে যার মতো। আমার বাবা-মা তো আজকাল বাঘাযতীনে দু-কামরার ফ্ল্যাটে থাকে।
সেদিন পাড়ায় পুলিশ এল। কারা নাকি লকডাউনের যাবতীয় নিয়মকানুন তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে গোবিন্দর চায়ের দোকানে নিয়মিত আড্ডা মারছিল। বারণ করলেও শুনছিল না। শেষে শোনা গেল ক্লাবের ছেলেদের কেউ একটা মোবাইলে ভিডিও তুলে ভাইরাল তো করে দিয়েইছে, উপরন্তু থানাতেও খবর চলে গেছে। ফলে বিকেলবেলায় পুলিশের বাঁশি, কিছু পলায়নশীল মানুষের হুটোপাটি, চোঙা মুখে থানার মেজবাবুর হুংকার... ইত্যাদি নিয়ে পাড়া একেবারে সরগরম। মূলত রগড় দেখতেই ছাদে উঠেছিলাম। আশপাশের আরও অনেক ছাদ, বারান্দা, জানালাতেই কৌতুকপ্রিয় লোকজনের উকি-ঝুঁকি। এমন বন্দিদশায় এ ধরনের আলোড়ন একটু-আধটু না হলে কেমন যেন পানসে লাগে। আজও যথারীতি বউটার সঙ্গে দেখা। মনে পড়ল সকালে আমার মেয়ে তোয়া প্রশ্ন করছিল, আচ্ছা মা আমাদের পাশের বাড়ির লোকজনগুলো কেমন বলো তো?
—কেন রে?
—না, আসলে কাল অনেক রাত অবধি চিলের ঘরে প্রজেক্টের কাজ করছিলাম। মাথাটা হ্যাং করে যাওয়াতে ভাবলাম ছাদে একটু হাঁটাহাঁটি করি। অত রাতে চারিদিক পুরো শুনসান। তারই মধ্যে মনে হল ওদের বাড়িতে কিছু একটা গণ্ডগোল চলছে। একটি পুরুষ এবং একটি মহিলা কণ্ঠ মিলে কার উপর যেন খুব হম্বিতম্বি করছে। মারধর করলেও অবাক হব না। অন্য আরেকটি মহিলা কণ্ঠ চাপা স্বরে কেঁদে চলেছে। আমি একটু জোরে গলা খাঁকারি দিতেই হম্বিতম্বিগুলো হঠাৎ একদম থেমে গেল৷ কিন্তু কান্নার শব্দটা আরও অনেকক্ষণ অবধি পাচ্ছিলাম।
মেয়েকে কিছু বললাম না। তবে বুঝলাম বউটার চোখের তলার কালিটা পরদিন আরও গাঢ় হয়ে উঠবে।
কিন্তু আশ্চর্য আজ তাকে অতটা মনমরা দেখলাম না। বরং একটু খুশি খুশি ভাব। কী ব্যাপার? না আজ ফোনে বাবার সাথে কথা হয়েছে।
—বাবার বড্ড আদরের ছিলাম তো। ছোটোবেলায় খেলতে গিয়ে ধরো চোট লেগেছে... কী অসুখ-বিসুখ করেছে... বাবা কেমন কোলে তুলে নিয়ে একেবারে নিজের বুকের মধ্যে করে রাখত। এখন মনে হয়, ওই জায়গাটাই পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ছিল, জানো। ছোটোবেলায় মায়ের পর্যন্ত আমার গায়ে হাত তোলার সাহস ছিল না।
—শোনো। বাবা-মায়ের স্নেহ কখনও পালটায় না। তুমি চলে যাও তোমার বাবার কাছে। গিয়ে সব খোলাখুলি জানাও।
—কী যে বলো! আমার বাবা সেই আগের মতো আর আছে নাকি? এখন তিনি হার্টের পেশেন্ট। মাকে জানিয়েছিলাম সব ফোনে। বললাম এ সংসার করব না। বাড়ি ফিরে যাব। মা শুনে বললো, এত ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া হল, তুমি এখন ফিরে এলে আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাব কী করে? আর সেই আঘাত বাবা সহ্য করতে পারবেন ভেবেছ? নতুন জায়গায় শুরুতে সবারই একটু আধটু অসুবিধে হয়। যেখানে আছো, সেখানেই একটু মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো। তা সেই চেষ্টাই করছি..। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস যেন তার নাভি থেকে উঠে আসে।
—আচ্ছা তোমার কোনো বন্ধু নেই? মানে পুরুষ বন্ধু। বয়ফ্রেন্ড?
—না... তবে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে একজন... সে আমারই ক্লাসমেট ছিল। তারপর হঠাৎ একদিন... বাবার ম্যাসিভ হার্ট-আ্যাটাক! নেহাত গুরুকৃপা ছিল তাই। নইলে তো বাঁচার কোনো আশাই ছিল না। একটু সুস্থ হতেই বাবা আমার বিয়ের জন্য একেবারে উতলা হয়ে পড়ল। মুখে শুধু একটাই কথা, “বেঁচে থাকতে থাকতে মেয়েটার একটা হিল্লে করে দিয়ে যাই”। ছোটোমাসি সম্বন্ধ আনল। ছেলে বড়ো সরকারি চাকুরে। ওরাও বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছিল খুব। তবে বাবাকে কিন্তু ওরা কথা দিয়েছিল জানো, যে আমাকে পড়াবে।
—আর তোমার সেই বন্ধু? তার কী হল?
—কী আবার হবে? কিছুদিন মন খারাপ করে একা একা ঘুরে বেড়াল। তারপর একদিন শুনলাম আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তানিয়ার সঙ্গে ঘুরছে। সন্ধ্যাবেলা চায়ের টেবিলে সটান মেয়েকে প্রশ্নটা করলাম। —এই যে তোরা আজকাল কী সব ‘মি টু’ আন্দোলন করিস... পুরুষতন্ত্র নিপাত যাক বলে গলা ফাটাস... কিন্তু তোরা কি জানিস মেয়েদের আসল শত্রু আসলে মেয়েরাই?
আমার মেয়ে তো হেসে খুন! আমার গালটা একটু টিপে দিয়ে আদুরে গলায় বলে— আহা রে! আমার গসিপ গার্ল! কেন জানবো না? তোমার গসিপ ক্লাবের মেম্বারদের দেখলেই তো সেটা টের পাওয়া যায়! মেয়ে হয়ে মেয়েদের নিয়ে যা পিএনপিসি তোমরা করো!
—শোনো, এটা ঠাট্টার বিষয় নয়। তুমি কি জানো আমাদের পাশের বাড়ির বউটা স্বামীর ঘর করতে পারছে না তার জায়ের জন্য। আর তার চেয়েও খারাপ, সে বাপের বাড়িতে ফিরতে পারছে না তার নিজের মায়ের জন্য।
এবার কালো ফ্রেমের আঁতেল চশমাটা একটু ঠিক করে নিয়ে আমার মেয়ে বলতে থাকে।
—দেখো মা, অন আ সিরিয়াস নোট, পুরুষতন্ত্র বেসিকালি একটা মানসিকতা। বলা ভালো মানসিক বিকার। অন্যের মাথায় পা দিয়ে দাবিয়ে রেখে মজা নেওয়া। অন্যকে কন্ট্রোল করতে না পারলে মারাত্মক রকমের ইনসিকিওরিটিতে ভোগা। এ জিনিস একজন পুরুষের মধ্যে যেমন, ঠিক তেমনি একজন মহিলার মধ্যেও থাকতে পারে। ইট ইজ নাথিং বাট আ পাওয়ার প্লে! বুঝলে গসিপ গার্ল?
এক মুহূর্তে আমার সামনে সবটা হঠাৎ কেমন পরিষ্কার হয়ে গেল। অনেক সময় ছেলেমেয়েদের থেকেও কত কী শেখার থাকে! আমার নিজের শাশুড়িকে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে খুব দমন-পীড়ন সহ্য করতে হয়েছিল। তিনি অপূর্ব এসরাজ বাজাতেন। সেই বাজনা শুনেই নাকি তাঁর শ্বশুরমশাই তাঁকে ছেলের বউ করে নিয়ে আসেন। কিন্তু বিয়ের পর সেই তাঁকেই আর কখনও এসরাজ হাতে নিতে দেওয়া হয়নি। এ কথা তাঁর নিজের মুখে শোনা। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমার শাশুড়িও কি করলেন না? যখন বউ হয়ে এ বাড়িতে আসার পর আমার স্কুলের চাকরিটা তিনি ছাড়তে বাধ্য করলেন? নইলে আজ হয়তো আমার মস্তিষ্কটা গসিপের থেকে বড়ো কিছু, মহৎ কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারতো। কে জানে হয়তো পুরুষতন্ত্রের অস্ত্রে আহত হতে হতে নিজের অজান্তে কখন ওই একই অস্ত্র তিনিও হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এই পাওয়ার প্লে ঠিক কতটা ক্ষতি করতে পারে? একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিতে পারে। তাকে বিষণ্ণ, অসুস্থ করে তুলতে পারে। কেড়ে নিতে পারে মানুষটির বেঁচে থাকার ইচ্ছা... এবং, চূড়ান্ত ক্ষেত্রে তার জীবনও।
নতুন আলাপী বউটাকে আমার একটা মৃদু কোমল প্রজাপতির মতো মনে হয়, যার পায়ে খেলাচ্ছলে সুতো দিয়ে কেউ যেন একটা ভারি পাথর বেঁধে দিয়েছে। সে শারীরিক ভাবে খুব একটা বলশালী নয়। নমিতার মায়ের মতো একটা কিছু হল তো ঝগড়া করে পাড়া মাথায় তোলার স্কিলও তার নেই। পরিবারের সাপোর্ট নেই। তাকে উদ্ধারের জন্য পক্ষীরাজ ঘোড়া নিয়ে রেডি নেই কোনো রাজপুত্র। ফলে এই পাওয়ার প্লে-তে তার হার একপ্রকার নিশ্চিত।
কিন্তু তবু এই বিপুলা প্রকৃতি ভারি রহস্যময়ী। ডিসকভারি চ্যানেলে দেখি হিংস্র শ্বাপদ যে জীবনীশক্তি নিয়ে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে... সেই একই জীবনীশক্তি নিয়ে গুটি কেটে আলোয় বেরিয়ে আসে রঙিন প্রজাপতি। যে মুহূর্তটাতে এইসব ঘটনাগুলি ঘটে তা আসলে এক অলৌকিক ক্ষণ। ওই মুহূর্তে যদি মনোযোগ দাও... প্রতিটি অঙ্গ সঞ্চালন, প্রতিটি শ্বাসের ক্রিয়া তুমি আলাদা করে চিনে নিতে পারবে। অনন্ত সময় যেন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে থাকে ওই একটি মুহূর্তের জন্য। কারণ এমন মুহূর্তেই প্রকৃতির সুবিশাল ময়দানে নির্ধারিত হয়ে যায় এক একটি ম্যাচের হার-জিত। আর ঠিক এই রকমই কোনো এক দিব্য-মুহূর্তে আমাদের পাশের বাড়ির বউটি আলুথালু, টলটলায়মান শরীরে প্রাণ হাতে করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
সেদিন সকাল থেকেই অশান্তি ঘনিয়ে উঠেছিল। বউটি অতিষ্ঠ হয়ে থানায় যাবার ভয় দেখিয়েছিল। সে হয়তো যেত না। কেবল ভয়ই দেখিয়েছিল। এরপর বাকি দিনটা বেশ নিরুপদ্রবেই কাটে। স্বামীর ব্যবহার হঠাৎ অত্যন্ত মোলায়েম হয়ে পড়ে। এমনকি তার জা পর্যন্ত গেরস্থালির কাজে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। রাতে খাবার পরে রান্নাঘরে বাসন ধুতে ধুতে সে প্রথম আচ্ছন্ন ভাবটা টের পায়। তার পা টলছিল। দু-চোখ খুলে রাখা যচ্ছিল না। খাবারে কিছু মেশানো ছিল কি? দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কালান্তক যমের মতো তার স্বামী। হাতে তার ঘরে পরার লাল শাড়িটা পেঁচানো কেন? পিছনে দাঁড়িয়ে ওর জা। ওরা ওইভাবে এগিয়ে আসছে কেন? জা এসে হঠাৎ তার গালটা টিপে ধরে। ঠিক যেভাবে কোনো বাচ্চার গাল টিপে আদর করা হয়। ক্রমশ তার গালের কোমল চামড়া কেটে বসতে থাকে ম্যানিকিওর করা তীক্ষ্ণ নখের সারি। নরম ত্বক জ্বলে যেতে থাকে। অপরজন তার চুলের মুঠি ধরে এমন এক ধাক্কা মারে যে সে উলটে পড়ে রান্নাঘরের মেঝেয়। আর ঠিক সেই সময়, ভাগ্যক্রমে হাতের কাছে সে পেয়ে যায় রান্নাঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা ধারালো আঁশবটিখানা। সেটা নিয়েই শূন্যে মাতালের মতো এলোপাথাড়ি চালাতে চালাতে কোনোরকমে দরজা খুলে সে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং আমার দরজায় ঘা দেয়।
আজ সকালেই প্রথম জেনেছি মেয়েটির ভালো নাম অপরাজিতা। আপাতত সে আমার বাড়িতেই থাকবে। আমার মেয়ের সঙ্গে। ওর যতদিন খুশি। পুলিশ এসেছে। সকালে ওর মাকে ফোন করা হয়েছিল থানা থেকে। তিনিও এসে পড়লেন বলে। “নিজের মেয়ের জীবনের থেকে তার বিবাহিত জীবন টিকিয়ে রাখাটা কি সত্যিই বেশি জরুরি?” ঠিক করেছি সামনাসামনি ওঁনাকে এই প্রশ্নটা করব। আর এই প্রথম, পাড়ার কোনো নতুন বউকে নিয়ে আমি গসিপ করব না। কারণ এই প্রথম নতুন বউয়ের ইউনিফর্মের আড়ালে আমি একটা আস্ত জীবনকে অনুভব করতে পেরেছি।
পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৭ ডিসেম্বর ২০২০
লেখক : ছোটোগল্পকার
ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট
0 Comments
Post Comment