- 24 May, 2023
- 0 Comment(s)
- 633 view(s)
- লিখেছেন : রুশতী মুখার্জী
কিছুদিন আগে রুপা গাঙ্গুলি ‘মেয়েবেলা’ সিরিয়ালটিতে অভিনয় ছেড়ে দেওয়ায় বাংলা সিরিয়ালের দর্শকের মধ্যে বেশ আলোড়ন পড়ে গেছে। এই কারণে বাংলা সিরিয়ালের প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথোপকথন শুরু হয়েছে— বাংলা সিরিয়ালের মান ।
ভারতের উচ্চশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় তারা সিরিয়াল দেখে কি না তাদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রথমেই নাক সিঁটকোবে। তারা নিজেরা সিরিয়াল দেখলেও সেটা সহজে জানাতে চাইবে না অন্যদের। ফিল্ম, ওয়েব সিরিজের মতো সিরিয়ালও সিনেমা নামক শিল্পটির একটি মাধ্যম। অথচ এই সিরিয়ালের প্রতিই এত অবজ্ঞা। তার পেছনে একটি কারণ হতে পারে পিতৃতন্ত্র। যেহেতু সকলে জানে সিরিয়ালের দর্শক প্রধানত মেয়েরা। তাদের প্রতি এক লুকোনো অবজ্ঞা থেকে তাদের থেকে নিজেকে আলাদা করার জন্য কেউ কেউ বলে যে সে সিরিয়াল জিনিসটাই পছন্দ করে না। মেয়েদের মধ্যেও কেউ কেউ এটা করে এই প্রমাণ করার জন্য যে সে অন্য মেয়েদের মতো নয়। তারা বুদ্ধিমতী; সিরিয়ালের মতো বোকাবোকা জিনিস দেখে না।
কিন্তু সিরিয়ালের প্রতি অবজ্ঞার একেবারেই কি কোন ন্যায্য কারণ নেই? আছে। ভারতবর্ষের সিরিয়ালগুলির গল্পের মান নিয়ে বারবারই কথা ওঠে। যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা হয়। দর্শকেরা নিজেরাই এই সমালোচনা করে। ইদানিংকালে সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে দর্শকেরা সিরিয়াল সম্পর্কে নিজেদের মতামত জানিয়ে এটি ভালো করেই প্রমাণ করে দেন।
সিরিয়ালের গল্পগুলি যখন শুরু হয় তখন দর্শকের মধ্যে প্রত্যাশা জাগে যে একটা আলাদা কিছু দেখানো হবে এবার। সে একটা অন্য স্বাদের প্রেমের গল্প হোক কি একটি মেয়েদের ক্ষমতায়নের গল্প। কিন্তু একটা মাস যেতে না যেতেই গল্পটি হয়ে যায় সাংসারিক কূটকাচালি ও ষড়যন্ত্রের গল্প। গল্পের নারীচরিত্রদের শুধু দুটো লক্ষ্য থাকে। এক, গল্পের প্রধান পুরুষ চরিত্রের থেকে নায়িকাকে দূরে রাখা, এবং দুই, নায়িকার ক্ষতি করা। এই খলনায়িকার চরিত্রেরা নায়িকার শ্বশুরবাড়ির কেউ হতে পারে কিংবা নায়ক বা নায়িকার পরিচিত কেউ হতে পারে। এরা অনিবার্যভাবে নারীই হয়, এবং চাকুরিরতা হলেও এদের চাকরি করতে কখনও দেখা যায় না। এরা সর্বক্ষণ বাড়িতে থাকে; নিজের বাড়ি না হলেও নায়িকার শ্বশুরবাড়িতেই থাকে। এবং নায়ক-নায়িকার বিবাহিত জীবনে সমস্যা তৈরি করতে চায়। সুতরাং, মেয়েদের ক্ষমতায়ন না দেখিয়ে দেখানো হয় যে সে নায়িকা হোক আর খলনায়িকা নারীদের জীবনের একমাত্র কেন্দ্র তার শ্বশুরবাড়ি, এবং সেই শ্বশুরবাড়ি না থাকলে সেটি কোনরকমে আদায় করা তাদের প্রধান লক্ষ্য। এই নারীরা বিয়ে না করলে তাদের জীবনের কোন মানে নেই। বিয়ে না করলে সে খুশি হতে পারবে না, প্রেম করতে পারবে না, ডাক্তার হতে পারবে না, পাইলট হতে পারবে না, জিমন্যাস্টিক্স করতে পারবে না, কিছুই করতে পারবে না! সংসারের নোংরামিতেই মেয়েদের জীবন আবদ্ধ। মজার কথা এই যে সিরিয়ালই একমাত্র মাধ্যম যেখানে সবসময়ই প্রধান চরিত্র নায়িকা হয়, গল্পটি সত্যি সত্যি সেই নায়িকার চোখ দিয়েই দেখানো হয়। অথচ, সেখানেই সেই নায়িকাকে পিতৃতন্ত্রের নিয়মগুলো ভেঙে বেরোতে না দেখিয়ে তাকে আদর্শ বউ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে দেখানো হয়।
সিরিয়ালের সমালোচনা বহু বছর ধরেই চলে আসছে। কিন্তু সিরিয়াল-নির্মাতারা কিছুতেই সেই সমালোচনা কানে তোলেন না। একই গল্প বছর পর বছর ধরে রিসাইকল করে যান। সিরিয়ালের নিম্নমানের গল্পের কারণে ‘সিরিয়াল’ মাধ্যমটারই কুখ্যাতি রটতে থাকে। যারা সিরিয়াল দেখে তাদেরও রুচি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু এখানে মজার কথা হল সিরিয়ালের দর্শকও সমালোচনায় অতি মুখর। কিন্তু তাদের কথাও কেউ কানে তোলেন না। তবে সিরিয়াল কর্তৃপক্ষ নিজেরা এই সমালোচনাগুলি অস্বীকার করেন না। বরং, তারা হাত তুলে দিয়ে বলে সিরিয়ালের গল্পগুলি অন্যরকম করার চেষ্টা করলেই নাকি TRP কমে যায়। সিরিয়ালের প্রধান দর্শক নাকি গ্রামের গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মহিলারা, এবং তারা সাংসারিক নোংরামির গল্পই দেখতে ভালোবাসে, এবং তার বাইরে কিছু দেখতে নারাজ। সিরিয়ালের গল্প অন্যরকম হলেই তারা সেটি দেখা ছেড়ে দেয়।
এই যুক্তির সমস্যা হল এই যে এই যুক্তি আসলে যুক্তিই নয়, নিতান্তই দোষারোপ। নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে সাধারণ মানুষকে ছোট করা। আমার অন্তত তাইই মনে হয়। কোন মানুষই এতটা নির্বোধ নয় যে দিনের পর দিন একই গল্পের সিরিয়াল দেখে যাবে, কিংবা সাংসারিক ষড়যন্ত্র তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে। তারাও মানুষ। শহরের লোকের মতো তাদের মধ্যেও কেউ বেশি বুদ্ধিসম্পন্ন কেউ কম। তারাও অনেকে শিক্ষিত। সোশাল মিডিয়াতে তাদের মধ্যে কমবয়সীরা শুধু নয় মধ্যবয়সীরাও সমালোচনার ঝড় তোলে। তাদেরও অনেক মতামত আছে। সিরিয়ালের দর্শকদের নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা হয়েছে ইতিমধ্যে। নারীবাদী ঐতিহাসিক অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় সিরিয়াল ও তার দর্শকদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। সিরিয়াল দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বহু মহিলা এবং পুরুষের সঙ্গে। তাঁর গবেষণা থেকে জানা গেছে যে সিরিয়ালের দর্শক তাদের পছন্দের সিরিয়ালকে যেমন প্রশংসা করেন, তেমন তাতে বেশি ষড়যন্ত্র, সন্দেহ বা পারিবারিক অশান্তির গল্প শুরু হলে প্রাণভরে সমালোচনাও করেন। নতুন কোন সিরিয়াল শুরু হলে প্রথমেই তাদের মনে আশংকা জাগে, এই সিরিয়ালও গড্ডালিকা প্রবাহে মিশে যাবে না তো? গোড়ার প্রতিশ্রুতি অচিরেই একরাশ হতাশায় পর্যবসিত হবে না তো? কিছুদিন পরে নায়িকাকে বিয়ে দিয়ে তার স্বপ্নগুলির কথা ভুলে গিয়ে তার সংসার করার গল্প দেখাতে শুরু করবে না তো?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের ধরন বদলেছে, ওয়েব সিরিজ জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু সিরিয়ালের ক্ষেত্রে পারিবারিক কূটকাচালিই দেখানো হয় কেন তাহলে? TRPর দোহাই দিয়ে সিরিয়ালের প্রযোজকেরা লেখকেরা দশকের পর দশক ধরে একই গল্প বলে যায় কেন? বর্তমান কালে গ্রামের মেয়েরাও উচ্চশিক্ষালাভ করে, পিএইচডি করে, চাকরি করে স্বাবলম্বী হতে চায়। শহরের মেয়েরা বিয়ে অনেক দেরি করে করে, কমবয়সে হয় পড়াশোনা ও চাকরিতে মন দেয়, কিংবা তার পাশাপাশি অবিবাহিত থেকেই প্রেম করে। মেয়েদের জীবন, প্রেমের ধরন বদলেছে ইদানিংকালে। কিন্তু সিরিয়ালে আজও চাকুরিরতা মেয়েদেরও সংসারের বাইরে কোন জীবন থাকে না, এবং তারা স্কুলে বা কলেজে পড়তে পড়তেই বিয়ে করে ফেলে, অনেক সময় আঠারো বছর না হতে না হতেই। কেন?
আমার মতে সিরিয়ালের নিম্নমানের গল্পের পেছনে তার নারীদর্শকের কোন হাতই নেই। TRP একটি মিথ্যে অজুহাত মাত্র। পিতৃতন্ত্রই আসল কারণ। দর্শকদের মধ্যে নয়, যারা সিরিয়ালগুলি বানানোর দায়িত্বে থাকে তাদের মধ্যে পিতৃতন্ত্র ঢুকে বসে আছে। সিরিয়ালের নির্মাতাদের মধ্যে অনেকেই নারী। সিরিয়াল তৈরির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ সময় তাঁরাই নেন। কিন্তু কোনও কারণে তাঁরা সাধারণ আধুনিক মেয়েদের মন বুঝতে পারেন না। বোঝার চেষ্টাও করেন না। ভাবেন নারীদর্শকেদের কোন রুচিবোধই নেই। সংসারের বাইরে তারা কিছু ভাবতে পারে না। বাইরের জগত বুঝতে এবং এই জগতের কর্মকান্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে তারা একেবারেই অক্ষম। তা ছাড়া, নারীর মনকে না বুঝে, নারীকে না সম্মান করেই তারা নারীকেন্দ্রিক গল্প বানাতে যায়, অথচ বুঝতেই পারে না নারীরা তাদের জীবনকে কী চোখে দেখে। সিরিয়াল প্রোডাকশনে গুণী স্ক্রিপ্টরাইটার আছেন, কিন্তু গল্পের ব্যাপারে তাঁদেরকে কোন স্বাধীনতাই দেওয়া হয় না। ওপর থেকে যা লেখার নির্দেশ আসে তাইই তাদের টাইপরাইটারের মতো লিখে যেতে হয়। এদিকে যারা প্লটের দায়িত্বে থাকেন, তারা একটা সময়ের পরে সাংসারিক কূটকাচালি ছাড়া অন্য কিছু লেখার কথা ভাবতেই পারে না। সিরিয়ালের ট্রেলারে দেখানো নারীবাদী content নিছক লোকদেখানো হয়ে দাঁড়ায় তখন। একটি ভালো গল্প তৈরি করার জন্য পরিশ্রম বা পড়াশোনা করতে এঁরা একেবারেই রাজি নয়। মেয়েদের মতো বোকা প্রাণীদের জন্যে কেনই বা এত কিছু করবে তারা!
সিরিয়াল জগতে পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধিরাই মেয়েদের ও ‘সিরিয়াল’ নামক সিনেম্যাটিক আর্টের মাধ্যমটিকে বদনাম করে যায়। তাই সিরিয়ালের নাম শুনলেই শিক্ষিতেরা ও পুরুষেরা নাক সিঁটকোয়, হাসাহাসি করে। বাড়ির ছেলেরা তাদের মা, বোন বা বউদের বলে, ‘তোমরা কীসব দেখো, ছি!’ অথচ একটু খেটে, ভাবনাচিন্তা করে গল্প লিখলে এমন একটা সিরিয়াল বানানো যায় যা দেখে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সকলেরই মন ভরে যাবে। বিদেশিরাও হয়তো আনিমে, কে-ড্রামার মতো সাবটাইটাল দিয়ে বাংলা সিরিয়াল দেখতে চাইবে। বাঙালির মতো একটা বুদ্ধিমান জাতির পক্ষে এটা করা একেবারেই অসম্ভব নয়। কিন্তু সিরিয়ালের নির্মাতাদের মধ্যে এই দূরদৃষ্টি একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। তাদের সঙ্কুচিত সঙ্কীর্ণ মন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সিরিয়ালও যেহেতু একরকম শিল্প, সমাজকে বদলানোর দায়িত্ব সিরিয়ালের কর্তৃপক্ষেরও। মেয়েদের স্বপ্ন দেখানোর দায়িত্ব, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার দায়িত্ব তাদেরও। যদি ধরেই নেওয়া হয় যে গ্রামের মেয়েদের মধ্যে এখনও মানসিকতাটা পশ্চাদমুখী, পিতৃতান্ত্রিক, তারা আধুনিক গল্প পছন্দ করে না , তবুও তাদেরকে বদলানোর সামাজিক দায়িত্ব সিরিয়ালের আছে। দেখাই যাচ্ছে সিরিয়ালের প্রতি এত নালিশ থাকা সত্ত্বেও মানুষ সিরিয়াল দেখা বন্ধ করে না। সেখানে গ্রামের মেয়েরা প্রথম দিকে নতুন ধরনের গল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেও একটা সময়ে মেনে নিতে বাধ্য হবে। ধীরে ধীরে, সমাজে বদল আনতে পারবে সিরিয়াল। তবে ভালো খবর এই, যে গ্রামের ও মফস্বলের মেয়েরাও সম্ভবত একটা প্রকৃত ভালো সিরিয়ালের অপেক্ষাতেই বসে আছে। যে কোনও দর্শকই বসে থাকে।
লেখক : শিক্ষার্থী
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment